ইলতুৎমিস

ইলতুৎমিস প্রসঙ্গে নাম পূর্ব জীবন, সিংহাসনের অধিকার, তার সমস্যা, সমস্যার সমাধান, ইলদুজের পতন, কুবাচার পতন, চেঙ্গিস খানের আক্রমণ, খারাজম শাহের পলায়ন, সংগঠন নীতি, সেনাদল গঠন, বিচার ব্যবস্থা ও মুদ্রার প্রচলন সম্পর্কে জানবো।

সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস

সুলতানসামসুদ্দিন ইলতুৎমিস
রাজত্ব১২১১-১২৩৬ খ্রি
বংশদাস বংশ
প্রতিষ্ঠাতাকুতুবউদ্দিন আইবক
পূর্বসূরিআরাম শাহ
উত্তরসূরিরুকনউদ্দিন ফিরোজ শাহ
সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস

ভূমিকা :- ১২১১ খ্রিস্টাব্দে কুতবউদ্দিনের জামাতা ইলতুৎমিস দিল্লীর অভিজাতদের সহায়তায় সুলতানি সিংহাসন অধিকার করেন। ইলতুৎমিস ছিলেন ইলবারী গোষ্ঠীর তুর্কী। তার আমল থেকেই ইলবারী শাসন আরম্ভ হয়।

ইলতুৎমিসের নাম

  • (১) এনসাইক্লোপিডিয়া অফ ইসলাম গ্রন্থে ইলতুৎমিস কথাটির উচ্চারণ ‘ইলেৎমিশ’ করা হয়েছে। পারসিক উচ্চারণ মেনে ইলিয়ট ইলতুৎমিসের নাম “আল তামাস” উচ্চারণ করেছেন। বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক ‘ইলতুৎমিস’ নামটিই বেছে নিয়েছেন।
  • (২) কুতুব মিনারের ফটকে “ইলতুৎমিস-আল-কুতুবী” নামটি খোদাই আছে দেখা যায়। কুতুব মিনারের তৃতীয় তলায় “ইলতুৎমিস-আল-সুলতান” কথাটি খোদাই আছে। কাজেই, এরই ভিত্তিতে সুলতানের নাম ইলতুৎমিস উচ্চারণ করাই সঙ্গত মনে হয়।

সুলতান ইলতুৎমিসের পূর্বজীবন

  • (১) ইলতুৎমিসের পূর্বজীবন সম্পর্কে জানা যায় যে, ইলতুৎমিস বাল্যকাল থেকেই দেহসৌন্দর্যের অধিকারী ছিলেন। তাঁর সম্পন্ন পরিবারে জন্ম হলেও তার ভাইরা তাঁর প্রতি ঈর্ষাবশত তাকে ক্রীতদাস হিসেবে বিক্রি করে দেন।
  • (২) দাস বিক্রেতা তাকে বোখরার সম্ভ্রান্ত সদর-ই-জাহানের কাছে বিক্রি করে দেন। এই পরিবারে থাকার সময় ইলতুৎমিস বহু সহবৎ ও সদাচার শিক্ষা করেন। এই সময় তিনি যুদ্ধবিদ্যাও শিক্ষা করেন। পরে জামালউদ্দিন কাবা নামে এক বণিক তাকে কিনে দিল্লীতে সুলতান কুতুবউদ্দিন আইবেকের কাছে বিক্রি করেন।
  • (৩) কুতুবউদ্দিন তার দেহসৌন্দর্য ও সাহসিকতায় সন্তুষ্ট হয়ে তাকে বিভিন্ন দায়িত্বপূর্ণ পদ দেন এবং শেষ পর্যন্ত তিনি বাদাউনের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। খোক্করদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে ইলতুৎমিসের বীরত্বের জন্য কুতুবউদ্দিন তাঁর ক্রীতদাস সেনাপতি ইলতুৎমিসকে মুক্তিপত্র দেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর ১৯১১ খ্রিস্টাব্দে দিল্লীর কর্মচারীরা তাকে সুলতান হিসেবে নির্বাচন করেন।

