ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা বিষয়ে রমেশচন্দ্র মজুমদারের অভিমত, তারা চাঁদের অভিমত, ডঃ সীতারামাইয়া-র অভিমত, কিছু মতবাদ, সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা, হিউমের ভূমিকা, হিউমের ভূমিকার বিরোধিতা, লর্ড ডাফরিনের ভূমিকা, সেফটি ভালভ তত্ত্ব ও তার সমালোচনা, প্রকৃত কারণ ও ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জানবো।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা প্রসঙ্গে ভারতের ব্যাপকভিত্তিক রাজনৈতিক দল, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সীতারামাইয়ার অভিমত, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় অ্যালান অক্টাভিয়ান হিউমের ভূমিকা, ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় সেফটি ভালভ তত্ত্ব, জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় লর্ড ডাফরিনের ভূমিকা ও জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার প্রকৃত কারণ সম্পর্কে জানব।

ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা (The Foundation of the Indian National Congress)

ঐতিহাসিক ঘটনাভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা
প্রতিষ্ঠাকাল১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দ
স্থানবোম্বাইয়ের গোকুল দাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ
প্রথম অধিবেশন১৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮-৩০ ডিসেম্বর
প্রথম সভাপতিউমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়
ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা

ভূমিকা :- ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারতীয় জাতীয়তাবাদ ও স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাসে এক যুগান্তকারী ঘটনা। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার বলেন যে, “১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের একেবারে শেষ লগ্নে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ফলে ভারত-এর রাজনৈতিক জীবনে এক নবযুগের সূচনা হয়।”

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে আর. সি. মজুমদারের অভিমত

ঐতিহাসিক রমেশচন্দ্র মজুমদার  বলেন যে, পৃথিবীর ইতিহাসে কোনও যুগ বা দেশে এমন একটি দৃষ্টান্তও খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে একটি রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান দীর্ঘ ষাট বছরেরও বেশি সময় ধরে বিদেশি শাসনের হাত থেকে মাতৃভূমির স্বাধীনতা সংগ্রামের কেন্দ্রবিন্দু হিসেবে কাজ করেছে।

প্রধান প্রতিষ্ঠান ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস

এই কথা অনস্বীকার্য যে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে কংগ্রেস ছাড়াও বহু দল ও সংগঠন যুক্ত ছিল, কিন্তু এই কথাও সত্য যে এই দীর্ঘ ও কঠিন সংগ্রামে কংগ্রেসই ছিল কেন্দ্রীয় চরিত্র এবং তাকে কেন্দ্র করেই এই মহাসংগ্রাম বিবর্তিত বা আবর্তিত হয়েছিল।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে তারা চাঁদের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ তারা চাঁদ বলেন যে, ভারতের রাজনৈতিক ইতিহাসে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা অভূতপূর্ব ঘটনা। এই ঘটনা এক নতুন যুগের, রাজনৈতিক ঐক্যের যুগের আগমন বার্তা ঘোষণা করে।

কেন্দ্রিয় চরিত্র ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস

পলাশির যুদ্ধ -এর পর একশ বছর ধরে অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক বিবর্তনের ফলে যে নতুন সমাজ গড়ে ওঠে, কংগ্রেস ছিল তার কেন্দ্রীয় চরিত্র।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে ডঃ সীতারামাইয়া-র মত

ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের উৎপত্তি সম্পর্কে নানা মতামত ও বিতর্ক আছে। ‘কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটি’ প্রকাশিত ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের ইতিহাস’ (‘History of the Indian National Congress’) গ্রন্থের রচয়িতা ডঃ পট্টভি সীতারামাইয়া-র মতে কংগ্রেসের জন্মবৃত্তান্ত রহস্যাবৃত। তিনি এই ব্যাপারে কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেছেন। এগুলি হল –

