বিষ্ণুপুরের ইতিহাস

বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের ইতিহাস, শিল্প, মন্দির স্থাপত্য, সংস্কৃতির বিস্তার, রাজবাড়ী, বিখ্যাত কামান ও বিষ্ণুপুরের রাজবংশের তালিকা তুলে ধরা হল।

বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুরের ইতিহাস নিয়ে আলোচনা

পূর্ব নামমল্লভূম
অবস্থান পশ্চিমবঙ্গ -এর বাঁকুড়া জেলায়
মললরাজবংশের প্রতিষ্ঠাতাআদি মল্ল
বিষ্ণুপুর -এর অন্যতম আকর্ষণীয় কামানদলমাদল
ঐতিহাসিক স্থাপত্যরাসমঞ্চ, মৃণ্ময়ী মন্দির
বিষ্ণুপুর

বিষ্ণুপুরের ইতিহাস

বিষ্ণুপুর, ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বাঁকুড়া জেলার মন্দির শহরটি তার দুর্দান্ত ঐতিহ্য, গর্বিত সংস্কৃতি, উজ্জ্বল স্থাপত্য এবং পোড়ামাটির গল্প দ্বারা আমাদের স্বাগত জানায়। এই নির্মল জায়গায় আমরা ছুটির গন্তব্য পরিকল্পনা করতে পারি। এমন একটি শহর ঘুরে দেখা যেতে পারে যেখানে টেরাকোটা যেন ভাষা বলে। বিষ্ণুপুরের পোড়ামাটির শিল্পকর্মের দর্শনীয় পদচিহ্নগুলি সহ অসংখ্য কাঠামোর মধ্যে হিন্দু পৌরাণিক কাহিনীগুলির সমৃদ্ধিতে আমরা আকৃষ্ট হতে পারি। বিষ্ণুপুরের বিভিন্ন মন্দিরগুলির আপনার আশেপাশে ফিসফিসিয়ে বলে যাওয়া ইতিহাস এবং মায়াময় শিল্প-ফর্ম অবশ্যই আপনাকে শিহরণ দেবে।

মল্লভূম তথা বিষ্ণুপুরের ইতিহাস

‘মল্ল’ কথার অর্থ মুষ্টিযুদ্ধ। তা থেকেই রাঢ়বঙ্গের এক অংশের নাম হয়েছিল মল্লভূম। আবার অনেকের মতে, স্থানীয় মল্ল আদিবাসীদের থেকেই এই নামকরণ। এই ভূমির প্রথম মল্ল শাসক ছিলেন আদি মল্ল। তাঁর জন্মরহস্য এখনও অস্পষ্ট। জানা যায় তাঁর রাজপুত পিতা অন্তঃস্বত্ত্বা স্ত্রীকে জঙ্গলে ফেলে চলে গিয়েছিলেন পুরীতে তীর্থ করতে। স্ত্রীর কাছে রেখে গিয়েছিলেন নিজের তলোয়ার এবং বংশপরিচয়।

পরবর্তীতে জঙ্গলে পুত্রসন্তান প্রসব করে মারা যান সেই রাজপুত নারী। মাতৃহারা শিশুটি বাগদি সম্প্রদায়ের মধ্যে বড় হয়। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তাঁর শারীরিক বৈশিষ্ট্য এবং তাঁর বাবার রেখে যাওয়া অভিজ্ঞান থেকে স্পষ্ট হয়ে ওঠে বাগদি সম্প্রদায় থেকে তাঁর পার্থক্য। এরপর স্থানীয় এক ব্রাহ্মণের কাছে বড় হয়ে ওঠে শিশুটি। পরবর্তীকালে তিনিই শাসক আদি মল্ল হয়ে স্থাপন করেন মল্ল বংশ। এর ফলে গোড়াপত্তন হয় মল্লভূমির। মল্ল শাসকরা ছিলেন বৈষ্ণব। সেই সূত্রে পরে তাঁদের রাজ্যের নাম হয় ‘বিষ্ণুপুর’।

বিষ্ণুপুরের বিস্তার

আমরা আগেই জেনেছি বিষ্ণুপুর-সংলগ্ন অঞ্চলটিকে অতীতে মল্লভূম বলা হত। মল্লভূম রাজ্যের কেন্দ্রীয় এলাকা ছিল বর্তমান বাঁকুড়া থানা এলাকা (ছাতনা বাদে), ওন্দা, বিষ্ণুপুর, কোতুলপুর ও ইন্দাস। তবে প্রাচীন বিষ্ণুপুর রাজ্যের আয়তন আরও বড়ো ছিল। উত্তরে সাঁওতাল পরগনার দামিন-ই-কোহ থেকে এই রাজ্য দক্ষিণে মেদিনীপুর পর্যন্ত প্রসারিত ছিল। পূর্ব বর্ধমান -এর পূর্বাঞ্চল থেকে পশ্চিমে ছোটোনাগপুরের একটি অঞ্চলও এই রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। মল্ল রাজারা এই সব অঞ্চল মল্লভূমের অধিকারে আনতে সক্ষম হয়েছিলেন।

বিষ্ণুপুরের ভৌগোলিক অবস্থান

বিষ্ণুপুর শহরটির অবস্থানের অক্ষাংশ ও দ্রাঘিমাংশ হল ২২.৩৮° উত্তর ৮৮.২৭° পূর্ব। সমুদ্র সমতল হতে এর গড় উচ্চতা হল ৫৯ মিটার (১৯৪ ফুট)।

বিষ্ণুপুরের জনসংখ্যা

ভারত -এর ২০০১ সালের আদম শুমারি অনুসারে বিষ্ণুপুর শহরের জনসংখ্যা হল ৬১,৯৪৩ জন। যার মধ্যে পুরুষ ৫০% এবং নারী ৫০%। এখানে সাক্ষরতার হার ৬৯%। পুরুষদের মধ্যে সাক্ষরতার হার ৭৭% এবং নারীদের মধ্যে এই হার ৬১%। সারা ভারতের সাক্ষরতার হার ৫৯.৫%, তার থেকে বিষ্ণুপুর এর সাক্ষরতার হার বেশি। এই শহরের জনসংখ্যার ১১% হল ৬ বছর বা তার কম বয়সী।

বিষ্ণুপুরের ভাষা

বিষ্ণুপুর শহরের প্রধান ভাষা বাংলা। এখানকার ৯০ শতাংশের বেশি অধিবাসীর মাতৃভাষা বাংলা।

