ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে দ্য ভলতেয়ার

একজন ফরাসি দার্শনিক, লেখক এবং আলোকপ্রাপ্ত যুগের প্রভাবশালী চিন্তাবিদ ছিলেন ভলতেয়ার। তিনি ১৮শ শতকের সামাজিক, রাজনৈতিক এবং ধর্মীয় সংস্কার আন্দোলনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তাঁর সৃজনশীল কাজ, যেমন “কঁদিদ” (Candide), তীক্ষ্ণ বিদ্রূপ, যুক্তিবাদ এবং মানবাধিকার সমর্থনের জন্য পরিচিত। ভলতেয়ার মুক্ত চিন্তা, বাকস্বাধীনতা এবং ধর্মীয় অসহিষ্ণুতার বিরুদ্ধে সংগ্রামের প্রতীক।

দার্শনিক ভলতেয়ার

ঐতিহাসিক চরিত্রভলতেয়ার
পুরো নামফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে
জন্ম২১ নভেম্বর ১৬৯৪ খ্রি
জন্মস্থানপ্যারিস, ফ্রান্স
পেশাসাহিত্যিক
প্রধান রচনাকাঁদিদ, লেটার্স অন দ্য ইংলিশ
প্রভাবিত ক্ষেত্রসাহিত্য, দর্শন, মানবাধিকার আন্দোলন, ধর্মনিরপেক্ষতা
মূল দর্শনবাক স্বাধীনতা, ধর্মীয় সহনশীলতা, যুক্তিবাদ, ও ন্যায় বিচারের পক্ষে
রচনা বৈশিষ্ট্যব্যঙ্গাত্মক রচনা, যুক্তি নির্ভর বিশ্লেষণ এবং সামাজিক সংস্কারের আহ্বান
মৃত্যু৩০ মে ১৭৭৮ খ্রি

ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে দ্য ভলতেয়ার

ভূমিকা :- সাহিত্য, ধর্ম ও রাজনীতিকে কেন্দ্র করে অষ্টাদশ শতাব্দীর ইউরোপ-এর সমাজ জীবনে চিন্তা ও মননের বিপ্লব ঘটিয়ে মানব ইতিহাসে যিনি স্বাধীনতার প্রতীক রূপে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, তাঁর নাম ভলতেয়ার। নির্ভীক, সত্য ও ন্যায়ের পূজারী এই মহান পুরুষের চিন্তার ফলেই সে যুগের স্বৈরতান্ত্রিক ফ্রান্সের মানুষ সামাজিক অজ্ঞতা, কুসংস্কার, চার্চের মিথ্যাচার, ভণ্ডামি, নির্যাতন ও কদর্যতার কবল থেকে মুক্তিলাভ করে এক নতুন যুগের অভ্যুদয় ঘটিয়েছিল। সংঘটিত হয়েছিল ফরাসী বিপ্লব

ভলতেয়ারের জন্ম

প্যারিসে এক সম্ভ্রান্ত বংশে ১৬৯৪ খ্রিস্টাব্দের ২১শে নভেম্বর ভলতেয়ারের জন্ম। চতুর্দশ লুই তখন ফ্রান্সের সিংহাসনে অধিষ্ঠিত। ভলতেয়ারের পিতা নোটারি আরোয়েট ছিলেন বাস্তববাদী তীক্ষ্ণধী মানুষ। মা ছিলেন সংস্কৃতিমনা, সংগতি-সম্পন্ন বংশের কন্যা।

দার্শনিক ভলতেয়ারের ছেলেবেলা

উত্তরাধিকার সূত্রে পিতামাতা দুজনেরই কাছ থেকে ভলতেয়ার পেয়েছিলেন দোষে গুণে মিশ্রিত পরস্পরবিরোধী ভাব। জন্ম থেকেই ছিলেন ক্ষীণজীবী। কিন্তু ছেলেবেলা থেকেই ছিলেন অসাধারণ মেধা সম্পন্ন। মাত্র তিন বছর বয়সেই ছড়া কবিতা অনর্গল মুখস্থ বলে যেতে পারতেন।