  • (১) তাঁর মতে, ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দে মহারানি ভিক্টোরিয়ার সম্মানার্থে অনুষ্ঠিত ‘দিল্লি দরবারে’ ভারতের নানা অঞ্চলের নেতারা সমবেত হন এবং সেখান থেকেই ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের পরিকল্পনা আসে।
  • (২) তিনি এই প্রসঙ্গে ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর কথাও বলেছেন। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন -এ যোগদানকারী অন্যতম সদস্য জি. সুব্রহ্মণ্য আয়ার-ও এই প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর কথা বলেছেন।
  • (৩) ডঃ সীতারামাইয়া আরও বলেন যে, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি‘-র সতেরো জন সদস্যের এক গোপন বৈঠকে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা হয়। শ্রীমতী অ্যানি বেশান্ত-এর রচনায় এই মতের সমর্থন পাওয়া যায়।
  • (৪) তিনি বলেন যে, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের এই অধিবেশন থেকে ‘মাতৃভূমিকে রক্ষার জন্য একটি জাতীয় রাজনৈতিক আন্দোলনের প্রেরণা আসে এবং জাতীয় কংগ্রেসের মাধ্যমে এই পরিকল্পনা বাস্তবায়িত হয়।

সিতারামাইয়ার মতের সমালোচনা

ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার উপরিউক্ত কোনও মতকেই স্বীকার করেন না। তিনি বলেন যে,

  • (১) ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের দিল্লি দরবার বা ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনীর সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কোনও সম্পর্ক ছিল না। ১৮৭৭খ্রিস্টাব্দের দিল্লি দরবার থেকে ‘জাতীয় কংগ্রেস’ নয়- সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ‘সর্বভারতীয় জাতীয় সম্মেলন‘ -এর পরিকল্পনা পান।
  • (২) কলকাতায় অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী উপলক্ষে জনসমাগমকে ব্যবহার করার উদ্দেশ্যে সুরেন্দ্রনাথ ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বরে ‘জাতীয় সম্মেলনের’ অধিবেশন আহ্বান করেন। ‘দিল্লি দরবার’ এবং কলকাতার আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী সুরেন্দ্রনাথকেই উদ্বুদ্ধ করেছিল, অথচ পট্টভি-র রচনায় সুরেন্দ্রনাথের কোনও উল্লেখ নেই।
  • (৩) ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে মাদ্রাজে ‘থিওসফিক্যাল সোসাইটি’-র সম্মেলনের সঙ্গে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সম্পর্ককে ডঃ মজুমদার ভিত্তিহীন বলে মনে করেন। তাঁর মতে শ্রীমতী বেশান্ত-রচিত গ্রন্থ ‘How India Wrought for Freedom’ ব্যতীত অন্য কোথাও এই মতের সমর্থন পাওয়া যায় না।
  • (৪) শ্রীমতী বেশান্ত তাঁর গ্রন্থে সতেরো জন নেতার মধ্যে এমন অনেকের নাম করেছেন, যাঁরা তখন মাদ্রাজে উপস্থিত ছিলেন না। উদাহরণ হিসেবে সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নাম করা যায়।
  • (৫) সুরেন্দ্রনাথ নিজেই তাঁর ‘আত্মজীবনী’ (‘A Nation in Making)-তে বলছেন যে, তিনি মাদ্রাজে যান নি—তিনি তখন কলকাতায় অন্য কাজে ব্যস্ত ছিলেন। এদিকে শ্রীমতী বেশান্ত প্রদত্ত সতেরো জনের তালিকায় হিউমের নাম নেই, কিন্তু সুরেন্দ্রনাথ উক্ত সতেরো জনের অন্যতম হিসেবে হিউমের নাম উল্লেখ করেছেন।
  • (৬) শ্রীমতী বেশান্ত-প্রদত্ত তালিকার অন্যতম অধ্যাপক সুন্দররাজন বলেন যে, ঐ সভায় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কোনও কথা হয় নি। শ্রীমতী বেশান্ত যে সতেরো জনের নাম বলেছেন, তাঁদের অধিকাংশই কংগ্রেসের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে হাজির ছিলেন না।
  • (৭) সুতরাং দেখা যাচ্ছে যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে ১৮৭৭ খ্রিস্টাব্দের দিল্লি দরবার, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের আন্তর্জাতিক প্রদর্শনী বা থিওসফিক্যাল সোসাইটির সম্মেলন—সবই গুরুত্বহীন।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে কিছু মতবাদ