বিষ্ণুপুর রাজ্যের উত্থান ও পতন

খ্রিষ্টীয় সপ্তম শতাব্দী থেকে ব্রিটিশ শাসনের শুরু পর্যন্ত প্রায় এক হাজার বছর কাল বিষ্ণুপুরের ইতিহাস হিন্দু মল্ল রাজবংশের উত্থান ও পতনের সঙ্গে ওতোপ্রোতভাবে জড়িত। ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষভাগে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, “বিষ্ণুপুরের প্রাচীন রাজবংশের সূচনা সেই সময় ঘটে যখন দিল্লিতে হিন্দু রাজবংশ শাসন করত। সেই সময় ভারতের কেউ মুসলমান সম্প্রদায়ের নাম শোনেনি। বখতিয়ার খলজি হিন্দু রাজাদের হাত থেকে বাংলার শাসন অধিকার কেড়ে নেওয়ার আগে পাঁচশ বছর এই মল্ল রাজবংশ বিষ্ণুপুর শাসন করেছিল। যদিও, বাংলায় মুসলমান বিজয় বিষ্ণুপুর রাজাদের শাসনের ক্ষেত্রে কোনো পরিবর্তন আনতে সক্ষম হয় নি।

বাংলার মুসলমান শাসকেরা এই অরণ্যরাজ্য সম্পর্কে সম্যক অবহিত ছিলেন না। তারা এই অঞ্চলে কখনও আসেনি। এই কারণে, শতাব্দীর পর শতাব্দীকাল বিষ্ণুপুরের রাজারা নির্বিঘ্নে শাসনকার্য চালিয়ে যান। পরবর্তীকালে অবশ্য মুঘল রাজশক্তি এই অঞ্চল পর্যন্ত প্রসারিত হয়েছিল। এমনকি শোনা যায় যে, মাঝে মাঝে মুঘল বাহিনী বিষ্ণুপুরের কাছে এসে রাজস্ব দাবি করত এবং সম্ভবত বিষ্ণুপুরের রাজারা রাজস্ব দিয়েও দিতেন। মুর্শিদাবাদ -এর সুবাদারেরা পরবর্তীকালের বীরভূমবর্ধমান -এর রাজাদের মতো বিষ্ণুপুরের রাজাদেরও নিয়ন্ত্রণে আনতে সম্পূর্ণ সক্ষম হননি। পরে অবশ্য বর্ধমানের রাজাদের শক্তিবৃদ্ধি হওয়ার পর বিষ্ণুপুর রাজবংশের অবক্ষয় শুরু হয়। বর্ধমানের মহারাজা কীর্তিচাঁদ বিষ্ণুপুর আক্রমণ করে এই অঞ্চলের একটি বিস্তীর্ণ অঞ্চল নিজ জমিদারির অন্তর্ভুক্ত করেন। পরবর্তীতে বর্গী হানার সঙ্গে সঙ্গে বিষ্ণুপুর রাজবংশের পতন সম্পূর্ণ হয়। বর্তমানে এই রাজবংশ একটি দরিদ্র জমিদার পরিবার মাত্র।

বিষ্ণুপুরের রাজাদের উৎস

বিষ্ণুপুর রাজাদের উৎস রহস্যাবৃত। বহু শতাব্দীকাল ধরে তাদের বাগদি রাজা বলে উল্লেখ করা হয়েছে। যদিও বিষ্ণুপুরের রাজারা এবং তাদের অনুগামীরা দাবি করেন যে তারা উত্তর ভারতের ক্ষত্রিয় বংশোদ্ভুত। এই অঞ্চলের আর্যীকরণের শেষ পর্যায়ে এই দাবি বিশেষ জোরালো হয়ে ওঠে। বিষ্ণুপুরের রাজারা মল্ল রাজা নামে পরিচিত। সংস্কৃত মল্ল শব্দটির অর্থ মল্লযোদ্ধা। তবে এই শব্দটির সঙ্গে এই অঞ্চলের মাল উপজাতির সম্পর্ক থাকাও সম্ভব। এই উপজাতির সঙ্গে বাগদিদের সম্পর্ক বিদ্যমান।

বিষ্ণুপুরের রাজবংশের তালিকা

রাজাদের নামসময়কাল
আদি মল্ল(৬৯৪ – ৭১০)
জয় মল্ল(৭১০ – ৭২০)
বেণু মল্ল(৭২০ – ৭৩৩)
কিনু মল্ল(৭৩৩ – ৭৪২)
ইন্দ্র মল্ল(৭৪২ – ৭৫৭)
কানু মল্ল(৭৫৭ – ৭৬৪)
ধা (ঝাউ) মল্ল(৭৬৪ – ৭৭৫)
শূর মল্ল(৭৭৫ – ৭৯৫)
কনক মল্ল(৭৯৫ – ৮০৭)
কন্দর্প মল্ল(৮০৭ – ৮২৮)
সনাতন মল্ল(৮২৮ – ৮৪১)
খড়্গ মল্ল(৮৪১ – ৮৬২)
দুর্জন (দুর্জয়) মল্ল(৮৬২ – ৯০৬)
যাদব মল্ল(৯০৬ – ৯১৯)
জগন্নাথ মল্ল(৯১৯ – ৯৩১)
বিরাট মল্ল(৯৩১ – ৯৪৬)
মহাদেব মল্ল(৯৪৬ – ৯৭৭)
দূর্গাদাস মল্ল(৯৭৭ – ৯৯৪)
জগৎ মল্ল(৯৯৪ – ১০০৭)
অনন্ত মল্ল(১০০৭ – ১০১৫)
রূপ মল্ল(১০১৫ – ১০২৯)
সুন্দর মল্ল(১০২৯ – ১০৫৩)
কুমুদ মল্ল(১০৫৩ – ১০৭৪)
কৃষ্ণ মল্ল(১০৭৪ – ১০৮৪)
দ্বিতীয় রূপ (ঝাপ) মল্ল(১০৮৪ – ১০৯৭)
প্রকাশ মল্ল(১০৯৭ – ১১০২)
প্রতাপ মল্ল(১১০২ – ১১১৩)
সিঁদুর মল্ল(১১১৩ – ১১২৯)
শুখময়(শুক) মল্ল(১১২৯ – ১১৪২)
বনমালি মল্ল(১১৪২ – ১১৫৬)
যদু মল্ল(১১৫৬ – ১১৬৭)
জীবন মল্ল(১১৬৭ – ১১৮৫)
রাম (ক্ষেত্র) মল্ল(১১৮৫ – ১২০৯)
গোবিন্দ মল্ল(১২০৯ – ১২৪০)
ভীম মল্ল(১২৪০ – ১২৬৩)
কাতর(ক্ষাত্তর) মল্ল(১২৬৩ – ১২৯৫)
পৃথ্বী মল্ল(১২৯৫ – ১৩১৯)
তপ মল্ল(১৩১৯ – ১৩৩৪)
দীনবন্ধু মল্ল(১৩৩৪ – ১৩৪৫)
দ্বিতীয় কিনু / কানু মল্ল(১৩৪৫ – ১৩৫৮)
দ্বিতীয় শূর মল্ল(১৩৫৮ – ১৩৭০)
শিব সিং মল্ল(১৩৭০ – ১৪০৭)
মদন মল্ল(১৪০৭ – ১৪২০)
দ্বিতীয় দুর্জন মল্ল(১৪২০ – ১৪৩৭)
উদয় মল্ল(১৪৩৭ – ১৪৬০)
চন্দ্র মল্ল(১৪৬০ – ১৫০১)
বীর মল্ল(১৫০১ – ১৫৫৪)
ধারী মল্ল(১৫৫৪ – ১৫৬৫)
হাম্বীর মল্ল দেব(১৫৬৫ – ১৬২০)
ধারী হাম্বীর মল্ল দেব(১৬২০ – ১৬২৬)
রঘুনাথ সিংহ দেব(১৬২৬ – ১৬৫৬)
বীর সিংহ দেব(১৬৫৬ – ১৬৪২)
দুর্জন সিংহ দেব(১৬৪২ – ১৭০২)
দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেব(১৭০২ – ১৭১২)
গোপাল সিংহ দেব(১৭১২ – ১৭৪৮)
চৈতন্য সিংহ দেব(১৭৪৮ – ১৮০১)
মাধব সিংহ দেব(১৮০১ – ১৮০৯)
দ্বিতীয় গোপাল সিংহ দেব(১৮০৯ – ১৮৭৬)
রামকৃষ্ণ সিংহ দেব(১৮৭৬ – ১৮৮৫)
ধ্বজামণী দেবী(১৮৮৫ – ১৮৮৯)
নীলমণি সিংহ দেব(১৮৮৯ – ১৯০৩)
রাজা নেই(১৯০৩ – ১৯৩০)
কালীপদ সিংহ ঠাকুর(১৯৩০ – ১৯৮৩)
বিষ্ণুপুরের রাজবংশের তালিকা