সিংহাসনে ইলতুৎমিসের অধিকার

দিল্লীর সুলতানি সিংহাসনের ওপর ইলতুৎমিসের অধিকার বৈধ ছিল কিনা অথবা তিনি জবরদখলকারী ছিলেন কিনা এই সাংবিধানিক প্রশ্নটি এখানে প্রাসঙ্গিক। এ প্রসঙ্গে বিভিন্ন মত হল –

  • (১) ডঃ আর পি ত্রিপাঠীর মতে, “ইলতুৎমিসকে বেআইনী দখলকারী বলা যায় না। কারণ জবরদখল করার মত কোনো কিছুই দিল্লীতে ছিল না। ইলতুৎমিসের আগে দিল্লীর সিংহাসনে কোনো সার্বভৌম সম্রাট ছিলেন না”। অর্থাৎ কুতুবউদ্দিনকে কোনো অর্থে ভারতের সার্বভৌম সম্রাট বলা যায় না। সুতরাং ইলতুৎমিস যে সিংহাসন অধিকার করেন, তা করার ক্ষমতা তাঁর ছিল।
  • (২) আরাম শাহ কুতুবউদ্দিনের বৈধপুত্র ও প্রকৃত উত্তরাধিকারী ছিলেন কিনা সন্দেহ। সেক্ষেত্রে কুতুবউদ্দিনের প্রিয় ক্রীতদাস সেনাপতি ও জামাতা হিসেবে ইলতুৎমিসের দাবী অনেক জোরালো মনে হয়। দিল্লীর অধিকাংশ তুর্কী সেনাপতি ইলতুৎমিসকেই সমর্থন করেন। তাঁরা আরাম শাহের বিরোধিতা করেন। কারণ ইলতুৎমিস ছিলেন তুর্কীদের নির্বাচিত নেতা।
  • (৩) ইবন বতুতার মতে কুতুবউদ্দিনকে কোনোক্রমেই দিল্লীর প্রথম স্বাধীন সুলতান বলা যায় না। ফিরোজ শাহ তুঘলক তাঁর খুৎবায় কুতুবউদ্দিনের নাম উল্লেখ করেননি। সুতরাং ডঃ আর. পি. ত্রিপাটী মন্তব্য করেছেন যে “ভারতে মুসলিম সার্বভৌম অথবা সুলতানি প্রকৃতপক্ষে ইলতুৎমিসের আমল থেকে শুরু হয়।”

দিল্লির সুলতান ইলতুৎমিসের সমস্যা

সিংহাসনে বসার পর ইলতুৎমিস বহু প্রকার সমস্যার সম্মুখীন হন। যেমন –

  • (১) তিনি এক সাংবিধানিক সমস্যার সম্মুখীন হন। মহম্মদ ঘুরীর প্রতিনিধি হিসাবে তাজউদ্দিন, কুতুবউদ্দিন ও নাসিরুদ্দিন ছিলেন সমমর্যাদাসম্পন্ন। এখন কুতুবউদ্দিনের অবর্তমানে তার জামাতা ও দাস ইলতুৎমিস মর্যাদায় তাজউদ্দিন ও নাসিরুদ্দিন অপেক্ষা নীচে ছিলেন। এই কারণে তাজউদ্দিন ইলতুৎমিসকে তাঁর বশ্যতা স্বীকারে আহ্বান জানান।
  • (২) যদি ইলতুৎমিস তাজউদ্দিনের বশ্যতা স্বীকার করতেন তবে দিল্লীর সুলতানি গজনীর অধীনে চলে যেত।
  • (৩) ইলতুৎমিসের সঙ্গে দিল্লীর তুর্কী আমীর ও মালিকদের সাংবিধানিক সম্পর্ক নির্ধারণ করার দরকার দেখা দেয়। মালিক ও আমীররা নিজেদের সুলতানের সমকক্ষ বলে ভাবতে থাকে। যেহেতু তুর্কী মালিকদের মধ্য থেকে ইলতুৎমিস সুলতানের পদে মালিক ও আমীরদের দ্বারা নির্বাচিত হন, স্বভাবতই এই শ্রেণী নিজেদের সিংহাসনের পিছনে শক্তি বলে মনে করত। এর ফলে সিংহাসনের মহিমা কমে যায়।
  • (৪) কুতুবউদ্দিনের মৃত্যুর পর বাংলার আলিমর্দান খলজি বিদ্রোহ করে বাংলায় স্বাধীন সুলতানি স্থাপন করেন। এমন কি তিনি খলিফার কাছ থেকে বাংলার স্বাধীন সুলতানির অনুজ্ঞা পত্র যোগাড় করেন। উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের মতই, সুলতানি সাম্রাজ্য-এর পূর্ব সীমান্ত বাংলায় বিচ্ছিন্নতাবাদ দেখা দেয়।
  • (৫) সুযোগ বুঝে রাজপুত রাজারা একের পর এক গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ যথা, রণথম্ভোর, কালিঞ্জর প্রভৃতি এবং গুরুত্বপূর্ণ স্থান পুনর্দখল করে।
  • (৬) ইলতুৎমিসের রাজত্বকালেই “মানব জাতির মড়ক” (Scourge of mankind), রক্তলোলুপ চেঙ্গিজ খান পাঞ্জাবে তাঁর মোঙ্গল বাহিনী নিয়ে ঢুকে পড়েন।