  • (১) অনেকে বলেন যে, ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় লর্ড রিপন-এর বিদায় সম্বর্ধনা সভায় ভারতের বিভিন্ন প্রদেশের নেতৃমণ্ডলীর সমাবেশ থেকেই একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের কথা চিন্তা করা হয়।
  • (২) অনেকে দাদাভাই নওরোজি-কে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার কৃতিত্ব দিতে চান, কিন্তু তাঁর সমসাময়িক কংগ্রেসের অপর এক নেতা দীনশা ওয়াচা সুস্পষ্টভাবে বলেন যে, “ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার চিন্তা হিউম করেছিলেন— দাদাভাই নওরোজি নন।”
  •  (৩) ডঃ নন্দলাল চট্টোপাধ্যায় বলেন যে, সম্ভাব্য রুশ আক্রমণ প্রতিরোধের উদ্দেশ্যে কংগ্রেসের জন্ম হয়। বলা বাহুল্য, এই সময় রুশ আক্রমণের সম্ভাবনা ইংরেজ সরকারকে বিব্রত করেছিল ঠিকই, কিন্তু জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার সঙ্গে রুশ আক্রমণের কোনও সম্পর্ক নেই।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় সুরেন্দ্রনাথের ভূমিকা

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের ভূমিকা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য উঠে আসে। যেমন –

(১) অম্বিকাচরণের অভিমত

কংগ্রেসের অন্যতম সভাপতি অম্বিকাচরণ মজুমদার-এর মতে, ১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দে অনুষ্ঠিত সুরেন্দ্রনাথের ‘জাতীয় সম্মেলন’ থেকেই ‘জাতীয় কংগ্রেসের’ পরিকল্পনা গৃহীত হয় এবং এটাই বহুলাংশে জাতীয় কংগ্রেস সৃষ্টির পথ নির্মাণ করে।

(২) কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে ‘জাতীয় সম্মেলনে’র দ্বিতীয় অধিবেশন সমাপ্ত হওয়ার পরদিনই জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন শুরু হয়।

(৩) জাতীয় সম্মেলনের কার্যবিবরণী গ্ৰহণ

কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশনের উদ্যোক্তাগণ সুরেন্দ্রনাথের কাছ থেকে জাতীয় সম্মেলনের কার্যবিবরণী গ্রহণ করেন এবং এই অধিবেশনে ‘জাতীয় সম্মেলনে’র অনুকরণে বিভিন্ন প্রস্তাবাবলী পাশ করা হয়। এই থেকে সহজেই অনুমান করা যায় যে, ‘জাতীয় সম্মেলন’ থেকেই ‘জাতীয় কংগ্রেসের প্রেরণা আসে।

(৪) অমলেশ ত্রিপাঠীর অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী-র মতে ‘জাতীয় সম্মেলন’ হল ‘জাতীয় কংগ্রেসের মহড়া” এবং ‘জাতীয় সম্মেলনের’ মধ্যেই ‘জাতীয় কংগ্রেসের’ বীজ লুকিয়েছিল। ঐতিহাসিক ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার-ও এই মতের পক্ষপাতী।

(৫) ন্যাশনাল কংগ্রেস নামের উল্লেখ

ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, ১৮৮২ খ্রিস্টাব্দের ২৭শে মে সুরেন্দ্রনাথ তাঁর সম্পাদিত বেঙ্গলী পত্রিকায় প্রথম ‘ন্যাশনাল কংগ্রেস’ (‘National Congress’) কথাটির উল্লেখ করেন এবং লেখেন যে, এই ‘জাতীয় কংগ্রেসের’ উদ্দেশ্য হবে সারা দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রাজনৈতিক সংস্থাগুলিকে একত্রিত করে একটি ছাদের নীচে আনা।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা

অনেকে অবসরপ্রাপ্ত ইংরেজ রাজকর্মচারী অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউমকে ‘জাতীয় কংগ্রেসের জনক’ বা ‘প্রতিষ্ঠাতা’ বলে থাকেন। এই প্রসঙ্গে বিভিন্ন মতামত ব্যক্ত হয়েছে। যেমন –