ভলতেয়ারের নামকরণ

দুর্বল সন্তানটি বাঁচে কি মরে এই আশঙ্কায় তাঁর বাবা মা শিশু বয়সেই খ্রিস্ট ধর্মে দীক্ষিত করেন। সেই সময় তাঁর নামকরণ হয় ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে।

বিশ্ব পরিচিতি ভলতেয়ার নামে

পিতৃদত্ত নামে নয় আরুয়ে পরবর্তীকালে তাঁর নিজের দেওয়া ভলতেয়ার নামেই সারা বিশ্বে পরিচিতি লাভ করেছেন। ফ্রান্সের কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গের কারাগারে অবস্থান করার সময় তিনি এই নামটি গ্রহণ করেছিলেন।

ভলতেয়ারের শিক্ষা

  • (১) বাড়িতে প্রাথমিক শিক্ষালাভের পর দশ বছর বয়সে তাঁকে ভর্তি করে দেওয়া হল এক খ্রিস্টান যাজকের স্কুলে। কিন্তু শিক্ষার চাইতেও ফ্রাঁসোয়ার জীবনে গভীর প্রভাব বিস্তার করেছিলেন তাঁর ধর্মপিতা অ্যাবে দি শ্যাটেনফ-এর শিক্ষা। এই ধর্মপিতা ছিলেন মনেপ্রাণে যুক্তিবাদী। চাক্ষুষ করা যায় না এমন কিছুতে তিনি বিশ্বাস করতেন না।
  • (২) অন্ধবিশ্বাস ও কুসংস্কারে আচ্ছন্ন সেকালের সমাজে রীতিমত এক বিপরীত ব্যক্তিত্ব শ্যাটেনফ। কিশোর ফ্রাঁসোয়ার অন্তর্নিহিত ক্ষমতার আভাস সম্ভবত তাঁর চোখেই প্রথম ধরা পড়েছিল। তাই তিনি বিশেষ আগ্রহ সহকারে ফাঁসোয়াকে ধর্ম, দর্শন, সাহিত্য, চারুকলা বিষয়ে শিক্ষা দিতেন। তাঁর সান্নিধ্য ও শিক্ষার ফলেই সাহিত্যের প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন ফ্রাঁসোয়া।
  • (৩) ছেলেকে আইন শিক্ষা দেবেন এই ইচ্ছা ছিল ফ্রাঁসোয়ার বাবার। কিন্তু কিশোর ফ্রাঁসোয়া একদিন বাবাকে পরিষ্কার জানিয়ে দিলেন, কোনও পেশাগত শিক্ষা তাঁর পছন্দ নয়। বিশুদ্ধ জ্ঞান লাভই তাঁর অভিলাষ। সেই বয়সেই আরও কয়েকটি চারিত্রিক গুণ ফ্রাঁসোয়ার মধ্যে পরিস্ফুট হয়ে উঠেছিল। সেগুলো হল, সত্যবাদিতা, সততা ও স্বাধীনতার প্রতি তীব্র আকাঙ্ক্ষা।

রাষ্ট্রদূত ভলতেয়ার

যাই হোক, শেষ পর্যন্ত পিতার একান্ত ইচ্ছাতেই ফ্রাঁসোয়া হেগে গিয়ে সেখানকার রাষ্ট্রদূতের সহকারী হিসাবে কাজে যোগ দিলেন।

ভলতেয়ারের সহজাত মমতা ও সহানুভূতি

সমাজের দরিদ্র বঞ্চিত সাধারণ মানুষের প্রতি ছিল ফ্রাঁসোয়ার সহজাত মমতা ও সহানুভূতি। সাধারণের প্রতি একাত্মতা বশেই তিনি উচ্চবিত্ত অভিজাত ও তথাকথিত শিক্ষিত সম্প্রদায়ের প্রতি পোষণ করতেন তীব্র ঘৃণা ও অবজ্ঞা। এই মানসিক অবস্থায় আত্মমর্যাদা ক্ষুন্ন করে কাউকে তোষামোদ করা তাঁর ধাতে সইত না। রাষ্ট্রদূতের সঙ্গেও তাই মানিয়ে চলতে না পেরে কিছুদিন পরেই প্যারিসে ফিরে এলেন।