বিষ্ণুপুরের উল্লেখযোগ্য রাজা

মল্লভূম তথা বিষ্ণুপুরের রাজবংশের তালিকা বিশাল। নির্দিষ্ট উপাদান ও প্রমাণের অভাবে সেই সব রাজাদের সমস্ত কৃতিত্ব আজ আমরা জানতে পারি না তবে বিখ্যাত কয়েক জন রাজা তাদের বিশেষ ভূমিকার মাধ্যমে আমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।

(১) আদিমল্ল

মল্ল রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন আদিমল্ল। এই রাজবংশের সূচনা সম্পর্কে একটি কিংবদন্তি প্রচলিত আছে। ৬৯৫ খ্রিষ্টাব্দে এক রাজপুত্র পুরীর জগন্নাথ মন্দিরে তীর্থ করতে যাচ্ছিলেন। তিনি কোতুলপুর থেকে ৮.৪ কিলোমিটার দূরে লাউগ্রামের গভীর অরণ্যে তাঁবু ফেলেন। সেখানেই তার সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে এক ব্রাহ্মণের তত্ত্বাবধানে রেখে তিনি চলে যান। রাজার স্ত্রী এক পুত্রসন্তানের জন্ম দেন এবং তারা লাউগ্রামেই থেকে যান। সাত বছর বয়সে ছেলেটি রাখালের কাজ শুরু করে। তবে অল্প বয়স থেকে তার মধ্যে নেতাসুলভ ভাব লক্ষিত হতে দেখা যায়। সে যোদ্ধা হিসেবে প্রশিক্ষিত হয়। মাত্র পনেরো বছর বয়সেই সে অপ্রতিদ্বন্দ্বী মল্লযোদ্ধা হয়ে ওঠে। এই কারণে সে আদিমল্ল (আদি বা অদ্বিতীয় মল্লযোদ্ধা) নামে পরিচিত হয়। বড়ো হয়ে আদিমল্ল লাউগ্রাম থেকে ১২.৮ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত বর্তমান জয়পুরের নিকটস্থ পদমপুরের রাজার কাছ থেকে লাউগ্রাম ও পার্শ্ববর্তী কয়েকটি গ্রামের আধিপত্য অর্জন করেন।

অবশ্য এই কাহিনির সত্যতা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। বিষ্ণুপুরের রাজাদের সঙ্গে ক্ষত্রিয় বংশের সংযোগ নিয়ে এই রকম একাধিক কাহিনি মল্লভূমে প্রচলিত ছিল। আদিমল্ল ৩৩ বছর লাউগ্রাম শাসন করেন এবং বাগদি রাজা নামে অভিহিত হন।

(২) জয় মল্ল

রাজা আদিমল্ল – এর পুত্র জয়মল্ল রাজা হয়ে পদমপুর আক্রমণ করে সেখানকার দুর্গ অধিকার করেন। জয়মল্ল তার রাজ্যের বিস্তৃতি ঘটিয়ে বিষ্ণুপুরে রাজধানী সরিয়ে আনেন। পরবর্তী রাজারাও রাজ্যবিস্তারে মন দিয়েছিলেন। এঁদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলেন রাজা কানুমল্ল, ও রাজা ঝাউমল্ল। রাজা সুরমল্ল উত্তর মেদিনীপুরের বাগড়ির রাজাকে পরাজিত করেছিলেন। তার পরে আরও ৪০ জন বিষ্ণুপুর শাসন করেন। এঁরা সকলেই মল্ল নামে পরিচিত ছিলেন। এই রাজাদের পারিবারিক নথি থেকে জানা যায়, এঁরা বিদেশি শাসনের অধীনতাপাশ থেকে মুক্ত ছিলেন।

(৩) হাম্বীর মল্ল দেব (বীর হাম্বীর)

মল্ল রাজবংশের ৪৯তম শাসক বীর হাম্বীর ১৫৮৬ সালে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তিনি ছিলেন মুঘল সম্রাট আকবর -এর সমসাময়িক। তিনি বাংলার সুবাদারের নিকট বার্ষিক রাজস্ব প্রদান করতেন এবং মুঘল সার্বভৌমত্ব স্বীকার করে নিয়েছিলেন। বীর হাম্বীর ছিলেন শক্তিশালী ও ধার্মিক রাজা। শ্রীনিবাস আচার্য তাকে বৈষ্ণব ধর্ম -এ দীক্ষিত করেন। এ প্রসঙ্গে নরোত্তম দাস রচিত প্রেমবিলাস ও নরহরি চক্রবর্তী রচিত ভক্তিরত্নাকর গ্রন্থ থেকে জানা যায়, শ্রীনিবাস ও অন্যান্য ভক্তেরা বৃন্দাবন থেকে গৌড় যাত্রাপথে হাম্বীর কর্তৃক লুণ্ঠিত হন। কিন্তু পরে শ্রীনিবাসের ভাগবত পাঠ শুনে তিনি বৈষ্ণব ধর্মের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে পড়েন এবং শ্রীনিবাসকে প্রচুর অর্থ ও ভূসম্পত্তি দান করেন।

(৪) রঘুনাথ সিংহ

বীর হাম্বীরের পুত্র রঘুনাথ সিংহ বিষ্ণুপুরের প্রথম রাজা যিনি ক্ষত্রিয় সিংহ উপাধি ব্যবহার করেন। বলা হয় যে, এই উপাধি তাকে প্রদান করেছিলেন মুর্শিদাবাদের নবাব। তার রাজত্বকাল থেকেই বিষ্ণুপুর রাজ্যের সুবর্ণযুগের সূচনা ঘটে। রঘুনাথ সিংহের আমলে বিষ্ণুপুরে নয়নাভিরাম প্রাসাদ ও মন্দিরাদি নির্মিত হয়। কিন্তু এই সময়েই রাজনৈতিকভাবে বিষ্ণুপুর তার স্বাধীনতা হারিয়ে অনেকটাই করদ রাজ্যের পর্যায়ে পর্যবসিত হয়।

