একজন প্রখ্যাত বাঙালি চিকিৎসক, সমাজসংস্কারক ও বিজ্ঞানপ্রেমী ছিলেন মহেন্দ্রলাল সরকার (১৮৩৩–১৯০৪)। তিনি কলকাতা জেনারেল অ্যাসেম্বলি ইনস্টিটিউশন থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে ডিগ্রি অর্জন করেন এবং পরে ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান, ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS) প্রতিষ্ঠা করেন। বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের মধ্যে জনপ্রিয় করতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সমাজে প্রগতিশীল চিন্তাধারা প্রচার ও বিজ্ঞানশিক্ষার প্রসারে তাঁর অবদান উল্লেখযোগ্য।
ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার
ঐতিহাসিক চরিত্র | মহেন্দ্রলাল সরকার |
জন্ম | ২ নভেম্বর ১৮৩৩ খ্রি |
জন্মস্থান | কলকাতা, ব্রিটিশ ভারত |
পেশা | চিকিৎসক, সমাজসংস্কারক, বিজ্ঞান প্রচারক |
ডিগ্রি | এম ডি |
গুরুত্বপূর্ণ অবদান | IACS প্রতিষ্ঠা |
প্রভাবিত ক্ষেত্র | বিজ্ঞান, সমাজসংস্কার, শিক্ষা |
বিশেষ পরিচিতি | হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রবক্তা |
উল্লেখযোগ্য উদ্যোগ | বিজ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার চেষ্টা |
মৃত্যু | ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৪ খ্রি |
মহেন্দ্রলাল সরকার
ভূমিকা :- আমাদের দেশ ভারতবর্ষ-এ নতুন যুগের সমাজসচেতন, জাতীয়তাবাদী ও মুক্তবুদ্ধির অন্যতম পথিকৃৎ ছিলেন ডাঃ মহেন্দ্রলাল সরকার। তাঁর সত্যানুরাগ ছিল প্রবাদের মতো। তাঁর দৃঢ় চিত্ততা ও প্রত্যক্ষ উদ্যোগে এদেশে বিজ্ঞান শিক্ষা ও চর্চার পথ সুগম হয়েছিল।
মহেন্দ্রলাল সরকারের জন্ম
১৮৩৩ খ্রিস্টাব্দে ২রা নভেম্বর ব্রিটিশ ভারতের হাওড়া জেলার পাইকপাড়া গ্রামে মহেন্দ্রলালের জন্ম।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ছেলেবেলা
ছেলেবেলা থেকেই নিরন্তর সংগ্রামের মধ্য দিয়ে তাঁকে চলতে হয়েছিল। পিতা তারকনাথকে হারিয়েছিলেন শিশু বয়সেই। শিশুপুত্রকে নিয়ে মা আশ্রয় নিয়েছিলেন কলকাতার নেবুতলায় পৈতৃক বাড়িতে। সেখানে আসার পর মাত্র বছর চারেক মায়ের স্নেহ সাহচর্য পেয়েছিলেন তিনি। মাও গত হলেন অত্যন্ত কম বয়সে। অনাথ মহেন্দ্রলালের লালন-পালনের দায়িত্ব নিলেন তাঁর দুই মামা ঈশ্বরচন্দ্র ঘোষ ও মহেন্দ্রচন্দ্র ঘোষ। তাঁদের তত্ত্বাবধান ও যত্নে বড় হয়ে উঠতে লাগলেন অনাথ বালক।
মহেন্দ্রলাল সরকারের শিক্ষা
- (১) ডাক্তার মহেন্দ্রলালের শিক্ষা শুরু হয় স্থানীয় পাঠশালাতেই। ইংরাজী শেখাবার জন্য নিযুক্ত হয়েছিলেন এক গৃহশিক্ষক। এই গৃহশিক্ষকের নাম ছিল ঠাকুরদাস। মহেন্দ্রলাল তাঁকে অত্যন্ত শ্রদ্ধাভক্তি করতেন। ঠাকুরদাসের উৎসাহ ও প্রেরণাতেই বিজ্ঞান বিষয়ের প্রতি বিশেষ আগ্রহ জন্মেছিল তাঁর। পরবর্তীকালেও ঠাকুরদাসের প্রতি শ্রদ্ধা ভক্তি অটুট ছিল মহেন্দ্রলালের। যত দিন তিনি জীবিত ছিলেন মহেন্দ্রলাল তাঁকে উপযুক্ত মর্যাদাদানে ত্রুটি করেন নি।
