সুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

সুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা প্রসঙ্গে ধনসম্পদ জমা, কৃষি, ইবন বতুতার বর্ণনা, ধান রপ্তানি, চিনি রপ্তানি, শিল্প, বাণিজ্য, বাণিজ্য বন্দর, রপ্তানি দ্রব্য, আমদানি দ্রব্য ও মুদ্রা ব্যবস্থা সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা
সম্পদের প্রধান উৎসকৃষি
বন্দরসপ্তগ্ৰাম, চট্টগ্ৰাম
রপ্তানিসুতী বস্ত্র, চিনি, মরীচ
আমদানিঘোড়া
সুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

ভূমিকা :- সুলতানি যুগে বাংলায় মাঝে মাঝে দিল্লীর আধিপত্য স্থাপিত হলেও বেশীর ভাগ সময় বাংলায় স্বাধীন সুলতানি বিদ্যমান ছিল।

ধনসম্পদ জমা

বাংলায় স্বাধীন সুলতানি থাকায় বাংলার ধনসম্পদ কর হিসেবে বাংলার বাইরে না গিয়ে বাংলায় জমা হয়। সুলতানি যুগে বাংলা খুব সমৃদ্ধশালী দেশ ছিল।

সুলতানি যুগে বাংলার কৃষি

বাংলার সম্পদের প্রধান উৎস ছিল তার উর্বরা জমি ও কৃষি। বাংলার জমিতে ধান, পাট ছাড়া কলাই, গম, তরিতরকারী, নানাবিধ ফল বিশেষত আম, জাম, নারকেল, কলা প্রভৃতি ফলত। বাংলার মাটিতে সুপারী ও তামাকও ফলত।

সুলতানি যুগে বাংলার কৃষি সম্পর্কে ইবন বতুতার বর্ণনা

ইবন বতুতা বাংলায় এত ধান ফলতে দেখেন যে তাঁর মিশর দেশের কথা মনে পড়েছিল।

সুলতানি যুগে বাংলার ধান রপ্তানি

বাংলায় প্রচুর ধান উৎপাদন হত। এই ধান মসুলিপত্তন, করমন্ডল উপকূল, সিংহল ও মালদ্বীপে রপ্তানি হত।

সুলতানি যুগে বাংলার চিনি রপ্তানি

বাংলার আখ ও আখ থেকে গুড় ও চিনির বিশেষ উৎপাদন হত। এই চিনি ভারত-এর বিভিন্ন অঞ্চলে ও বাইরে রপ্তানি হত। বাংলার চিনি দক্ষিণ ভারতে ও পশ্চিম এশিয়ায় রপ্তানি হত।

সুলতানি যুগে বাংলায় ঘি, মাখন উৎপাদন

বাংলায় ঘি, মাখনেরও প্রচুর উৎপাদন হত। বাংলার মাখন বিদেশে রপ্তানি হত।

সুলতানি যুগে বাংলার শিল্প

  • (১) বাংলার বীরভূম জেলায় লোহার খনি ছিল। মল্লারপুর ও কৃষ্ণনগরেও লোহার খনি ছিল। লবণ, গালা, আফিম, নীল প্রভৃতি দ্রব্যও বাংলায় উৎপন্ন হত। দক্ষিণ বাংলায় সমুদ্রের লোনা জল থেকে প্রচুর লবণ তৈরি করা হত। বাংলায় রেশম ও রেশমের বস্ত্র উৎপাদন ছিল এক বিখ্যাত শিল্প।
  • (২) যদিও ইবন বতুতা বাংলায় রেশমের কথা বলেন নি তবুও অন্য সূত্র থেকে বাংলার রেশম বস্ত্র ও মসলিনের কথা বিশেষভাবে জানা যায়। ১৪৩৭ খ্রিস্টাব্দে চীনা পর্যাটক মা-হুয়ান বাংলায় রেশমের গুটিপোকা চাষের জন্য তুত গাছের চাষ ব্যাপকভাবে লক্ষ্য করেন।
  • (৩) বাশের চোঙায় ভরে সূক্ষ্ম মসলিন কাপড় বিদেশে রপ্তানি হত। বাংলার সুতীবস্ত্রের শিল্পও বিশেষ বিখ্যাত ছিল। বাংলার সুতী কাপড় ভারতে ও ভারতের বাইরে রপ্তানি হত। বাংলার মিহিসুতার সুতী কাপড়ের চাহিদা বাংলার বাইরে এমনকি ভারতের বাইরেও ছিল। ভাল মসলিনের কাপড়ের বহু দাম ছিল।
  • (৪) কাঁসা, পিতলের শিল্প, সোনা ও রূপার অলঙ্কার শিল্প, কাঠখোদাই-এর কাজ বাংলায় ভাল রকম চলত। গ্রামের লোহা ও মাটির জিনিষের চাহিদা মেটাতে কামার ও কুমোররা লোহা ও মাটির জিনিষ তৈরি করত।
  • (৫) শাখের জিনিষ, গহনা তৈরি ছিল বাংলার আর একটি বড় শিল্প। প্রতি হিন্দু বাড়ির সধবা বিবাহিতা নারীরা শাঁখের তৈরি বালা বা শাখা পরত। বাংলার নৌ নির্মাণ শিল্প বিখ্যাত ছিল। গাম্ভারী কাঠের তৈরি নৌকায় সমুদ্র পাড়ি দেওয়া হত।

