গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা প্রসঙ্গে অভিজাত সম্পর্কিত নীতি, প্রতিকারমূলক আইন, রাজস্ব নীতি, উন্নয়ণমূলক কাজ, রাজস্ব ব্যবস্থার সুফল, সেনাদলের পুনর্গঠন, সাধারণ শাসন নীতি সম্পর্কে জানবো।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাগিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা
সুলতানগিয়াসউদ্দিন তুঘলক
বংশতুঘলক বংশ
হত্যাখসরু শাহ
রাজস্ব প্রথাগাল্লাবকস
গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা :- গিয়াসউদ্দিন তুঘলক ১৩২০ খ্রিস্টাব্দে সিংহাসনে আরোহণ করেন। তার পূর্বের শাসন ব্যবস্থা সর্বত্র শিথিল হয়ে পড়ে। আলাউদ্দিন খলজির মৃত্যুর পর শাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়ে।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের অভিজাত সম্পর্কিত নীতি

  • (১) তিনি সর্বপ্রথম অভিজাতদের সম্পর্কে নীতি স্থির করেন। তাঁর নীতিকে দৃঢ়তা ও আপোষের সমন্বয় বলা যায়। তিনি খলজি আমলের তুর্কী সেনাপতিদের জাগীর ও পদমর্যাদা বহাল রাখেন।
  • (২) এর সঙ্গে খসরু শাহের আমলে যে সকল অভিজাত খসরু শাহের পক্ষ নেয় তিনি তাদের প্রতিও উদারতা দেখান। যে সকল অভিজাত এই উদারতায় সাড়া না দিয়ে বিরোধিতা চালিয়ে যান, একমাত্র তাদেরই তিনি দমন করেন এবং জাগীরগুলি কেড়ে নেন।
  • (৩) খলজি পরিবারের বিবাহযোগ্যা কন্যাদের তিনি উপযুক্ত বিবাহের ব্যবস্থা করেন। আলাউদ্দিনের আমলে যারা জাগীর হারায় তিনি বেশীরভাগ ক্ষেত্রে তাদের জাগীর ফিরিয়ে দেন। এই উদার আপোষ নীতির ফলে তিনি অধিকাংশ অভিজাতদের আনুগত্য পান।

সুলতান গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের প্রতিকারমূলক আইন

  • (১) এরপর সুলতান গিয়াসউদ্দিন কয়েকটি প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নেন। কুতবউদ্দিন ও খসরু শাহের আমলে বহু অযোগ্য স্তাবকদের রাজকোষের বহু অর্থ দেওয়া হয়। এর ফলে রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়।
  • (২) সুলতান গিয়াসউদ্দিন এই অর্থ সরকারে ফিরিয়ে দেওয়ার আদেশ দেন। এই আদেশ অনেক পরিমাণে কার্যকরী হয়। সন্ত শেখ নিজামুদ্দিন আওলিয়াকে খসরু শাহ ৫ লক্ষ মুদ্রা দেন।
  • (৩) শেখ নিজামুদ্দিন সেই অর্থ তৎক্ষণাৎ জনসাধারণের মধ্যে বিলিয়ে দেন। সেই অর্থ আদায় করা যায়নি। তিনি গিয়াসউদ্দিনকে জানান যে জনসাধারণের অর্থ জনসাধারণের হাতে দেওয়া হয়েছে।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের রাজস্ব নীতি

সুলতান গিয়াসউদ্দিন এরপর রাজস্ব নীতির সংস্কারে মন দেন। গিয়াসউদ্দিনের রাজস্ব নীতি সম্পর্কে বরণীর বিবরণে কিছু অসঙ্গতি লক্ষ্য করা যায়। যাই হোক বরণীর বিবরণ থেকে মোটামুটি জানা যায় যে,

