ফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীণ নীতি

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীণ নীতি প্রসঙ্গে স্বল্পমূল্যের মুদ্রা, কারখানা স্থাপন, ক্রীতদাস নিয়োগ, নির্মাণ নীতি ও কর্মসংস্থান, দাতব্য ব্যবস্থা, শিক্ষা নীতি, বিচার ব্যবস্থা ও স্থায়ী সেনা দল ধ্বংস সম্পর্কে জানবো।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীণ নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীন নীতি
সুলতানফিরোজ শাহ তুঘলক
মুদ্রারূপা ও তামা
প্রিয় বাসস্থানফিরোজাবাদ
দাতব্য বিভাগদেওয়ান-ই-খয়রাত
ফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীণ নীতি

ভূমিকা :- বিভিন্ন আভ্যন্তরীন নীতির ক্ষেত্রে ফিরোজ শাহ তুঘলক এক নির্ভরযোগ্য মুদ্রা নীতি গ্ৰহণ করেন। মন্ত্রী খান-ই-জাহান মকুবুলের পরামর্শে তিনি খাঁটি সোনা ও রূপার মুদ্রা চালু করে মুদ্রা ব্যবস্থার প্রতি জনসাধারণের আস্থা বৃদ্ধি করেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে স্বল্প মূল্যের মুদ্রা

সুলতান ফিরোজ শাহ স্বল্প মূল্যের মুদ্রা যথা – জিতল, অর্ধ জিতল বা আধা এবং সিকি জিতল বা বিখ চালু করেন। এই ক্ষুদ্র মানের মুদ্রাগুলি রূপা ও তামা মিশিয়ে তৈরি করা হয়।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন কেনাবেচা

সাধারণ দরিদ্র লোক এই স্বল্পমানের মুদ্রার সাহায্যে তাদের দৈনন্দিন কেনাবেচা করতে পারত।

ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক কারখানা স্থাপন

সুলটন ফিরোজ শাহ সরকারী পরিচালনায় বেশ কয়েকটি কারখানা স্থাপন করেন। তিনি পুরাতন কারখানাগুলির সংস্কার করেন। কারখানাগুলি পরিচালনার জন্য তিনি একটি ওয়াজিরাৎ বা দপ্তর গঠন করেন। তার বিশ্বস্ত খাজা আবুল হাসানকে এই দপ্তরের দায়িত্ব দেওয়া হয়। এই দপ্তর অন্তত ৪টি উপদপ্তরে বিভক্ত ছিল।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে রাজকীয় কারখানা

রতিবি বা খাদ্যদ্রব্য প্রস্তুতের কারখানার জন্য সুলতান মাসে ১ লক্ষ ৬০ হাজার টঙ্কা ব্যয় করতেন। খাদ্য, পোষাক, রাজকীয় ও অভিজাতদের ব্যবহারযোগ্য জিনিষ এই কারখানাগুলিতে তৈরি হত। ফিরোজ দাবী করেন যে, তার রাজকীয় কারখানা থেকে সমগ্র মূলতান প্রদেশের রাজস্বের সমান অর্থ তিনি পেতেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলক কর্তৃক ক্রীতদাস নিয়োগ

  • (১) ফিরোজ শাহের অধীনে ১ লক্ষ ৮০ হাজার ক্রীতদাস ছিল বলে আফিফ বলেছেন। এই ক্রীতদাসদের বড় অংশকে কারখানার উৎপাদনের কাজে লাগানো হত। এই ক্রীতদাস বাহিনীর মধ্যে প্রায় ১২০০ দক্ষ কারিগর ছিল। এদের শিল্পদ্রব্য উৎপাদনের জন্য লাগান হয়।
  • (২) ঐতিহাসিক ষ্ট্যানলি লেনপুন ফিরোজ শাহের অসংখ্য ক্রীতদাস নিয়োগ ও তজ্জনিত অর্থ ব্যয়ের জন্য নিন্দা করেছেন। কিন্তু এই সঙ্গে বলা দরকার যে, ফিরোজ শাহ এই ক্রীতদাসদের একটি বড় অংশকে উৎপাদনের কাজে লাগান। প্রায় ৪০ হাজার ক্রীতদাস দ্বারা তিনি তার নিজস্ব দেহরক্ষী বাহিনী গড়েন।
  • (৩) তিনি প্রধানত যুদ্ধ বন্দী ও বিদ্রোহীদের বন্দী করে দাসে পরিণত করতেন। যদিও তার জীবিতকালে এই দাস বাহিনী তার প্রতি অনুরক্ত ছিল, তার মৃত্যুর পর এই বাহিনী বিদ্রোহী হয় এবং তুঘলক বংশ-এর অনেককে হত্যা করে।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের নির্মাণ নীতি ও কর্মসংস্থান