- (২) সীমিত ক্ষমতার মধ্যেই তাঁর মামারা ভাগ্নেকে যুগোপোযোগী শিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলবার চেষ্টায় কার্পণ্য করেন নি। ইংরাজী শিক্ষায় কিছুটা অগ্রসর হলে তাঁরা তাঁকে ভর্তি করিয়ে দিলেন ডেভিড সাহেবের হেয়ার স্কুলে। এই মহাপ্রাণ শিক্ষাব্রতীর অনুগ্রহে এখানে অবৈতনিক ছাত্র হিসাবে শিক্ষালাভের সুযোগ পেয়েছিলেন বালক মহেন্দ্রলাল।
- (৩) পড়াশুনায় বরাবরই ভাল ছিলেন মহেন্দ্রলাল। অদম্য কৌতূহল ও অনুসন্ধিৎসা তাঁকে নতুন নতুন বিষয়ের প্রতি আগ্রহী করে তুলত। বিজ্ঞানের প্রতি আকর্ষণই ছিল প্রবল। ১৮৩৯ খ্রিস্টাব্দে প্রবেশিকা পরীক্ষায় বৃত্তি পেয়ে উত্তীর্ণ হন। উচ্চতর শিক্ষা অর্জনের জন্য এরপর ভর্তি হলেন হিন্দু কলেজে।
- (৪) সেইকালে দেশে বিজ্ঞান চর্চার প্রসার বিশেষ ছিল না। হিন্দু কলেজেও বিজ্ঞান পড়ার তেমন সুযোগ ছিল না। কিন্তু মহেন্দ্রলালের অজানা বিষয়কে বিজ্ঞানের আলোয় দেখার আগ্রহ এতই প্রবল হয়ে উঠেছিল যে কলেজের পাঠ্যপুস্তকের নির্ধারিত বিষয় তাঁকে তৃপ্ত করতে পারত না। চেষ্টা চরিত্র করে তিনি বিজ্ঞান বিষয়ের বই সংগ্রহ করে পড়তে লাগলেন। তাতে জ্ঞানস্পৃহা আরও বেড়ে গেল।
চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার
হিন্দু কলেজের পড়া শেষ হলে কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেন মহেন্দ্রলাল। সেখানে ছয় বছর পড়াশুনা করে ১৮৬১ খ্রিস্টাব্দে আই এম এস এবং ১৮৬৩ খ্রিস্টাব্দে এম. ডি. পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে চিকিৎসক হলেন। তাঁর আগে ভারতীয় ছাত্রদের মধ্যে একমাত্র ডাঃ চন্দ্রকুমার দে এম. ডি উপাধি পেয়েছিলেন ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে। মহেন্দ্রলাল এবং জগবন্ধু বসু ছিলেন কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের দ্বিতীয় এম. ডি।
মহেন্দ্রলাল সরকার চিকিৎসা জগতের অন্যতম ব্যক্তিত্ব
মেডিকেল শিক্ষা সমাপ্ত করে মহেন্দ্রলাল স্বাধীন ভাবে চিকিৎসা পেশায় আত্মনিয়োগ করেন। কলকাতার দ্বিতীয় এম. ডি হিসাবে সুচিকিৎসার গুণে অল্পদিনের মধ্যে তাঁর পশার জমে উঠল। চিকিৎসক হিসেবে খ্যাতি ছড়িয়ে পড়লে অচিরেই চিকিৎসা জগতে হয়ে উঠলেন অন্যতম ব্যক্তিত্ব।
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা সম্পর্কে মহেন্দ্রলাল সরকারের বক্তৃতা