(১) ওয়েডারবার্নের অভিমত

হিউমের জীবনীকার ও অন্যতম কংগ্রেস সভাপতি উইলিয়ম ওয়েডারবার্ন রচিত ‘অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম, ফাদার অব দি ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল কংগ্রেস’ গ্রন্থ থেকে জানা যায় যে, ১৮৭০-৭৯ খ্রিস্টাব্দে ভারত সরকারের দায়িত্বপূর্ণ সচিব পদে নিযুক্ত থাকার সময় সিমলাতে অবস্থানকালে তিনি স্বরাষ্ট্র দপ্তরের বহু গোপনীয় সরকারি দলিলপত্র দেখার সুযোগ পান।

(২) সরকারি দমন নীতির প্রভাব

সাতটি বৃহৎ খণ্ডে রক্ষিত প্রায় ত্রিশ হাজারেরও বেশি এই সব দলিল দেখে হিউম সিদ্ধান্তে আসেন যে, সরকারি দমননীতির ফলে সমগ্র ভারত—বিশেষ করে দেশের নিম্নশ্রেণীর লোকেরা যে কোনও সময় বিদ্রোহ করতে পারে।

(৩) শিক্ষিত সমাজকে নিয়ন্ত্রণ

দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়কে আসন্ন বিদ্রোহ থেকে দূরে রেখে তাদের প্রগতিশীল মতামতকে নিয়মতান্ত্রিক পথে চালিত করে তিনি ভারত থেকে ব্রিটিশ-বিরোধী মনোভাব দূর করতে সচেষ্ট হন। এই কারণে ব্রিটিশ সরকারের স্বার্থে তিনি ‘সেফটি ভালভ’ বা ধ্বংসাত্মক শক্তির প্রতিরোধক হিসেবে ‘কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠায় উদ্যোগী হন।

(৪) হিউমের নিজস্ব অভিমত

হিউমের নিজের কথায়— “আমাদের নিজেদের কার্যাবলীর ফলে যে ভয়াবহ শক্তির উদ্ভব ঘটেছে তার হাত থেকে রেহাই পেতে গেলে জরুরি প্রয়োজন সেফটি ভালভের। আমাদের কংগ্রেস আন্দোলনের চেয়ে দক্ষ সেফটি ভালভ বোধ হয় আবিষ্কার করা যাবে না।”

(৫) হিউমের খোলা চিঠি

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দের ১লা মে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের উদ্দেশ্যে এক খোলা চিঠিতে হিউম দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক, মানসিক ও নৈতিক উন্নতির জন্য তাদের সংঘবদ্ধ হবার আহ্বান জানান।

(৬) ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন প্রতিষ্ঠা

১৮৮৩ খ্রিস্টাব্দেই তিনি ইণ্ডিয়ান ন্যাশনাল ইউনিয়ন’ প্রতিষ্ঠা করেন। পুণাতে ঐ বছরই তিনি একটি সর্বভারতীয় সম্মেলন আহ্বানের পক্ষপাতী ছিলেন, কিন্তু সম্মেলন শুরু হয় আরও দু’বছর বাদে।

(৭) বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে আলোচনা

পরে ভারত ও ইংল্যান্ড -এর লর্ড রিপন, জন ব্রাইট প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তি ও ভারত-বন্ধু — এমনকী ভাইসরয় লর্ড ডাফরিনের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করেন।

(৮) জাতীয় কংগ্রেসের জনক

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ডিসেম্বর মাসে ‘ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেস’ প্রতিষ্ঠিত হয়। জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়, হিউমের জীবনীকার ও জাতীয় কংগ্রেসের পঞ্চম সভাপতি উইলিয়ম ওয়েডারবার্ন, ডঃ পট্টভি সীতারামাইয়া, মার্কসবাদী লেখক রজনীপাম দত্ত প্রমুখ হিউম-কেই জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা বা জনক বলে অভিহিত করেছেন।

হিউমের ভূমিকার বিরোধিতা

ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী, ডঃ বিপান চন্দ্র, ডঃ অনীল শীল কোনওভাবেই জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের ভূমিকা মানতে রাজি নন।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠায় ডাফরিনের ভূমিকা

লর্ড ডাফরিনের সঙ্গে হিউমের সাক্ষাৎকার সম্পর্কে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর মন্তব্য বিষয়টিকে অতি জটিল করে তুলেছে।

