অর্থশাস্ত্র

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র -এর অর্থ, রচনাকাল, গুরুত্ব, রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে ভূমিকা, শাসকের কর্তব্য, সম্রাটের বিভিন্ন কার্য, গঠন কাঠামো, বিষয়বস্তু তুলে ধরা হল।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র

রচনাকারকৌটিল্য বা চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত
রচনাকালচন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে
বিষয়বস্তুরাজনীতি
গ্ৰন্থটির আবিষ্কার১৯০৫ খ্রিস্টাব্দে, ড. শ্যাম শাস্ত্রী
অর্থশাস্ত্র

ভূমিকা :- অর্থশাস্ত্র হল কৌটিল্য বা চাণক্য রচিত হিন্দু রাষ্ট্রচিন্তা সম্পর্কে একটি প্রাচীন গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি মৌর্য সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ উৎস উপাদান।

অর্থশাস্ত্রের রচয়িতা কৌটিল্য বা চাণক্য

বিষ্ণুগুপ্ত বা কৌটিল্য নামে পরিচিত তক্ষশিলার অধিবাসী জনৈক ব্রাহ্মণকে এই গ্রন্থের রচয়িতা হিসেবে ধরা হয়। তিনি চাণক্য নামেও পরিচিত।

কৌটিল্য বা চাণক্যের অর্থশাস্ত্রের অর্থ

‘অর্থ’ বলতে সাধারণত টাকা, সম্পদ ইত্যাদিকেই বােঝায়। আর ‘শাস্ত্র’ শব্দের অর্থ হল বিদ্যা বা বিজ্ঞান। ব্যুৎপত্তিগত অর্থে তাই অর্থশাস্ত্র হল সম্পদের শাস্ত্র বা বিদ্যা। কিন্তু অর্থশাস্ত্রে আলোচিত হয়েছে রাজনীতি।

মুদ্রারাক্ষস -এর বর্ণনা

বিশাখদত্ত রচিত মুদ্রারাক্ষস থেকে জানা যায় যে কৌটিল্য মগধ -এ মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য – এর প্রধানমন্ত্রী ছিলেন।

কৌটিল্য বা চাণক্য রচিত অর্থশাস্ত্রের রচনাকাল

গ্রন্থটির রচনাকাল এবং রচয়িতা কৌটিল্য সম্পর্কে মতভেদ আছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব

  • (১) কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি শুধু ধনসম্পদ সম্পর্কিত নয়, তাতে রাষ্ট্রনীতি, দণ্ডনীতি, আইন, প্রশাসন, সমাজতত্ত্ব ইত্যাদি বিষয় আলোচিত হয়েছে।
  • (২) গ্রন্থকার আন্বীক্ষিকী, ত্রয়ী, বার্তা ও দণ্ডনীতি এই বিদ্যা চতুষ্টয়ে তাঁর অধিকারের স্বাক্ষর রেখেছেন।
  • (৩) গ্রন্থটিতে তিনি শুল্কশাস্ত্র, বাস্তুবিদ্যা, ধাতুবিদ্যা, রসায়নশাস্ত্র, উদ্ভিদবিদ্যা, ভূগোল, ইতিহাস প্রভৃতি নানা জ্ঞানের ক্ষেত্রে গভীর বিদ্যাবত্তার পরিচয় দিয়েছেন।

অর্থশাস্ত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালের উল্লেখ

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য -এর শাসনের বিস্তারিত বিবরণ আছে।

অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্র শাসনের উপদেশ

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের মধ্যে রাষ্ট্র শাসনের সর্ববিষয়ে সম্রাট তথা শাসকের করণীয় সম্পর্কে উপদেশ লিপিবদ্ধ করা হয়েছে।

রাষ্ট্রের প্রকৃতি বিষয়ে অর্থশাস্ত্র

রাষ্ট্র বা শাসকের প্রকৃতি সম্পর্কে গ্রীক অ্যারিস্টটল -এর ‘পলিটিকস’ এর ন্যায় তাত্ত্বিক আলোচনা না থাকলেও শাসকের করণীয় সম্পর্কে কৌটিল্যের উপদেশাবলী থেকে রাষ্ট্র ও শাসক সম্পর্কে তাঁর একটি ধারণারও আভাস পাওয়া যায়।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র অনুসারে শাসকের কর্তব্য