করণিক ভলতেয়ার

এর পর সাধারণ এক করণিকের চাকরি নিলেন। সেই সময় তাঁর ধর্মপিতার যোগাযোগে রাজপরিবারের কিছু সদস্যের সান্নিধ্যে আসার সুযোগ হল তাঁর। শিহরিত হলেন পঙ্কিলতায় লিপ্ত মানুষগুলোর কদর্যরূপ দেখে।

ভলতেয়ারের সাহিত্যের প্রতি আগ্রহ

সাহিত্যের প্রতি আগ্রহবশেই ছেলেবেলা থেকেই তাঁর লেখালেখির অভ্যাস তৈরি হয়েছিল। নানা বিষয় নিয়ে লিখতেন। রাজপরিবারের ঘৃণ্য পরিবেশের অভিজ্ঞতা তাঁকে নতুনভাবে প্রাণিত করল। তিনি লিখতে আরম্ভ করলেন শ্লেষাত্মক ছোট ছোট কবিতা প্রবন্ধ। কিছুদিনের মধ্যেই নিজের অভিজ্ঞতা অনুভূতি প্রকাশের জন্য সাহিত্যের এক ভিন্ন ক্ষেত্র বেছে নিলেন ফ্রাঁসোয়া। তিনি লিখলেন Cedipe নামে ট্রাজেডি নাটক। কিন্তু যথাযথ উৎসাহী বন্ধু ও সুযোগের অভাবে সেই নাটক প্রকাশ বা মঞ্চস্থ করতে পারা গেল না।

হল্যান্ডে ভলতেয়ার

ছেলের ভবিষ্যৎ নিয়ে বরাবরই ভাবিত ছিলেন ফ্রাঁসোয়ার বাবা। সাহিত্য নিয়ে মেতে উঠে পাছে উচ্ছন্নে যায় এই আশঙ্কায় তিনি ছেলেকে তাঁর ধর্মবাবার ভাই নেদারল্যান্ডস বা হল্যান্ডের মার্কুইস ডি স্যাটেনফের কাছে পাঠিয়ে দিলেন। সেখানে কিছুদিন কাজ করার পর তাঁর পরিচয় হল মায়ের এক বান্ধবীর মেয়ে অলিম্পে দুয়ের সঙ্গে। পরিচয় অল্পদিনেই পরিণতি পেল প্রেমে (ভলতেয়ারের প্রেমপত্র)। প্যারিসে মায়ের কানে এই সংবাদ পৌঁছালে তাঁকে অবিলম্বে ফিরিয়ে নিয়ে আসা হল।

ফ্রান্সের তৎকালীন পরিস্থিতি

ইতিমধ্যে দেশের রাজনৈতিক ও সামাজিক পরিস্থিতির কিছুটা রদবদল ঘটল। ১৭১৫ খ্রিস্টাব্দে ফ্রান্সের সম্রাট চতুর্দশ লুই মারা গেলেন। সিংহাসনে বসলেন পঞ্চদশ লুই। মাত্র চার বছর বয়সী নাবালক সম্রাটের অভিভাবক রূপে রাজ্য পরিচালনার দায়িত্ব নিলেন তাঁর কাকা অর্লিয়েন্সের ডিউক ফিলিপ। নতুন সম্রাটের শাসনে রাজকীয় বিধিনিষেধ অনেকটাই শিথিল করা হল। নিপীড়িত প্রজারা ক্রমে ফিরে পেল তাদের বাকস্বাধীনতা।

কারাগারে বন্দী ভলতেয়ার

এই সুযোগে ফ্রাঁসোয়াও তৎপর হয়ে উঠলেন। তাঁর রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে দীর্ঘ দিনের ক্ষোভ প্রকাশ করতে লিখলেন আক্রমণমুখী ব্যাঙ্গাত্মক প্রবন্ধ ফিলিপকে নিয়ে। সঙ্গে সঙ্গে বন্দি হলেন তিনি। তাঁকে আঠারো মাসের জন্য পাঠিয়ে দেওয়া হল কুখ্যাত বাস্তিল দুর্গে। কারাগারে বসেই ফ্রাঁসোয়া তাঁর দীর্ঘ কাব্য হেনরি ফোর রচনা শুরু করলেন।