(৫) বীর সিংহ

১৬৫৬ সালে বীর সিংহ বিষ্ণুপুরের সাক্ষ্য বর্তমান দুর্গ ও লালজি মন্দির নির্মাণ করান। এছাড়া তিনি লালবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ, যমুনাবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, শ্যামবাঁধ ও পোকাবাঁধ নামে বেশ কিছু বড়ো জলাধারও নির্মাণ করান। ১৬৬৫ সালে তাঁর মহিষী শিরোমণি বা চূড়ামণি মদনমোহন ও মুরলিমোহন মন্দিরদুটি নির্মাণ করান।

(৬) দুর্জন সিংহ

১৬৯৪ সালে দুর্জন সিংহ মদনমোহন মন্দির নির্মাণ করেন। পারিবারিক নথি অনুযায়ী, বিষ্ণুপুরের রাজারা মুসলমান শাসকদের রাজস্ব প্রদান করলেও, অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তারা স্বাধীনই ছিলেন। মুসলমান ঐতিহাসিকেরাও এই ব্যাপারে একই কথা লিখেছেন। বিষ্ণুপুরের রাজারা করদ রাজা হলেও, মুর্শিদাবাদের দরবারে তাদের উপস্থিত থাকতে হত না। তবে মুর্শিদাবাদে তাদের একজন রাজপ্রতিনিধি থাকতেন।

(৭) গোপাল সিংহ

বিষ্ণুপুরের ধার্মিক রাজা ছিলেন গোপাল সিংহ (১৭৩০-১৭৪৫)। কিন্তু রাজ্যের আসন্ন বিপদের মোকাবিলা করার ক্ষমতা তার ছিল না। ১৭৪২ সালে ভাস্কর রাওয়ের নেতৃত্বে মারাঠারা বিষ্ণুপুর আক্রমণ করলে, তার বাহিনী কঠিন প্রতিরোধ গড়ে তুলেও শেষ পর্যন্ত গোপাল সিংহ সেনাবাহিনীকে দুর্গের মধ্যে প্রত্যাহার করে নেন ও দুর্গ সুরক্ষিত করেন। তিনি নগরবাসীকে মদনমোহনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে বলেন। কথিত আছে, মদনমোহন সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত দলমাদল কামান মানুষের সহায়তা ছাড়াই নাকি গর্জে উঠেছিল। সম্ভবত মারাঠারা কঠিন দুর্গপ্রাকার ধ্বংস করতে না পেরে ফিরে গিয়েছিলেন। মারাঠারা এরপর রাজ্যের অপেক্ষাকৃত কম সুরক্ষিত অঞ্চলগুলিতে লুটতরাজ চালায়। ১৭৬০ সালে দ্বিতীয় শাহ আলমের যুদ্ধাভিযানের কালে মারাঠা সর্দার শেওভাট বিষ্ণুপুরকে সদর করেছিলেন। মারাঠারা বিষ্ণুপুর ও বীরভূমের সীমান্ত অঞ্চলে এমন ভয়াবহ লুণ্ঠন চালান যে, একসময়ের সমৃদ্ধ অঞ্চলগুলি জনবিরল হয়ে পড়ে।

(৮) চৈতন্য সিংহ

চৈতন্য সিংহও ছিলেন ধার্মিক রাজা। কিন্তু তাকেও প্রতিকূল পরিস্থিতির সম্মুখীন হতে হয়। তিনি ধর্মকর্ম নিয়ে এতই ব্যস্ত থাকতেন যে, প্রশাসনিক কাজকর্ম কিছুই দেখতেন না। এরই সুযোগ নিয়ে দামোদর সিংহ নামে তার এক জ্ঞাতিভাই ক্ষমতা দখলের চেষ্টা করেন। তিনি মুর্শিদাবাদের দরবারে নিজের যোগ্যতা প্রমাণে সমর্থ হন। প্রথমে সিরাজদ্দৌলা তাকে নিজ বাহিনী ধার দেন। কিন্তু তিনি বিষ্ণুপুর দখলে অসমর্থ হন। ইংরেজদের হাতে সিরাজের পরাজয়ের পর মিরজাফর দামোদর সিংহকে আরও শক্তিশালী বাহিনী ধার দিলে তিনি বিষ্ণুপুর দখল করতে সমর্থ হন। পরাজিত চৈতন্য সিংহ মদন গোপালের বিগ্রহ নিয়ে কলকাতায় পালিয়ে আসেন। এরপর রাজ্যের মালিকানা নিয়ে বহুদিন মামলা মোকদ্দমা চলে। এই মামলা চালাতে গিয়ে বিষ্ণুপুর রাজ পরিবারের পতন সম্পূর্ণ হয়। মনে করা হয় ১৮০৬ সাল নাগাদ রাজস্ব বাকি রাখার দায়ে রাজ্য বিক্রি হয়ে যায় এবং বর্ধমানের রাজা সমগ্র এস্টেটটি কিনে নেন।

বিষ্ণুপুরের উৎসব ও তার ইতিহাস

বিষ্ণুপুরের মেলা খুব বিখ্যাত। প্রতি বছর ডিসেম্বর মাসের শেষ সপ্তাহে রাজ দরবারে অনুষ্ঠিত হত এই মেলা। পরবর্তীতে হাইস্কুলের মাঠে এবং বর্তমানে এটি নন্দলাল মন্দিরের কাছে অনুষ্ঠিত হচ্ছে। বর্তমানে বিষ্ণুপুরের এই মেলার সাথে সংযোজন করা হয় বিষ্ণুপুর উৎসব । এটি বিষ্ণুপুর মেলার পর অনুষ্ঠিত হয়। এই অনুষ্ঠানে সংগীতের ‘বিষ্ণুপুর ঘরানা’ -র ধ্রুপদী সংগীত উৎসব এবং নৃত্য উৎসব হয়। এটি ২০১২ সালের পরে বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারি মাস থেকে রাসমঞ্চে এই উৎসব আবার শুরু হয়।

২০১৮ সাল থেকে বিষ্ণুপুর মেলা সম্পূর্ণ পরিবর্তিত হয়েছে। এখন এই মেলার পটভূমিতে বিষ্ণুপুরের টেরাকোটা মন্দিরগুলো রাখা হয়। বিষ্ণুপুর মেলার উদ্বোধন করেছিল বিষ্ণুপুর ঘরানার কয়েকজন নামী ব্যক্তি তাদের সংগীত দিয়ে। ২০১৮ সালের মেলায় বালুচরী শাড়ির একটি ফ্যাশন শো আয়োজন করা হয়েছিল। এর মাধ্যমে আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বালুচরী শাড়ির একটা প্রচার চালানোর উদ্দোগ নেওয়া হয়েছিল। বিভিন্ন কারিগর মেলার স্টল থেকে কারুশিল্প বিক্রি করে বিপুল অর্থ উপার্জন করত।

