ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা

ফ্রান্সে ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা -র সময়কাল, নতুন শাসক, নতুন শাসকদের লক্ষ্য, দুর্নীতিগ্ৰস্থ শাসনকাল, ডিরেক্টরির শাসন সংগঠন, পঞ্চ রাজা, বাসকুল নীতি ৫ জন ডিরেক্টর, ডিরেক্টরদের দুই গোষ্ঠী, আর্থিক সংকট, বেবিউফের বিদ্রোহ, ডিরেক্টরি শাসনের পতন, ডিরেক্টরি শাসনের পতনের কারণ ও ডিরেক্টরি শাসনের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

ফ্রান্সে ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা (১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রি)

ঐতিহাসিক ঘটনাডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা
সময়কাল১৭৯৫-৯৯ খ্রিস্টাব্দ
পর্বফরাসি বিপ্লব
ডিরেক্টরবারাস, লা রেভেলিয়ে, লার্তুনায়ের, রিউবেলও কারনো
লক্ষ্যনিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা
আদর্শসংসদীয় গণতন্ত্র
ফ্রান্সে ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা

ভূমিকা:- অধ্যাপক ডেভিড থমসন বলেন যে, ডিরেক্টরির শাসন হল ফরাসি বিপ্লবের শেষ অধ্যায়। এই পর্বের নেতৃবৃন্দ বিপ্লবের ধ্বংসসাধনে সক্ষম হন।

নতুন শাসক

ফ্রান্স-এর নতুন শাসকরা ছিলেন শ্রেণিচরিত্র মধ্যপন্থী বুর্জোয়া। তাঁদের সমর্থকরা ছিলেন নব্য ধনী, ফাটকাবাজ, কন্ট্রাক্টর ও সম্পন্ন কৃষক।

নতুন শাসকদের লক্ষ্য ও আদর্শ

তাঁদের লক্ষ্য ছিল নিজেদের স্বার্থ সুরক্ষিত করা। তাঁরা রাজতন্ত্র এবং জনতার কর্তৃত্ব দুইয়েরই বিরোধী ছিলেন। তাঁদের আদর্শ ছিলসংসদীয় গণতন্ত্র।

দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনকাল

ডিরেক্টরির শাসনকাল হল ফরাসি বিপ্লবের ইতিহাসে সর্বাপেক্ষা প্রতিক্রিয়াশীল ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনকাল।

ডিরেক্টরির শাসন সংগঠন

বলা হয় যে, রাজতন্ত্রের গলিত অংশের সঙ্গে বুর্জোয়াতন্ত্রের গলিত অংশের মিলনে ডিরেক্টরির শাসন সংগঠিত হয়।

পঞ্চ রাজা

নতুন শাসকদের নৈতিক চরিত্রও ভালো ছিল না। পঞ্চ ডিরেক্টর নির্বাচিত সদস্যের মতো আচরণ না করে অচিরেই ‘পঞ্চ রাজায়’ পরিণত হন।

ডিরেক্টরি শাসকদের বাসকুল নীতি

নতুন শাসকরা প্রথম থেকেই দক্ষিণপন্থী রাজতন্ত্রী ও বামপন্থী জেকোবিনদের বিরোধিতার সম্মুখীন হন। এই অবস্থায় তাঁরা এই দুটি দলের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে চলার নীতি গ্রহণ করেন। এই নীতি ‘বাসকুল’ বা ভারসাম্য রক্ষার নীতি নামে পরিচিত। তাঁরা জানতেন যে, দক্ষিণ বা বামপন্থী কোনও পক্ষ শক্তিশালী হয়ে উঠলে নতুন সংবিধান ভেঙে যাবে।

ডিরেক্টরির শাসনে পাঁচজন ডিরেক্টর

নতুন সংবিধান অনুসারে যে পাঁচজন ডিরেক্টর নিযুক্ত হন, তাঁরা হলেন বারাস (Barras), লারেভেলিয়ে (La Revallier), লার্তুনায়ের (Letourneur), রিউবেল (Rewbell) ও কারনো (Carnot)। এঁরা সকলেই ষোড়শ লুইয়ের প্রাণদণ্ডের ব্যাপারে ভোট দেন। অধ্যাপক ডেভিড টমসন বলেন যে, ডিরেক্টরির পাঁচজন শাসক দুর্ভাগ্য নিয়ে তাঁদের শাসন শুরু করেন। ডিরেক্টরদের মধ্যে একমাত্র কারনো বাদে সকলেই ছিলেন অপদার্থ ও দুর্নীতিগ্রস্ত।

ডিরেক্টরদের দুই গোষ্ঠী

শুরু থেকে ডিরেক্টররা দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত ছিলেন। যথা –

