সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা প্রসঙ্গে আর্য জাতি স্রষ্টা, আর্য জাতির বিরোধিতা, সুমেরীয়রা স্রষ্টা, পণ্ডিতদের বিরোধিতা, দ্রাবিড় জাতি স্রষ্টা, দ্রাবিড় জাতির ক্ষেত্রে বিরোধিতা, নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক নিদর্শন, স্থানীয় আদিবাসীরা স্রষ্টা ও আমরি সংস্কৃতি সম্পর্কে জানবো।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

বিষয়সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা
সুমেরীয়মার্টিমার হুইলার
দ্রাবিড়ফাদার হেরাস
মানবগোষ্ঠীর অস্তিত্বচারটি
পরবর্তী সভ্যতাবৈদিক সভ্যতা
সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

ভূমিকা:- সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতা কারা সৃষ্টি করেছিল সে সম্পর্কে সঠিক কিছু জানা যায় নি। সিন্ধু লিপির পাঠোদ্ধার না হওয়ায় এ সম্পর্কে নিশ্চিত কিছু জানা যায় নি। তাই সঠিক তথ্য আজ পর্যন্ত অজানাই থেকে গেছে।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা আর্য জাতি

কেউ কেউ বলেন যে, আর্য জাতিই সিন্ধু সভ্যতা সৃষ্টি করে। এক্ষেত্রে তাদের যুক্তি গুলি হল –

(১) সিন্ধুর অধিবাসী ও আর্যদের মিল

সিন্ধু নগরে যে মানুষের কঙ্কাল পাওয়া গেছে তাতে আর্য জাতির কঙ্কাল আছে। এর দ্বারা সিন্ধু নগরে আর্য জাতির অস্তিত্ব ছিল বুঝা যায়। সিন্ধু অধিবাসীরা যেরূপ পোশাক পরত ও খাদ্য আহার করত তার সঙ্গে আর্য জাতির পোষাক ও খাদ্যের তেমন কোন পার্থক্য নেই বলা হয়। সিন্ধু লিপিকে ব্রাহ্মী লিপির আদি রূপ বলে মনে করা হয়।

(২) বসবাস

অনেকেই বলেন যে আর্য জাতি ভারতেই আগাগোড়া বাস করত। তারা বাইরে থেকে ভারতে আসে নি। যদি ভারতবর্ষ আর্যদের আদি বাসস্থান বলে মেনে নেওয়া হয় তাহলে হরপ্পা সভ্যতা আর্য মনীষার অবদান বলে মেনে নেওয়া উচিত।

সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা আর্য মতের বিরোধিতা

এই মতের বিরুদ্ধে যুক্তি দেখান হয় যে, সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা হিসেবে আর্য জাতিকে যদি গণ্য করতে হয় তবে আর্য জাতি ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্ব আগে ভারতে ছিল একথা প্রমাণ করা দরকার। কারণ সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার কালসীমা ৩ হাজার খ্রিস্টপূর্ব বলে ধরা হয়। কিন্তু যে সকল প্রমাণ পাওয়া যায় তা হতে জানা যায় যে, বৈদিক সভ্যতা বা আর্য সভ্যতা আনুমানিক ১৫০০ বা ১৪০০ খ্রিস্টপূর্ব আগে ভারতে ছিল না। এই কারণে আর্য জাতি সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা এই মত গ্রহণযোগ্য নয়।

হরপ্পা ও বৈদিক সভ্যতার পার্থক্য

সিন্ধু ও বৈদিক সভ্যতার মধ্যে প্রচুর পার্থক্য দেখা যায়। যেমন –

  • (১) সিন্ধু সভ্যতা ছিল নগরকেন্দ্রিক, আর্যসভ্যতা ছিল গ্রামীণ। সিন্ধু নগরগুলিতে লোহার ব্যবহার দেখা যায় নি, আর্যরা তামা বা ব্রোঞ্জের ব্যবহার করলেও লোহার ব্যবহার জানত। তাদের অস্ত্রশস্ত্র ছিল লোহা থেকে তৈরি।
  • (২) সিন্ধু অধিবাসীরা মাতৃপুজো ও শিবপুজো করত, বৈদিক আর্যরা ইন্দ্র, মিত্র, বরুণ প্রভৃতি দেবতার পুজো করত। বৈদিক আর্যদের ধর্মচিন্তায় শিব বা শক্তির তেমন কোন গুরুত্ব ছিল না। হরপ্পা সংস্কৃতির মূর্তি পুজোকে বৈদিক আর্যরা স্বীকার করত না। হরপ্পার অধিবাসীরা শিব লিঙ্গের পুজো করত। বৈদিক আর্যরা লিঙ্গ পুজো করত না। তারা যজ্ঞ করত। হরপ্পায় যজ্ঞের প্রথা প্রচলিত ছিল না।
  • (৩) হরপ্পা সংস্কৃতিতে ষাঁড়কে অবধ্য মনে করা হত। বৈদিক আর্যরা গাভীকে অবধ্য মনে করত। সিন্ধু অধিবাসীদের মৃৎশিল্প আর্যদের অপেক্ষা উন্নত ছিল। সিদ্ধ নগরগুলিতে ঝকঝকে রং করা মাটির পাত্র তৈরি হত। বৈদিক আর্যরা এরূপ মৃৎশিল্পে দক্ষ ছিল না।
  • (৪) সিন্ধু নগরগুলিতে বাণিজ্য ও শিল্প ছিল। লোকের প্রধান জীবিকা। বৈদিক আর্যরা পশুপালন ও কৃষিকেই জীবিকা হিসেবে গ্রহণ করে। সিন্ধু নগরগুলির ঘরবাড়ি ছিল পোড়ামাটির ইটের তৈরি, বহুতল বাড়ি ও তাতে স্নানঘর ছিল। বৈদিক আর্যরা মাটির তৈরি খড়ের ঘরে বাস করত।
  • (৫) সিন্ধু নগরে মৃতদেহ প্রধানতঃ কবর দেওয়া হত, পরে কিছু কিছু দাহ করা হয়। বৈদিক আর্যরা মৃতদেহ দাহ করত। সিন্ধুলিপির এখনও পাঠের ব্যবস্থা করা যায় নি, কিন্তু বৈদিকলিপি সিন্ধুলিপি থেকে পৃথক।
  • (৬) অনেকে বলেন যে, বৈদিক আর্যরা লিখতে জানত না। লিপিবিদদের মতে সিন্ধু লিপি ছিল চিত্রলিপি আর বৈদিকলিপি ছিল রৈখিক। স্যার জন মার্শাল এই সকল কারণে সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা হিসেবে আর্য জাতির দাবী নাকচ করেছেন।

সুমেরীয়রা সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল সুমেরীয়দের সৃষ্টি। সার মার্টিমার হুইলার এই মতের প্রধান প্রবক্তা। তার যুক্তি গুলি হল –

  • (১) সুমেরীয় সভ্যতার সঙ্গে সিন্ধু সভ্যতার বহু সাদৃশ্য দেখা যায়। সুমেরিয়ায় মাতৃপুজোর প্রচলন ছিল, সিন্ধু নগরগুলিতেও মাতৃপুজোর প্রচলন ছিল। সুমেরিয়ার নগর বিন্যাস ছিল সিন্ধু সভ্যতার শহরগুলির মতই। হরপ্পা সংস্কৃতিতে সুমেরিয়ার মতই গরু ভেড়াকে পোষ মানানো হত। তুরপুনে পাথরের খণ্ডকে ছেঁদা করে সুমেরিয়ার মতই রুদ্রাক্ষ তৈরি করা হত।
  • (২) সুমেরিয়ার মতই হরপ্পা নগরগুলিতে পোড়া ইটে বাড়ি তৈরি হত এবং পয়ঃপ্রণালী দ্বারা গৃহের জল নির্গমণের ব্যবস্থা করা হয়। হরপ্পা সংস্কৃতি ছিল সুমেরীয় সংস্কৃতির মতই তাম্র যুগের।
  • (৩) উভয় সংস্কৃতি ছিল নদীমাতৃক। সুমেরীয় সভ্যতা ইউফ্রেটিস ও টাইগ্রীস নদীর তীরে এবং হরপ্পা সংস্কৃতি সিন্ধুনদ ও বিভিন্ন নদ-নদীর তীরে গড়ে ওঠে। স্যার মার্টিমার হুইলার এজন্য হরপ্পা সংস্কৃতিকে সুমেরীয় সংস্কৃতির স্থানান্তরকরণ বলে মনে করেন।
  • (৪) তাঁর মতে, যেহেতু এই সংস্কৃতি ছিল বিদেশ হতে আগত সেহেতু ভারতের গভীরে গঙ্গা-যমুনা উপত্যকায় তা বিস্তৃত হতে পারে নি। ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে তা সীমাবদ্ধ ছিল। হরপ্পার শাসকগোষ্ঠী বিদেশী বলেই তারা নগর দুর্গে বাস করত এবং বাকি লোকেদের প্রায় দাসের মতই খাটাত।
  • (৫) স্থান মাহাত্ম্যের ফলে হরপ্পার সংস্কৃতিতে কিছু কিছু নিজস্ব বৈশিষ্ট্য দেখা দেয়। নতুবা এই সংস্কৃতির উৎস ছিল সুমেরীয় সভ্যতা। নতুবা ভারতের সার্বিক এবং নাশ্ছিদ্র গ্রামীণ ও কৃষি সভ্যতার মধ্যে অকস্মাৎ কিভাবে হরপ্পার নগর সভ্যতার উদ্ভব হয়, যদি না তার বীজ সুমেরীয় নগর থেকে আসে?