  • (১) কৌটিল্যের মতে শাসকের প্রধান কর্তব্য হল রাষ্ট্র এবং নিজের শাসনকে রক্ষা করা। তার শাসনকে রক্ষা করার জন্য তাকে শত্রু মিত্রকে চিহ্নিত করতে হবে।
  • (২) সম্রাটের বিরুদ্ধে কোথাও কোনো ষড়যন্ত্র শুরু হচ্ছে কিনা, তা জানার জন্য তাকে গুপ্তচর নিয়োগ করতে হবে।
  • (৩) শাসকের রাষ্ট্রের বিদ্যমান অবস্থা সম্পর্কে জ্ঞাত থাকতে হবে। তার কর্মচারীবৃন্দকে নির্দেশ দিতে হবে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত সম্রাটের বিভিন্ন কার্য

‘অস্ত্রশাস্ত্রের’ মধ্যে সম্রাটের দৈনন্দিন কার্যের বিভিন্ন ভাগ ও প্রহরকে নির্দিষ্ট করে দেওয়া হয়েছে।

  • (১) রাষ্ট্র ও নিজের শাসনকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য সম্রাটকে প্রয়োজনে নির্মম হতে হবে। এ লক্ষ্যে কোনো কৌশল গ্রহণেই সম্রাটকে দ্বিধা করা চলবে না।
  • (২) সম্রাটের শাসনের লক্ষ্য হবে প্রজাদের সুশাসন করা। সম্রাটকে সুশাসনের জন্য শপথ গ্রহণকরতে হবে। এই শপথের মর্ম হবে আমি প্রজাদের নির্যাতন করলে মৃত্যুর পরে আমার যেন নরকবাস ঘটে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের গঠন কাঠামো

  • (১) গ্রন্থটি ‘অধিকরণ’ নামে ১৫টি পরিচ্ছেদে বিভক্ত এবং এক একটি অধিকরণ কিছু সংখ্যক প্রকরণে বিভক্ত। মোট ১৮০টি প্রকরণ আছে। প্রকরণগুলি ১৫০টি অধ্যায়ে বিন্যস্ত।
  • (২) ৬০০ টি শ্লোকে অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি রচিত। প্রতিটি পরিচ্ছেদের শেষে আলোচিত বিষয়বস্তুর সার প্রদান করা হয়েছে।
  • (৩) গ্রন্থটি ভাষ্য ও সূত্রাকারে রচিত। মাঝে মাঝে কিছু শ্লোক অন্তর্ভুক্ত হয়েছে। শ্লোকের সংখ্যা মোট ছয় হাজর।
  • (৪) গ্রন্থকার বৃহস্পতি, শুক্র প্রমুখ পূর্বসূরিদের কাছে তাঁর ঋণ স্বীকার করেছেন।
  • (৫) অর্থশাস্ত্র গ্ৰন্থের ভাষা সহজ, কিন্তু স্থানবিশেষে দুর্বোধ্য।
  • (৬) অর্থশাস্ত্রের একাধিক টীকা আছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তু

কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন বিষয় আলােচিত হয়েছে। বিষয়গুলি ৬০০০ শ্লোকে ১৫ টি অধিকরণে বিভাজিত হয়ে আলােচিত হয়েছে। তন্ত্র’ ও ‘আবাপ’ এই দুই মূল অংশে অর্থশাস্ত্রের বিষয়বস্তুগুলি বর্ণিত হয়েছে।

(১) ‘তন্ত্র’ অংশে আলোচিত বিষয়

‘তন্ত্র’ অংশে রাজার বিনয়, বিদ্যাভ্যাস, শিক্ষালাভ, রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতি, বিচারব্যবস্থা, অধ্যক্ষদের দায়িত্ব-কর্তব্য প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

(২) ‘আবাপ’ অংশে আলােচিত বিষয়

‘আবাপ’ অংশে আন্তঃরাজ্য সম্পর্ক, কূটনীতি বিষয়ক ছটি কৌশল, সপ্তাঙ্গবিশিষ্ট রাষ্ট্রের নানা সংকট, যুদ্ধকৌশল, বিজিগীষু রাজার কর্তব্য প্রভৃতি বিষয় আলোচিত হয়েছে।

(৩) বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ 

কৌটিল্য তার অর্থশাস্ত্রে রাজার প্রতি বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ দিয়েছেন। যেমন – রাজ্যশাসন, পালন, প্রজাস্বার্থ রক্ষা, দণ্ডবিধি, কূটনীতি গ্রহণ, গুপ্তচর নিয়োগ, যুদ্ধপরিচালনা পদ্ধতি প্রভৃতি।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রকৃতি

(১) ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনিক তত্ব

অর্থশাস্ত্র হল ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসনিক তত্ত্ব। ধর্মনিরপেক্ষ প্রশাসন পরিচালনার শিক্ষা দিয়ে থাকে অর্থশাস্ত্র।