সেই সময় ডা: সূর্যকুমার চক্রবর্তীর উদ্যোগে কলকাতায় British Medical Association-এর শাখা গড়ে ওঠে। মহেন্দ্রলাল হয়েছিলেন প্রথমে তার সেক্রেটারি ও পরে সহ সভাপতি। সমিতির প্রতিষ্ঠা উৎসব উপলক্ষে অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার গুণাগুণের প্রশংসা করে মহেন্দ্রলাল এক সারগর্ভ বক্তৃতা দেন। তাঁর যুক্তিনিষ্ঠ বক্তব্য ও বাগ্মীতায় উপস্থিত শ্রোতৃবর্গ মুগ্ধ হয়েছিলেন।
ডাঃ রাজেন্দ্র দত্ত ও মহেন্দ্রলাল সরকারের মধ্যে তর্ক
একজন অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসক হিসেবে স্বাভাবিক ভাবেই মহেন্দ্রলাল এই সময় হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীর প্রসঙ্গ উত্থাপন করে সমালোচনা করেছিলেন। তখনকার কলকাতা শহরে হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের অভাব ছিল না। ডাঃ রাজেন্দ্র দত্ত ছিলেন তাঁদের মধ্যে অগ্রগণ্য। লোকপরম্পরায় মহেন্দ্রলালের সমালোচনার কথা তিনি জানতে পারলেন। ডাঃ মহেন্দ্রলালের সঙ্গে ডাঃ দত্তের পূর্ব থেকেই পরিচয় ছিল। একদিন উভয়ের সাক্ষাৎ হলে ডাঃ দত্ত মহেন্দ্রলালের সে দিনের সভায় হোমিওপ্যাথি বিষয়ে বিভিন্ন উক্তির বিরোধিতা করেন। দুজনেই নিজেদের বিষয়ে বিশেষজ্ঞ। অতএব তাঁদের আলোচনা বিচারে পর্যবসিত হতে বিলম্ব হল না। তর্ক বিতর্ক বিচারের জের চলল কয়েকদিন ধরে।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক মহেন্দ্রলাল সরকার
- (১) ইতিমধ্যে ঘটল অন্য এক ঘটনা। মর্গ্যান নামে এক প্রসিদ্ধ চিকিৎসকের ফিলজফি অব হোমিপ্যাথি নামে একটি বই ঘটনাচক্রে এসে পড়ল মহেন্দ্রলালের হাতে। সেইকালে ইণ্ডিয়ান ফিল্ড নামে একটি পত্রিকা প্রকাশিত হত কিশোরীচরণ মিত্র মহাশয়ের সম্পাদনায়। সেই পত্রিকায় প্রকাশের জন্য উক্ত বইটি সমালোচনার ভার পেলেন মহেন্দ্রলাল।
- (২) বইটি পড়তে গিয়ে চমৎকৃত হলেন তিনি। তার মধ্যে তাঁর অজ্ঞাত বেশ কিছু তথ্যের সন্ধান পেলেন। বিষয়গুলি সম্পর্কে ভালভাবে না জেনে কোনো সমালোচনামূলক মন্তব্য প্রকাশ তাঁর কাছে অসমীচীন বোধ হল। বাধ্য হয়ে তিনি হোমিওপ্যাথি বিষয়ে বিশেষজ্ঞ ডাঃ রাজেন্দ্র দত্তের শরণাপন্ন হলেন। বিষয়গুলো সম্পর্কে পরিষ্কার ধারণা না পাওয়া পর্যন্ত তিনি স্বস্তি পাচ্ছিলেন না।
- (৩) মহেন্দ্রলালের বিনম্র আগ্রহ ও মনোভাব লক্ষ্য করে আনন্দিত হলেন ডাঃ দত্ত। কয়েকটি কঠিন রোগের হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ফলাফল দেখাবার জন্য মহেন্দ্রলালকে সঙ্গে নিয়ে তিনি বিভিন্ন রোগীর অবস্থা দেখালেন। মহেন্দ্রলাল আগ্রহ সহকারে রোগীদের নিজস্ব বিধিমতেই পরীক্ষা করলেন এবং তাদের ওপর হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার ফলাফল অত্যন্ত সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করতে লাগলেন।