সমস্যার সমাধানে ইলতুৎমিসের পদক্ষেপ

ইলতুৎমিস এই সঙ্কটজনক সমস্যাগুলির সমাধান করে শিশু সুলতানির চারাগাছটি রক্ষা করেন, যা বলবন-এর আমলে মহীরুহে পরিণত হয়। তিনি তিনটি কারণে বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে কাজ আরম্ভ করেন। যথা –

  • (১) তুর্কী অভিজাতরা ইলতুৎমিসকে নির্বাচন করেন। কাজেই তাকে তারা সমর্থন করতেন।
  • (২) ইলতুৎমিস ছিলেন সুদক্ষ সেনাপতি। বিরোধী শক্তিকে দমন করার দক্ষতা তাঁর ছিল।
  • (৩) বাগদাদের খলিফার ফর্মান লাভ করায়, তার অধিকার সম্পর্কে যাবতীয় আইনগত জটিলতা তিনি দূর করেন।

ইলতুৎমিস কর্তৃক ইলদুজের পতন

  • (১) সুলতান ইলতুৎমিস দৃঢ়ভাবে তাজউদ্দিন ইলদুজ ও নাসিরুদ্দিন কুবাচার হাত থেকে দিল্লীর সুলতানি সিংহাসনের স্বাধীনতা রক্ষার কাজে আত্মনিয়োগ করেন। তাজউদ্দিন নিজেকে মহম্মদ ঘুরীর উত্তরাধিকারী বলে মনে করতেন।
  • (২) তিনি গজনীতে বসে সমগ্র ঘুরী সাম্রাজ্যকে নিজের অধীনে আনার কথা ভাবেন। কুতুবউদ্দিনের মৃত্যু হলে তার দাস ইলতুৎমিসকে তিনি নিজের অধীন বলে দাবী করেন। কারণ কুতুবউদ্দিন ও তাজউদ্দিন উভয়েই ছিলেন মহম্মদ ঘুরীর অনুচর ও সমমর্যাদা সম্পন্ন।
  • (৩) ইতিমধ্যে খারজম শাহের আক্রমণে গজনী হারিয়ে, তাজউদ্দিন পাঞ্জাবে আশ্রয় নেন। তিনি সরস্বতী, ভাতিন্ডা এবং লাহোর অধিকার করেন। ফুতুহ-উস-সালাতিনের মতে, তিনি এক পরোয়ানা দ্বারা ইলতুৎমিসের বশ্যতা দাবী করেন, এই সংবিধান দেখিয়ে যে, “তিনি মহম্মদ ঘুরীর উত্তরাধিকারী”।
  • (৪) ইলতুৎমিস উত্তরে জানান যে, বংশানুক্রমিক অধিকারের আইন এখন অচল হয়ে গেছে। গজনী ও ঘুরী রাজ্যের পতন ঘটেছে। সুতরাং তাজউদ্দিনের দাবীর বৈধতা নেই। অবশ্য এই যুগে তলোয়ারের দাবীই ছিল শেষ কথা।
  • (৫) সুতরাং তাজউদ্দিনের বাহিনীকে ইলতুৎমিস তরাইনের রণক্ষেত্রে (মতান্তরে সামানা) ধ্বংস করেন। তাজউদ্দিন বন্দী ও নিহত হন। এই ব্যবস্থার দ্বারা ইলতুৎমিস দিল্লীর সুলতানির পূর্ণ স্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা করেন। ভবিষ্যতে আর গজনীর দাবী দিল্লী সুলতানিকে দুর্বল করতে পারেনি।

