সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান

সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান প্রসঙ্গে চাচনামা, তহকিক-ই-হিন্দ কিতাব-উল-ইয়ামিনি, হাসান নিজামি, মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ, জিয়াউদ্দিন বরনী, আমীর খসরু, নাসিরুদ্দিন চিরাগ, মহম্মদ ইসামী, ইবন বতুতা, আফিফ ও ইউরোপীয় পর্যটকদের বিবরণ সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান

বিষয়সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান
তাজ-উল-মাসিরহাসান নিজামি
তবাকৎ-ই-নাসিরিমিনহাজ উদ্দিন সিরাজ
তারিখ-ই-ফিরোজশাহীজিয়াউদ্দিন বরনণী
খাজাইন-উল-ফুতুহআমীর খসরু
সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান

ভূমিকা :- প্রাচীন যুগের লিখিত ইতিহাসের সংখ্যা খুবই কম। তাই প্রাচীন যুগের ইতিহাস রচনায় প্রধানত প্রত্নতাত্ত্বিক উপাদান-এর উপর নির্ভর করতে হয়। কিন্তু মধ্য যুগের ক্ষেত্রে এই অসুবিধা নেই। কারণ, মুসলিম পণ্ডিতরা ছিলেন ইতিহাস সচেতন।

সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান চাচনামা

ভারত -এর সিন্ধুপ্রদেশে আরব বিজয়ের কাহিনী চাচনামা নামে গ্রন্থ থেকে জানা যায়। গ্রন্থটি আরবি ভাষায় রচিত। মীর মহম্মদ মাসুম রচিত তারিখ-ই-সিন্ধ গ্রন্থেও আরবদের সিন্ধু জয়ের কাহিনী পাওয়া যায়।

সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান তহকিক-ই-হিন্দ

  • (১) আলবিরুণীর তহকিক-ই-হিন্দ বা তারিখ-উল-হিন্দ একটি বিখ্যাত গ্রন্থ। সুলতান মামুদ-এর ভারত আক্রমণের প্রাক্কালে ভারতের অবস্থা এই গ্ৰন্থে পাওয়া যায়। আলবিরুণীর বর্ণনার নিরপেক্ষতা ও গভীরতা আধুনিক পাঠকের প্রশংসা পেয়েছে। তিনি বারাণসীতে সংস্কৃত ভাষা পড়েন।
  • (২) ভারতীয় ধর্ম, দর্শন সম্পর্কে তিনি চর্চা করেন। আলবিরুনির জন্মস্থান ছিল খিভ বা খারাজম রাজা। জ্ঞান-বিজ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় তাঁর অবাধ বিচরণ ছিল। ভারতের সামাজিক অবস্থা সম্পর্কে তার গ্রন্থটিকে এক আকর গ্রন্থ বলে মনে করা হয়। তাঁর রচনায় তিনি সংস্কৃত সাহিত্য থেকে বহু তথ্য দিয়েছেন।

সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান কিতাব-উল-ইয়ামিনি

সুলতান মামুদের সভাসদ উৎবির রচনা কিতাব-উল-ইয়ামিনি থেকে সুলতান মামুদের ভারত অভিযানগুলির বিবরণ পাওয়া যায়। উৎবি নিজে সুলতান মামুদের সঙ্গে ভারতে না আসায় তার দেওয়া বিবরণে বহু ভুল ভৌগোলিক তথ্য দেখা যায়। উৎবি ছিলেন গোঁড়া সুন্নী মুসলমান। এজন্য তাঁর রচনায় ধর্মীয় গোঁড়ামির ছাপ আছে। গ্রন্থটি আরবি ভাষায় লিখিত।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক হাসান নিজামি

  • (১) তাজ-উল-মাসির গ্ৰন্থটি হাসান নিজামি রচনা করেন। ১১৯২-১২২৮ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত বিভিন্ন ঘটনা এতে লিপিবদ্ধ হয়েছে। কুতুবউদ্দিন আইবকইলতুৎমিস-এর রাজত্বকালের প্রধান ঘটনাগুলি এতে পাওয়া যায়। হাসান নিজামি সমকালীন ঐতিহাসিক ছিলেন। তার বর্ণনায় অলঙ্কারের বহুলতা দেখা যায়।
  • (২) মহম্মদ ঘুরীর ভারত জয় থেকে ইলতুৎমিস পর্যন্ত ঐতিহাসিক ঘটনার জন্য তাজ-উল-মাসির প্রামাণ্য গ্রন্থ। হাসান নিজামির গ্রন্থটি আংশিক আরবী ও আংশিক ফারসীতে রচিত।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ

  • (১) মিনহাজ উদ্দিন সিরাজের রচনা তবকৎ-ই-নাসিরি হল মুসলিম দুনিয়ার ইতিহাস। এই ইতিহাসে মহম্মদ ঘুরীর ভারত জয় এবং বখতিয়ার খলজির বাংলা জয়-এর বিশ্বাসযোগ্য বিবরণ পাওয়া যায়।
  • (২) মিনহাজ দিল্লীর কাজী হিসাবে নিজে তথ্য সংগ্রহ করেন এবং কোনো কোনো ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী ছিলেন। তবে তার প্রভু ঘুরী বংশ ও ইলতুৎমিসের প্রতি তার পক্ষপাত তার রচনায় দেখা যায়। মিনহাজের রচনাটি ২৩টি অধ্যায়ে বিভক্ত। তিনি বহু দলিল দস্তাবেজ ঘেঁটে তার ইতিহাসটি রচনা করেন।

দিল্লির সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দিন বরণি

  • (১) গিয়াসউদ্দিন বলবন-এর আমল থেকে প্রামাণ্য ইতিহাসের জন্য জিয়াউদ্দিন বরণির বিখ্যাত রচনা তারিখ-ই-ফিরোজশাহী একটি অতি মূল্যবান গ্রন্থ। এই গ্রন্থটি বরণি ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর নামে উৎসর্গ করেন। বলবনের রাজত্বের আরম্ভ থেকে ফিরোজ তুঘলকের রাজত্বের গোড়ার দিকের ঘটনার কথা এই গ্রন্থে পাওয়া যায়।
  • (২) মিনহাজের দেওয়া বিবরণ সুলতান নাসিরউদ্দিন মহম্মদের রাজত্বকালে শেষ করা হয়। বরণীর ইতিহাস বলবনের রাজত্ব থেকে আরম্ভ হওয়ায় মিনহাজের রচনার সঙ্গে ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা অক্ষুণ্ণ থাকে। বরণী তাঁর গ্রন্থে সুলতানদের নীতি ও চরিত্রের বিচার করেছেন।
  • (৩) বরণী ছিলেন গোঁড়া মুসলমান। তার দৃষ্টিভঙ্গির নিরিখে তিনি সুলতানদের কাজগুলির ভাল ও মন্দ দিক বিচার করেছেন। যেহেতু তার দৃষ্টিভঙ্গি ধর্মনিরপেক্ষ ছিল না, সেহেতু বরণীর সিদ্ধান্ত সর্বদা নিরপেক্ষ হয় নি। বরণী তাঁর দেওয়া তথ্যগুলি যত্ন করে যোগাড় করেছেন।
  • (৪) তার মন্তব্য অনেক সময় আধুনিক গবেষকদের বিচারে পক্ষপাতদুষ্ট মনে হলেও, তাঁর সংগৃহীত তথ্যগুলি বিশেষ মূল্যবান। তারিখ-ই-ফিরোজশাহী থেকে ১২৫১-১৩৫২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত প্রায় এক শতাব্দীর ঐতিহাসিক তথ্য পাওয়া যায়।
  • (৫) বলবন থেকে ফিরোজ শাহ তুঘলক পর্যন্ত ধারাবাহিক ঐতিহাসিক বিবরণ বরণী দিয়েছেন। তবে বরণী সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলক-এর প্রতি ন্যায় বিচার করেননি। তিনি সন-তারিখগুলি নির্ভুল ভাবে দিয়েছেন। তাঁর বিবরণগুলি বেশ যত্ন সহকারে লিখিত এবং তিনি প্রতি ঘটনার ঐতিহাসিক বিশ্লেষণ করেছেন।
  • (৬) বরণীর অপর গ্রন্থ হল ফতোয়া-ই-জাহান্দারী। এই গ্রন্থে বরণী রাজ্যশাসন নীতি সম্পর্কে তার অভিমত ব্যক্ত করেছেন এবং ইলতুৎমিস ও বলবনের শাসননীতিকে উদাহরণ হিসেবে ব্যবহার করেছেন। বরণীর রচনায় শাসনতান্ত্রিক তথ্য বেশী পাওয়া যায়। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ঘটনাকেই তিনি উপজীব্য করেননি।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক আমীর খসরু