মুক্ত ভলতেয়ার

জেলজীবনে স্বাস্থ্য ভেঙ্গে পড়েছিল। মুক্ত হবার পর স্বাস্থ্য উদ্ধারের জন্য ডিউক ডি বেথুনের আমন্ত্রণে তিনি চলে এলেন সূলিতে। এখানে এসে সংশোধন করলেন Cedipe। পরিচয় হল মিলি ডি লিভলির সঙ্গে। তাঁরই উৎসাহে লিখতে শুরু করলেন অভিনয়োপযোগী নাটক।

ভলতেয়ারের মহাকাব্য

  • (১) প্যারিসে ফিরে এসে গুণগ্রাহী বন্ধুদের সহযোগিতায় মঞ্চস্থ করলেন Cedipe নাটক। রাজপরিবারের নানা পাপ, দুর্নীতি ও ব্যভিচার তুলে ধরা হয়েছিল এই নাটকে। ফলে অল্পদিনেই অসম্ভব জনপ্রিয়তা লাভ করল। কিন্তু ফ্রাঁসোয়ার পরবর্তী নাটক কয়েকটি তেমন জমল না। ব্যর্থ হয়ে দ্রুত হাতে মহাকাব্য হেনরি ফোর শেষ করলেন।
  • (২) এই সময়েই তিনি ভলতেয়ার ছদ্মনাম নিলেন। সেই সঙ্গে হেনরি ফোরের নতুন নামকরণ করলেন হেনরিয়েড। কিন্তু প্রোটেস্টান্টদের বক্তব্যকে তুলে ধরার চেষ্টা হয়েছে এই অভিযোগে বইটি প্রকাশের অনুমতি পেলেন না। বাধ্য হয়ে কয়েন থেকে ১৭২৩ খ্রিস্টাব্দে হেনরিয়েড প্রকাশ করলেন। এই সময় বসন্তরোগে আক্রান্ত হয়ে বেশ কিছুদিন শয্যাশায়ী থাকতে হয়েছিল ভালতেয়ারকে।

পুনরায় বন্দী ভলতেয়ার

কিছুদিনের মধ্যেই আকস্মিকভাবে পড়লেন বিপর্যয়ের মুখে। এক রাজকর্মচারী শেভলির যোহন প্রকাশ্যে ভলতেয়ারকে অপমান করায় তিনি তার বিরুদ্ধে লিখলেন বিদ্রূপাত্মক কবিতা। ক্রুদ্ধ যোহন একদিন দলবল নিয়ে বেদম প্রহার করল ভলতেয়ারকে। অপমানের প্রতিশোধ নেবার জন্য তিনি ডুয়েলে আহ্বান জানালেন যোহনকে। নির্দিষ্ট দিনে ডুয়েলের জায়গায় উপস্থিত হলেই মিথ্যা অভিযোগে বন্দি করা হল ভলতেয়ারকে। আবার তাঁকে পাঠিয়ে দেওয়া হল বাস্তিল দুর্গে। সেখানে পনেরো দিন এই দফায় বন্দি ছিলেন তিনি। স্বেচ্ছায় ফ্রান্স ছেড়ে চলে যাবার অঙ্গীকার করে ছাড়া পেলেন।

ভলতেয়ারের ইংল্যান্ডে আগমন

  • (১) মাত্র ৩২ বছর বয়সে ইংল্যান্ড-এ স্বেচ্ছা-নির্বাসন নিলেন ভলতেয়ার। ইংল্যান্ডের মানুষ তাঁকে সহানুভূতির সঙ্গেই গ্রহণ করল। লর্ড বালিংব্রুকের মাধ্যমে দেশের বুদ্ধিজীবীদের সঙ্গে তাঁর পরিচয় হল। বন্ধুত্ব হল জোনাথন সুইফটের সঙ্গে। তাঁকে তিনি বলতেন বিদ্রোহী ইংরাজ।
  • (২) এছাড়া পরিচিত হলেন তখনকার দিনের অনেক বিখ্যাত ব্যক্তিত্বের সঙ্গে, যেমন, পোপ ইয়ং, গে, কনগ্রিভ, ডাচেস অব মার্লবরো, চেস্টারফিল্ড, পিটারবার্গ প্রমুখ। ইংল্যান্ডের ধর্মীয় সংস্কারমুক্ত পরিবেশ মুগ্ধ করল ভলতেয়ারকে। ইংরাজ জাতির সম্মানবোধ ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা গভীরভাবে প্রভাবিত করল তাঁকে।
  • (৩) ইংরাজ কবি দার্শনিক ও চিন্তাবিদদের রচনা তাঁর মনন ও জ্ঞান বিকাশের সুযোগ করে দিল। ভলতেয়ার ইংল্যান্ডে বসবাস করলেন তিন বছর। এই সময়ের মধ্যে রচনা করলেন History of Charls Twelve এবং Letters on the English ।