 বিষ্ণুপুরে আগস্ট মাসে একটি সাপের উৎসব ও উল্টোরথের উৎসব পালন করা হয়। এছাড়াও বিষ্ণুপুরে দুর্গা পূজা এবং কালী পূজাদীপাবলি খুব ধুমধাম করে উদ্‌যাপন করা হয়। বিষ্ণুপুরের রাজবাড়ীর মৃন্ময়ী মায়ের দুর্গা পূজা খুব জনপ্রিয়। রাজবাড়ির এই দুর্গা পূজা ৯৯৪ খ্রিস্টাব্দে শুরু হয়েছিল বলে মনে করা হয়। বিষ্ণুপুরের এই দুর্গা পূজা বর্তমানে বাংলাদেশ, ওড়িশা ও ত্রিপুরা সহ সমগ্র বাংলা অঞ্চলের প্রাচীনতম দুর্গাপূজা হয়ে দাঁড়িয়েছে।

সঙ্গীতে বিষ্ণুপুর ঘরানার ইতিহাস

বিষ্ণুপুর ঘরানা হল ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের হিন্দুস্তানি ধারার ধ্রুপদ সংগীতের একটি ঘরানা। অষ্টাদশ শতাব্দীতে এই ঘরানা বিশেষ জনপ্রিয়তা অর্জন করেছিল। বর্তমানে বিষ্ণুপুর শহরটি ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর মহকুমার সদর শহর। মধ্যযুগে এই শহরটি ছিল মল্লভূম রাজ্যের রাজধানী। ঐতিহাসিকদের মতে, মল্লভূম ছিল পূর্বভারতের অন্যতম প্রধান সাংস্কৃতিক কেন্দ্র। মল্ল রাজারা ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার পৃষ্ঠপোষক। ১৩৭০ খ্রিষ্টাব্দে মল্ল রাজদরবারে বিষ্ণুপুর ঘরানার সূত্রপাত ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। এই বিষ্ণুপুর ঘরানাই ভারতীয় শাস্ত্রীয় সংগীতের একমাত্র ঘরানা যেটির কেন্দ্র ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্য।

(১) বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎপত্তি

বিষ্ণুপুর ঘরানার উৎপত্তি ত্রয়োদশ শতাব্দীতে ঘটেছিল বলে মনে করা হয়। যদিও এর কোনো ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তবে সপ্তদশ শতাব্দীতে মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেব -এর শাসনকালে ইসলামি কট্টরপন্থা চূড়ান্ত রূপ নিলে বহু সংগীতজ্ঞ শিল্প-সংস্কৃতির পৃষ্ঠপোষক মল্ল রাজদরবারে চলে আসেন। এই সময়েই কিংবদন্তি তানসেনের বংশধর তথা সেনিয়া ঘরানার বিশিষ্ট দ্রুপদ গায়ক বাহাদুর খান বিষ্ণুপুরে চলে আসেন। তিনি কেবলমাত্র কণ্ঠসংগীত শিল্পীই ছিলেন না, বীণা, রবাব ও সুরশৃঙ্গারের মতো বাদ্যযন্ত্রও দক্ষতার সঙ্গে বাজাতে পারতেন। রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহদেব তাকে সভাগায়ক নিযুক্ত করেন। রাজা আরও ঘোষণা করেন, যে কোনো সুকণ্ঠ গায়ক বিনামূল্যে বাহাদুর খানের কাছে সংগীত শিক্ষা করতে পারবেন। বহু সুকণ্ঠ ছাত্র বাহাদুর খানের শিষ্যত্ব গ্রহণ করেন।

(২) বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা

ঐতিহাসিকরা উস্তাদ বাহাদুর খানের শিষ্য পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্যকে বিষ্ণুপুর ঘরানার প্রতিষ্ঠাতা বলে মনে করেন। সেদিক থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানার সঙ্গে বেতিয়া ঘরানার একটি দৃঢ় যোগসূত্র গড়ে ওঠে। অষ্টাদশ শতাব্দীর শেষ ও উনিশ শতাব্দীর প্রথম ভাগে যখন বিভিন্ন ঘরানা খেয়াল সংগীতকে কেন্দ্র করে একত্রিত হওয়ার সময়েও বিষ্ণুপুরের দ্রুপদ ঘরানা নিজস্বতা বজায় রেখেছিল।

(৩) ঋতুভিত্তিক রাগ উপস্থাপনে বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী

১৯২১ সালে যখন যুবরাজ এডওয়ার্ড ভারতে আসেন, তখন বিভিন্ন ঘরানার ছয় শিল্পীকে নির্বাচিত করা হয়েছিল তার সামনে ছয়টি ঋতুভিত্তিক রাগ উপস্থাপন করার জন্য। এঁদের মধ্যে তিন জন ছিলেন বিষ্ণুপুর ঘরানার। এই বিখ্যাত শিল্পীরা হলেন গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় ও ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী। বিষ্ণুপুর ঘরানার রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়ের অধীনে লালচাঁদ বড়াল তারা পরমেশ্বরী খেয়ালটি শিখে প্রথম ১৯০২ সালে সেটি গ্রামাফোনে রেকর্ড করেন। এটি প্রকাশ করেছিল গ্রামাফোন কনসার্ট অ্যান্ড নিকোল। একই কোম্পানি প্রথম দ্রুপদ রেকর্ড করে ১৯০২ সালে। গানটি ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় -এর গাওয়া ‘নাদ বিদ্যা সবসে সেরা’ (রাগ দরবারি, তাল চৌতাল)। রামশঙ্কর ভট্টাচার্যের সময় থেকে বিষ্ণুপুর ঘরানায় খেয়াল গাওয়া শুরু হয়। ১৯২৮ সাল পর্যন্ত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায় ছিলেন ভারতের প্রথম সারির সুরবাহার ও সেতার শিল্পী।

(৪) বারাণসী সম্মেলনে বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পী

১৯২১-২২ সাল নাগাদ বিষ্ণুনারায়ণ ভাতখণ্ডে বারাণসী -র একটি সম্মেলনে বিষ্ণুপুর ঘরানার শিল্পীদের সঙ্গে পরিচিত হন। রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায় ও সত্যকিংকর বন্দ্যোপাধ্যায় এই সম্মেলনে অংশ নিয়েছিলেন। সেই সময় দ্রুপদ শিল্পীরা দ্বৈতকণ্ঠে গাইলেও, এঁরা তিনজন একত্রে সেই সম্মেলনে সংগীত পরিবেশন করেছিলেন। পরে তারা একক সংগীতও পরিবেশন করেন।