  • (১) সুলতানী যুগের অপর প্রসিদ্ধ ঐতিহাসিক ও কবি ছিলেন আমীর খসরু। তিনি ছিলেন সুলতানী দরবারের সভাসদ, সভাকবি ও উচ্চ কর্মচারী। সুতরাং সরকারের বিভিন্ন নীতির সঙ্গে তাঁর কিছুটা পরিচয় ছিল। বহু ঘটনা তিনি নিজ চক্ষে দেখেছেন। এই কারণে তাঁর বিবরণের বিশেষ গুরুত্ব আছে।
  • (২) আমীর খসরু ছিলেন মূলত কবি ও সাহিত্যিক। তাই তার রচনায় সর্বদা ঐতিহাসিক নিরপেক্ষতা ছিল না। কাজেই তিনি সর্বদা তাঁর পৃষ্ঠপোষক দিল্লি সুলতানের অতিরিক্ত প্রশংসা করেছেন। সুলতানের দোষ ত্রুটিগুলি তাঁর রচনায় পাওয়া যায়নি।
  • (৩) আমীর খসরুর রচনা ইজাজ-ই-খসরুভি একটি বিশিষ্ট রচনা। এতে কয়েকটি সুলতানি চিঠি ও ফর্মান পাওয়া যায়। তার বিখ্যাত গ্রন্থ খাজাইন-উল-ফুতুহতে আলাউদ্দিন খলজির দক্ষিণী অভিযান, তার সংস্কার ও মোঙ্গল আক্রমণের বিবরণ পাওয়া যায়।
  • (৪) তাঁর ‘আশিকা বা মসনভি নামক কবিতাগুলিতে আলাউদ্দিন খলজির পুত্র খিজির খাঁ ও দেবলাদেবীর প্রেম কাহিনীর বিবরণ পাওয়া যায়। কিরান-উস-সাদাইন হল কাইকোবাদ-এর সঙ্গে বুঘরা খাঁর সাক্ষাতের বিবরণ।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক নাসিরুদ্দিন চিরাগ

তৎকালীন সুফী সন্ত শেখ নাসিরুদ্দিন চিরাগের খয়ের-উল-মজলিশ গ্রন্থ থেকে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি, মোঙ্গল আক্রমণে দিল্লীর অবস্থা ও আলাই যুগে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে বহু তথ্য পাওয়া যায়।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক মহম্মদ ইসামী

  • (১) চতুর্দশ শতকের খ্যাতনামা ঐতিহাসিক হলেন মহম্মদ ইসামী। তার গ্রন্থটির নাম হল ফুতুহ-উস-সালাতিন। ১৩৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই গ্রন্থ রচনা সমাপ্ত হয়। এই গ্রন্থে সুলতান মামুদের আমল থেকে মহম্মদ বিন তুঘলকের আমল পর্যন্ত ঘটনার বর্ণনা পাওয়া যায়।
  • (২) ইসামির রচনা দুটি কারণে বেশ গুরুত্বপূর্ণ। মিনহাজের রচনা তরকৎ-ই-নাসিরী এবং বরণীর রচনা তারিখ-ই-ফিরোজ শাহীর মধ্যে ইসামীর রচনা যোগ সূত্র হিসেবে কাজ করে। মিনহাজ যেখানে তার রচনা শেষ করেন তা হল নাসির উদ্দিন মহম্মদের রাজত্বের গোড়ার দিক। বরণী বলবনের আমল থেকে শুরু করেন। এই ফাঁকটি ইসামীর রচনার দ্বারা পূরণ হয়েছে।
  • (৩) ইসামীর রচনা থেকে সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের দেবগিরিতে রাজধানী স্থানান্তর-এর বিবরণ পাওয়া যায়। সেই সময় থেকে ইসামী দেবগিরিতেই বসবাস করতেন।