দার্শনিক ভলতেয়ারের প্যারিসে আগমন

১৭২৯ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসে ফিরে এসে তিনি প্রকাশ করলেন পত্রগুচ্ছ। এই লেখাগুলোতে প্রতিফলিত হয়েছিল তাঁর মনন ও চিন্তা। পাশাপাশি ছিল সহজাত ব্যঙ্গ বিদ্রূপের বিচ্ছুরণ। প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই বইটি বাজেয়াপ্ত হল। প্রকাশককে বন্দী করা হল বাস্তিল দুর্গে। প্রমাদ গুণলেন ভলতেয়ার।

এক সহৃদয় মহিলার আশ্রয়ে ভলতেয়ার

  • (১) ভলতেয়ার পালিয়ে আশ্রয় নিলেন Cirey-তে Chatelet নামে এক সহৃদয় মহিলার আবাসে। নিঃসন্তান ২৮ বছরের এই মহিলা ছিলেন স্বামীসুখে বঞ্চিতা। সুরূপা ছিলেন না, তাই সম্ভবতঃ স্বামী তাঁর সম্পর্কে ছিলেন নিস্পৃহ। কিন্তু রাষ্ট্রদ্রোহী নির্বাসিত লেখকের প্রতি দুজনেই ছিলেন সহানুভূতিশীল।
  • (২) অল্পদিনেই মাদামের সঙ্গে বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছিল ভালতেয়ারের এবং এই সম্পর্ক অটুট ছিল দীর্ঘ পনের বছর, মাদামের মৃত্যু পর্যন্ত। মাদামের উষ্ণ ভালবাসা ও সান্নিধ্যের প্রেরণায় অব্যাহত ছিল ভালতেয়ারের সাহিত্য রচনা। এখানেই তিনি রচনা করেছিলেন বীরাঙ্গনা জোয়ান অব আর্কের জীবন নিয়ে Mondain, ধর্মের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক রচনা Mahomet, কিছু বিজ্ঞান বিষয়ক রচনা ও Merope.

প্রশিয়ার রাজদরবারে ভলতেয়ার

  • (১) প্রাশিয়ার যুবরাজ দ্বিতীয় ফ্রেডারিক ছিলেন সাহিত্যানুরাগী ও গুণগ্রাহী। ভলতেয়ারের রচনায় আকৃষ্ট হয়ে তিনি তাঁকে রাজদরবারে সম্মাননীয় অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানালেন। কিন্তু মাদাম রাজি না হওয়ায় ভলতেয়ার সেই আমন্ত্রণ রক্ষা করতে পারলেন না।
  • (২) কিছুকাল পরেই ভলতেয়ারের অনুরাগী দ্বিতীয় ফ্রেডারিক প্রাশিয়ার সিংহাসনে বসলেন। তাঁর আমন্ত্রণ পেয়ে ভালতেয়ার চলে গেলেন প্রাশিয়ায়। সম্মানীত অতিথি হিসেবে রাজপ্রাসাদেই রাখা হল তাঁকে। প্রাশিয়ায় দু বছর ছিলেন ভলতেয়ার। প্রাশিয়ায় থাকার সময়েই প্রকাশিত হয়েছিল ভলতেয়ারের বৃহত্তম ও অন্যতম শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ The Epoch of Louis XIVI ।
  • (৩) সেখানে থাকতেই তিনি জানতে পেরেছিলেন রাষ্ট্রদ্রোহী রচনার অপরাধে ফ্রান্সে তাঁকে নির্বাসন দণ্ড দেওয়া হয়েছে। ততদিনে দ্বিতীয় ফ্রেডরিকের আচার আচরণেও কিছুটা কর্তৃত্বের আভাস ফুটে উঠতে শুরু করেছে। উপযুক্ত সময় বুঝে প্রাশিয়া ত্যাগ করে ভলতেয়ার চলে এলেন।

