হিউয়েন সাঙ

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ -এর জন্ম পরিচয়, বংশ পরিচয়, প্রাথমিক শিক্ষা, ভারতে আগমনকাল, ভারত সফরের উদ্দেশ্য, ভারত-চীন যোগসূত্র স্থাপন, হিউয়েন সাঙের দীক্ষাগুরু সম্পর্কে জানবো।

এছাড়াও ভারতে আগত চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং -এর রচিত গ্রন্থ ও গ্রন্থের গুরুত্ব, হর্ষবর্ধনের রাজ্যে আগমন, শশাঙ্কের রাজ্যে আগমন, বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে বিবরণ ও তার গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙ

জন্ম৬০২ খ্রিস্টাব্দ, চীন -এর হুনান প্রদেশ
পিতাচেন হুই
পরিচিতিবৌদ্ধ ভিক্ষু
গ্ৰন্থসি-ইউ-কি
মৃত্যু৬৬৪ খ্রিস্টাব্দ
হিউয়েন সাঙ

ভূমিকা :- হিউয়েন সাঙ ছিলেন বিখ্যাত চীনা বৌদ্ধ ভিক্ষু, পণ্ডিত, পর্যটক এবং অনুবাদক।

হিউয়েন সাঙের জন্ম পরিচয়

চীনের লুজহু প্রদেশের (বর্তমান হিনান প্রদেশ) গৌসি টাউনের চিনহি গ্রামে ৬০২ খ্রিষ্টাব্দে একটি সম্ভ্রান্ত ও উচ্চশিক্ষিত পরিবারে হিউয়েন সাঙ জন্মগ্রহণ করেন।

হিউয়েন সাঙের বংশ পরিচয়

হিউয়েন সাঙের পূর্বসূরী চেন শি ছিলেন হান সম্রাজ্যের একজন মন্ত্রী। তার বাবা চেন হুই, শুই সম্রাজ্যের একজন ম্যাজিষ্ট্রেট হিসেবে কাজ করেছেন কিন্তু পরবর্তীতে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার আশঙ্কায় চাকরি ছেড়ে দেন।

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাঙের বিভিন্ন নাম

চীনা পর্যটক হিউয়েন সাং, হিউয়েন সাং বা হুয়ান-সাং বা জুয়ানজ্যাং ইত্যাদি নামে পরিচিত।

হিউয়েন সাঙের প্রাথমিক শিক্ষা

ভাই বোনদের মতই হিউয়েন সাং তাদের বাবার কাছ থেকে প্রাথমিক শিক্ষা লাভ করেন।

হিউয়েন সাঙের ভারত সফরের উদ্দেশ্য

মূলত গৌতম বুদ্ধ -এর নিদর্শন ও স্মৃতিধন্য স্থানসমূহ পরিদর্শন এবং আমাদের দেশ ভারতবর্ষ থেকে বুদ্ধ ও অন্যান্য বৌদ্ধ ভিক্ষুদের রচনা সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়ার জন্যই হিউয়েন সাং ভারত ভ্রমণ করেছিলেন।

ভারত-চীন যোগসূত্র স্থাপন

হিউয়েন সাঙের ভারত সফরের সময় তিনি উত্তর ভারতের সম্রাট হর্ষবর্ধন (৬০৬ – ৬৪৭) – এর রাজত্বকালে চৈনিক এবং ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম -এর মধ্যে যোগসূত্র স্থাপনের ব্যাপারে অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন।

কনফুসীয় তত্ত্বে হিউয়েন সাঙের আগ্ৰহ

বিভিন্ন স্থানে প্রাপ্ত তার আত্মজীবনী থেকে জানা যায় যে, হিউয়েন সাং খুব ছোটবেলা থেকেই কনফুসিয়াস -এর গতানুগতিক তত্ত্বের উপর ব্যাপক আগ্রহ এবং পারদর্শিতা প্রদর্শন করতে থাকেন যা তার বাবাকে অবাক করে দেয়।