  • (১) স্থাপত্য নির্মাণ ও নগর স্থাপনে ফিরোজ শাহের বিশেষ উৎসাহ ছিল। তিনি হিসার, ফিরোজা, ফতেহাবাদ, ফিরোজপুর ও দিল্লীর ফিরোজাবাদ এবং উত্তর প্রদেশের জৌনপুর প্রভৃতি নগর স্থাপন করেন।
  • (২) দিল্লীর ফিরোজাবাদ ছিল তার প্রিয় বাসস্থান। এই স্থানে তাঁর প্রাসাদের ছাদের ওপর তিনি মৌর্য সাম্রাজ্য-এর রাজা অশোক-এর তৈরি একটি সুদৃশ্য স্তম্ভ এনে স্থাপন করেন। দিল্লীর ফিরোজ শাহ কোটলায় এই প্রাসাদের ধ্বংসাবশেষ দেখা যায়।
  • (৩) তিনি বহু পুরাতন প্রাসাদ, স্মৃতিসৌধের সংস্কার করেন। এগুলির মধ্যে ছিল পুরাতন দিল্লীর জামা মসজিদ, সুলতান ইলতুৎমিসআলাউদ্দিন খলজির সমাধি, শেখ নিজামুদ্দিন আওলিয়ার স্মৃতিসৌধ, কুতুব মিনার প্রভৃতি। ফিরোজ প্রায় ১২০০ উদ্যান স্থাপন করেন এবং অসংখ্য ফলের গাছ রোপন করেন। এই নির্মাণ নীতির ফলে বহু লোকের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা হয়।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের দাতব্য ব্যবস্থা

  • (১) ফিরোজ শাহের সামাজিক ও জনকল্যাণমূলক নীতিরও এই প্রসঙ্গে উল্লেখ করা দরকার। সুলতান ফিরোজ শাহের জনহিতকর নীতির ফলে বহু দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপিত হয়। বেকার লোকেরা যাতে কাজ পায় এজন্য তিনি দিল্লীতে একটি নিয়োগ দপ্তর স্থাপন করেন।
  • (২) দরিদ্র ব্যক্তিদের বিনামূল্যে চিকিৎসার জন্য তিনি দার-উল-সাফা নামে দাতব্য হাসপাতাল স্থাপন করেন। এই হাসপাতালের ব্যয় নির্বাহের জন্য তিনি কয়েকটি গ্রাম দান করেন। তিনি দেওয়ান-ই-খয়রাত নামে একটি দাতব্য বিভাগ স্থাপন করেন।
  • (৩) এই দপ্তর থেকে মুসলিম অনাথা, বিধবা ও কন্যাদায়গ্রস্থ পিতা-মাতাদের সাহায্য দেওয়া হত। সুফী সন্ত, দরবেশ ও ফকিরদেরও এই দপ্তর থেকে সাহায্য দেওয়া হত। খানকাগুলির ব্যয় নির্বাহের জন্য এই দপ্তর থেকে অনুদান দেওয়া হত।
  • (৪) এমনকি চালচুলোহীন দরিদ্র ব্যক্তিদের জন্য রন্ধন করা খাদ্য বিতরণ এই দপ্তরের সাহায্যে করা হত। মুসলিম তীর্থযাত্রীদের সুবিধার জন্য তিনি পথে সরাই নির্মাণের আদেশ দেন।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের শিক্ষানীতি