জেনেভায় ভলতেয়ার

এরপর ভলতেয়ার চলে এলেন জেনেভার কাছে ফার্নে নামে এক গ্রামে। সেখানে বাস করতেন তাঁর ষাট বছর বয়সী ভাইঝি ডেনিস। তাঁর সান্নিধ্যে উন্মুক্ত প্রকৃতির কোলে বাধা-বন্ধনহীন প্রকৃত স্বাধীন ও নির্ভার জীবন লাভ করলেন। জীবনের অবশিষ্ট দিনগুলি এখানেই শাস্তিতে কাটিয়েছেন তিনি।

ভলতেয়ারের শরীর ভঙ্গ

মুক্ত বুদ্ধির স্বাধীনচেতা লেখক ও চিন্তাবিদ হিসেবে ততদিনে ভলতেয়ারের নাম চারিদিকে ছড়িয়ে পড়েছিল। দেশের ও বিদেশের চিন্তাবিদ, লেখক ও সমাজ সংস্কারকদের সঙ্গে তাঁর চিঠিপত্রের মাধ্যমে মতামতের আদান প্রদান হত। কিন্তু নির্বাসিত জীবনের গ্লানি প্রতিনিয়ত তাঁর মনকে পীড়া দিত। ফলে ক্রমেই তাঁর শরীর ভেঙ্গে পড়তে লাগল। ১৭৪৯ খ্রিস্টাব্দে দুর্দিনের বন্ধু মাদামের মৃত্যুতে তীব্র শোকে ভেঙ্গে পড়লেন ভলতেয়ার। প্রায়ই অসুস্থ হয়ে পড়তে লাগলেন।

প্যারিসে ভলতেয়ারের নাটক রচনায় হাত

এই সময়ে হিতৈষীদের আহ্বানে তিনি প্যারিসে ফিরে এলেন এবং নাটক রচনায় হাত দিলেন। মানব ইতিহাস ও সভ্যতার অগ্রগতির পরম্পরা দার্শনিকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে এই গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছেন তিনি। ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে দার্শনিকের ভূমিকা সম্পর্কেও স্পষ্ট সুচিন্তিত মতামত ব্যক্ত করে বলেছেন, ইতিহাসের ঘটনাবলীকে দর্শকের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে দেখতে পারেন বলে একমাত্র দার্শনিকের পক্ষেই প্রকৃত ইতিহাস রচনা সম্ভব। ভলতেয়ারের এই রচনা আধুনিক ইতিহাস রচনার দিকনির্দেশক গ্রন্থ রূপে স্বীকৃত।

ভলতেয়ারের মহত্তম সৃষ্টি

ফার্নের শান্ত প্রাকৃতিক পরিবেশে সৃষ্টি সুখের উল্লাসে ভলতেয়ার রচনা করলেন তাঁর মহত্তম সৃষ্টি Candid। দীর্ঘ মানসিক প্রস্তুতির পর মাত্র তিন দিনে সম্পূর্ণ করেছিলেন এই লেখা। যত কিছু অন্যায়, মিথ্যাচার, অসত্য, সংস্কার ও অজ্ঞতার বিরুদ্ধে আবাল্য লালিত দুরন্ত ক্রোধ ও অপরিমেয় ঘৃণা বর্ষিত হয়েছে এই লেখায় ব্যঙ্গ রসসিক্ত সহজ সরল ভাষা ও জটিলতাহীন বিচিত্র এক কাহিনীর মধ্য দিয়ে। বিশ্বসাহিত্যে এমন ব্যঙ্গ রচনার কোন তুলনা নেই। সম্পূর্ণ কল্পনাপ্রসূত এই কাহিনীর কাঠামো জীবন-বিষ্কৃত, আবেদন চিরকালীন।