- (৪) যথা সময়েই নিজস্ব পদ্ধতির ভুলত্রুটিগুলি তাঁর চোখে ধরা পড়ল। তিনি তাঁর মত পরিবর্তন করতে বাধ্য হলেন। তাঁর প্রতীতি হল বিভিন্ন রোগে জার্মান ডাক্তার হ্যানিম্যানের উদ্ভাবিত প্রণালী যুক্তিসম্মত এবং বিশ্বাসযোগ্য। এই ঘটনার প্রভাবে চিকিৎসক হিসাবে মহেন্দ্রলালের ধ্যানধারণার আমূল পরিবর্তন ঘটে গেল। তিনি হয়ে উঠলেন হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসাপ্রণালীর সমর্থক ও পৃষ্ঠপোষক।
সত্যানুরাগী মহেন্দ্রলাল সরকার
কলকাতা শহরের একজন লব্ধপ্রতিষ্ঠ অ্যালোপ্যাথির চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল। এই অবস্থায় নিজের পশার প্রতিপত্তি স্বাচ্ছন্দ্য বজায় রাখার উদ্দেশ্যে তিনি নির্বিকার চিত্তে নিজের পরিবর্তিত বিশ্বাস মনে চেপে রাখতে পারতেন। অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে অন্য সুখ্যাত চিকিৎসকগণের ন্যায় করণীয় সব কিছুই বজায় রাখা অসম্ভব হত না। কিন্তু সত্যানুরাগে একনিষ্ঠ মহেন্দ্রলাল যা সত্য বলে জানতেন তা নির্দ্বিধায় বলতে বা করতে কখনো কুণ্ঠাবোধ করতেন না।
হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসার প্রতি মহেন্দ্রলাল সরকারের আস্থা
ব্যক্তিগত লাভলোকসানের নীচ চিন্তা তিনি কখনও মনে প্রশ্রয় দিতেন না। তিনি ছিলেন দৃঢ়চিত্ত ও স্বাধীনচেতা। তাই কারও বিরাগ উৎপত্তির তোয়াক্কা না করে তাঁর মত পরিবর্তন ও হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীর প্রতি আস্থার কথা চিকিৎসক বন্ধুদের জানাতে লাগলেন।
অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসার ত্রুটি নিয়ে মহেন্দ্রলাল সরকারের বক্তৃতা
কিছুদিনের মধ্যেই চিকিৎসক হিসেবে নিজস্ব প্রতিক্রিয়া প্রচার করবার বৃহত্তর সুযোগ উপস্থিত হল। ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দের ১৬ই ফেব্রুয়ারি অ্যাসোসিয়েশনের চতুর্থ বার্ষিক সভায় মহেন্দ্রলাল অ্যালোপ্যাথিক চিকিৎসা প্রণালীর বহুনিন্দিত কতগুলি ত্রুটি উল্লেখ করে সারগর্ভ বক্তৃতা করলেন। সেই সঙ্গে নির্ভীক চিত্তে সর্বসমক্ষে ডাঃ হ্যানিম্যানের আবিষ্কৃত প্রণালীর যুক্তিযুক্ততা প্রদর্শন করে তার ভূয়সী প্রশংসা করলেন।
মহেন্দ্রলাল সরকারের বহিস্কার
প্রকাশ্য সভায় মহেন্দ্রলালের দৃঢ় মতামত শোনার পরে বহু সাহেব ও ভারতীয় ডাক্তার যারপরনাই রুষ্ট হন। মহেন্দ্রলাল যখন উপস্থিত অন্যান্য ডাক্তারের প্রশ্নের উত্তর দিচ্ছিলেন, তখন জনৈক শ্বেতাঙ্গ ডাক্তার ওয়ালাহ এতটাই ক্রুদ্ধ হয়ে উঠলেন যে তিনি বারবার মহেন্দ্রলালের বক্তব্যে বাধার সৃষ্টি করতে লাগলেন। শেষপর্যন্ত চিৎকার করে বললেন যে ডাঃ সরকার যদি এই সংগঠনের সদস্য থাকেন এমনকি এই সভায় পর্যবেক্ষক হিসেবেও উপস্থিত থাকেন তাহলে তিনি এই সভা ও সংগঠন পরিত্যাগ করবেন। তখনকার সুখ্যাত চিকিৎসক ডাঃ চক্রবর্তী, ডাঃ ইওয়াট প্রমুখ অনেকেই ওয়ালাহ-এর বক্তব্য সমর্থন করে মহেন্দ্রলালের বহিষ্কার দাবি করতে লাগলেন। নিজের বিশ্বাসে অচল অটল দৃঢ়চিত্ত মহেন্দ্রলাল অম্লানবদনে সভা ত্যাগ করে বাড়ি ফিরে এলেন।
ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকারের ঐতিহাসিক শপথ
উক্ত ঘটনা প্রসঙ্গে পরে তিনি যা বললেন, তা এক ঐতিহাসিক শপথ হিসেবে আজও স্মরণীয় হয়ে আছে। তিনি বললেন, “আমি চাষার ছেলে, না হয় সামান্য কাজ করে খাব, তাতে কিছু এসে যাবে না। তবে যা সত্য তা অস্বীকার করতে পারব না। সত্য যা তা বলতেই হবে বা করতেই হবে।”
মহেন্দ্রলাল সরকারের প্রতি উৎপীড়ন
ডাক্তার মহেন্দ্রলালের বিশ্বাস মননশীলতা ও বক্তব্যের যুক্তিযুক্ততা নিয়ে সমিতির সদস্য ডাক্তারগণ মাথা ঘামালেন না। তাঁকে অবিলম্বেই সমিতি থেকে বহিষ্কার করা হল। কেবল তাই নয়, তাঁকে একঘরে করার জন্য নানা রকম উৎপীড়ন আরম্ভ হল। মেডিকেল কলেজের মিশনারি ডাক্তার ইওয়াট মহেন্দ্রলালের বিরুদ্ধে সংবাদপত্রে লিখতে আরম্ভ করলেন। অনেকে মহেন্দ্রলালের নিন্দা সূচক বক্তৃতাও করলেন। সেই সব বক্তব্য খবর হিসেবে সংবাদপত্রে ছাপা হতে লাগল। এসকল অপপ্রচারের ফল ফলতেও দেরি হল না। মহেন্দ্রলালের পসার বসে গেল। কোনও রোগীই তাঁর কাছে যেতে ভরসা পায় না।
পত্রিকা সম্পাদক মহেন্দ্রলাল সরকার
মহেন্দ্রলাল কিন্তু দমলেন না। সকল বিরুদ্ধতার বিপক্ষে নিজের সত্য মতামত প্রমাণ করার উদ্দেশ্যে এক বছরের মধ্যেই, ১৮৬৭ খ্রিস্টাব্দে প্রকাশ করলেন Calcutta Journal of Medicine পত্রিকা। এর মাধ্যমে তিনি নির্দ্বিধায় নিজের মতামত জনসাধারণকে জানাতে লাগলেন।
মহেন্দ্রলাল সরকারের ঘোর পরীক্ষা
এই সময় তাঁর ভূতপূর্ব অনেক প্রফেসরও তাঁর প্রতি রুষ্ট হয়েছিলেন। কিন্তু সত্য প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে তিনি সকল বিরূপ সমালোচনা ও নিন্দনীয় রটনা শান্ত ভাবে উপেক্ষা করেছিলেন। তিনি নিজে এই অবস্থাকে পরে ঘোর পরীক্ষা বলে উল্লেখ করে বলেছিলেন, ‘I was sustained by my faith in the ultimate triumph of truth.” সত্যের জয় অবশ্যম্ভাবী জেনেই তিনি নিজের বিশ্বাসে স্থির ও অটল ছিলেন। ভূতপূর্ব শিক্ষকদের প্রতিও অশ্রদ্ধেয় উক্তি কখনও করেন নি।
স্বীয় মনোভাব সম্পর্কে মহেন্দ্রলাল সরকারের বক্তৃতা
এক বক্তৃতায় স্বীয় মনোভাব ব্যক্ত করে তিনি বলেছিলেন, “Whatever may now have become the differences between my venerable preceptors of the Medical College and myself shall always look back with ecstacy and gratitude on those days when I used to be charmed by their elequence pregnant with the words of Science.”