বৌদ্ধ ভিক্ষু হিউয়েন সাঙ

পরিবারের সকলে কনফুসিয়াসের তত্ত্বের উপর বিশ্বাসী হলেও হিউয়েন সাং তার দাদা চেন সু এর পদাঙ্ক অনুসরণ করে বৌদ্ধ ভিক্ষু হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশ করেন।

বৌদ্ধ আশ্রমে হিউয়েন সাঙ

৬১১ খ্রিষ্টাব্দে তার বাবার মৃত্যু হলে হিউয়েন সাং লুয়াং প্রদেশে জিংতু বুদ্ধ আশ্রমে তার ভাইয়ের সাথে প্রায় পাঁচ বছর কাটান। সেই বুদ্ধ আশ্রমে সেই সময় বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ হিসেবে মাহাযান চর্চা করা হত।

হিউয়েন সাঙের দীক্ষাগুরু

হিউয়েন সাঙের দীক্ষাগুরু ছিলেন শীলভদ্র ।

পূর্ণরূপে বৌদ্ধ ভিক্ষু

৬২২ সালে ২০ বছর বয়সে হিউয়েন সাং একজন পূর্ণ বৌদ্ধ ভিক্ষু হয়ে ওঠেন। এই সময় তিনি বৌদ্ধতত্ত্ব বিষয়ে বিস্তৃত পড়াশোনা করেন।

সংস্কৃত ভাষাচর্চা

ভারতবর্ষে গিয়ে অরো জ্ঞানার্জনের ইচ্ছা পোষণের চিন্তা করে হিউয়েন সাং তার ভাইকে রেখে পুনরায় তাং সম্রাজ্যের রাজধানীতে চলে যান। সেখানে তিনি সংস্কৃত ভাষা চর্চা শুরু করেন। একই সময়ে তিনি বৌদ্ধতত্ত্বের অধিবিদ্যার উপর আগ্রহী হয়ে ওঠেন।

হিউয়েন সাঙের পূর্ব সুরী

ফা-হিয়েন-এর ভারত ভ্রমণ সম্পর্কে তিনি অবহিত ছিলেন এবং তিনিও চীনে পৌঁছানো বৌদ্ধ ধর্মশাস্ত্রের অসম্পূর্ণতা ও ভুলব্যাখ্যা সম্পর্কে অবহিত ছিলেন।

ভারত যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট

৬২৯ সালে একটি স্বপ্ন দেখে হিউয়েন সাং ভারত যাত্রার প্রতি আকৃষ্ট হন। ঐ সময়ে তাং সম্রাজ্যের সাথে তুর্কদের যুদ্ধ চলছিল তাই তাং রাজা তাইজং সকল নাগরিকদের বিদেশ যাত্রা নিষেধ করে দিয়েছিলেন।

হিউয়েন সাঙের ভারত ভ্রমণের সূচনা

মূলত লামখান থেকেই হিউয়েন সাঙের ভারতবর্ষ ভ্রমণের সূচনা।

হিউয়েন সাঙের ভারতে প্রবেশ

ধারণামতে ৬৩০ খ্রিষ্টাব্দের কোন এক সময়ে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছিলেন।

হিউয়েন সাঙের তুর্পান যাত্রা

হিউয়েন সাং কুইংঘি প্রদেশ হয়ে গোবি মরুভূমি পার হয়ে ৬৩০ সালে তুর্পান পৌছান। এখানে তিনি বৌদ্ধ রাজার সাথে দেখা করেন যিনি হিউয়েন সাং কে কিছু মূল্যবান জিনিসপত্র এবং যাত্রার জন্য রসদ সরবরাহ করেন।

কিরগিজস্তাননে হিউয়েন সাঙ

তুর্পান থেকে আরো পশ্চিমে যেতে থাকলে ইয়ানজি ও কুচা হয়ে হিউয়েন সাং কিরগিজস্তান পৌছান, যেখানে তিনি তুর্ক খানের সাথে সাক্ষাৎ করেন।

সমরখন্দে হিউয়েন সাঙ

কিরগিজস্তান থেকে পরবর্তীতে তিনি বর্তমান উজবেকিস্তানের রাজধানী তাসখন্দে পৌছান। সেখান থেকে আরো পশ্চিমে পার্সিয়া নিয়ন্ত্রিত সমরখন্দ শহরে পৌছান।

এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ

সমরখন্দে তিনি কিছু ধ্বংশ হয়ে যাওয়ে বৌদ্ধ স্থাপনা দেখে বিস্মিত হন। সমরখন্দ থেকে আরো পশ্চিমে আমু দরিয়া এবং তিরমিজে পৌছান যেখানে তিনি প্রায় এক হাজার বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে সাক্ষাৎ করেন।

ধর্মসীমা ও হিউয়েন সাঙ

যাত্রাকালে ধর্মসীমা নামে এক বিখ্যাত বৌদ্ধ ভিক্ষুর সাথে হিউয়েন সাং সাক্ষাৎ করেন।

নব বিহারে হিউয়েন সাঙ

পশ্চিমে নব বিহার পরিদর্শন করেন। নব বিহারের বর্তমান নাম আফগানিস্তান। সেখানে তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ এবং মহাবিশ্ব গ্রন্থের অনুসারী প্রায় তিন হাজার বৌদ্ধ বিক্ষু দেখেন। হিউয়েন সাং -এর মতে নব বিহার হল পৃথিবীর সর্ব পশ্চিমে অবস্থিত দেশ, যা বৌদ্ধ ধর্ম প্রতিপালন করে।

জালালাবাদে হিউয়েন সাঙ

নব বিহারে কিছুদিন অবস্থান করে ৬৩০ সালের দিকে তিনি আদিনপুর (বর্তমান জালালাবাদ) যান। জালালাবাদ এসেই হিউয়েন সাং মনে করতে থাকেন যে তিনি ভারতবর্ষে প্রবেশ করেছেন।

পেশোয়ারে হিউয়েন সাঙ

আদিনপুর ত্যাগ করে তিনি খাইবার পাস হয়ে পেশাওয়ার দিকে রওনা হন। যাওয়ার পথে তিনি অনেক বৌদ্ধ মঠ দেখেন কিন্তু সেগুলোতে সে তুলনায় বৌদ্ধ ভিক্ষু ছিল না। হিউয়েন সাং -এর মতে পূর্বে পেশওয়ারের বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কিত যে গৌরব ছিল তা তৎকালীন পেশওয়ার হারাতে বসেছিল।

সোয়াত উপত্যাকায় হিউয়েন সাঙ

পেশাওয়ার থেকে হিউয়েন সাং সোয়াত উপত্যকার দিকে অগ্ৰসর হন, যেখানে তিনি চোদ্দশ পরিত্যক্ত বৌদ্ধ মঠ দেখতে পান। এখানে পূর্বে প্রায় আঠারো হাজার ভিক্ষু বসবাস করতেন।

কাশ্মীরে হিউয়েন সাঙ

সোয়াত উপত্যাকা দিয়ে হিউয়েন সাং সিন্ধু নদ পার হন। সিন্ধু পার হয়ে তিনি কাশ্মীরের দিকে ধাবিত হন।

  • (১) কাশ্মীরে হিউয়েনের সাথে বৌদ্ধ ভিক্ষু সংঘাসের সাথে দেখা হয়ে যায়। সংঘাস ছিলেন মহাযান গ্রন্থের পন্ডিত। হিউয়েন কাশ্মীরে ৬৩২ থেকে ৬৩৩ সাল পর্যন্ত অন্যান্য জ্ঞানী ভিক্ষুদের সাথে মহাযান অধ্যয়ন করে কাটান।
  • (২) এখানে অবস্থানকালেই তিনি তার বইয়ে খৃষ্টপূর্ব প্রথম শতকে অনুষ্ঠিত প্রথম বৌদ্ধ কাউন্সিলের ব্যাপারে লিখেছিলেন। এরপর তিনি আরো পূর্বের দিকে লাহোর ও মতিপুরের দিকে রওনা দেন।

হিউয়েন সাঙ ও উজ্জয়িনী

খ্রিস্টীয় ষষ্ঠ শতাব্দীতে চীনা তীর্থযাত্রী হিউয়েন সাং ভারত সফরকালে উজ্জয়িনী ঘুরে যান। তিনি অবন্তী -র শাসক সম্পর্কে বলেছেন যে, তিনি দরিদ্রদের প্রতি উদার ছিলেন এবং তাদের উপহার দিয়েছিলেন।