সরাসরি আঘাত হানতে বদ্ধপরিকর ভলতেয়ার

এর পর নিজের মতপ্রকাশে রচনায় আর কোনো আড়াল রাখলেন না ভলতেয়ার। পরিহাস বিদ্রূপ স্থগিত রেখে সরাসরি আঘাত হানলেন ধর্মজগতের অচলায়তনে। বহু যত্নে ও শঠতায় জনমানসে গড়ে তোলা চার্চের ভাবমূর্তি তীব্র আঘাতে ফালাফালা হতে লাগল তাঁর এক একটি শাণিত রচনায়। এই সময়ের সবচেয়ে বিখ্যাত রচনা Quotations of Zapeta-তে তিনি যাজকদের শয়তানি ভন্ডামির মুখোশ খুলে দিয়ে ধর্মের জোয়াল ছুঁড়ে ফেলে দেবার আহ্বান জানালেন।

রাজকীয় অভ্যর্থনায় অভিনন্দিত ভলতেয়ার

ধর্মাচরণের মিথ্যাচারের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণাই বিদ্রোহী ভলতেয়ারের জীবনের শ্রেষ্ঠ অবদান। চিরনিপীড়িত ধর্মের নিগড়ে বদ্ধ মুক্তিকামী মানুষকে এক নতুন জীবনের সন্ধান দিলেন তিনি। মৃত্যুর দুবছর আগে প্যারিসে ফিরে এসেছিলেন তিনি। অগণিত সাধারণ মানুষের সঙ্গে দেশের জ্ঞানীগুণী মানুষেরা রাজকীয় অভ্যর্থনায় অভিনন্দিত করলেন তাঁকে। সেই সময় প্যারিসের প্রধান রঙ্গমঞ্চে অভিনীত হচ্ছিল তাঁরই রচিত নাটক।

ভলতেয়ারকে সম্বর্ধনা

ফরাসী সাহিত্য একাডেমির সভাপতি নির্বাচিত হলেন তিনি। প্রধান রঙ্গমঞ্চে মাথায় মুকুট পরিয়ে সম্বর্ধনা জানানো হল তাঁকে। মঞ্চে স্থাপিত হল তাঁর মূর্তি। প্রাণবন্যার জোয়ারে উদ্বেলিত হয়ে উঠল গোটা দেশ।

ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিভা ভলতেয়ার

জীবিতকালে ভলতেয়ার হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের সবচেয়ে সম্মানিত প্রতিভা। কেবল নাটক রচনা করেই নয়, গল্প কবিতা, উপন্যাস, নিবন্ধ, সমালোচনামূলক প্রবন্ধ, ইতিহাস, দর্শন, বিজ্ঞান প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রেই তিনি তাঁর শ্রেষ্ঠত্ব নিরূপণ করেছেন। তাঁর প্রতিটি রচনাই ছিল তরবারির মত ক্ষুরধার। হাতের কলমকে তিনি ব্যবহার করেছেন সৈনিকের হাতের অস্ত্রের মতো। পরবর্তীকালে তাঁর বিপুল রচনাবলী ৭০ খন্ডে প্রকাশিত হয়েছে। ভলতেয়ার মানুষকে যাজক সম্প্রদায়ের নিষ্ঠুর পীড়ন থেকে মুক্ত হবার, স্বাধীনতার পথ দেখিয়েছিলেন, যে স্বাধীনতা তাদের সমস্ত বন্ধন থেকে মুক্তির পথে পরিচালিত করেছিল।

ভলতেয়ারে মৃত্যু

১৭৭৮ খ্রিস্টাব্দের ৩০ মে। ভলতেয়ারের ট্রাজেডি নাটক ইরেনে-এর অভিনয় মঞ্চ। অসংখ্য দর্শনার্থীর ভিড় চারদিকে। চরম সাফল্য পেল ইরেনে নাটক। ইরেনে এর সাফল্যে উদ্বেলিত ৮৩ বছরের নাট্যকার ভলতেয়ার। সহসা তিনি বলে উঠলেন, এবারে আমি শান্তিতে মরতে চাই – ক’টি মাত্র শব্দ উচ্চারণ করেই সমাপ্তি ঘটল মানব ইতিহাসের এক মহৎ জীবনের। ভলতেয়ার গত হলেন।