  • (১) আলাউদ্দিনের প্রবর্তিত হুকুম-ই-মাসাহাত বা জমি জরিপের ভিত্তিতে রাজস্ব নির্ধারণ প্রথা তিনি রদ করেন।
  • (২) গিয়াসউদ্দিন হুকুম-ই-হাসিল বা গাল্লাবক্স প্রথা অনুযায়ী উৎপন্ন ফসলের ভাগ নেওয়ার প্রথা চালু করেন। গিয়াসউদ্দিন উৎপন্ন ফসল থেকে রাজস্ব কত হারে ভাগ নেওয়ার নিয়ম চালু করেন তা সঠিক জানা যায়নি। বরণীর বিবরণে এই বিষয়ে কিছু অসঙ্গতি দেখা যায়।
  • (৩) একথা ঠিক যে তিনি আলাউদ্দিনের আমলের শতকরা ৫০ ভাগ রাজস্ব বৃদ্ধি রদ করে দেন। তিনি চিরাচরিত নিয়ম অনুযায়ী আগে ফসলের ১/৫ ভাগ রাজস্ব ধার্য করার পর কোনো কোনো ক্ষেত্রে তদুপরি ১/১০ ভাগ বৃদ্ধিকে অনুমোদন দেন।
  • (৪) গিয়াসউদ্দিন রাজস্ব আদায়ের জন্য কঠোরতা প্রদর্শন নিষিদ্ধ করেন। রাজস্ব কর্মচারীদের বাড়তি কর আদায় না করতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়। কৃষির উন্নতির জন্য রাজস্ব কর্মচারীদের সচেষ্ট হতে বলা হয় এবং সেচ ব্যবস্থার ওপর জোর দেওয়া হয়। তিনি পতিত জমিকে আবাদযোগ্য করার নীতি নেন।
  • (৫) গিয়াসউদ্দিনের অপর একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার ছিল সুলতান আলাউদ্দিন প্রবর্তিত মধ্যস্বত্বভোগী খুৎ, মুকাদ্দম ও অভিজাতদের বিশেষ অধিকার বিলোপের ব্যবস্থাকে রদ করা।
  • (৬) আলাউদ্দিন জাকতা বা অভিজাত খুৎ, মুকাদ্দমের ওপর একই হারে কর চাপান। তাদের হাতে তিনি উদ্বৃত্ত রাজস্ব রাখতে রাজী ছিলেন না। গিয়াসউদ্দিন অনুভব করেন যে অভিজাত ও মধ্যস্বত্বভোগীরা সমাজ ও রাষ্ট্রে যে বিশেষ দায়িত্ব বহন করে এজন্য তারা কিছু সুবিধা দাবী করতে পারে।
  • (৭) এই কারণে খুৎ, মুকাদ্দম প্রভৃতি গ্রাম প্রধানদের রাজস্ব আদায়ের কমিশন পুনরায় চালু করা হয়। গিয়াসুদ্দিন স্বীকার করতেন যে, কৃষি ও গ্রাম পরিচালনার জন্য এই শ্রেণীর সাহায্য বিশেষ প্রয়োজন। তবে যাতে তারা প্রজাদের শোষণ না করে সেদিকে তিনি নজর দেন।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের উন্নয়নমূলক কাজ

তিনি জমি ইজারা ব্যবস্থাকে বন্ধ করার চেষ্টা করেন। তিনি জলসেচের জন্য খাল খননে উৎসাহ দেন। অনাবৃষ্টির সময় কৃষকদের তাকাভি ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করেন। তিনি রাস্তাঘাট ও স্কুল তৈরি করেন। সরকারী ডাক ব্যবস্থার উন্নতি করা হয়।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের রাজস্ব ব্যবস্থার সুফল

গিয়াসউদ্দিনের রাজস্ব ব্যবস্থার বিশেষ সুফল দেখা যায়। ভূমি-রাজস্বের হার আলাউদ্দিনের আমল অপেক্ষা কম করায় কৃষকরা কৃষিতে উৎসাহ দেখায়। ফসল হানি হলে রাজস্ব দিতে কৃষকদের কষ্ট কম হয়। কারণ যখন যেমন ফসল ফলত সুলতান তার ভিত্তিতে রাজস্ব দাবী করতেন। আলাউদ্দিনের মত জরিপ করে নির্দিষ্ট হারে রাজস্ব ধার্য করতেন না।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলক কর্তৃক সেনাদলের পুনর্গঠন

  • (১) গিয়াসউদ্দিন সুলতানি সেনাদলের পুনর্গঠন করেন। গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর মতই নিজ পিতামাতা অপেক্ষা তিনি সেনাদলকে ভালবাসতেন। সুলতানি সেনাদলে আলাউদ্দিনের মৃত্যুর পর বিশৃঙ্খলা দেখা দেয়।
  • (২) গিয়াসউদ্দিন বিশৃঙ্খলা দূর করে সেনাদলকে শক্তিশালী করার চেষ্টা করেন। যাতে সেনাদল নিয়মিত বেতন পায় এজন্য তিনি ব্যবস্থা করেন। তিনি আলাউদ্দিনের “দাগ” ও “হুলিয়া” প্রথাকে চালু করেন।

গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের সাধারণ শাসন নীতি

তিনি আইন-শৃঙ্খলার উন্নতি, পুলিশের উন্নতি সাধন করেন। তিনি আলাউদ্দিনের মদ্যপান বিরোধী আইনকেও প্রয়োগ করেন। হিন্দুদের প্রতি তিনি ন্যায্য ব্যবহার করতেন। গোঁড়ামির আশ্রয় নিয়ে তিনি তাদের ওপর নির্যাতন করতেন না। তিনি হিন্দুদের ধর্মে আঘাত করেন নি। সরকারী পদে অধিক সংখ্যক হিন্দু নিয়োগের ফলে যাতে মুসলিম আমীররা অসন্তুষ্ট না হন তা তিনি দেখতেন।

উপসংহার :- গিয়াসউদ্দিন তুঘলক হিন্দুদের ওপর আলাউদ্দিনের স্থাপিত বাড়তি কর ও বিধি-নিষেধ লোপ করেন। অথচ যাতে তারা অধিক অর্থশালী ও বিদ্রোহী না হয় সেদিকে তিনি নজর দেন।

(FAQ) গিয়াসউদ্দিন তুঘলকের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক সর্বপ্রথম কাদের প্রতি নীতি স্থির করেন?

অভিজাত।

২. গিয়াসউদ্দিন কাকে হত্যা করে সিংহাসন অধিকার করেন?

খসরু শাহ।

৩. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক রাজস্ব ব্যবস্থায় কোন প্রথা চালু করেন?

গাল্লাবকস।

৪. গিয়াসউদ্দিন তুঘলক প্রথমে কত ভাগ রাজস্ব ধার্য করেন?

১/৫ ভাগ।

Leave a Comment