(২) রাষ্ট্রনীতিবিদ্যা

কৌটিল্য অর্থশাস্ত্রকে রাষ্ট্রনীতির সমার্থক বলে উল্লেখ করেছেন। রাজ্যশাসনের জন্য রাজার যে সমস্ত নিয়মনীতি অনুসরণ করা উচিত তা হল রাষ্ট্রনীতি।

(৩) ভূমি সংরক্ষণবিদ্যা

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র হল ভূমিরূপী রাজ্যজয় ও তার সংরক্ষণবিদ্যা। এই গ্রন্থ থেকে রাজ্যরক্ষার নানা ধারণা পাওয়া যায়। অধ্যাপক বি. এ. সালেতার, আর. পি. কাঙলে প্রমুখ মনে করেন অর্থশাস্ত্র হল ভূমি সংরক্ষণবিদ্যা।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের প্রধান প্রধান দিক

আলোচনার সুবিধার্থে সুবিশাল এই গ্রন্থের বিভিন্ন অধিকরণকে মোটামুটি তিনটি পর্যায়ে ভাগ করে আলোচনা করা যেতে পারে। যথা – সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব, রাজ্যের প্রশাসন এবং যুদ্ধ ও কূটনীতি।

অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত রাষ্ট্রের সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব

কৌটিল্য রচিত অর্থশাস্ত্রে রাষ্ট্রের বর্ণনায় সপ্তাঙ্গ তত্ত্ব অনুসারে রাজ্য বা রাষ্ট্র সর্বসমেত ৭টি অঙ্গ নিয়ে গঠিত। এই সাতটি অঙ্গ হল স্বামী, অমাত্য, জনপদ, পুর, কোশ, দণ্ড এবং মিত্র।

(১) স্বামী

অর্থশাস্ত্রে কৌটিল্য স্বামী বলতে রাজা অর্থাৎ রাজ্যের প্রধানকেই বুঝিয়েছেন। এই স্বামী অর্থাৎ রাজার কর্তব্যের উল্লেখে তিনি রাজার চারটি গুণাবলির প্রয়ােজনীয়তার কথা উল্লেখ করেছেন। যথা –

ক) অভিগামিক গুণ

অর্থশাস্ত্রের বর্ণনায় সত্যনিষ্ঠা, ধর্মপরায়ণ, বিনয়, শিক্ষার আকাঙ্ক্ষা প্রভৃতি হল স্বামী বা রাজার অভিগামিক গুণ।

(খ) প্রজ্ঞাপন

দ্রুত কোনাে সমস্যা সঠিকভাবে বুঝে নেওয়ার ক্ষমতা, সঠিক কাজ এবং সঠিক সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতাই হল প্রজ্ঞাপন।

(গ) উত্থান গুণ

সাহস এবং দ্রুততার সঙ্গে কাজ শেষ করার ক্ষমতা হল উত্থান গুণের লক্ষণ।

(ঘ) আত্ম সম্পদ

বাগ্মিতা, ইন্দ্রিয় সংযম, স্মৃতিশক্তি, বিপদকালে অবিচলিত থাকা এই সমস্ত গুণই হল আত্মসম্পদ।

(২) অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত অমাত্য বা মন্ত্রী

কৌটিল্য তাঁর অর্থশাস্ত্রে বিভিন্ন ধরনের‌ কর্মচারী বা অমাত্য এবং তাদের নিয়োগ পদ্ধতি, দায়িত্ব ও কর্তব্য আলােচনা করেছেন।

  • (ক) অর্থশাস্ত্র অনুসারে এরকম কয়েকজন কর্মচারী হলেন পুরােহিত, সমাহর্তা, সন্নিধাতা, কোশাধ্যক্ষ, রাজদূত, দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার বিচারক প্রমুখ।
  • (খ) অমাত্যের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হল কোনাে কাজ শুরু করার আগে তার নীতি ও পদ্ধতি নির্ধারণ করা। কৌটিল্য বলেছেন, “অমাত্য অবশ্যই দেশীয় হবেন এবং স্বামী রাজার প্রতি গভীর অনুরক্ত থাকবেন।”