মুক্তির দুর্বার জাগরণে ভলতেয়ারের বাণী

শাসক, সমাজপতি ও যাজক সম্প্রদায়ের প্রতি তাঁর লেখনী হয়ে উঠেছিল সৈনিকের অস্ত্র। পৃথিবীতে অপর কোনো লেখক জীবদ্দশায় তাঁর মতো প্রভাবশালী ছিলেন না। অথচ তাঁর সম্মুখের পথ ছিল না কুসুমাস্তীর্ণ। রাষ্ট্রের হাতে পীড়ন, নির্বাসন, কারাদণ্ড, চার্চের হাতে লাঞ্ছনা-তাঁর জীবনে কোনও নিগ্রহেরই অভাব ঘটে নি। কিন্তু সমস্ত প্রতিকূলতার মধ্যে দিয়ে অপ্রতিহত বেগে তিনি তৈরি করেছিলেন চিরন্তন সত্যের পথ। তাঁর বাণী জনমানসে ঘটিয়েছিল মুক্তির দুর্বার জাগরণ।

উপসংহার :- দেশ ও কালের গণ্ডি অতিক্রম করে ভলতেয়ার চিহ্নিত হয়েছেন ইতিহাস-পুরুষ রূপে। জীবিতকালেই ভলতেয়ার হয়ে উঠেছিলেন ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ব্যক্তিত্ব। তাঁর সর্বাত্মক সমাজ-বিপ্লবের হাতিয়ার ছিল তাঁর রচিত সাহিত্য। তিনি লিখেছেন নাটক, গল্প, ইতিহাস, সাহিত্য, কবিতা, দর্শন, বিজ্ঞান বিষয়ক ও সমালোচনামূলক সাহিত্য। প্রতিটি ক্ষেত্রেই তাঁর বিস্ময়কর প্রতিভার বিচ্ছুরণ ঘটেছে শ্লেষ ও বিদ্রূপের ছটায়।

(FAQ) ফ্রাঁসোয়া মারি আরুয়ে দ্য ভলতেয়ার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভলতেয়ার কে ছিলেন?

ভলতেয়ার ছিলেন ফরাসি আলোকপ্রাপ্ত যুগের একজন প্রধান দার্শনিক এবং লেখক, যিনি বাকস্বাধীনতা, ধর্মনিরপেক্ষতা, এবং মানবাধিকারের পক্ষে কাজ করেছেন।

২. ভলতেয়ারের বিখ্যাত কাজ কী?

তাঁর সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো কঁদিদ (Candide), যা ব্যঙ্গাত্মক উপন্যাস এবং তৎকালীন সমাজ ও ধর্মীয় কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনা।

৩. ভলতেয়ারের প্রধান দর্শন কী ছিল?

তাঁর প্রধান দর্শন ছিল যুক্তিবাদ, ধর্মীয় সহনশীলতা এবং বাকস্বাধীনতা প্রতিষ্ঠা।

৪. ভলতেয়ার কোন যুগে কাজ করেছিলেন?

তিনি ১৮শ শতকের আলোকপ্রাপ্ত যুগে কাজ করেছিলেন, যা যুক্তিবাদ ও সামাজিক সংস্কারের যুগ।

৫. ভলতেয়ার কেন গুরুত্বপূর্ণ?

ভলতেয়ার আধুনিক সমাজে মুক্ত চিন্তার গুরুত্ব তুলে ধরেন এবং ধর্ম ও রাষ্ট্রের পৃথকীকরণে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন।

6. ভলতেয়ারের মৃত্যুর পর তাঁর কাজের প্রভাব কী ছিল?

তাঁর কাজ ফরাসি বিপ্লব এবং আধুনিক পশ্চিমা দর্শনের বিকাশে গভীর প্রভাব ফেলেছে।

৭. ভলতেয়ার ধর্ম সম্পর্কে কী ভাবতেন?

ভলতেয়ার ধর্মীয় সহিষ্ণুতা সমর্থন করতেন এবং গোঁড়ামি ও কুসংস্কারের সমালোচনা করতেন। তিনি বিশ্বাস করতেন যে ধর্ম মানুষের ব্যক্তিগত বিষয় হওয়া উচিত।

Leave a Comment