জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি

রাশিয়ার জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি প্রসঙ্গে ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায়, ফ্রান্সের সাথে সম্পর্ক, প্রাশিয়ার সাথে সম্পর্ক, তিন সম্রাটের চুক্তি, প্যারিসের সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন, তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ, বার্লিন সন্ধি, রুশ প্রভাব খর্ব, রুশ – জার্মান সম্পর্কে ফাটল ও এশিয়ায় রুশ অগ্রগতি সম্পর্কে জানবো।

জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাজার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি
সময়কাল১৮৫৫-১৮৮১ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিজার প্রথম নিকোলাস
উত্তরসূরিজার তৃতীয় আলেকজান্ডার
উল্লেখযোগ্য ঘটনানিহিলিস্ট আন্দোলন
উল্লেখযোগ্য কীর্তিরাশিয়ায় ভূমিদাস প্রথার বিলোপ
জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি

ভূমিকা:- ক্রিমিয়ার যুদ্ধ -এর শেষ পর্বে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার সিংহাসনে বসেন এবং যুদ্ধশেষে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি স্বাক্ষরে বাধ্য হন। এই অপমানজনক সন্ধির ফলে ইউরোপ ও এশিয়া ভূখণ্ডের বহু স্থান রাশিয়ার হস্তচ্যুত হয়। দক্ষিণ-পূর্ব ইউরোপে রাশিয়ার অগ্রগতিও সম্পূর্ণভাবে প্রতিহত হয়।

ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে দূরত্ব বজায়

ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পর প্রায় দীর্ঘ কুড়ি বছর ধরে রাশিয়া ইউরোপীয় রাজনীতি থেকে দূরে ছিল। জারের বিদেশমন্ত্রী মনে করতেন যে, রাশিয়া ইউরোপ থেকে হাত গুটিয়ে নিলে ইউরোপীয় শক্তিগুলির মধ্যে অন্তর্বিরোধ দেখা দেবে, যা রাশিয়ার পক্ষে মঙ্গলজনক হবে।

জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি

ক্রমে অবস্থার পরিবর্তন ঘটে এবং রাশিয়া তথা জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার বিদেশ নীতি তথা পররাষ্ট্র ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্ৰহণ করে। যেমন –

(১) ফ্রান্স

রুশ বিদেশমন্ত্রী প্রিন্স গোরচাকফ ফ্রান্সের সঙ্গে মিত্রতা গড়ে তুলতে সচেষ্ট হন। ইতিমধ্যে ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে পোল্যান্ড-এ বিদ্রোহ শুরু হলে ফরাসি সম্রাট বিদ্রোহীদের নানাভাবে সাহায্য করতে থাকেন। এর ফলে রুশ-ফ্রান্স সম্পর্ক তিক্ত হয়ে ওঠে।

(২) প্রাশিয়া

  • (ক) প্রাশিয়া পোল্যান্ডের বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সাহায্য করে। এর ফলে রাশিয়া ও প্রাশিয়া মিত্রতার বন্ধনে আবদ্ধ হয়। রাশিয়ার সাহায্য নিয়ে প্রাশিয়া প্রথমে অস্ট্রিয়া ও পরে ফ্রান্সকে প্রাশিয়া থেকে বিতাড়িত করে। এইভাবে জার্মানির ঐক্য সম্পন্ন হয়।
  • (খ) ক্রিমিয়ার যুদ্ধের সময় (১৮৫৩-১৮৫৬ খ্রিঃ) অস্ট্রিয়া রাশিয়ার বিরোধিতা করেছিল। স্যাডোয়ার যুদ্ধ -এ (১৮৬৬ খ্রিঃ) অস্ট্রিয়ার পরাজয়কে রাশিয়া ক্রিমিয়ার যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার বিরোধিতার প্রতিশোধ বলে মনে করে।

(৩) তিন সম্রাটের চুক্তি

১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানি ঐক্যবদ্ধ হলে ফ্রান্সকে কোণঠাসা করার উদ্দেশ্যে জার্মানির চ্যান্সেলার বিসমার্ক অস্ট্রিয়া, রাশিয়া ও জার্মানির মধ্যে ‘তিন সম্রাটের চুক্তি‘ বা ‘ড্রেইকাইজারবুন্ড’ স্বাক্ষর করান। বলা বাহুল্য, এর দ্বারা জার্মানিই লাভবান হয় – রাশিয়া নয়।