ইলতুৎমিসের নিকট নাসিরুদ্দিন কুবাচার পতন

  • (১) তাজউদ্দিন পাঞ্জাবের যে সকল স্থান অধিকার করেন, নাসিরুদ্দিন কুবাচা লাহোরসহ সেই সকল স্থান সঙ্গে সঙ্গে অধিকার করেন। আপাতত কূটনৈতিক কারণে ইলতুৎমিস কুবাচার উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে সহ্য করেন।
  • (২) কুবাচা এর পর শিরহিন্দ দখলের চেষ্টা করলে ইলতুৎমিস বাধাদানের প্রয়োজনীয়তা বুঝেন। ১২১৭ খ্রিস্টাব্দে ইলতুৎমিস মানসেরার যুদ্ধে কুবাচাকে পরাস্ত করলে তিনি সিন্ধু প্রদেশে পালিয়ে যান।
  • (৩) উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে খারাজম শাহের অনুপ্রবেশের ফলে গণ্ডগোল দেখা দেওয়ায়, ইলতুৎমিস সিন্ধুদেশ, কুবাচার অধিকার থেকে মুক্ত করতে আপাতত বিরত থাকেন।

সুলতান ইলতুৎমিসের আমলে চেঙ্গিজের আক্রমণ

  • (১) ইতিমধ্যে ১২২১ খ্রিস্টাব্দ থেকে পাঞ্জাবে নতুন পরিস্থিতি দেখা দিলে সমগ্ৰ দিল্লী সুলতানির অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে। দ্বিগ্বিজয়ী মোঙ্গল বীর তেমুচীন বা চেঙ্গিজ খান খারাজম রাজ্য আক্রমণ করে ধ্বংস করলে, খারাজমের শাহ জালালুদ্দিন মঙ্গবরণী পাঞ্জাবে পালিয়ে আসেন।
  • (২) পাঞ্জাব-কাশ্মীরের খোক্কর উপজাতির রাজকন্যাকে বিবাহ করে তিনি খোক্কর উপজাতির সাহায্যে পাঞ্জাবে নিজ আধিপত্য স্থাপনের চেষ্টা করেন। জালালুদ্দিনের পিছু নিয়ে চেঙ্গিজ পাঞ্জাবে ঢুকে পড়ে সিন্ধু নদের তীরে শিবির স্থাপন করেন।
  • (৩) এদিকে জালালুদ্দিন ইলতুৎমিসকে তাঁর পক্ষ নিয়ে এগিয়ে আসতে বলেন। অপর দিকে চেঙ্গিজ খান, ইলতুৎমিসের কাছে দূত পাঠিয়ে খারাজম শাহকে সাহায্য করতে নিষেধ করেন। ইলতুৎমিস এই উভয় সঙ্কটে মাথা ঠাণ্ডা রেখে নিরপেক্ষতা নীতি নেন।
  • (৪) জালালুদ্দিন যাতে আর পাঞ্জাবের ভেতর বেশী দূর এগোতে না পারেন সেজন্য ইলতুৎমিস সামরিক তৎপরতা দেখান। জালালুদ্দিন মঙ্গবরণী অতপর পাঞ্জাব হতে পিছু হঠে সিন্ধুর দিকে চলে যান।

ইলতুৎমিসের সাম্রাজ্য থেকে খারাজম শাহের পলায়ন

মঙ্গবরণী পালিয়ে যাবার সময় নাসিরুদ্দিন কুবাচাকে কয়েকটি যুদ্ধে পরাস্ত করে সিন্ধুর বহু অঞ্চল অধিকার করেন। শেষ পর্যন্ত মোঙ্গল সেনা তাঁর পিছু নিয়ে সিন্ধুতে আসবার উপক্রম করলে তিনি পারস্যে পালিয়ে যান।