(৩) অর্থশাস্ত্রে উল্লেখিত জনপদের বর্ণনা

  • (ক) জনপদ বলতে কৌটিল্য রাষ্ট্রের ভূখণ্ড ও তার অধিবাসীদের বুঝিয়েছেন। তিনি বলেছেন জনবিহীন জনপদ অর্থহীন। তার মতে, প্রতিটি গ্রামে কমপক্ষে একশত এবং সর্বাধিক পাঁচশত পরিবার বসবাস করবে।
  • (খ) কৌটিল্য আদর্শ ভূখণ্ড বলতে উর্বরভূমি, প্রচুর অরণ্য সম্পদ, খনিজ সম্পদ বিশিষ্ট অঞ্চল এবং উৎকৃষ্ট মানের গােচারণভূমিকে বুঝিয়েছেন।

(৪) অর্থশাস্ত্রে দুর্গের বর্ণনা

কৌটিল্যের মতে সাম্রাজ্যের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ অংশ হল দুর্গ। কৌটিল্য চার ধরনের দুর্গের কথা বলেছেন। এগুলি হল –

(ক) জলদুর্গ

চারিদিকে জলবেষ্টিত এলাকা নিয়ে গঠিত দুর্গই হল জলদুর্গ।

(খ) গুহা বা পার্বত্য দুর্গ

এই ধরনের দুর্গ চারিদিকে পাহাড় দিয়ে ঘেরা বা পাহাড়ের মধ্যে তৈরি হয়।

(গ) মরুদুর্গ

মরুপ্রান্তর সংলগ্ন দুর্গগুলির নাম ছিল মরুদুর্গ।

(ঘ) বনদুর্গ

বনাঞ্চলে প্রতিরক্ষার প্রয়ােজনে স্থাপিত হয় বনদুর্গ।

(৫) অর্থশাস্ত্রে কোশ সম্পর্কে বর্ণনা

কৌটিল্যের মতে রাষ্ট্রের শক্তি নির্ভর করে কোশ বা রাজার আর্থিক ক্ষমতার ওপর।

  • (ক) কোশ হল এমন এক অর্থভাণ্ডার যা রাজা রাজস্ব সংগ্রহের মাধ্যমে উপার্জন করেন অথবা অন্য কোনাে সৎ উপায়ে সংগ্রহ করেন।
  • (খ) অর্থের কয়েকটি উৎস হল প্রজাদের ওপর আরােপিত ভূমিরাজস্ব, চাষিদের থেকে সংগৃহীত শস্যকর, সেচকর, ব্যাবসাদারদের থেকে আদায়িকৃত পণ্যকর প্রভৃতি।

(৬) অর্থশাস্ত্রে দণ্ডের উল্লেখ

কৌটিল্যের মতে দণ্ড বা বল অর্থাৎ সেনাবাহিনীর ওপর রাষ্ট্রের স্থায়িত্ব নির্ভর করে। তার ধারণায় সেনারা রাজার ইচ্ছায় পরিচালিত হবে এবং রাজার নির্দেশ মতাে কাজ করবে। দণ্ড বা বল শব্দ দ্বারা মূলত হস্তী, অশ্ব, রথ এবং পদাতিক এই চতুরঙ্গ সেনাদের কথা বলা হয়েছে।

(৭) অর্থশাস্ত্রে বর্ণিত মিত্র

সপ্তাঙ্গর শেষ উপাদানটি হল মিত্র বা সুহৃদ। কৌটিল্যের ধারণায়, মিত্র হল সেই, যার কাছ থেকে বিপদের কোনাে সম্ভাবনা থাকে না। কৌটিল্য দু ধরনের মিত্রের কথা বলেছেন। যেমন –

(ক) সহজ

পিতামহ ও পিতার সময়কাল থেকে যে ধরনের ব্যক্তিদের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্ক রয়েছে তারা হল সহজমিত্র।

(খ) কৃত্রিম

এই ধরনের মিত্র হল অর্জিত মিত্র। এই ধরনের মিত্রতা স্বাস্থ্য, সম্পদ ও জীবনের নিরাপত্তা দেয়। কৌটিল্যের মতে, সহজমিত্ৰতা কৃত্রিমের চেয়ে উৎকৃষ্ট বা শ্রেষ্ঠ।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে রাজ্যের প্রশাসন

