দীন-ই-ইলাহী

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের প্রবর্তন, ধর্মমতের প্রবক্তা, ধর্মমতের গঠন, আকবরের নিজস্ব অভিমত, ইলাহীবাদীদের প্রতিশ্রুতি, অবশ্য কর্তব্য, ধর্মমত গ্ৰহণ, ধর্মমতের শিষ্য, বদাউনির অভিমত, বদাউনির যুক্তি, ইসলাম বিরোধী নয়, ক্ষুব্ধ উলেমা, রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম, আকবরের লক্ষ্য, আকবরের শ্রেষ্ঠত্ব, ধর্মমতের পরিসমাপ্তি ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানবো।

মোগল সম্রাট আকবর প্রচারিত দীন ই ইলাহি ধর্মমত সম্পর্কে সুলহ ই কুল, দীন ই ইলাহি ধর্মমত গ্ৰহণ কারী হিন্দু বীরবল, মোট ১৯ জন দীন ই ইলাহী ধর্ম গ্ৰহণকারী, দীন ই ইলাহি আক্ষরিক অর্থ ঈশ্বরের ধর্ম, বা ঐশ্বরিক ধর্ম, দীন ই ইলাহী আধ্যাত্মিক কর্মসূচি, দীন ই ইলাহীর প্রতিষ্ঠাতা আকবর, দীন ই ইলাহী ধর্মমতের গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

দীন-ই-ইলাহী

বিষয়দীন-ই-ইলাহী
প্রবর্তকমোগল সম্রাট আকবর
সময়কাল১৫৮২ খ্রিস্টাব্দ
অর্থঈশ্বরের আদেশ
মূল নীতিসুলহ-ই-কুল বা পরধর্মসহিষ্ণুতা
গ্ৰহণকারী হিন্দুবীরবল
দীন-ই-ইলাহী

ভূমিকা :- আকবরের ধর্মচিন্তার বিবর্তনেচূড়ান্ত পর্যায় হল ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে দীন-ই-ইলাহী’ নামে এক একেশ্বরবাদী ধর্মের প্রবর্তন।

তৌহিদ-ই-ইলাহী

আবুল ফজলবদাউনি এই তথাকথিত ধর্মমতকে ‘তৌহিদ-ই-ইলাহী’ বলে অভিহিত করেছেন, যার প্রকৃত অর্থ হল ‘স্বর্গীয় একেশ্বরবাদ’।

দীন-ই-ইলাহী

পরবর্তীতে ‘তৌহিদ’-এরপরিবর্তে ‘দীন’ (বিশ্বাস) শব্দটি যুক্ত হয়ে এর নাম হয় ‘দীন-ই-ইলাহী’ বা ‘দৈবাদেশ’।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের প্রবক্তা

সকল ধর্মের সারবস্তু নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত এবং এই ধর্মমতে কোনও সাম্প্রদায়িকতা, অন্ধ বিশ্বাস, দেবতা, দেব-মন্দির, পুরোহিত বা ধর্মগ্রন্থের স্থান ছিল না—স্বয়ং সম্রাটই ছিলেন এর প্রবক্তা এবং যে কোনও মানুষ এই ধর্মমত গ্রহণ করতে পারত।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের গঠন

উপনিষদের একেশ্বরবাদ, হিন্দু দর্শনের জন্মান্তরবাদ, বৌদ্ধ ধর্ম অবলম্বী (গৌতম বুদ্ধ) ও জৈন ধর্ম অবলম্বীদের (মহাবীর) অহিংসা নীতি, পারসিকদের সূর্য ও অগ্নি উপাসনা, ইসলাম ধর্মের নমাজ, রমজান, হজযাত্রা প্রভৃতি নয়টি বিধি এবং খ্রিস্টধর্মের সৌভ্রাতৃত্ব প্রভৃতি আদর্শ নিয়ে এই ধর্মমত গঠিত।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত সম্পর্কে আকবরের অভিমত

স্বয়ং সম্রাট আকবর বলেন যে, “একটি ধর্মে যা ভালো তা যেন হারাতে না হয়, এবং এর সঙ্গে সঙ্গে অন্য ধর্মে যা ভালো তা যেন লাভ করা যায়।”

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত সম্পর্কে ফন নোয়ের অভিমত

জার্মানি-র ঐতিহাসিক ফন নোয়ের এই ধর্মমতকে একেশ্বরবাদ না বলে সর্বেশ্বরবাদ’ বলার পক্ষপাতি।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতে গুরুত্ব আরোপ

এই ধর্মমতে পার্থিব উদারতা ও চারিত্রিক পবিত্রতার ওপর গুরুত্ব আরোপ করা হয়।

ইলাহীবাদীর প্রতিশ্রুতি

প্রত্যেক ইলাহীবাদীকে সম্রাটের স্বার্থে সম্পত্তি (মাল), জীবন (জান), সম্মান (দীন) এবং ধর্ম (নামুস) বিসর্জনের প্রতিশ্রুতি দিতে হত।