মহেন্দ্রলাল সরকারের চেষ্টায় হোমিওপ্যাথি চিকিৎসার প্রসার
উল্লেখযোগ্য যে তাঁর সময়ে মহেন্দ্রলালই কালক্রমে সর্বশ্রেষ্ঠ হোমিওপ্যাথিক চিকিৎসকের সম্মান ও গৌরভ লাভ করেছিলেন। তাঁর সত্যানুরাগ ও অনমনীয় দৃঢ়তা দেশবাসীকে মুগ্ধ করেছিল। আজীবন হোমিওপ্যাথির প্রচারে নিজেকে নিয়োজিত রেখেছিলেন মহেন্দ্রলাল। এই কাজে তাঁকে যথোপযুক্ত সহায়তা করেছিলেন বিখ্যাত অক্রুর দত্তের পরিবারের রাজেন্দ্র দত্ত মহাশয়। বস্তুতঃ মহেন্দ্রলালের চেষ্টাতেই এদেশে হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা সমাদৃত ও প্রসার লাভ করেছিল।
IACS প্রতিষ্ঠায় মহেন্দ্রলাল সরকার
দেশহিতকর বহু কাজের মধ্য দিয়ে জাতির সেবায় প্রাণমন সমর্পণ করেছিলেন মহেন্দ্রলাল। তাঁরই প্রত্যক্ষ সাহায্যে ও অনুপ্রেরণায় এককালে ভারতবাসী বিশ্ববিজ্ঞান সভায় নিজেদের শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণের সুযোগ পেয়েছিল।দেশবাসীকে বিজ্ঞান চর্চায় উৎসাহিত ও সুযোগদানের উদ্দেশ্যে ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দের ১৫ জানুয়ারী কলকাতায় Indian Association for the Cultivation of Science প্রতিষ্ঠা করেছিলেন মহেন্দ্রলাল। এই বিজ্ঞান গবেষণা কেন্দ্র প্রতিষ্ঠা তাঁর অন্যতম শ্রেষ্ঠ কীর্তি।
জনসাধারণের সহযোগিতা প্রার্থনায় মহেন্দ্রলাল সরকার
ছয় বছর আগেই ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে এবিষয়ে জনসাধারণের সহযোগিতা প্রার্থনা করে মহেন্দ্রলাল হিন্দু প্যাট্রিয়ট কাগজে একটি প্রচারপত্র প্রকাশ করেছিলেন। দেশের জ্ঞানীগুণী ধনী অনেকেই এই মহৎ কাজে সাহায্য সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেন। উত্তরপাড়ার জমিদার জয়কৃষ্ণ মুখোপাধ্যায়, রাজা কমলকৃষ্ণ বাহাদুর, রাজা দিগম্বর মিত্র প্রমুখ অনেকেই টাকা দিয়ে সাহায্য করলেন। এ বিষয়ে সহযোগিতা পাওয়া গিয়েছিল সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজের পাদ্রী লাফো সাহেবের কাছ থেকেও। সাধারণ মানুষও তাঁদের সাধ্যানুযায়ী অর্থ সাহায্য করেছিলেন। সকলের সমবেত সাহায্যে এবং প্রধানত মহেন্দ্রলালের ব্যক্তিগত উদ্যোগে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেট হলে এক মহতী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে ভারতীয় বিজ্ঞানচর্চার সংস্থা প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেছিলেন তৎকালীন লাটসাহেব রিচার্ড টেম্পল। পরে সংস্থার সঙ্গে যুক্ত হয়ে নানা বিষয়ে সাহায্য করেছিলেন পণ্ডিত ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও অনুকূলচন্দ্র মুখোপাধ্যায়, দ্বারকানাথ মিত্র, রমেশচন্দ্র মিত্র প্রমুখ বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ।
