সুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ

সুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ প্রসঙ্গে সেনাদলের কথ্য ভাষা, শিবিরের ভাষা, জবান-ই-উর্দু, উর্দুর বীজক্ষেত্র, সাহিত্য রচনা, উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ ও দক্ষিণ ভারতের কথ্য ভাষা সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ
ব্রজভাষামথুরা
লস্করসেনাদলের কথ্য ভাষা
আমীর খসরুউর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ
সুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ

ভূমিকা :- ভারত-এর প্রধান কথ্য ভাষাগুলির মধ্যে উর্দুভাষা একটি বিশেষ স্থান অধিকার করে আছে। সুলতানি যুগে উর্দুভাষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে।

সুলতানি যুগে সেনাদলের কথ্য ভাষা উর্দু

মধ্য এশিয়া থেকে আগত তুর্কী ও মোঙ্গলদের সামরিক বাহিনীর শিবিরে এক প্রকার কথ্য ভাষা চালু ছিল তাকে অবহেলা ভরে উর্দু বলা হত। এই যুগে ‘উর্দু’ ও ‘লস্কর’ বা সেনাদলের কথ্য ভাষা ছিল সমার্থক।

সুলতানি যুগে শিবিরের ভাষা উর্দু

দিল্লি সুলতানির দেহরক্ষী বাহিনীতে এবং সেনাদলে মধ্য এশিয়া থেকে আগত বহু উপজাতির লোক থাকত। তাদের শিবিরে পরস্পরের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য এক প্রকার মিশ্রভাষা ব্যবহার করা হত যাকে উর্দু বলা হত। পরবর্তীকালে যে উন্নত উর্দুভাষা চালু হয় তার মূলগত পারসিক অর্থ ছিল ‘শিবির’ অর্থাৎ শিবিরের ভাষা।

সুলতানি যুগে জবান-ই-উর্দু

  • (১) বহিরাগত তুর্কী বিশেষজ্ঞরা স্থানীয় ভারতীয়দের সঙ্গে ভাব বিনিময়ের জন্য একটি ভাষার মাধ্যম খোঁজার চেষ্টা করেন। তাদের পক্ষে সংস্কৃত বা প্রাকৃত বা স্থানীয় কথ্য ভাষা শেখা ছিল দুস্কর। তাদের এত ধৈর্য্য বা অধ্যবসায় ছিল না।
  • (২) অথচ ভাব বিনিময়ের জন্য তাঁরা একটি ভাষার মাধ্যম খোঁজার চেষ্টা করেন। এর ফলে ভারতীয় কথ্য ভাষার সঙ্গে ফার্সী এবং সামরিক ভাষা উর্দু মিলিয়ে এক জগা-খিচুড়ি ভাষা চালু হয়।
  • (৩) এই ভাষা প্রথম রাজধানী দিল্লীতে চালু হয়। এজন্য এর নাম ছিল ‘দেহলভী’ বা দিল্লীর অধিবাসীদের ভাষা অথবা হিন্দভী অথবা জবান-ই-উর্দু। সাধারণ লোকে এই ভাষাকে দ্রুত বরণ করে নেয়।

সুলতানি যুগে মিশ্র ভাষার প্রথম প্রচলন

  • (১) কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে এই মিশ্র ভাষা সর্বপ্রথম দিল্লীতে নয় পাঞ্জাব, হরিয়ানা অঞ্চলে সর্বপ্রথম চালু হয়। গজনীর সুলতান দিল্লী জয়ের আগে প্রায় ৭ দশক ধরে এই অঞ্চলে আধিপত্য স্থাপন করেন।
  • (২) কাজেই প্রথমে উর্দু বা এই মিশ্র ভাষা এই অঞ্চলে প্রচলিত ছিল। পরে মহম্মদ ঘুরী দিল্লি জয় করলে তুর্কী সেনা শাসকরা দিল্লীতে বসবাস করেন। এই মিশ্র ভাষা দেহলভী এবং শতদ্রুর অপর দিকে হরিনাভী বা হরিয়ানী নামে পরিচিত হয়।