হিউয়েন সাঙ ও তক্ষশীলা

চৈনিক ভিক্ষু হিউয়েন সাং ৬৩০ এবং ৬৪৩ সালে তক্ষশীলা -য় ভ্রমণ করেছিলেন। তিনি শহরটির নাম বলেছিলেন তা-চা-শি-লো (Ta-Cha-Shi-Lo)। ধারণা করা হয় যে, সেই সময়েই শহরটি প্রায় ধ্বংসস্তুপে পরিণত হয়েছিল।

নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয়ে হিউয়েন সাঙ

হিউয়েন সাং মগধ -এর বিভিন্ন বৌদ্ধ তীর্থস্থান পরিদর্শন করেন এবং অনেক সময় তৎকালীন বিখ্যাত বৌদ্ধ শিক্ষাকেন্দ্র  নালন্দা বিশ্ববিদ্যালয় – এ পড়াশোনায় অতিবাহিত করেন।

কনৌজে হিউয়েন সাঙ

রাজা হর্ষবর্ধনের আমন্ত্রণে হিউয়েন সাং কনৌজ -এ আসেন।

হিউয়েন সাঙের কাঞ্চী ভ্রমণ

তিনি অন্ধ্রপ্রদেশের অমরাবতী এবং নাগার্জুনকোণ্ডা বিহার ভ্রমণ করেন। এরপর পল্লবদের রাজধানী কাঞ্চী ভ্রমণ করেন।

হিউয়েন সাঙের বাংলা আগমন

ভারত ভ্রমণের সাথে বাংলা (বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গবাংলাদেশ) তে হিউয়েন সাঙের আগমন একটি গুরুত্বপূর্ণ দিক। নালন্দা, পুন্দ্রনগর হয়ে তিনি পশ্চিমে সমুদ্র তীরবর্তী তাম্রলিপ্ত বন্দরে যান।

শশাঙ্ক ও হিউয়েন সাঙ

সম্ভবত এর পর শশাঙ্ক এর রাজধানী কর্ণসুবর্ণ তে গিয়েছিলেন হিউয়েন সাং।

চীনে প্রত্যাবর্তন

মনে করা হয় যে, হিউয়েন সাং উড়িষ্যা দিয়ে চীনে ফিরে যান।

বিখ্যাত গ্ৰন্থ

ভারতের সফরকালে ভারতে বৌদ্ধ ধর্ম বিষয়ে হিউয়েন সাঙের লেখা গ্ৰন্থ টি হল ‘সি-ইউ-কি’।

 উপসংহার :- ঐতিহাসিক স্মিথ যথার্থই বলেছেন যে, হিউয়েন সাঙের কাছে ভারতীয় ইতিহাসের ঋণ অস্বীকার করা সম্ভব নয় (It is impossible to over – estimate the debt which the history of India owes to Hiuen – Xang)

(FAQ) হিউয়েন সাঙ সম্পর্কে হতে জিজ্ঞাস্য?

১. সি ইউ কি কার লেখা?

হিউয়েন সাং।

২. হিউয়েন সাং কার রাজত্বকালে ভারতে আসেন?

হর্ষবর্ধন।

৩. হিউয়েন সাঙের লেখা গ্ৰন্থের নাম কি?

সি-ইউ-কি।

৪. হিউয়েন সাং এর লেখা বইটির নাম কী?

সি ইউ কি।

৫. হিউয়েন সাঙ/সাং কে ছিলেন?

একজন চীনা পর্যটক।

৬. হিউয়েন সাং কখন ভারতে আসেন?

৬৩০ খ্রীষ্টব্দে।

৭. সুয়ান জাং কে ছিলেন?

হিউয়েন সাঙের অপর নাম।

৮. হিউয়েন সাং কার রাজত্বকালে বাংলায় আসেন?

হর্ষবর্ধন।

৯. হিউয়েন সাঙ কখন বাংলায় আসেন?

৬৩৮ সালের কোনো এক সময়।

Leave a Comment