সুলতানি যুগে বাংলার বাণিজ্য বন্দর

বাংলার বন্দরগুলির মধ্যে সপ্তগ্রাম ছিল সমৃদ্ধশালী বন্দর। পরে চট্টগ্রামও বাণিজ্যের কেন্দ্রে পরিণত হয়। বাংলার সপ্তগ্রাম, চট্টগ্রাম প্রভৃতি বন্দর থেকে দক্ষিণ ভারতের কোরামন্ডল ও অন্ধ্রের মসুলিপত্তন এবং সিংহল দেশের সঙ্গে বাণিজ্য চলত।

সুলতানি যুগে বাংলার বাণিজ্য

  • (১) সাহসী বণিকরা সমুদ্রে ‘ডিঙা’ বা মালবাহী জাহাজ ভাসিয়ে মালয়, সুমাত্রা এমন কি চীনের উপকূল পর্যন্ত পাড়ি দিত। বাংলার সুলতানরা চীনের সঙ্গে বাণিজ্য বৃদ্ধির আশায় চীন সম্রাটের দরবারে উপঢৌকন সহ কয়েকবার দূত পাঠান।
  • (২) বাংলার বণিক বা সওদাগররা ভারত মহাসাগর পাড়ি দিয়ে, ভারতের পশ্চিম উপকূলে গুজরাট পত্তনে বাণিজ্যে যেত। বিজয় গুপ্তের মনসামঙ্গলে একথা বলা হয়েছে। এছাড়া স্থলপথে আভ্যন্তরীণ বাণিজ্য চলত।
  • (৩) গিয়াসুদ্দিন আইওয়াজ খলজি চাঁদপুর থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এক দীর্ঘ বাঁধ তৈরি করেন। একদিকে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ করলেও, এই বাঁধ পথের কাজ করে। দূরবর্তী স্থানে মাল পাঠাতে গরুর গাড়ি ব্যবহার করা হত। সাধারণ লোকে পায়ে অথবা ঘোড়ায় চড়ে যেত।
  • (৪) ভারতের অন্যান্য প্রদেশের সঙ্গে বাংলার বাণিজ্যের প্রধান বাধা ছিল মুদ্রা বিনিময়ের অসুবিধা এবং অন্য প্রদেশের শাসকশ্রেণীর উৎপীড়ন। এতসব বাধা সত্ত্বে অন্তর্ভারতীয় বাণিজ্যে বাংলার বিশেষ স্থান ছিল। বাংলার চিনি, মসলিন ছাড়া উত্তর ভারতের সম্পন্ন লোকেদের চলত না।

সুলতানি যুগে বাংলার রপ্তানি দ্রব্য

বাংলা থেকে প্রধানত সুতী বস্ত্র, চাউল, সাবান, চিনি, গুড়, সুপারি, মরিচ প্রভৃতি দ্রব্য রপ্তানি হত। বাংলার মসলিনের সর্বত্র চাহিদা ছিল।

সুলতানি যুগে বাংলার আমদানি দ্রব্য

বাংলায় ভাল ঘোড়া বাইরে থেকে আমদানি করা হত। বখতিয়ার খলজি ঘোড়া বিক্রেতার ছদ্মবেশে নদীয়ায় ঢুকে ছিলেন বলে জানা যায়। আরবী ঘোড়া ছাড়া, দক্ষিণ চীনের ভাল জাতের ঘোড়া বাংলায় আমদানি করা হত।

সুলতানি যুগে বাংলার মুদ্রা ব্যবস্থা

সুলতানি যুগে বাংলায় সুলতানি মুদ্রাই চলত। রূপার মুদ্রা বা টঙ্ক-এর ওজন ছিল ১/১২ আউন্স। খুচরা কেনা-বেচার জন্য কড়ি ব্যবহার করা হত। ২৫০০ কড়ি সমান ছিল এক টঙ্ক।

উপসংহার :- বাংলায় অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি থাকলেও, সমাজে ধনবণ্টন না থাকায় ধনী ও দরিদ্রের পার্থক্য ছিল বিস্তর। ভূস্বামী, সুলতানি কর্মচারী ও সওদাগর শ্রেণী যথেষ্ট ধনবান ছিল। সাধারণ কৃষক ছিল করভাবে নিষ্পিষ্ট। তারা খড়ের চালার নীচে দীনভাবে দিন কাটাত।

(FAQ) সুলতানি যুগে বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলার সম্পদের প্রধান উৎস কি?

কৃষি।

২. বাংলা থেকে কি কি দ্রব্য রপ্তানি করা হত?

সুতী বস্ত্র, চাউল, সাবান, চিনি, গুড়, সুপারি, মরিচ প্রভৃতি।

৩. বাংলার কোন বস্ত্রের সর্বত্র চাহিদা ছিল?

মসলিন।

Leave a Comment