  • (১) বারাস, রেভেলিয়ে ও রিউবেল ছিলেন বিপ্লবপন্থী। তাঁদের লক্ষ্য ছিল দেশত্যাগী অভিজাত, যাজক ও তাদের আত্মীয়-স্বজনদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা, ইউরোপীয় শক্তিগুলির বিরুদ্ধে যুদ্ধ অব্যাহত রাখা এবং ইউরোপ-এ ফরাসি বিপ্লবের আদর্শ ও ভাবধারা ছড়িয়ে দেওয়া।
  • (২)  অপরদিকে লার্তুনায়ের, কারনো এবং পাঁচশত পরিষদের সদস্যগণ ছিলেন সংবিধানপন্থী। এঁরা ক্লিচিয়েস (Clichions) নামেও পরিচিত ছিলেন। এঁরা যুদ্ধের অবসান ঘটিয়ে ফ্রান্সে সাংবিধানিক শাসনতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। এঁরা রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন না, কিন্তু সন্ত্রাসের শাসন-এর প্রতি ঘৃণাবশত তাঁরা নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পক্ষপাতী ছিলেন। এই কারণে শুরু থেকেই তাদের মধ্যে মতপার্থক্য ও স্ব-বিরোধিতা দেখা যায়, যা এই শাসনকে দুর্বল করে দেয়।

ডিরেক্টরির শাসনকালে আর্থিক সংকট

  • (১) ডিরেক্টরির শাসনকালে ফ্রান্সকে ভয়াবহ আর্থিক সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। সন্ত্রাসের আমলের নিয়ন্ত্রিত অর্থনীতি নয়- এই সরকার অবাধ অর্থনীতির সমর্থক ছিলেন। এর ফলে দ্রব্যমূল্য প্রবলভাবে বৃদ্ধি পায়, মুদ্রাস্ফীতি ঘটে এবং মুদ্রার মূল্য অভাবনীয় রূপে হ্রাস পায়।
  • (২) এই অবস্থায় ডিরেক্টরি ‘অ্যাসাইনেট নামক কাগজি মুদ্রা বাতিল করে ‘ম্যান্ডেট টেরিটারিয়ান’ নামক নতুন কাগজি মুদ্রা চালু করে।কিছুদিন পর এই মুদ্রাও অচল হয়ে যায়। সাধারণ মানুষ ধাতব মুদ্রার পরিবর্তে কাগজি মুদ্রা গ্রহণে অস্বীকৃত হয়।
  • (৩) এরপর নতুন ধাতব মুদ্রা চালু করা হয়। এতেও সমস্যার সমাধান হয়নি। দেশে যথেষ্ট পরিমাণ সোনা-রূপা না থাকায় মুদ্রার সংখ্যা হ্রাস পায়। এর ফলে দেশে মুদ্রা-সংকট দেখা দেয়।
  • (৪) ব্যবসা-বাণিজ্য অচল হয়ে পড়ে। অর্থনীতির উপর চাপ কমানোর জন্য জাতীয় ঋণ পরিশোধের উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়। রুটির দাম দারুণভাবে বেড়ে যায়। দরিদ্র মানুষ ও জনসাধারণ সরকারের উপর প্রবল ক্ষুব্ধ হয়।

ডিরেক্টরির শাসনকালে বেবিউফ-এর বিদ্রোহ

  • (১) ডিরেক্টরির ব্যর্থতার জন্য দেশময় বিক্ষোভ শুরু হয়। রাজতন্ত্রী, বামপন্থী জোকোবিন এবং অন্যান্য শক্তি এই বিদ্রোহে সামিল হয়। এইসব বিদ্রোহের মধ্যে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দের মে মাসে বামপন্থী ফ্রাঁসোরা বেবিউফ (Babeuf)-এর বিদ্রোহ।
  • (২) তিনি ছিলেন ‘সোসাইটি অব দি প্যান্থিয়ন নামক বিপ্লবী সংস্থার সদস্য এবং ‘ট্রিবিউন’ পত্রিকার সম্পাদক। তিনি মনে করতেন যে সম্পত্তির মালিকানা থাকলে সমাজে ধনী-দরিদ্রের ব্যবধান থাকবে। এজন্য সামাজিক ন্যায় ও সাম্য প্রতিষ্ঠার জন্য সম্পত্তির ব্যক্তিগত মালিকানার বিলোপ অপরিহার্য।
  • (৩) তিনি ডিরেক্টরিকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র করেন। চক্রান্ত ফাঁস হয়ে গেলে তিনি গ্রেপ্তার হন এবং তাঁকে গিলোটিনে হত্যা করা হয়। অনেকে তাঁকে কার্ল মার্কস-এর অগ্রদূত বলে চিহ্নিত করেছেন।