সুলতানি যুগে ভারতে আগত পর্যটক ইবন বতুতা

ইবন বতুতার রচনা কিতাব-উল-রেহলা তুঘলক যুগের ইতিহাস রচনার জন্য মূল্যবান উপাদান। গ্রন্থটি আরবি ভাষায় লিখিত। সুলতান মহম্মদ বিন তুঘলকের রাজত্বকাল সম্পর্কে এই গ্ৰন্থটি একটি আকর গ্রন্থ বিশেষ। সমকালীন সমাজ ও অর্থনীতির ওপর গ্ৰন্থটিতে তথ্য পাওয়া যায়।

সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক আহমদ শিরহিন্দি

ইয়াহিয়া বিন আহমদ শিরহিন্দির রচনা তারিখ-ই- মুবারকশাহীতে এমন অনেক তথ্য আছে, যা অন্য কোনো গ্রন্থে নেই।

দিল্লির সুলতানি যুগের ঐতিহাসিক সিরাজ আফিফ

  • (১) শামস-ই-সিরাজ আফিফের রচনা তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের রাজত্বকালের বহু বিবরণ পাওয়া যায়। আফিফ সুলতান ফিরোজশাহ তুঘলকের বিশ্বাসভাজন ছিলেন। ফিরোজের মৃত্যুর পর তৈমুর লঙের ভারত আক্রমণকালে তিনি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গ্রন্থটি রচনা করেন।
  • (২) ফিরোজ তুঘলকের সংস্কারগুলির পটভূমিকা আফিফের গ্রন্থে সঠিকভাবে আলোচিত হয়েছে। আফিফ সমকালীন সমাজজীবনের ওপরেও তাঁর গ্রন্থে আলোকপাত করেছেন। ইলিয়টের (Elliot) মতে আইন-ই-আকবরীর আগে আফিফের মত আর কোনো লেখক এত বিশ্লেষণ মূলক ইতিহাস লেখেন নি।

সুলতানি যুগে ভারতে আগত কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক

সুলতানি যুগে কয়েকজন ইউরোপীয় পর্যটক ভারত ভ্রমণ করেন। তাদের রচনা থেকে বহু ঐতিহাসিক তথ্য বিশেষত সামাজিক ও অর্থনৈতিক তথ্য পাওয়া যায়। যেমন –

(১) মার্কোপোলো

ভিনিসীয় পর্যটক মার্কোপোলো ত্রয়োদশ শতকে দক্ষিণ ভারতে আসেন। দক্ষিণের রাজ্যগুলি সম্পর্কে তার বিবরণ মূল্যবান।

(২) নিকলো কন্টি

নিকলো কন্টি ১৪২০ খ্রিস্টাব্দে বিজয়নগর ভ্রমণ করেন। বিজয়নগর সাম্রাজ্য-এর সামাজিক, রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার কথা তাঁর রচনা থেকে জানা যায়।

(৩) বারবোসা ও পায়েজ

পর্তুগীজ পর্যটক বারবোসা ও দামিনগো পায়েজ বিজয়নগর রাজ্য ভ্রমণ করে তাদের অভিজ্ঞতা লিপিবদ্ধ করেন।

উপসংহার :- ফিরোজশাহের নিজের প্রচলিত ফুতুহ-ই-ফিরোজশাহী একটি ঘোষণাপত্র। এর থেকে তার ধর্মনীতির কথা জানা যায়। পাঠান বা আফগান যুগের ইতিহাসের জন্য তারিখ-ই-শেরশাহী ও নিয়ামত উল্লাহের রচনা মাখজাম-ই-আফগান উল্লেখ্য।

(FAQ) সুলতানি যুগের ইতিহাসের উপাদান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন গ্ৰন্থ থেকে আরবদের সিন্ধু জয়ের কথা জানা যায়?

চাচনামা।

২. তাজ-উল-মাসির গ্ৰন্থটি রচনা করেন কে?

হাসান নিজামি।

৩. তবাকৎ-ই-নাসিরী কার লেখা?

মিনহাজ উদ্দিন সিরাজ।

৪. জিয়াউদ্দিন বরণীর লেখা দুটি গ্ৰন্থের নাম লেখ।

তারিখ-ই-ফিরোজশাহী, ফতোয়া-ই-জাহান্দারী।

৫. আমীর খসরুর লেখা দুটি গ্ৰন্থের নাম লেখ।

খাজাইন-উল-ফুতুহ, কিরান-উস-সাদাইন।

Leave a Comment