(৪) প্যারিসের সন্ধির শর্ত লঙ্ঘন

প্রাশিয়ার সমর্থনপুষ্ট রাশিয়া প্যারিসের সন্ধি (১৮৫৬ খ্রিঃ)-র কৃষ্ণসাগর সম্পর্কিত শর্তাদি (কৃষ্ণসাগর নিরপেক্ষ অঞ্চল বলে পরিগণিত হবে, কোনও রাষ্ট্রের রণতরী সেখানে প্রবেশ করতে পারবে না এবং রাশিয়া বা তুরস্ক এর তীরে কৃষ্ণসাগর ও বলকান অস্ত্রাগার নির্মাণ করতে পারবে না) উপেক্ষা করে সেখানে প্রবেশের চেষ্টা করে।

(৫) তুরস্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ

১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সঙ্গে রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। পরাজিত তুরস্ক ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সানস্টিফানোর সন্ধি দ্বারা রাশিয়াকে নানা সুযোগ-সুবিধা দিতে বাধ্য হয়। তুরস্ক রাশিয়াকে বাটুম, বেসারাবিয়া এবং দোব্রুজা ছেড়ে দেয়।

(৬) বার্লিনের সন্ধি

রাশিয়ার এই সাফল্যে ইংল্যান্ড, অস্ট্রিয়া ও অন্যান্য রাষ্ট্রবর্গ শঙ্কিত হয়ে ওঠে এবং এই সন্ধির শর্তাবলী পরিবর্তনের জন্য চাপ দিতে থাকে। শেষ পর্যন্ত জার্মানির চ্যান্সেলার বিসমার্কের সভাপতিত্বে ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে বার্লিনের সন্ধি দ্বারা সানস্টিফানোর সন্ধির শর্তাবলী বহুলাংশে পরিবর্তিত হয়।

(৭) রুশ প্রভাব খর্ব

রাশিয়া তুরস্ক থেকে প্রাপ্ত অনেক সুযোগ-সুবিধাই ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। রাশিয়া বাটুম, বেসারাবিয়া, দোব্রুজা প্রভৃতি অঞ্চল ধরে রাখতে পারলেও দার্দানালিস প্রণালীতে রুশ জাহাজ চলাচল নিয়ন্ত্রিত হয় এবং বৃহত্তর বুলগেরিয়াতেও রুশ প্রভাব খর্ব করা হয়।

(৮) রুশ-জার্মান সম্পর্কে ফাটল

বার্লিন কংগ্রেস ছিল রাশিয়ার কূটনৈতিক পরাজয়। এই সন্ধিতে রাশিয়ার মিত্র বিসমার্ক অস্ট্রিয়াকে সমর্থন করায় রুশ-জার্মান সম্পর্কে ফাটল ধরে।

(৯) এশিয়ায় রুশ অগ্রগতি

ইউরোপ ও বলকান অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি ব্যাহত হলেও এশিয়ার পূর্বাঞ্চলে দ্বিতীয় আলেকজান্ডার অনেকটাই সফল হন। যেমন –

  • (ক) তিনি ১৮৭৫ খ্রিস্টাব্দে দূর-প্রাচ্যে শাখালিন দ্বীপপুঞ্জ আবিষ্কার করেন।
  • (খ) চিন-এর সঙ্গে আইগুনের সন্ধি দ্বারা রাশিয়া প্রশান্ত মহাসাগরের উপকূলে অবস্থিত ভ্লাডিভস্টক বন্দর এবং আমুর নদীর উপকূলবর্তী অঞ্চল লাভ করে।
  • (গ) মধ্যপ্রাচ্যে ক্রমাগত অভিযান চালিয়ে রাশিয়া মার্ভ, পারস্য ও আফগানিস্তান পর্যন্ত রুশ সীমানা সম্প্রসারিত করে। এশিয় ভূখণ্ডে রাশিয়ার এই বিস্তৃতির ফলে ইংল্যান্ড তার ভারতীয় সাম্রাজ্য-এর নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে।
  • (গ) দক্ষিণে রুশ সীমানা ককেশাস পর্যন্ত বিস্তৃত হয়।

উপসংহার:- সবশেষে বলা যায় যে, জার আলেকজান্ডারের বিদেশ নীতি তাঁর অভ্যন্তরীণ নীতির মতো চমকপ্রদ ছিল না ঠিকই, কিন্তু আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে তিনি রাশিয়ার লুপ্ত গৌরব বহুলাংশে পুনরুদ্ধার করেন।

(FAQ) জার দ্বিতীয় আলেকজাণ্ডারের বিদেশ নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মুক্তিদাতা জার কাকে বলা হয়?

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।

২. কে, কবে রাশিয়ার ভূমিদাস প্রথার বিলোপ সাধন করেন?

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে।

৩. কোন জারের আমলে নিহিলিস্ট আন্দোলন সংঘটিত হয়?

জার দ্বিতীয় আলেকজান্ডার।

৪. বার্লিনের সন্ধি কবে স্বাক্ষরিত হয়?

১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment