মার্কসবাদের সমালোচনা

মার্কসবাদের সমালোচনা প্রসঙ্গে অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ভুল ও অসম্পূর্ণ, অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাব, বৌদ্ধিক শক্তি অগ্ৰাহ্য, মধ্যবিত্তশ্রেণির উপস্থিতি, দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অসারতা, ইতিহাসের গতিপথ, উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব, হিংসাত্মক বিপ্লবের অপ্রয়োজনীয়তা, শ্রেণীহীন সমাজ আজও অপ্রতিষ্ঠিত, সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান, জাতীয়তাবাদী ভাবধারা, আন্তর্জাতিকতার তত্ত্ব সঠিক নয় এবং মার্কসবাদের বিরোধিতা সম্পর্কে জানবো।

মার্কসবাদের সমালোচনা

ঐতিহাসিক ঘটনামার্কসবাদের সমালোচনা
প্রবক্তাকার্ল মার্কস
অন্য নামবৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ
ফ্যাক্টরি প্রথাশিল্প বিপ্লব
সাম্যবাদী রাষ্ট্রসোভিয়েত রাশিয়া, চিন
মার্কসবাদের সমালোচনা

ভূমিকা:- কার্ল মার্কস প্রচারিত মতবাদ বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রবাদ বা সাম্যবাদ বা মার্কসবাদ নামে পরিচিত। মার্কসীয় মতবাদ একেবারে ত্রুটিমুক্ত নয়। পণ্ডিতরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোণ থেকে এর সমালোচনা করেছেন।

(১) অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ভুল ও অসম্পূর্ণ

মার্কস-কর্তৃক ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যা ভুল ও অসম্পূর্ণ। ইতিহাসের গতি কেবল অর্থনৈতিক প্রভাবেই নিয়ন্ত্রিত হয় না। অর্থনীতি ছাড়াও ধর্ম, জলবায়ু, দেশপ্রেম, বৈজ্ঞানিক আবিষ্কার, বিভিন্ন ব্যক্তি ও শ্রেণির উচ্চাকাঙ্ক্ষা, প্রতিবেশী রাষ্ট্রসমূহের চাপ প্রভৃতি বিভিন্ন বিষয়ের উপরেও ইতিহাসের গতি-প্রকৃতি নির্ভর করে। ঐতিহাসিক হ্যাজেন ইতিহাসের অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে অতিরঞ্জন বলে অভিহিত করেছেন।

(২) অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাব

মার্কস বলেন যে, মানুষের সকল ক্রিয়াশীলতার পশ্চাতে অর্থনৈতিক শক্তির প্রভাব থাকে। এই বক্তব্যও সঠিক নয়। আইনস্টাইন-এর আপেক্ষিক তত্ত্ববাদ-এর মূলে অর্থনৈতিক কারণ নয় – সৃজনশীলতাই দায়ী ছিল। শেক্সপিয়র-এর নাটকগুলি নিশ্চয়ই কোনও অর্থনৈতিক কারণে রচিত হয় নি।

(৩) বৌদ্ধিক শক্তি অগ্ৰাহ্য

সমাজ ও সংস্কৃতির বিকাশে কেবলমাত্র অর্থনৈতিক ব্যাখ্যাকে গ্রহণ করলে মানুষের বৌদ্ধিক শক্তিকে অগ্রাহ্য করা হয়, যা মোটেও ঠিক নয়।

(৪) মধ্যবিত্ত শ্রেণির উপস্থিতি

মার্কসীয় সমাজ কেবলমাত্র ধনী ও দরিদ্র – এই দুই শ্রেণিতে বিভক্ত। এখানে মধ্যবিত্ত শ্রেণির কোনও অস্তিত্ব নেই। মার্কসের মতে, মধ্যবিত্ত শ্রেণি ধ্বংস হয়ে যাবে, থাকবে কেবলমাত্র ধনী ও দরিদ্র – এই দুই শ্রেণি। এই বক্তব্য সঠিক নয়। মার্কসীয় ব্যাখ্যার পরেও দেখা গেছে যে মধ্যবিত্ত শ্রেণি লোপ পায় নি বরং তা আরও শক্তিশালী হয়েছে।

(৫) দ্বান্দ্বিক পদ্ধতির অসারতা

অনেকের মতে, দ্বন্দ্ববাদ কখনোই ইতিহাসের চাবিকাঠি হতে পারে না। দ্বান্দ্বিক পদ্ধতি অনুসারে কেবল একটি নির্দিষ্ট পথেই ইতিহাসের ব্যাখ্যা করা যায়, অন্য পথে নয়। বলা বাহুল্য, ইতিহাস কিন্তু সর্বদা সেই পথে চলে না।

(৬) ইতিহাসের গতিপথ

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন বলেন যে, ইতিহাস কোনও ছক ধরে চলে না। ঐতিহাসিকরাই ইতিহাসের গতিপথের উপর ছক চাপিয়ে দেন।

(৭) উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব

উদ্বৃত্ত মূল্যতত্ত্ব সম্পর্কে মার্কসের বক্তব্য সঠিক নয়। তাঁর মতে সকল উৎপাদনের মূলে শ্রম – এই বক্তব্য যথার্থ নয়। কারণ, শিল্প পরিচালনা, মূলধন, বিজ্ঞাপন প্রভৃতি খাতে উৎপাদনকারীকে যথেষ্ট ব্যয় করতে হয়। এই ব্যয় তাকে উৎপাদিত সামগ্রী বিক্রি করেই তুলতে হয়। সুতরাং কেবল শ্রমের মূল্য দ্বারা উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্য নির্ধারণ করতে গেলে উৎপাদন ধ্বংস হয়ে যাবে।

(৮) হিংসাত্মক বিপ্লবের অপ্রয়োজনীয়তা

মার্কস হিংসাত্মক সংগ্রামের মধ্য দিয়ে শ্রমিক শ্রেণির জয়লাভের কথা বলেছেন, কিন্তু দেখা গেছে নির্বাচনের মাধ্যমে শ্রমিক শ্রেণি রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করে শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন আনতে সক্ষম। আবার এমনও দেখা গেছে যে, বহু ধনতান্ত্রিক দেশে আইন প্রণয়নের মাধ্যমে শ্রমিকদের অবস্থার পরিবর্তন ঘটানো হয়েছে। এর জন্য কোনও হিংসাত্মক বিপ্লবের প্রয়োজন হয় নি।

(৯) শ্রেণিহীন সমাজ আজও অপ্রতিষ্ঠিত

মার্কস শ্রেণিহীন সমাজের কথা বলেছেন, কিন্তু আধুনিক সমাজতান্ত্রিক দেশগুলিতে আজও তা প্রতিষ্ঠিত হয় নি। তাই ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্যবাদ একটি সত্য ও বাস্তব ঘটনা।

(১০) সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থ

মার্কসের মতে, বিশ্বের সকল শ্রমিক মিলিতভাবে সাম্যবাদ প্রতিষ্ঠায় অবতীর্ণ হবে এবং বিশ্ববিপ্লবের তাগিদে সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলি ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্রগুলির বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হবে। মার্কসের এই স্বপ্ন সফল হয় নি, কারণ সাম্যবাদী রাষ্ট্রগুলি সঙ্কীর্ণ জাতীয় স্বার্থের ঊর্ধ্বে উঠতে পারে নি। চিন ও ভিয়েতনাম এবং চিন ও সোভিয়েত ইউনিয়নের লড়াই এই বক্তব্যের সত্যতা প্রমাণ করে।

(১১) শান্তিপূর্ণ সহাবস্থান

মার্কসের মতে, ধনতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সাম্যবাদী রাষ্ট্র পরস্পরের শত্রু এবং এরা সর্বদাই পারস্পরিক সংঘর্ষে লিপ্ত থাকবে। বলা বাহুল্য, এই মতও ভ্রান্ত। বর্তমানে দু’ধরনের রাষ্ট্র পারস্পরিক আদান-প্রদানের মাধ্যমে শান্তিপূর্ণভাবে সহাবস্থান করছে।

(১২) জাতীয়তাবাদী ভাবধারা

বলা হয় যে, মার্কস জাতীয়তাবাদকে অবহেলা করে আন্তর্জাতিকতার উপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। বিশ্বের নিপীড়িত শ্রমিক শ্রেণির প্রতি তাঁর আহ্বান, “দুনিয়ার মজদুর এক হও।” তিনি বলেন যে, “শ্রমিকের কোনও দেশ নেই।” এসব সত্ত্বেও চিন, পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন, ভিয়েতনাম ও অন্যান্য সাম্যবাদী দেশগুলিতে জাতীয়তাবাদী ভাবধারা প্রবল।

(১৩) আন্তর্জাতিকতার তত্ত্ব সঠিক নয়

চিন ও সোভিয়েত রাশিয়া এবং ভিয়েতনাম ও চিন বিরোধ সর্বজনবিদিত। পরাধীন ভারত -এ ব্রিটিশ সরকার অত্যাচার চালালেও ইংল্যান্ড -এর শ্রমিক দল ও শ্রমিক সরকার নিজ স্বার্থের জন্য তা সমর্থন করে। সুতরাং মার্কসের আন্তর্জাতিকতার তত্ত্বও সঠিক নয়।

(১৪) মার্কসবাদের বিরোধিতা

বর্তমানে সাম্যবাদী দেশগুলিতেও মার্কসবাদের বিরুদ্ধে নানা প্রতিক্রিয়া লক্ষ করা যায়। বহু দেশেই মানুষ সাম্যবাদের প্রতি বিরূপ হয়ে উঠেছে। পূর্বতন সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে যাওয়া তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।

উপসংহার:- সারা বিশ্বে মার্কসবাদ এক যুগান্তকারী আলোড়ন সৃষ্টি করেছে। শিল্প বিপ্লব-প্রসূত ‘ফ্যাক্টরি প্রথা’-র ফলে শিল্পপতিদের অত্যাচারে শ্রমিকদের অবস্থা যখন শোচনীয়, তখন কার্ল মার্কস তাঁর প্রচারের দ্বারা বিশ্ববাসীকে শ্রমিকদের দুরবস্থা সম্পর্কে সচেতন করেন। তাঁর প্রচারকার্যের ফলে শ্রমিকদের মধ্যেও উদ্দীপনার সৃষ্টি হয়।

(FAQ) মার্কসবাদের সমালোচনা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মার্কসবাদের প্রধান প্রবক্তা কে?

কার্ল মার্কস।

২. কাল মার্কসের দুটি গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থের নাম লেখ।

‘কমিউনিস্ট ম্যানিফেস্টো’, ‘দাস ক্যাপিটাল’।

৩. কাল মার্কসের প্রধান সহযোগী কে ছিলেন?

ফ্রেডরিক এঙ্গেলস।

৪. মার্কসবাদী দর্শনের অন্যতম প্রধান দিক কি ছিল?

দ্বন্দ্বমূলক বস্তুবাদ।

Leave a Comment