ইলাহীবাদীর অবশ্য কর্তব্য

আমিষ ভোজন, মদ্যপান, বাল্যবিবাহ, নিকট আত্মীয়কে বিবাহ, জুয়া খেলা, শিকার প্রভৃতির বিরোধিতা এবং বিধবা বিবাহ, সহধর্মাবলম্বীদের পরস্পরকে ভোজ দ্বারা আপ্যায়ন, জন্মমাসে দান, দরিদ্রের সেবা প্রভৃতিতে উৎসাহ দান এই ধর্মাবলম্বীদের অবশ্যকর্তব্য বলে বিবেচিত হত।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত গ্ৰহণ

নব-প্রচারিত এই ধর্মমত এত বেশি তাত্ত্বিক ছিল যে, কেবলমাত্র আঠারো জন বিশিষ্ট মুসলিম ও একজন বিশিষ্ট হিন্দু বীরবল এই ধর্মমত গ্রহণ করেন।”The New Cambridge History of India’-র মতে এই ধর্মে দীক্ষিতদের সংখ্যা ছিল পঁচিশ, মতান্তরে বাহাত্তর জন।

দীন-ই-ইলাহীর শিষ্য

দীন-ই-ইলাহীর প্রাথমিক শিষ্যরা হল বীরবল, যুবরাজ সেলিম (জাহাঙ্গীর), আবুল ফজল ইবন মুবারক, যুবরাজ মুরাদ, কাশিম খান, আজম খান, শেখ মুবারাক, আবদুস সামাদ, মোল্লা শেখ মোহাম্মদ শাহাদাত, সুফি আহমেদ, মির শরিফ আমল, সুলতান খাজা, মির্জা সদর-উদ-দিন, তাকি সুস্তার, শেখজাদা গোসলা বেনারসি, সদর জাহান, সদর জাহানের প্রথম ও দ্বিতীয় ছেলে, শেখ ফয়েজি, জাফর বেগ।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত সম্পর্কে বদাউনির অভিমত

আকবরের কঠোর সমালোচক বদাউনি বলেন যে ‘দীন-ই-ইলাহী’ ছিল একটি নতুন ধর্মমত এবং আকবর ইসলাম ধর্ম পরিত্যাগ করেছিলেন। এক্ষেত্রে স্মিথ, এডওয়ার্ড ও গ্যারেট, রম্যান প্রমুখ তাঁকে সমর্থন জানান।

বদাউনির যুক্তি

ঐতিহাসিক বদাউনি তাঁর বক্তব্যের সমর্থনে আকবর কর্তৃক সূর্য ও অগ্নিপূজা, নওরোজ উৎসব, ‘সিজদা’ প্রথা প্রবর্তন এবং বাল্যবিবাহ, গোমাংস ভক্ষণের বিরোধিতা, সুন্নৎ প্রথার দিন নির্ধারণ, ‘মাহজারনামা’, সম্রাটের নামে ‘খুৎবা পাঠ, ‘দীন ই-ইলাহী’-তে কোরান ও পয়গম্বরের অনুপস্থিতি প্রভৃতির কথা বলেন।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত সম্পর্কে বদাউনির মতের বিরোধিতা

গোঁড়া সুন্নি বদাউনি-র বক্তব্য গ্রহণযোগ্য নয় এবং তা ভিত্তিহীন। ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ, ডঃ কালিকিঙ্কর দত্ত, ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী প্রমুখ ঐতিহাসিক বদাউনি-র মতের বিরোধিতা করেছেন।

দীন-ই-ইলাহী ইসলাম বিরোধী নয়

এই ‘দীন-ই-ইলাহী’ কখনোই ইসলাম বা কোরান-বিরোধী নয়। হজযাত্রা, জাকৎ, নমাজ, রমজান প্রভৃতি কোরানের দশটি নির্দেশের মধ্যে ন’টিই এর অঙ্গীভূত হয়েছে। মাহজার -এর মধ্যেও আল্লা-বিরোধী কোনও বক্তব্য নেই।

ক্ষুব্ধ উলেমা

আমৃত্যু তিনি আল্লার ওপর বিশ্বাস রেখেছেন এবং মুসলিম সাধু-সন্তদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছেন। তাঁর উদার মতামত গোঁড়া উলেমাদের ক্ষুব্ধ করে এবং তারাই নানাভাবে তাঁর বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত সম্পর্কে স্মিথের অভিমত

ঐতিহাসিক স্মিথ বলেন যে, “দীন-ই-ইলাহী ছিল আকবরের বুদ্ধিহীনতার স্তম্ভ, প্রজ্ঞার পরিচায়ক নয়। সমগ্র পরিকল্পনাটি ছিল সম্রাটের হাস্যকর অহমিকা ও অসংযত স্বেচ্ছাচারের জ্বলন্ত নিদর্শন।”

স্মিথের বক্তব্যের বিরোধিতা

ঐতিহাসিক স্মিথের অভিমতও গ্রহণযোগ্য নয়। আকবর যদি অহংবোধ ও স্বেচ্ছাচারের পথে অগ্রসর হতেন, তাহলে তিনি বহু মানুষকে এই ধর্মে দীক্ষিত করতে পারতেন, কিন্তু সে পথে তিনি অগ্রসর হন নি।