IACS -এর কাজের সূত্রপাত
অ্যাসোসিয়েশনের কাজের সূত্রপাত হয়েছিল ২১০ নম্বর বৌবাজার স্ট্রিটের একটি বাড়িতে। পরবর্তীকালে কাজকর্মের প্রসার ঘটায় সংস্থাটি স্থানান্তরিত হয় যাদবপুরের একটি প্রশস্ত বাড়িতে। এখানে গড়ে ওঠে বিজ্ঞান বিষয়ক একটি পরীক্ষাগার ও আধুনিক বিজ্ঞানের একটি সমৃদ্ধ লাইব্রেরী।
Raman effect আবিষ্কার
বউবাজারের বাড়ির পরীক্ষাগারে গবেষণা করে দশ বছরের মধ্যেই ভারতের বিশিষ্ট পদার্থবিদ সি. ভি. রমন আলোর বিকিরণ তত্ত্ব আবিষ্কার করে ১৯২৫ খ্রিস্টাব্দে এফ আর এস হন। তাঁর আবিষ্কার আখ্যাত হয় Raman effect নামে। এই অবদানের জন্য ইংরাজ সরকার তাঁকে ১৯২৯ খ্রিস্টাব্দে স্যার উপাধি দিয়ে সম্মানিত করেন। ১৯৩১ খ্রিস্টাব্দে বিজ্ঞানে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতি জানিয়ে নোবেল কমিটি জগদ্বিখ্যাত নোবেল পুরস্কারে সম্মানিত করেন রমনকে। ভারত তথা সমগ্র এশিয়ার বিজ্ঞান সাধনা এভাবে বিশ্ব বিজ্ঞান ইতিহাসে শ্রেষ্ঠত্বের স্বীকৃত লাভ করেছিল।
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো মহেন্দ্রলাল সরকার
মহেন্দ্রলাল ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফেলো নিযুক্ত হলেন। ক্রমে সমাজ সংস্কারের কাজেও তাঁর হস্ত প্রসারিত হল।
ঠাকুর রামকৃষ্ণের চিকিৎসক মহেন্দ্রলাল সরকার
- (১) শহরের বিশিষ্ট হোমিওপ্যাথি চিকিৎসক হিসাবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ-এর ভক্তগণ তাঁর চিকিৎসার ভার ডাঃ সরকারের ওপর দেন। ঠাকুরকে রোগমুক্ত করার জন্য তিনি অক্লান্ত পরিশ্রম করেন। ঠাকুরের সংস্পর্শে আসার পর থেকে ডাঃ সরকারের আধ্যাত্মিক ধ্যানধারণারও পরিবর্তন ঘটে।
- (২) ঠাকুরের মনের অলৌকিক মাধুর্য ও প্রেম এবং তাঁর ভেতর থেকে অদৃষ্টপূর্ব আধ্যাত্মিক প্রকাশ ডাক্তার সরকার লক্ষ্য করতেন, তাতেই ধর্ম বিষয়ে তিনি প্রকৃত জ্ঞান লাভ করতে সক্ষম হন। এক বছর দুর্গাপূজার সন্ধিক্ষণে ঠাকুরের মধ্যে যে অলৌকিক বিভূতি প্রকাশ লাভ করে ডাক্তার সরকার তা প্রত্যক্ষ করেছিলেন।