ইলতুৎমিসের পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু জয়

  • (১) ইলতুৎমিস তাঁর নিরপেক্ষতা নীতির দ্বারা চেঙ্গিজের ক্রোধ হতে শিশু সুলতানি রাষ্ট্রকে রক্ষা করেন। চেঙ্গিজ ভারত ছেড়ে চলে গেলেও কিছু মোঙ্গল সেনা সিন্ধু উপত্যকায় বসবাস করতে থাকে। তারা ইলতুৎমিসের পক্ষে এর উপদ্রব সৃষ্টি করে।
  • (২) যতদিন চেঙ্গিজ জীবিত ছিলেন তাঁর ভয়ে ইলতুৎমিস পশ্চিম পাঞ্জাবে অভিযান চালিয়ে এই অঞ্চলকে মোঙ্গল অধিকার মুক্ত করতে বিরত থাকেন। ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে চেঙ্গিজের মৃত্যু হলে তিনি পশ্চিম পাঞ্জাব ও সিন্ধু অধিকার করেন।

ইলতুৎমিসের সংগঠন নীতি

চেঙ্গিজের অভিযান অপসারিত হলে ইলতুৎমিস বিদ্রোহ দমন ও তার প্রতিদ্বন্দ্বীদের ধ্বংস করার কাজে হাত দেন। ১২২৮ খ্রিস্টাব্দ থেকে ১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে তাঁর মৃত্যুকাল পর্যন্ত তিনি অব্যাহতভাবে সংগঠন নীতি অনুসরণ করেন।

ইলতুৎমিসের সিন্ধু ও মুলতান দখল

খারাজম শাহের আক্রমণে সিন্ধুতে নাসিরুদ্দিন কুবাচার শক্তি ক্ষয় হয়। সেই সুযোগে ইলতুৎমিস কুবাচাকে আক্রমণ করেন। ইলতুৎমিস তাকে ভাঘরের যুদ্ধে ১২২৭ খ্রিস্টাব্দে পরাস্ত করলে তিনি সিন্ধু নদের জলে ডুবে আত্মহত্যা করেন। সিন্ধু ও মুলতান ইলতুৎমিসের অধিকারে আসে।

বাংলার বিদ্রোহ দমনে ইলতুৎমিসের অবদান

  • (১) বাংলায় আলিমর্দান খলজি বিদ্রোহ ঘোষণা করলে তাকে হিসামউদ্দিন খলজি হত্যা করেন। হিসামউদ্দিন নিজে গিয়াসউদ্দিন খলজি নাম নিয়ে স্বাধীনভাবে সিংহাসনে বসেন।
  • (২) ইলতুৎমিসের পুত্র নাসিরউদ্দিন মাহমুদ তাকে নিহত করেন। এর পর বল্কা খলজি বাংলার সিংহাসনে স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার চেষ্টা করলে ইলতুৎমিস তাকে নিহত করে বাংলায় সুলতানি শাসন পুনঃপ্রতিষ্ঠা করেন।

সাম্রাজ্যের সীমা বিস্তারে ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব

এর পর ইলতুৎমিস রণথম্ভোর, গোয়ালিয়র, কনৌজ, কালিঞ্জর পুনর্দখল করে সুলতানি সাম্রাজ্যের সীমাকে পুনরায় নায্য সীমায় স্থাপন করেন।

ইলতুৎমিস কর্তৃক খলিফার সনদ লাভ ও তার তাৎপর্য

সুলতান ইলতুৎমিস লক্ষ্য করেন যে, তুর্কী মালিক ও আমীররা তাঁর সঙ্গে সমান মর্যাদা দাবী করছেন। তিনি তার বৈধতা ও রাজকীয় মর্যাদা স্থাপনের জন্য ১২২৯ খ্রিস্টাব্দে খলিফার কাছ থেকে ফর্মান লাভ করেন। এর ফলে দিল্লীর সিংহাসনে তাঁর বৈধ অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়। কারণ মুসলিম জগতে খলিফার পরোয়ানা ছিল বৈধ অধিকারের স্বীকৃতি পত্ৰ।