(১) উমেশচন্দ্রের অভিমত

১৮৯৮ খ্রিস্টাব্দে উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর রচিত গ্রন্থে (‘Introduction to Indian Politics’) জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার জন্য ডাফরিনকেই সর্বপ্রকার গুরুত্ব দিয়েছেন। এক্ষেত্রে তিনি বেশ কিছু বক্তব্য তুলে ধরেছেন যেমন –

  • (ক) তিনি বলছেন যে, এটি অনেকের কাছেই একটি সংবাদ হবে যে ডাফরিনই ছিলেন জাতীয় কংগ্রেসের মূল প্রতিষ্ঠাতা। তাঁর মতে কংগ্রেস প্রতিষ্ঠায় হিউমের চেয়ে ডাফরিনের ভূমিকা ছিল অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।
  • (খ) উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় বলেন যে, হিউম ডাফরিনকে বলেছিলেন যে তাঁর পরিকল্পিত সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠানটি কেবলমাত্র সামাজিক সমস্যাবলী নিয়েই আলোচনা করবে।
  • (গ) অপরপক্ষে ডাফরিন চান যে, সামাজিক সমস্যাবলী নয় — এই নবগঠিত সংগঠনটি ইংল্যাণ্ডের বিরোধী দলের মত সরকারি দোষ-ত্রুটির সমালোচনা করে হার ম্যাজেস্টিজ অপোজিশনের’ (‘Her Majesty’s Opposition’) ভূমিকা পালন করবে।
  • (ঘ) তিনি মনে করেছিলেন যে, শিক্ষিত মধ্যবিত্তরা সরকারি কাজকর্মের সমালোচনা করার অধিকার পেলে তা ‘সেফটি ভালভের কাজ করবে। এইভাবে বড়লাট ডাফরিনের ‘আশীর্বাদ’ নিয়ে ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (ঙ) জন ম্যাকলেন বলেন যে, সম্ভবত ডাফরিনও একটি ‘সেফটি ভালভ’ চেয়েছিলেন এবং তা হিউম-কল্পিত গণ-বিদ্রোহের বিরুদ্ধে না হলেও, অবশ্যই তা ছিল সুরেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায়ের নেতৃত্বাধীন উগ্র দলের বিরুদ্ধে।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে সেফটি ভালভ তত্ত্ব

উপরোক্ত এই সব বিবরণের ওপর ভিত্তি করে ‘সেফটি ভালভ তত্ত্ব‘ (‘Safety- valve theory’) এবং ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ (‘Hume-Dufferin conspiracy theory’) গড়ে উঠেছে।

(১) লালা লাজপতের অভিমত

নরমপন্থী কংগ্রেস নেতৃত্বকে আক্রমণের উদ্দেশ্যে ১৯১৬ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশিত ‘ইয়ং ইণ্ডিয়া’ (‘Young India’) গ্রন্থে লালা লাজপৎ রায় ‘সেফটি ভালভ’ তত্ত্ব আলোচনা করে বলেন যে, ডাফরিনই হলেন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা। তিনি বলেন যে, “ভারতের রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন অপেক্ষা ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদকে বিপদ থেকে রক্ষা করাই ছিল কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্য। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের স্বার্থই মুখ্য; ভারতের স্বার্থ গৌণ।”

(২) রজনীপাম দত্তের অভিমত

এর পঁচিশ বছর পর মার্কসবাদী পণ্ডিত রজনীপাম দত্ত (R. P. Dutt ) জাতীয় কংগ্রেসকে ‘সেফটি ভাল্‌ভ্ তত্ত্ব’ ও ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্রের ফলশ্রুতি’ বলে অভিহিত করেন। তাঁর মতে গণ-বিদ্রোহের হাত থেকে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যকে রক্ষার উদ্দেশ্যে সরকারের প্রত্যক্ষ সহযোগিতায় জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠিত হয়।

(৩) ষড়যন্ত্র তত্ত্বের সমর্থন

সি. এফ. এ্যান্ড্রুজ (C. F. Andrews), গিরিজা মুখার্জী (Girija Mukherji), ডঃ মেহরোত্রা (S. R. Mehrotra) এই ষড়যন্ত্র তত্ত্বকে সমর্থন করেছেন।