- (৩) ভাবাবেশকালে ঠাকুরের স্পন্দনাদি যন্ত্রের সাহায্যে পরীক্ষা করে তাঁকে স্বীকার করতে হয়েছিল সম্পূর্ণ মৃতের ন্যায় প্রতীয়মান ঠাকুরের সমাধি অবস্থা সম্বন্ধে বিজ্ঞান কোনওরূপ আলোক এখনও পর্যন্ত প্রদান করতে অক্ষম। সাধ্যানুরূপ চেষ্টা সত্ত্বেও ঠাকুরের রোগ ডাঃ সরকার ভাল করতে পারেন নি।
মহেন্দ্রলাল সরকারের মৃত্যু
ঠাকুরের মহাপ্রয়াণের কয়েক বছর পরে ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দে ডাঃ সরকার নিজেই কঠিন রোগে আক্রান্ত হন। অবশেষে ১৯০৪ খ্রিস্টাব্দে ২৩শে ফেব্রুয়ারি তাঁর মৃত্যু হয়।
উপসংহার :- মহেন্দ্রলাল সরকার ছিলেন একজন দূরদৃষ্টিসম্পন্ন বিজ্ঞানপ্রেমী, সমাজসংস্কারক এবং চিকিৎসাবিদ, যিনি ভারতীয় সমাজে আধুনিক বিজ্ঞান এবং প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি বিশ্বাস করতেন, বিজ্ঞানই সমাজের উন্নতির মূল চাবিকাঠি। তাঁর প্রতিষ্ঠিত ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS) আজও ভারতের বিজ্ঞান গবেষণায় একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে বিদ্যমান। তার জীবন ও কাজ শুধুমাত্র তাঁর সময়ের জন্য নয়, বর্তমানেও প্রাসঙ্গিক। শিক্ষা, গবেষণা, এবং বিজ্ঞানমনস্কতা প্রসারে তাঁর অবদান ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে প্রেরণা জোগাবে। মহেন্দ্রলাল সরকার শুধু একজন চিকিৎসক ছিলেন না, তিনি ছিলেন জাতি গঠনের অগ্রদূত, যার প্রচেষ্টা ভারতীয় সমাজে অমর হয়ে থাকবে।
(FAQ) ডাক্তার মহেন্দ্রলাল সরকার সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
মহেন্দ্রলাল সরকারের সবচেয়ে বড় অবদান হল ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েশন ফর দ্য কাল্টিভেশন অব সায়েন্স (IACS) প্রতিষ্ঠা, যা ভারতের প্রথম বৈজ্ঞানিক গবেষণা প্রতিষ্ঠান।
তিনি কলকাতা মেডিকেল কলেজ থেকে চিকিৎসাশাস্ত্রে উচ্চশিক্ষা (এম.ডি.) অর্জন করেছিলেন।
তিনি IACS-এর মাধ্যমে বিজ্ঞান গবেষণা এবং জ্ঞানকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার জন্য কাজ করেছেন।
মহেন্দ্রলাল সরকার হোমিওপ্যাথি চিকিৎসা পদ্ধতির সমর্থক ছিলেন এবং তার প্রসারে ভূমিকা রেখেছেন।
তিনি সমাজে প্রগতিশীল চিন্তাধারার প্রচার করেন এবং শিক্ষা ও বিজ্ঞানচর্চার প্রসারে কাজ করেন।
তিনি সমাজে বিজ্ঞানচর্চার প্রসারের মাধ্যমে প্রগতিশীল আন্দোলনের অংশ ছিলেন, যা ভারতের স্বাধীনতা আন্দোলনের ভিত্তি গঠনে সহায়ক।
IACS-এর মূল লক্ষ্য ছিল ভারতের মধ্যে বিজ্ঞানচর্চা এবং গবেষণার প্রসার ঘটানো।