দিল্লি সুলতানি যুগে উর্দুর বীজক্ষেত্র

  • (১) আসলে এই মিশ্র ভাষা ছিল দিল্লীর কথ্য ভাষা খাড়িবোলী, রাজস্থানের রাজস্থানী, মথুরা অঞ্চলের ব্রজভাষার সঙ্গে ফার্সী ও সামরিক ভাষা উর্দুর সমন্বয়। এই ভাষাটিই শেষ পর্যন্ত উর্দু নামে পরিচিত হয়।
  • (২) এই ভাষাকে যদি একটি ভারতীয় ইসলামীয় ভাষার ঠাস বুনোট ধরা হয় তবে এই ভাষাতে তুর্কী, ফার্সী, খাড়িবোলী, হরিয়ানী ও ব্রজভাষা একত্রে মিশে ইন্দো-ইসলামীয় ভাষায় পরিণত হয়। দিল্লীতেই এর প্রধান বিকাশ হয়। এজন্য দেহলভী বা হিন্দভীই ছিল উর্দুর বীজক্ষেত্র।

সুলতানি যুগে সাহিত্য রচনা

ক্রমে মুসলিম পণ্ডিতরা ফার্সী হরফে দেহলভী বা জবান-ই-উর্দু লিখতে শুরু করেন। হিন্দু পণ্ডিতরা দেবনাগরী হরফে একই ভাষা লেখা শুরু করেন। ফার্সী হরফে লেখার ফলে মুসলিম পণ্ডিতরা ফার্সী ও আরবী শব্দ এবং এই সাহিত্যের ভাবধারা দেহলভী বা জবান-ই-উর্দুতে ব্যাপক ঢোকাতে থাকেন। হিন্দু পণ্ডিতরাও পিছিয়ে না থেকে সংস্কৃত সাহিত্যের ভাবধারা, শব্দ এই ভাষায় ঢোকাতে থাকেন। এভাবেই উভয় গোষ্ঠী সাহিত্য রচনা শুরু করেন।

সুলতানি যুগে উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ

  • (১) কবি আমীর খসরু ছিলেন উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ। তিনি হিন্দভী বা দেহলভী ভাষাকে তার কাব্য রচনা সাহিত্যের বাহন করেন। তিনি সুফী সন্ত শেখ নিজামুদ্দিন আওলিয়ার সংস্পর্শে আসার পর হিন্দভী ভাষার প্রতি আকৃষ্ট হন।
  • (২) এই সন্ত তার ধর্মীয় বাণীগুলি লোকের মুখের ভাষা হিন্দভী ভাষায় দিতেন। তা খুবই জনপ্রিয় ছিল। আমীর খসরু এতে অনুপ্রাণিত হয়ে হিন্দভীতে সাহিত্য রচনা শুরু করেন।
  • (৩) কাব্য রচনার জন্য ফার্সীর মতই জবান-ই-উর্দু বা হিন্দভী উপযুক্ত মাধ্যম বলে তিনি মনে করতেন। তাঁর ফার্সী ও হিন্দী মিশ্রিত উর্দু গোষ্ঠীর নাম ছিল রেখতা (Rekhta)।

সুলতানি যুগে যমজ ভগিনী ভাষা

কাজেই এখন যে সংস্কৃত মিশ্রিত হিন্দী চালু আছে আদিতে তা ছিল হিন্দভী বা হিন্দী এবং এখন যে ফার্সী মিশ্রিত উর্দু চালু আছে আদিতে তাও হিন্দভী ছিল। এই যমজ ভগিনী একই মাতার সন্তান।

সুলতানি যুগে দক্ষিণ ভারতের কথ্য ভাষা উর্দু

দক্ষিণ ভারতে দিল্লী সুলতানির প্রচারের ফলে উত্তর ভারতের মতই উর্দু দক্ষিণে কথ্য ভাষা রূপে ছড়িয়ে পড়ে। এই উর্দু দক্ষিণে কানাড়ী, তেলেগু ও পশ্চিমী মারাঠি ও গুজরাটী থেকে বহু শব্দ আত্মসাৎ করে দক্ষিণী উর্দুতে পরিণত হয়।

উপসংহার :- বাহমনী রাজ্য-এর সুলতানরা তাদের দরবারে ফার্সীর সঙ্গে উর্দুকেও মর্যাদার আসন দিতেন। বাহমনী সাম্রাজ্যের পতনের পর গোলকুন্ডা ও বিজাপুর সুলতানরাও উর্দুর পৃষ্ঠপোষকতা করেন।

(FAQ) সুলতানি যুগে উর্দু ভাষা সাহিত্যের বিকাশ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. উর্দু সাহিত্যের পথিকৃৎ কে?

আমীর খসরু।

২. মথুরা অঞ্চলের ভাষার নাম কি?

ব্রজভাষা।

৩. সুলতানি যুগে কোন ভাষার উদ্ভব ও বিকাশ ঘটে?

উর্দু।

Leave a Comment