অর্থশাস্ত্রের আলোচনার দ্বিতীয় বিষয় হল রাজ্যের প্রশাসন।

  • (১) অধ্যক্ষ নামে পরিচিত আমলার্গের দায়দায়িত্ব এবং সেইসঙ্গে ভূমিব্যবস্থা, রাজস্ব, রাজকোষ, পণ্যাদি উৎপাদন, বাণিজ্য, কৃষি, সামরিক বাহিনীর বর্গবিন্যাস, নগরের স্বায়ত্তশাসন ইত্যাদির বিস্তারিত আলোচনা দেখা যায় দ্বিতীয় থেকে পঞ্চম অধিকরণে।
  • (২) বিবাহ, উত্তরাধিকার, ঋণ, সঞ্চয়, দাস মালিকানা; অপরাধীকে কারারুদ্ধ করা ও শাস্তিদান; শাস্তি অথবা অঙ্গচ্ছেদের পরিবর্তে জরিমানা আদায়; আইন ও রীতিনীতি ভঙ্গের দায়ে দণ্ডবিধান ইত্যাদি বিষয় এক্ষেত্রে সবিস্তারে বলা হয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রে যুদ্ধ ও কূটনীতি

অর্থশাস্ত্রের তৃতীয় পর্যায়ের বিভিন্ন অধিকরণের বিষয় হল যুদ্ধ ও কূটনীতি।

  • (১) সপ্তম অধিকরণে কৌটিল্য ছয় ধরনের বিষয়সংক্রান্ত কর্মপন্থার কথা বলেছেন। যেমন – শান্তি, যুদ্ধনিরপেক্ষতা, অভিযানপ্রস্তুতি, জোটবদ্ধতা ও নিরাপত্তার চুক্তি, সন্ধি এবং সংগ্রাম।
  • (২) নবম অধিকরণে আক্রমণকারীর মতিগতি ও শক্তির বিশ্লেষণ করা হয়েছে।
  • (৩) দশম অধিকরণে যুদ্ধ, রণসজ্জা, শিবির স্থাপন, সৈন্যবাহিনীর প্রকৃতি অনুযায়ী রণকৌশল, নিরাপত্তা বিধান বিষয়ে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • (৪) দ্বাদশ অধিকরণে শক্তিশালী শত্রুপক্ষ সম্পর্কে ধারণা প্রদান করা হয়েছে।
  • (৫) ত্রয়োদশ অধিকরণে দুর্গ দখলসুত্রে শত্রুশিবিরে বিভেদ, গোপন কৌশলে পররাজ্যের নৃপতিদের প্রলোভন দেখানো, গুপ্তচর পাঠানো, অধিকৃত দেশে শান্তিস্থাপন বিষয়ে আলোচনা করা হয়েছে।
  • (৬) চতুর্দশ অধিকরণে শত্রুপক্ষের সঙ্গে গোপন আচরণ, ছলে বলে কৌশলে পর্যুদস্ত করা, নিজ সৈন্যবাহিনীর আহতদের নিরাময় ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে।

কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র ও পলিটিক্স গ্ৰন্থ

‘অর্থশাস্ত্রে’ শাসনের যে কূটনীতির বিস্তারিত বিবরণ পাওয়া যায় তাতে এই গ্রন্থকে সমসাময়িক গ্রিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী এরিস্টটলের ‘পলিটিক্স’ গ্রন্থের কোনো কোনো আলোচনার সঙ্গে সাদৃশ্যের ভিত্তিতে তুলনা করাই যায়।

কৌটিল্য ও মেকিয়াভেলি

শাসককে নিজের শাসন রক্ষা করার জন্য কোনো কৌশল গ্রহণেই দ্বিধা করলে চলবে না অর্থশাস্ত্রের এরূপ উপদেশ বর্তমান থাকায় ইউরোপ -এর পঞ্চদশ শতকের মেকিয়াভেলিকে ইউরোপের কৌটিল্য বলে আখ্যায়িত করা চলে।

উপসংহার :- অর্থশাস্ত্রের বিধিবিধানের ফলে দেশে সমকালে একটি সুশৃঙ্খল ও শক্তিশালী রাজ্য গড়ে উঠেছিল –একথা বললে অত্যুক্তি হয় না।

(FAQ) চাণক্য বা কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্রের গুরুত্ব কী?

অর্থশাস্ত্র চাণক্য রচিত একটি সুপ্রাচীন রাষ্ট্রনীতি বিষয়ক গ্রন্থ। মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনকালে রচিত এই গ্রন্থটি প্রাচীন ভারতের রাষ্ট্রনীতি ও শাসনসংস্কারের একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রামাণ্য ইতিহাস।

২. অর্থশাস্ত্র গ্রন্থটি কে কবে আবিষ্কার করেন?

ড: শ্যামশাস্ত্রী ১৯০৫ সালে।

৩. অর্থশাস্ত্র কোন ভাষায় রচিত?

সংস্কৃত।

৪. অর্থশাস্ত্র গ্রন্থের রচয়িতা কে?

কৌটিল্য বা চাণক্য।

1 thought on “অর্থশাস্ত্র”

Leave a Comment