বিক্ষুব্ধ ভারত

  • (১) আসলে উনিশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে সারা ভারতে এক অগ্নিগর্ভ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছিল। আফগানিস্তান ও উত্তর বার্মায় যুদ্ধজনিত প্রবল ব্যয়ভার, রাজস্বের চড়া হার, দুর্ভিক্ষ, মুদ্রাস্ফীতি, বৈষম্যমূলক শুল্ক নীতি, নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যাদির অগ্নিমূল্য দেশবাসীকে বিক্ষুব্ধ করে তুলেছিল।
  • (২) মহারাষ্ট্র, পাঞ্জাব, দাক্ষিণাত্য, পাবনা প্রভৃতি স্থানে তখন চলছিল কৃষক বিদ্রোহ। সমকালীন সরকারি নথিপত্রে দেশবাসীর এই অসন্তোষের পরিচয় মিলবে। ১৮৮১ খ্রিস্টাব্দে লিখিত এক পত্রে কার্ল মার্কসও ব্রিটিশ ভারতের এই বিক্ষুব্ধ অবস্থার কথা স্বীকার করেছেন।
  • (৩) অস্ত্র আইন, মাতৃভাষায় সংবাদপত্র আইন, ইলবার্ট বিল, সিভিল সার্ভিস পরীক্ষা প্রভৃতি নিয়ে দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায়ও তখন প্রবল ক্ষুব্ধ।
  • (৪) রজনীপাম দত্ত বলেন যে, দেশের শিক্ষিত সম্প্রদায় যাতে কৃষকদের সঙ্গে মিলিত হয়ে দেশে কোনও গণ-বিদ্রোহের সৃষ্টি না করে তা-ই ছিল হিউমের লক্ষ্য। এই কারণেই তিনি কংগ্রেস সৃষ্টির পরিকল্পনা করেন।

সেফটি ভালভ তত্ত্বের সমালোচনা

বলা বাহুল্য, সাম্প্রতিক গবেষণায় ‘সেফটি ভাল্ভ তত্ত্ব’ এবং ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ অগ্রাহ্য হয়েছে। ডঃ রমেশচন্দ্র মজুমদার, ডঃ অনিল শীল, ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী, ডঃ বিপান চন্দ্র, ডঃ সুমিত সরকার এই মতবাদের বিরুদ্ধে যুক্তিগ্রাহ্য প্রতিবাদ জানিয়েছেন। তাঁরা বলেন যে,

  • (১) হিউম রাজস্ব, কৃষি ও বাণিজ্য বিভাগের সচিব ছিলেন। ব্রিটিশ শাসনের কঠোর শৃঙ্খলার দিনে তাঁর পক্ষে স্বরাষ্ট্র বিভাগের গোপন নথি দেখা কখনোই সম্ভব ছিল না।
  • (২) হিউম ছিলেন সিমলায়, কিন্তু স্বরাষ্ট্র দপ্তরের নথিপত্র থাকত দিল্লিতে।
  • (৩) লালা লাজপৎ রায় প্রশ্ন তুলেছেন যে, ভারতের অবস্থা যদি সত্যিই এত ভয়ঙ্কর হয়ে থাকে, তাহলে তা প্রতিরোধের জন্য হিউমের অবসর গ্রহণের (১৮৭৯ খ্রিঃ) এত পরে কেন কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা হল?
  • (৪) হিউম ও ডাফরিনের ব্যক্তিগত চিঠিপত্র থেকে প্রমাণিত হয়েছে যে, ডাফরিনের সঙ্গে হিউম সাক্ষাৎ করলেও, কংগ্রেস সম্পর্কে ডাফরিন বিরক্তিই প্রকাশ করেন—এমনকী ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ১৭ই মে বোম্বাই এর গভর্নর রিয়ে (Reay)-কে তিনি কংগ্রেস এবং ‘বাঙালিবাবু’ ও ‘মারাঠি ব্রাহ্মণদের বিরুদ্ধে সতর্ক করে দেন।
  • (৫) তিনি হিউমকে একজন ‘মানসিক বিকারগ্রস্ত, মিথ্যাবাদী’ মানুষ বলে মনে করতেন। কংগ্রেসের লক্ষ্য ও কর্মসূচিকেও তিনি পছন্দ করতেন না।
  • (৬) ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী বলেন যে, হিউম বা উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় যাই বলুন না কেন, ডাফরিন কোনওদিনই চাননি যে কংগ্রেস রাজনৈতিক আলোচনায় নামুক।
  • (৭) ১৮৮৮-তে সেন্ট এ্যান্ড্রুজের ভোজসভায় ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী জাতীয় কংগ্রেসকে ‘আণুবীক্ষণিক সংখ্যালঘু’ (Microscopic minority) গোষ্ঠী বলে ব্যঙ্গ করেন। স্বভাবতই ‘হিউম-ডাফরিন ষড়যন্ত্র তত্ত্ব’ মেনে নেওয়া খুবই কষ্টকর।
  • (৮) সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, সাত খণ্ডের ঐ তথাকথিত দলিলপত্রের কোনও অস্তিত্বই ছিল না।

জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠার প্রকৃত কারণ

  • (১) ডঃ সুমিত সরকার বলেন যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে হিউমের ভূমিকাকে মাত্রাতিরিক্ত গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। আসলে ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী বহু পূর্ব থেকেই একটি সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করছিলেন এবং হিউম সেই অনুকূল অবস্থার সুযোগ নিয়েছিলেন মাত্র।
  • (২) বিশেষ কোনও অঞ্চলের অধিবাসী না হওয়ায় তিনি সব অঞ্চলের নেতাদের কাছে গ্রহণযোগ্য ছিলেন এবং সরকারি আমলাদের ওপর তাঁর প্রভাব সম্পর্কেও ভারতীয় নেতৃমণ্ডলীর অতিরঞ্জিত ধারণা ছিল। 
  • (৩) ভারতীয় নেতৃমণ্ডলী তাঁদের রাজনৈতিক কার্যকলাপের সূচনা-পর্বেই সরকারের রোষানলে পড়তে চাননি এবং এ কারণেই তাঁরা হিউমের সহযোগিতা চেয়েছিলেন।
  • (৪) ১৯১৩ খ্রিস্টাব্দে গোপালকৃষ্ণ গোখলে লেখেন যে, “কোনও ভারতীয়ের পক্ষে জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব ছিল না। রাজনৈতিক আন্দোলন সম্পর্কে সরকারের সন্দেহ তখন এত তীব্র ছিল যে, কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠাতা যদি একজন বিখ্যাত ও সম্ভ্রান্ত প্রাক্তন ইংরেজ রাজকর্মচারী না হতেন, তাহলে কর্তৃপক্ষ সঙ্গে সঙ্গে যে কোনও উপায়ে এই উদ্যোগ দমন করতেন।”
  • (৫) আসলে একটি সর্বভারতীয় প্রতিষ্ঠান স্থাপনের উদ্যোগ চলছিল অনেক আগে থেকেই হিউমের উদ্যোগ এ কাজটিকে ত্বরান্বিত করেছিল মাত্র।
  • (৬) ডঃ বিপান চন্দ্র বলেন যে, “বিধ্বংসী সংগঠন হয়ে ওঠার সম্ভাবনা-বিশিষ্ট একটি সংগঠনের প্রধান সংগঠক যদি একজন অবসরপ্রাপ্ত ব্রিটিশ রাজকর্মচারী হন তাহলে সরকার এই সংগঠনকে কম সন্দেহ করবে এবং তার ওপর আক্রমণের সম্ভাবনাও কম হবে।”
  • (৭) তিনি বলেন যে, “হিউম ও অন্যান্য ইংরেজরা যদি কংগ্রেসকে ‘সেফটি ভালভ’ হিসেবে ব্যবহার করবেন বলে আশা করে থাকেন, তাহলে কংগ্রেস নেতারাও হিউমকে ‘লাইটনিং কণ্ডাকটর’ বা বিদ্যুৎ পরিবাহী হিসেবে ব্যবহার করবেন বলে আশা করেছিলেন।”
  • (৮) ডঃ বিপান চন্দ্র আরও বলেন যে, “১৮৮৫ সালে ভারতীয় জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা কোনও আকস্মিক ঘটনা,বা কোনও ঐতিহাসিক দুর্ঘটনা ছিল না। এটা এক রাজনৈতিক জাগরণের পরিণতি যার সূচনা হয়েছিল ১৮৬০ ও ১৮৭০-এর দশকের শেষদিকে ও ১৮৮০-র দশকের গোড়ায়।”
  • (৯) ডঃ অমলেশ ত্রিপাঠী হিউমকে কোনওভাবেই ‘ভারতীয় কংগ্রেসের জনক’ আখ্যা দিতে রাজি নন। তিনি বলেন যে, হিউম ডাফরিন সম্পর্কে নানা মনগড়া কথা বলতেন, উমেশচন্দ্রের কাছেও বলেছেন। তারই ওপর ভিত্তি করে উমেশচন্দ্র কংগ্রেসের জন্মকাহিনী লেখেন এবং সীতারামাইয়া, রজনীপাম দত্ত সবাই তা বিশ্বাস করে বসেন।
  • (১০) তাঁর মতে ভারতীয় নেতাদের সঙ্গে হিউম বা আমলাদের কখনোই জ্ঞানে-অজ্ঞানে কোনও ষড়যন্ত্র হয় নি। “হিউমের নানা স্বকপোলকল্পিত উক্তি ও তার ওয়েডারবার্ন-উমেশ বন্দ্যোপাধ্যায় কৃত ভাষ্য ইতিহাস বলে চলছে। তার ওপর নির্ভর করতে গিয়ে রজনীপাম দত্ত-ও ভুল করেছেন।”
  • (১১) অমলেশ ত্রিপাঠীর মতে, তখন ভারতবাসীর রাজনৈতিক চেতনা যেভাবে অগ্রসর হচ্ছিল “তাতে হিউম না থাকলেও কোনও-না-কোনও সর্বভারতীয় রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানের জন্ম হত। হয়তো তার কেন্দ্র হত কলকাতা, কর্তা–সুরেন্দ্রনাথ।”

ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠা

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দের ২৮শে ডিসেম্বর কলকাতার বিশিষ্ট আইনজীবী উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়-এর সভাপতিত্বে বোম্বাই শহরের গোকুলদাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজ হলে ৭২ জন প্রতিনিধি নিয়ে জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন (২৮ – ৩০শে ডিসেম্বর) বসে।

তারা চাঁদের অভিমত

ডঃ তারা চাঁদ বলেন যে, কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা হয়। জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা ভারত ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা উল্লেখযোগ্য ঘটনা।

প্রথম রাজনৈতিক ঐক্যের উদ্দোগ

এই সর্বপ্রথম কয়েকজন দৃঢ়চেতা ভারত-সন্তানের উদ্যোগে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্যের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করা হয় এবং তাঁরা বিদেশি সরকারকে জানিয়ে দেন যে তাঁরা আর বিদেশিদের হাতে ভারতের ভাগ্য ছেড়ে দিতে রাজি নন।

উপসংহার :- ডঃ তারা চাঁদ-এর মতে “কংগ্রেস ছিল দেশবাসীর আশা-আকাঙ্ক্ষার বহিঃপ্রকাশ।” কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে একদিকে দেশবাসীর ক্ষোভ ও বেদনার প্রকাশ ঘটে, আবার অন্যদিকে শৃঙ্খল মোচনের রণবাদ্য ধ্বনিত হয়।

(FAQ) ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রতিষ্ঠা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ভারতের জাতীয় কংগ্রেস কখন প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে।

২. ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের জনক কাকে বলা হয়?

অ্যালান অক্টোভিয়ান হিউম।

৩. ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম অধিবেশন কখন কোথায় অনুষ্ঠিত হয়?

২৮-৩০ ডিসেম্বর ১৮৮৫ খ্রিস্টাব্দে বোম্বাইয়ের গোকুল দাস তেজপাল সংস্কৃত কলেজে।

৪. ভারতের জাতীয় কংগ্রেসের প্রথম সভাপতি কে ছিলেন?

উমেশচন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায়।

৫. জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার সময় ভারতের গভর্নর জেনারেল কে ছিলেন?

লর্ড ডাফরিন।

৬. ভারতের জাতীয় কংগ্রেস প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য তত্ত্বটির নাম কি?

সেফটি ভালভ তত্ত্ব।

Leave a Comment