ডিরেক্টরির পতন

  • (১) এই সময় রাজতন্ত্রীদেরও বিদ্রোহ সংঘটিত হয়। দেশত্যাগী অভিজাত ও যাজকরা দেশে ফিরে বিদ্রোহের আয়োজন শুরু করে। সেনাপতি পিসেগ্রু বিদ্রোহ ঘোষণা করেন।
  • (২) এই অবস্থায় স্বদেশি বিপ্লবী ও বিদেশি আক্রমণকারীদের মোকাবিলা করার জন্য ডিরেক্টরি সামরিক শক্তি বৃদ্ধির উদ্যোগ নেয়। সামরিক বৃত্তি গ্রহণ বাধ্যতামূলক করা হয় এবং এজন্য দেশবাসীর কাছ থেকে বলপূর্বক ঋণ আদায় করা শুরু হয়।
  • (৩) এইসব নানা কারণে ডিরেক্টরি জনপ্রিয়তা হারায় এবং দেশময় অসন্তোষের আগুন জ্বলে ওঠে। এই অবস্থায় তরুণ নেপোলিয়ন বোনাপার্ট অপদার্থ ডিরেক্টরদের বিতাড়িত করে কনসুলেট নামে এক শাসনব্যবস্থা প্রবর্তন করেন।

ডিরেক্টরির পতনের কারণ

ফ্রান্সে ডিরেক্টরির পতনের জন্য নানা কারণ দায়ী ছিল। যেমন –

  • (১) ডিরেক্টরির শাসনাধীনে প্রতি বছর আইনসভার এক তৃতীয়াংশ সদস্য এবং একজন ডিরেক্টরকে পদত্যাগ করতে হত। এইসব শূন্যপদ পূরণের জন্য দেশে প্রতি বছর নির্বাচন হত। এর ফলে রাজনৈতিক স্থিতি বিনষ্ট হত।
  • (২) আইনসভা ও শাসন পরিষদের মধ্যে বিবাদবাধলে তার মীমাংসার জন্য কোনও সাংবিধানিক ব্যবস্থা ছিল না।
  • (৩) ডিরেক্টরদের ব্যক্তিগত চরিত্র কলুষমুক্ত না হওয়ায় তারা জনগণের শ্রদ্ধা আকর্ষণ করতে পারে নি।
  • (৪) ডিরেক্টররা ছিলেন বুর্জোয়া সম্প্রদায়ের লোক। ফ্রান্সের সাঁকুলেৎরা তাঁদের মানতে পারে নি।
  • (৫) ডিরেক্টরির আমলে সর্বসাধারণের ভোটাধিকার ছিল না। এর ফলে এই শাসনব্যবস্থা প্রকৃত গণতান্ত্রিক চরিত্র পায় নি।
  • (৬) প্রবল অর্থসংকট ও মুদ্রাস্ফীতি ডিরেক্টরদের সফলতার পথে অন্যতম প্রধান অন্তরায় ছিল।

ডিরেক্টরির কৃতিত্ব

মাত্র কয়েক বছর ফ্রান্সের শাসনকার্য পরিচালনা করলেও ডিরেক্টরির কৃতিত্ব একেবারেই নগণ্য নয়। যেমন –

  • (১) নেপোলিয়নের বিখ্যাত সংস্কারগুলির মূলে ছিল ডিরেক্টরি শাসনের ঐতিহ্য। ডিরেক্টরিকে নেপোলিয়নের শাসন সংস্কারের প্রস্তাবনা বলা যায়।
  • (২) এই শাসনপর্বে ফ্রান্সের জাতীয় অর্থনীতি একটি সুনির্দিষ্ট রূপ ধারণ করে। ধাতুমুদ্রা প্রবর্তন করে মুদ্রাস্ফীতি রোধ করা হয়। রাজস্ব সংস্কার দ্বারা সরকারি আয়ের ঘাটতি ও সরকারি ঋণের পরিমাণ হ্রাস করা হয়। বিদেশি বাণিজ্যের উপর উচ্চহারে শুল্ক আরোপ করে দেশীয় শিল্পকে সংরক্ষণের অধীনে আনা হয়।
  • (৩) বৈজ্ঞানিক গবেষণা ও প্রযুক্তিবিদ্যার প্রসার ঘটিয়ে ফ্রান্সের শিল্পোন্নয়নের পথ প্রশস্ত করা হয়।

উপসংহার:- প্রকৃতপক্ষে বিদ্রোহ দমনের জন্য ডিরেক্টররা সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল ছিলেন। এর ফলে তাঁদের অস্তিত্ব সেনাপতিদের হাতে চলে যায় এবং নেপোলিয়ন বোনাপার্ট তাঁদের বিতাড়িত করে ক্ষমতা দখল করেন।

(FAQ) ফ্রান্সে ডিরেক্টরি শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ফ্রান্সে ডিরেক্টরি শাসনের সময়কাল কত?

১৭৯৫-১৭৯৯ খ্রিস্টাব্দ।

২. ডিরেক্টরি শাসনে কতজন ডিরেক্টর ছিলেন?

৫ জন।

৩. ডিরেক্টরি শাসনের পতন ঘটান কে?

নেপোলিয়ন বোনাপার্ট।

৪. ডিরেক্টরি শাসনের পতনের পর ফ্রান্সে কাদের শাসন প্রতিষ্ঠিত হয়?

কনসুলেটের শাসন।

Leave a Comment