  • (১) ফিরোজ শাহ শিক্ষা বিস্তারের জন্যও উদ্যম দেখান। তিনি সুন্নী উলেমা ও মৌলবীদের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। তাদের শাস্ত্রজ্ঞানকে তিনি সম্মান করতেন। প্রধান শহরগুলিতে তিনি প্রাথমিক শিক্ষার জন্য মক্তব ও উচ্চশিক্ষার জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করেন।
  • (২) তিনি ইলতুৎমিসের স্থাপিত মাদ্রাসার ভবনের সংস্কার করে তার চন্দন কাঠের দরজাটি পুনঃনির্মাণ করেন। ফিরোজাবাদে তার প্রতিষ্ঠিত ফিরোজশাহী মাদ্রাসা ইসলামীয় শাস্ত্র ও জ্ঞান-বিজ্ঞানের চর্চার একটি বিখ্যাত কেন্দ্রে পরিণত হয়।
  • (৩) তিনি জ্বালামুখী মন্দিরে প্রাপ্ত সংস্কৃত দর্শন ও জ্যোতিষের গ্রন্থগুলির ফার্সী অনুবাদ করান। এই গ্রন্থটির নাম ছিল দলাদল-ই-ফিরোজশাহী।

সুলতান ফিরোজ শাহ তুঘলকের বিচার ব্যবস্থা

  • (১) ফিরোজ শাহ বিচার ব্যবস্থার উন্নতি সাধন করেন। শরিয়তের বিধি অনুসারে তিনি কাজীদের বিচার করার অধিকার স্থাপন করেন। মহম্মদ তুঘলক কাজীর আদালতে প্রদত্ত রায়ের ওপর আপীলের বিচার করতেন। ফিরোজ এই প্রথা লোপ করেন।
  • (২) রাজধানী ও নগরে কাজীর দপ্তর স্থাপিত হয়। রাজধানীতে প্রধান কাজীর দপ্তর স্থাপিত হয়। ফিরোজ দণ্ডবিধির সংস্কার করে ‘সিয়াস্ত’ বা মৃত্যুদণ্ড প্রথা সাধারণভাবে রদ করেন। একমাত্র গুরুতর অপরাধ ছাড়া কোনো মুসলমানের মৃত্যুদণ্ড নিষিদ্ধ হয়। দৈহিক নির্যাতন ও অঙ্গচ্ছেদ নিষিদ্ধ করা হয়।

ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলে স্থায়ী সেনাদল ধ্বংস

সুলতান ফিরোজ শাহ, আলাউদ্দিন ও মহম্মদের আমলের বেতনভোগী কেন্দ্রীয় সেনাদল রাখার প্রথা ক্রমে লোপ করেন। তিনি সেনাদলে শৃঙ্খলা রাখতে অসমর্থ হন। তিনি প্রধানত প্রাদেশিক শাসনকর্তা বা মালিকদের সেনাদলের ওপর নির্ভরশীল হন।

উপসংহার :- ফিরোজ শাহ তুঘলকের শাসনকালে সাম্রাজ্য-এ মোটামুটি শান্তি বজায় ছিল। কেবলমাত্র বাংলায় বিদ্রোহ ঘটে। মুসলিম মালিক, আমীর ও উলেমারা ফিরোজের সমর্থক ছিলেন। জিনিষপত্রের দামও কম ছিল। কৃষির উন্নতি ঘটে। এইভাবে ফিরোজ তাঁর ৩৮ বছরের শাসন কায়েম করেন।

(FAQ) ফিরোজ শাহ তুঘলকের আভ্যন্তরীণ নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফিরোজ শাহ তুঘলক কত বছর রাজত্ব করেন?

৩৮ বছর।

২. কার মৃত্যুর পর ফিরোজ শাহ তুঘলক সিংহাসনে আরোহণ করেন?

মহম্মদ বিন তুঘলক।

৩. ফিরোজ শাহ তুঘলকের প্রিয় বাসস্থান কোথায় ছিল?

দিল্লির ফিরোজাবাদ।

৪. কোন সুলতান সাধারণ ভাবে মৃত্যু দণ্ড প্রথা রদ করেন?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

Leave a Comment