আকবরের লক্ষ্য

মোগল সম্রাট আকবরের লক্ষ্য ছিল হিন্দু-মুসলিম মিলন এবং ভারত-এ রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক ঐক্য প্রতিষ্ঠা। এই ধর্মমত নির্বুদ্ধিতা নয়- ‘সুল-ই-কুল’ বা বিশ্বজনীন সহিষ্ণুতার ফলশ্রুতি।

রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম

আকবর যখন বিশ্বজনীন সহিষ্ণুতার আদর্শ প্রচার করেন তখন ইউরোপ-এ ‘রাজার ধর্মই প্রজার ধর্ম’ নীতি বলবৎ ছিল। ষোড়শ শতকের মধ্যভাগ থেকে সপ্তদশ শতাব্দীর মধ্যভাগ পর্যন্ত ইউরোপে কোনও শান্তি ছিল না এবং প্রজাদের ধর্ম রাষ্ট্র কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত হত।

ইংল্যান্ড ও স্পেনের ধর্ম পরিস্থিতি

এলিজাবেথের রাজত্বকালে ইংল্যান্ড ও আয়ারল্যাণ্ডে প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্ম জোর করে প্রজাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া হয়। স্পেন-রাজ দ্বিতীয় ফিলিপ ছিলেন প্রবল ধর্মোম্মাদ মানুষ।

আকবরের শ্রেষ্ঠত্ব

আকবরের রাজত্বকালের এক শতাব্দী পরেও ফ্রান্স-এর সম্রাট চতুর্দশ লুই ‘হুগেনট’ প্রজাদের ওপর চণ্ডনীতি চালান। সুতরাং ইউরোপীয় রাজন্যবর্গের সঙ্গে তুলনা করলে আকবরের শ্রেষ্ঠত্ব সহজেই অনুমান করা যায়।

দীন-ই-ইলাহী ধর্মমতের পরিসমাপ্তি

‘দীন-ই-ইলাহী’ বেশি দিন স্থায়ী হয় নি এবং আকবরের মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গে এরও পরিসমাপ্তি ঘটে।

দীন-ই-ইলাহী-র গুরুত্ব

জাতীয় জীবনে দীন-ই-ইলাহী-র গুরুত্বকে অস্বীকার করা যাবে না। এর গুরুত্ব গুলি হল –

  • (১) কেবলমাত্র রাজনৈতিক ঐক্যই নয়- এই ধর্মের মাধ্যমে তিনিভারতের ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ঐক্যকে সুদৃঢ় করতে সচেষ্ট হন।
  • (২) ঐতিহাসিক ডঃ মাখনলাল রায়চৌধুরী-র মতে, আকবর-প্রচারিত ‘মাহজার’-টি ছিল সম্রাটের রাজনৈতিক বিচক্ষণতার চমকপ্রদ নিদর্শন।
  • (৩) আকবরের লক্ষ্য ছিল সুল-ই ‘কুল’ বা সকল ধর্মের সার নিয়ে একটি জাতীয় ধর্ম গড়ে তোলা। দীন-ই-ইলাহী হল এই ধরনের একটি জাতীয় ধর্ম এবং এই মতবাদ প্রচার করে আকবর ভারতবর্ষের জাতীয় নেতায় পরিণত হন।
  • (৪) ডঃ ত্রিপাঠী বলেন যে, ‘দীন-ই-ইলাহী’ এমন একটি আদর্শ স্থাপন করল যাতে সামাজিক, রাজনৈতিক ও ধর্মীয় পার্থক্য সত্ত্বেও জনগণ একটি সাধারণ বেদিতে মিলতে পারে। এটি সম্রাটের সিংহাসনে একটি আধ্যাত্মিক জ্যোতির্বলয় রচনা করে নিঃসন্দেহে আকবরের হাতকে শক্তিশালী করে।

উপসংহার :- এই মতাদর্শের ফলে হিন্দু-মুসলিমদের মধ্যে বিবাদ যথেষ্ট পরিমাণে স্তিমিত হয়। রাষ্ট্রকার্যে উলেমা ও মোল্লাদের প্রভাব যথেষ্ট পরিমাণে খর্ব হয় এবং ধর্মীয় ও রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে সম্রাটের সর্বময় কর্তৃত্ব স্বীকৃতি লাভ করে।

(FAQ) দীন-ই-ইলাহী সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কে কবে দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত প্রবর্তন করেন?

মোগল সম্রাট আকবর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে।

২. দীন-ই-ইলাহী -র মূল নীতি কী?

সুলহ-ই-কুল বা পরধর্মসহিষ্ণুতা।

৩. দীন-ই-ইলাহী ধর্মমত গ্ৰহণকারী একমাত্র হিন্দুর নাম কি?

বীরবল।

৪. মোট কতজন দীন ই ইলাহি ধর্মমত গ্ৰহণ করে?

আঠারো জন বিশিষ্ট মুসলিম ও একজন বিশিষ্ট হিন্দু বীরবল এই ধর্মমত গ্রহণ করেন।

Leave a Comment