শাসন ব্যবস্থা সংগঠনে ইলতুৎমিসের কৃতিত্ব

ইলতুৎমিস সুলতানি সাম্রাজ্যে একটি কার্যকরী শাসন ব্যবস্থা সংগঠন করেন। তিনি ইক্তা ব্যবস্থার সংগঠন করে মাকতি বা ইজাদারদের মাধ্যমে স্বকীয় শাসন ব্যবস্থা গঠন করেন। প্রাক্-তুর্কী যুগের সামন্ত শাসন ব্যবস্থাকে ভেঙে ইক্তাদারদের মাধ্যমে তিনি উত্তর ভারত-এর বিভিন্ন অঞ্চলকে কেন্দ্রীয় সুলতানির অধীনে আনেন। ইক্তাদারদের মাধ্যমে রাজস্ব আদায় ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়। বৃহৎ ইক্তাগুলি একই সঙ্গে রাজস্ব আদায় ও প্রশাসনিক দায়িত্ব বহন করে। তবে তুর্কী বা তাজিকরাই প্রধানত ইক্তাদারের পদে নিযুক্ত হয়। ইক্তাদারদের নিছক সরকারী কর্মচারী হিসেবে তিনি দেখতেন। তাদের মধ্যে তিনি স্থানীয়তা ও সামন্ততান্ত্রিক ভাব গড়ে উঠতে দেন নি।

ইলতুৎমিসের সেনাদল গঠন

তিনি সুলতানি সেনাদল গঠন করেন এবং তিনি কেন্দ্রীয় সরকারের বাহিনী হিসেবে গণ্য করতেন।

ইলতুৎমিসের বিচার ব্যবস্থা

তিনি মুসলিম আইন অনুসারে সর্বসাধারণের জন্য ন্যায় বিচারের ব্যবস্থা করেন।

মুদ্রার প্রচলনে ইলতুৎমিসের অবদান

তিনি সোনা ও রূপার মুদ্রা এবং তামার জিতল চালু করেন। তাঁর রৌপ্য মুদ্রার ওজন ছিল ১৭৫ গ্রাম।

ধর্মপ্রাণ মুসলমান ইলতুৎমিস

তিনি দরবারে অভিজাত ও উলেমাদের যথোচিত পদ মর্যাদা দিতেন। ব্যক্তিগতভাবে তিনি ছিলেন ধর্মপ্রাণ মুসলমান। কিন্তু উলেমাদের তার রাজকার্যে হস্তক্ষেপ করতে তিনি দিতেন না।

ইলতুৎমিস কর্তৃক উত্তরাধিকারী মনোনীত

১২৩৬ খ্রিস্টাব্দে মৃত্যুর পূর্বেই তিনি দিল্লী সুলতানির সিংহাসনের উত্তরাধিকারী হিসেবে তার কন্যা রাজিয়াকে মনোনীত করেন।

উপসংহার :- তিনি সুফী সন্তদের প্রতি অনুরাগ দেখান। সুফী সাধু সেখ কুতুবউদ্দিন বক্তিয়ার কাকীর স্মরণে কুতুবউদ্দিন আইবক বিখ্যাত কুতুবমিনারের নির্মাণ ১২০৯ খ্রিস্টাব্দে শুরু করেন। ইলতুৎমিস এই মিনারের নির্মাণ কার্য সমাপ্ত করেন।

(FAQ) সুলতান সামসুদ্দিন ইলতুৎমিস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. দিল্লী সুলতানির প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

ইলতুৎমিস।

২. সুলতান-ই-আজম উপাধি গ্ৰহণ করেন কে?

ইলতুৎমিস।

৩. ভারতে ইক্তা ব্যবস্থার প্রচলন করেন কে?

ইলতুৎমিস।

৪. ইলতুৎমিসের সময় কোন মোঙ্গল নেতা ভারত আক্রমণ করে?

চেঙ্গিজ খান।

Leave a Comment