(৫) বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতের বৈশিষ্ট্য

বিষ্ণুপুর ঘরানার সংগীতে গায়ক আলাপের মাধ্যমে রাগের সৌন্দর্য মেলে ধরেন। এই কাজটি সহজভাবে এবং কোনো রকম অতিরিক্ত অলংকরণ ব্যতিরেকে করা হয়। তালের জটিল বাদ্যও পরিহার করা হয়। বিষ্ণুপুর ঘরানার খেয়াল মিষ্টি সুরেলা সংগীতের জন্য খ্যাত। এতে সাধারণ অলংকরণ প্রয়োগ করা হয় এবং এর মাধ্যমে রাগের বিভিন্ন ধরনের সুরেলা উপস্থাপনা লক্ষ্য করা যায়।

বিষ্ণুপুর ঘরানার দ্রুপদে বসন্ত রাগে শুদ্ধ ধৈবত ব্যবহার করা হয় ভৈরব রাগের কোমল নিষাদের স্পর্শ দিয়ে। রাগ রামকেলিতে কড়ি মধ্যম পরিহার করা হয় এবং পুরবী ও ললিত রাগে শুদ্ধ ধৈবত এবং বেহাগ রাগে কোমল নিষাদ ব্যবহার করা হয়। তালের ক্ষেত্রেও এই ঘরানার নিজস্বতা আছে। হিন্দুস্তানি শাস্ত্রীয় সংগীতে এই ঘরানাই সওয়াল-জবাব প্রথার আবিষ্কারক বলে মনে করা হয়।

(৩) বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ 

উস্তাদ বাহাদুর খান, পণ্ডিত গদাধর চক্রবর্তী (কণ্ঠ ও যন্ত্রসংগীত), পণ্ডিত রামশঙ্কর ভট্টাচার্য, পণ্ডিত যদুভট্ট, পণ্ডিত অনন্তলাল বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রামপ্রসন্ন বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত গোপেশ্বর বন্দ্যোপাধ্যায়, কৃষ্ণচন্দ্র দে, মান্না দে, পণ্ডিত সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত রাধিকাপ্রসাদ গোস্বামী, সংগীতাচার্য রাজেন্দ্রনাথ কর্মকার, পণ্ডিত গিরিজাশঙ্কর চক্রবর্তী, আচার্য যোগেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়, আচার্য সত্যকিঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায়, সংগীতাচার্য রমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, সংগীতাচার্য অমিয়রঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায়,পণ্ডিত নীহাররঞ্জন বন্দ্যোপাধ্যায় ,পণ্ডিত শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়, পণ্ডিত ক্ষেত্রমোহন গোস্বামী, পণ্ডিত জ্ঞানেন্দ্রপ্রসাদ গোস্বামী, দেবব্রত সিংহ ঠাকুর, পণ্ডিত গোকুল নাগ, পণ্ডিত মণিলাল নাগ, বিদুষী মিতা নাগ, শ্রী পূর্বাচল বেরা, বাংলাদেশে সুরেন্দ্র নারায়ণ প্রমুখ বিষ্ণুপুর ঘরানার বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ। বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাবে এই সঙ্গীতজ্ঞরা তাদের বিশিষ্টতার প্রমাণ রেখে গেছেন।

বিষ্ণুপুরের শিল্প ও তার ইতিহাস

মল্লভূম নামে পরিচিত এই বিষ্ণুপুর শহর কুটির শিল্প ও হস্তশিল্পের জন্য বেশ বিখ্যাত। এই শহরের বেশকিছু পুরাতন শিল্প আজও তাদের অস্তিত্বকে বাঁচিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছে।সেই সব প্রাচীন শিল্পের মধ্যে দশাবতার তাস, পোড়ামাটির নানান রকম শিল্পকর্ম, নারকেল খোলার দ্রব্য, শাঁখের গহনা, ঘর সাজাবার দ্রব্য, মাটির প্রতিমা, মাটির হিংগলি পুতুল,বর-বউ পুতুল, মাটির ও কাঠের পুতুল, শোলার টোপর, প্রতিমার সাজ, বেল খোলার মালা, সুন্দর কারুকার্য করা ঘট, বাটি ও লন্ঠন আরো অনেক জিনিস আজও তাদের প্রাচীনত্বের সাক্ষ্য দিয়ে চলেছে। শাঁখের দ্রব্য প্রধানত বানানো হয় শাঁখারিবাজার পাড়াতে। তাছাড়া শাঁখারিবাজার পাড়ার ফোজদার পরিবারের নিজস্ব শিল্প ছিল দশাবতার তাস। গোপালগঞ্জ এলাকা, স্টেশনরোড ইত্যাদি অঞ্চলের লন্ঠন শিল্পীদের অসাধারণ লন্ঠন শিল্প আজও সবাইকে অবাক করে। পিতলের বাসন শিল্পও বিষ্ণুপুরের আর একটি অন্যতম পরিচায়ক। আর বিষ্ণুপুরের জগদ্বিখ্যাত বালুচরি শাড়িতো আছেই।

বিষ্ণুপুরের স্থাপত্যের ইতিহাস

প্রাচীনত্বের শিকড় বহু দূর অবধি ছড়িয়ে থাকলেও বিষ্ণুপুর মন্দিরনগরীর নির্মাণ স্থাপত্যগুলি তাদের স্বর্ণশিখরে পৌঁছেছিল মল্লরাজ বীর হাম্বিরের শাসনে। তাঁর তৈরি যে নির্মাণগুলি এখনও পর্যটকদের আকর্ষণের কেন্দ্রে, তাদের মধ্যে অন্যতম রাসমঞ্চ। ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে তৈরি বাংলার আটচালার আকারে টেরাকোটার এই মন্দিরের গঠন বৈশিষ্ট্য দেশের অন্যান্য মন্দিরের তুলনায় একেবারে অন্য রকম। প্রাচীন রীতি অনুসারে, রাসযাত্রার সময় বিষ্ণুপুরের সব মন্দির এবং অভিজাত বনেদি পরিবার থেকে রাধাকৃষ্ণের বিগ্রহ এখানে আনা হত। ১৯৩২ সাল অবধি এই রীতি পালিত হতে থাকে। এখন সুদৃশ্য বাগানের মধ্যে রাসমঞ্চ দাঁড়িয়ে আছে অতীতের সাক্ষী হয়ে।

রাসমঞ্চের কাছেই আছে জোড়বাংলা মন্দির। ১৬৫৫ খ্রিস্টাব্দে রাজা দ্বিতীয় রঘুনাথ সিংহ দেব এই মন্দির তৈরি করিয়েছিলেন বলে জানা যায়। দূর থেকে এই মন্দির দেখলে মনে হয় যেন গ্রামবাংলার দু’টি আটচালার ঘর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। মন্দিরের দেওয়াল জুড়ে টেরাকোটার কাজ বাংলার সৃজনশীল দিকটিকে আমাদের মনে করিয়ে দেয়। রাজা রঘুনাথের তৈরি ‘পঞ্চরত্ন মন্দিরও’ ইতিহাসের আর এক অপরূপ নিদর্শন।

বিষ্ণুপুরের সব মন্দিরই টেরাকোটার কারুকাজের জন্য বিখ্যাত। ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দে নির্মিত মদনমোহনের মন্দিরও এর ব্যতিক্রম নয়। এই মন্দিরের গায়ে খোদাই করা আছে রামায়ণ, মহাভারত এবং পুরাণের নানাবিধ কাহিনি। এছাড়াও শহরের অসংখ্য মন্দিরের মধ্যে উল্লেখযোগ্য দর্শনীয় মন্দিরগুলি হল লালজি মন্দির, রাধাশ্যাম মন্দির, নন্দলাল মন্দির, কালাচাঁদ মন্দির, রাধাগোবিন্দ মন্দির, রাধামাধব মন্দির এবং জোড় মন্দির। বর্তমানে প্রায় কোনও মন্দিরেই আর পুজো হয় না।

তবে ইতিহাস এবং নির্মাণশিল্পের আকর হিসেবে প্রত্যেকটি মন্দির আজও অনন্য। বাংলার মন্দির নির্মাণ ঘরানার অন্যতম বৈশিষ্ট্য হল একরত্ন। এখানে রত্ন বলতে মন্দিরের শীর্ষ বা চূড়াকে ধরা হয়। বিষ্ণুপুরের বেশ কিছু মন্দির আছে, যাদের একটি করে চূড়া। তাই সেগুলি সব একরত্ন মন্দির নামে পরিচিত।

বিষ্ণুপুরের কয়েকটি উল্লেখযোগ্য ঐতিহাসিক স্থাপত্যের ইতিহাস

বিষ্ণু পুরের অসংখ্য স্থাপত্য নিদর্শন গুলির মধ্যে কয়েকটি উল্লেখযোগ্য হল —

(১) রাসমঞ্চ

রাসমঞ্চ-বিষ্ণুপুর (Sourse-india.com)

ইটের তৈরি এই প্রাচীনতম মন্দিরটি রাজা হাম্বির ১৬০০ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে জানা যায়। আড়ম্বরপূর্ণ মন্দিরটি স্থাপত্যগতভাবে এতই অনন্য এবং অতুলনীয় যে এটি পুরো বাংলার পাশাপাশি সারা দেশে বিশিষ্ট। একটি ল্যাটারাইট স্তম্ভের উপরে গর্বের সঙ্গে দাঁড়িয়ে আছে রাসমঞ্চ এবং এর সাথে আছে দীর্ঘতর একটি টাওয়ারের পাশাপাশি একটি একক কক্ষের কুঁড়েঘর আকৃতির বুরুজ। এমন একটি ঐতিহ্য প্রত্যক্ষ করতে করতে পারি যা পিরামিডাল সুপারট্রাকচারের সাথে সজ্জিত এবং তিনটি চক্রাকার গ্যালারী, প্রশান্ত স্তম্ভ এবং পোড়ামাটির পদ্ম মোটিফ সহ রহস্যময় খিলান দ্বারা নির্মিত হয়ে আমাদের নয়নাভিরাম হয়েছে। দিনের বেলায় যখন গ্যালারীগুলির মধ্যে দিয়ে হাঁটলে ছায়ার ভাষা দ্বারা কানে কানে ফিসফিসিয়ে যেন ইতিহাসের অনুভূতি জাগায়।

(২) মৃন্ময়ী মন্দির

বিষ্ণুপুরের এই প্রাচীনতম মন্দিরটি রাজা জগৎ মল্ল ৯৯৭ খ্রিস্টাব্দে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন বলে মনে করা হয়। স্থানীয় ইতিহাস অনুসারে, জানা যায় যে, মা মৃন্ময়ী স্বপ্নে রাজাকে মন্দির তৈরির নির্দেশ দিয়েছিলেন। দেবী দুর্গাই এখানে মা মৃন্ময়ী হিসাবে পূজিত হন। অবশ্য পরবর্তীতে মন্দিরটি পুনর্গঠন করতে হয়েছিল। কিন্তু গঙ্গা-মাটির তৈরি সেই মূর্তিটি থেকে গিয়েছিল। বাংলার এই প্রাচীনতম দুর্গা পূজা (১০২১ বছর) এবং সমৃদ্ধ ঐতিহ্যকে ধর্মীয় উষ্ণতার এক ভিন্ন স্বাদে অনুভব করা যায়। মাটির পাত্র বা “ঘট” স্থাপনের পরে যথাক্রমে “বড়ো ঠাকুরানী”, “মেজো ঠাকুরানী” এবং “ছোট ঠাকুরানি” উপাসনার মধ্য দিয়ে এই উৎসব শুরু হয়। “মহাষ্টমী-সন্ধিপূজা” -র পবিত্র মুহূর্তে একটি কামান নিক্ষেপ করা হয় এবং তারপরে বলি দেওয়া হয় সবজী।

(৩) জোড়বাংলা মন্দির

এই মন্দিরটি মল্ল রাজা রঘুনাথ সিংহ ১৬৫৫ সালে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এই মন্দিরটি পশ্চিমবঙ্গের পোড়ামাটির শিল্পের অন্যতম ব্যতিক্রমী উদাহরণ এবং একটি অনন্য স্থাপত্য কাঠামোর মালিক। মন্দিরটির বিশেষ “দো-চালা” আকারের কারণে “জোড়বাংলা” নামকরণ করা হয়েছে। মন্দিরটির ছাদটি পাশাপাশি দ্বি-পার্শ্বযুক্ত বাঁকান অংশ, যথাক্রমে বারান্দা এবং মন্দির বলা হয়, এগুলি পরস্পর যুক্ত। পোড়ামাটির বিশেষ ভাস্কর্য দ্বারা মহাভারত, রামায়ণ, কৃষ্ণের বাল্যকালের একাধিক দৃশ্য চিত্রিত আছে মন্দিরগাত্রে। পোড়ামাটির কাহিনী দিয়ে সজ্জিত প্যানেলগুলিতে সুন্দরভাবে ‘ভীষ্মের শরসজ্জা’, ‘রাম-সীতার বিবাহ’, ‘মা পার্বতী তাঁর দুই ছেলের সাথে’, ‘বালগোপালের ক্রিয়াকলাপ’, ‘লক্ষ্মণ ও শূর্পণখার গল্প’ এবং আরও অনেক মহাকাব্য’র দৃশ্য চিত্রিত রয়েছে।

(৪) শ্যাম রায় মন্দির

উল্লেখযোগ্য এই মন্দিরটি ১৬৪৩ সালে রাজা রঘুনাথ সিংহ দ্বারা নির্মিত হয়েছিল। মন্দিরটি পাঁচটি চূড়ার মালিক হিসাবে “পঞ্চচুড়া” মন্দির নামে পরিচিত। মন্দিরটি চারপাশে তিন তোরণযুক্ত পথ সহ সুন্দর দৃশ্য ফুটিয়ে তুলেছে। ‘ঐরাবতের উপর বসে ইন্দ্রের যুদ্ধ’, ‘রাম ও রাবনের কাহিনী’, ‘কৃষ্ণ লীলার দৃশ্য’, ‘রাধা-কৃষ্ণের প্রেম’, ‘পুরানো সমাজের শিকারের পরিস্থিতি’ ইত্যাদি ধর্মীয় গল্পের উপর ভিত্তি করে বিভিন্ন দৃশ্য আমাদের সামনে যেন সত্য উপস্থাপন করছে। এই মন্দিরের আর একটি আকর্ষণ হল দৈত্যাকার রাশচক্র যা ‘গোপিনীদের মাঝে রাধা-কৃষ্ণ লীলা’ র বিভিন্ন রূপকে চিত্রিত করে চলেছে।

(৫) গড় দরজা

বিষ্ণুপুরের দুর্গের দু’টি সুদৃশ্য প্রবেশদ্বার রয়েছে। স্থানীয় লোকেরা এগুলিকে ‘গড় দরজা’ বলে সম্বোধন করে থাকে। ‘গড় দরজা’ শয়তান শত্রুদের হাত থেকে রক্ষার জন্য তৈরি করা হয়েছিল বলে কথিত আছে। এর একটি বিশাল ছাদ এবং গোপন কক্ষ আছে। সৈনিকরা ‘গড়’ থেকে অনধিকার প্রবেশকারীদের চিহ্নিত করে রাখত এবং তাদের ওপর অতর্কিতে আক্রমণ করত।

(৬) বিষ্ণুপুরের মদনমোহন মন্দির

আপনি যখন বিষ্ণুপুরে রয়েছেন, তখন এই ‘বিষ্ণু’ মন্দিরটি অবশ্যই দেখতে হবে। অবশ্যই, মন্দিরটি তার দেহের মধ্যে সেরা পোড়ামাটির শিল্পের বার্তা বহনকারী অন্যতম প্রধান কাঠামোগত রূপ। মল্ল রাজা দুর্জন ​​সিংহ দেব ১৬৯৪ সালে ভগবান মদন মোহন-এর নামে মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। এটি আজ অবধি একটি সক্রিয় মন্দির।

(৭) বিষ্ণুপুরের প্রত্নতাত্ত্বিক যাদুঘর

বিষ্ণুপুরের স্থানীয় যাদুঘর হল ‘আচার্য যোগেশচন্দ্র পুরাকীর্তি ভবন’। প্রত্নতত্ত্ব, শিল্প এবং ইতিহাসকে সজীব করে তোলে এই যাদুঘর। এখানে প্রায় ১০০ টি ভাস্কর্য, প্রায় ৫০০০ পাণ্ডুলিপি, বিভিন্ন ধরণের লোককলা, ফটোগ্রাফ, টেক্সটাইলগুলির অপূরণীয় নমুনাগুলি এবং আরও বহু প্রাচীন ঐতিহাসিক নমুনা রক্ষিত আছে।

(৮) বিষ্ণুপুরের জলাধার

জলে রয়ে যায় ইতিহাসের চিহ্ন :- বীর সিংহ ১৬৫৮ সালে পোকাবাঁধ, শ্যামবাঁধ, কালিন্দীবাঁধ, যমুনাবাঁধ, গনতাতবাঁধ, কৃষ্ণবাঁধ এবং লালবাঁধ নামে সাতটি জলাধার তৈরি করিয়েছিলেন। পানীয় জল এবং শহরকে শত্রু থেকে রক্ষার জন্য এগুলি তৈরি করা হয়েছিল বলে মনে করা হয়। কথিত আছে যে, মল্ল রাজ রঘুনাথ সিংহ লালবাঈ নামে একজন পার্সিয়ান নৃত্যশিল্পী দ্বারা লালিত হয়েছিলেন। পরবর্তী সময়ে তিনি লালবাঈয়ের নামে লালবাঁধ জলাধার টি খনন করিয়েছিলেন।

(৯) বিষ্ণুপুরের দলমাদল কামান

মন্দিরের পাশাপাশি বিষ্ণুপুরের অন্যতম আকর্ষণ হল দলমাদল কামান। বেশ কিছু ইতিহাসবিদের মতে, রাজা বীর হাম্বিরের সময়ে তৈরি করানো হয়েছিল এই কামান। আবার বেশ কিছু গবেষক বলেছেন, ১৭৪২ খ্রিস্টাব্দে রাজা গোপাল সিংহের সমসাময়িক এই কামান। জগন্নাথ কর্মকারের তৈরি এই কামানের গোলায় ভর করে মারাঠা আক্রমণ প্রতিহত করেছিলেন মল্লযোদ্ধারা। নি নগরবাসীকে মদনমোহনের নিকট সাহায্য প্রার্থনা করতে বলেন। কথিত আছে যে, মারাঠা আক্রমণ থেকে বাঁচার জন্য বিষ্ণুপুরের প্রজারা মদনমোহনের কাছে প্রার্থনা করেছিলেন। বলা হয় মদনমোহন সেই ডাকে সাড়া দিয়েছিলেন। কারণ, বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত দলমাদল কামান মানুষের সহায়তা ছাড়াই নাকি গর্জে উঠেছিল। ফলে মারাঠারা কঠিন দুর্গপ্রাকার ধ্বংস করতে না পেরে ফিরে গিয়েছিল। আশ্চর্যের বিষয় এই যে, খোলা আকাশের নীচে কয়েকশো বছর ধরে পড়ে থেকেও এতে আজও কোনো মরচে ধরেনি। ভক্তিরসের সঙ্গে বীররসের প্রতীক মল্লযোদ্ধাদের এই কামান।

বিষ্ণুপুরের ইতিহাস ও ঐতিহ্য

আজকের বাঁকুড়া জেলার বিষ্ণুপুর শহর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের দিক থেকে পিছনে ফেলে দেয় বহু জনপদকেই। মল্লরাজাদের তৈরি টেরাকোটার মন্দিরের পাশাপাশি এই জনপদের নামের সঙ্গে জড়িয়ে গিয়েছে ধ্রুপদী সঙ্গীতের ঘরানা এবং বালুচরী শাড়ির শিকড়। ‘একটি ঘাসের উপর একটি শিশিরবিন্দু’ -র মতো কলকাতার কাছেই এই মন্দিরনগরীকে ‘দুই পা ফেলিয়া’ আমাদের অনেকেরই দেখা হয়ে উঠেনি। হাতে দু’দিনের ছুটি থাকলেই আমরা দিব্যি ঘুরে আসতে পারি ঐতিহ্যবাহী প্রাচীন এই শহর।

(FAQ) বিষ্ণুপুরের ইতিহাস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য ?

১. বিষ্ণুপুর কোন জেলায় অবস্থিত?

বাঁকুড়া জেলায় ।

২. বিষ্ণুপুর কোন শিল্পের জন্য বিখ্যাত?

ট্যারাকোটা শিল্প ।

৩. বিষ্ণুপুরের বিখ্যাত কামানের নাম কি?

দলমাদল ।

৪. বিষ্ণুপুরের প্রাচীন নাম কি?

মল্লভূম।

Leave a Comment