পণ্ডিতদের বিরোধিতা

পণ্ডিতেরা এই মতের সমালোচনা করে থাকেন। সিন্ধু সভ্যতার এমন কয়েকটি বৈশিষ্ট্য ছিল যা সুমেরিয়ায় দেখা যায় নি। এই বৈশিষ্ট্যগুলি হল –

  • (১) সুমেরিয়ায় মৃতদেহ কবর দেওয়ার সময় মৃতদেহ আচ্ছাদিত করে কফিনে ভরে দেওয়া হত। সিন্ধু অঞ্চলে এই প্রথা ছিল না। সিন্ধু সভ্যতায় বস্ত্র বয়ন ছিল একটি প্রধান শিল্প। সুমেরিয়ায় বস্ত্র শিল্পের প্রাধান্য ছিল না। পোশাক, খাদ্যরীতি উভয় সভ্যতায় পৃথক ছিল।
  • (২) সিন্ধুলিপি সুমেরীয় লিপি থেকে পৃথক। সুমেরীয় লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলেও এখনও সিন্ধুলিপির পাঠোদ্ধার হয় নি। হরপ্পার সভ্যতা মাটির গভীরে পাওয়া গেছে যা এই সভ্যতার মৌলিকতার প্রমাণ দেয়। হরপ্পা নগরগুলির ইটের আকৃতি সুমেরিয়ার ইট থেকে আলাদা ছিল।
  • (৩) হরপ্পার মৃৎশিল্পের কাজ সুমেরিয়া থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। এরূপ লাল-কালো রং করা বাহারী মাটির পাত্র সুমেরিয়ায় তৈরি হত না। হরপ্পার সিলগুলি সুমেরিয়া থেকে স্বতন্ত্র ধরনের। হরপ্পার খেলনাগুলি পাখী টানা গাড়ি, গণ্ডার, হাতীর মূর্তি, আদিবাসী নর্তকীর মূর্তি সুমেরিয়ার থেকে আলাদা।
  • (৪) নৃতাত্বিক পরীক্ষায় হরপ্পার নগরগুলিতে নানা জাতির লোকের বসবাসের প্রমাণ পাওয়া গেছে। একমাত্র সুমেরীয় জাতিগোষ্ঠীর লোকই এখানে বসবাস করত না। সুমেরিয়ার কৃষিক্ষেত্রে খাল কেটে জলসেচ করা হত। সিন্ধু সভ্যতায় খাল দ্বারা জলসেচের প্রথা ছিল না।
  • (৫) ডঃ গর্ডন চাইল্ডের মতে, দুই সভ্যতার মধ্যে বৈষম্য বহু আছে। হরপ্পা সভ্যতা সুমেরীয় সভ্যতার স্থানান্তরকরণের ফল নয়। ডঃ এ. এল. বাসাম মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতার গঠনের পশ্চাতে ভারতীয় মানসিকতা কাজ করেছিল। হুইলার অবশ্য শেষ পর্যন্ত এই সিদ্ধান্তে এসেছেন যে, সিন্ধু সভ্যতার মৌলিকতা ও অখণ্ডত্ব প্রশ্নাতীত।

দ্রাবিড় জাতি সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

ফাদার হেরাস প্রমুখ পণ্ডিতেরা বলেন যে, সিন্ধু সভ্যতা ছিল দ্রাবিড় জাতির সৃষ্টি। এই মতের সমর্থনে বিভিন্ন যুক্তি দেখান হয়। যেমন –

  • (১) আর্য জাতির ভারতে আসার আগেই দ্রাবিড় সভ্যতার বিকাশ হয় একথা সকলেই স্বীকার করেন। প্রাক-আর্য সভ্যতা অর্থাৎ সিন্ধু সভ্যতার সহিত দ্রাবিড় সভ্যতা কালক্রমে মিলে যায়। কারণ দ্রাবিড় সভ্যতাও ছিল সিন্ধু সভ্যতার মত প্রাক-আর্য সভ্যতা।
  • (২) দক্ষিণের দ্রাবিড় জাতির ধর্ম বিশ্বাসে এখনও শিবলিঙ্গের প্রাধান্য দেখা যায়। সিন্ধুর অধিবাসীদের ধর্মবিশ্বাসে শিবলিঙ্গের প্রাধান্য ছিল।
  • (৩) সিন্ধুলিপির সাথে প্রাচীন দ্রাবিড়ীয় বা তামিল লিপির সাদৃশ্য ও সম্পর্ক আছে। দ্রাবিড় জাতি আদিতে উত্তর ভারতে বসবাস করত। বালুচিস্থানের ব্রাহুই উপজাতি দ্রাবিড় ভাষায় কথা বলে। এর থেকে প্রমাণ হয় যে, একদা উত্তর ভারতে দ্রাবিড়দের বসবাস ছিল এবং তারাই সিন্ধু সভ্যতা সৃজন করে।
  • (৪) সিন্ধু নগরে যে নরকস্থানগুলি পাওয়া গেছে তার মধ্যে ভূমধ্যসাগরীয় বা দ্রাবিড় জাতির কঙ্কালও দেখা যায়। প্রাক আর্যযুগে ভারতীয় জনগোষ্ঠী মুণ্ডা ও প্রাণিত এই দুভাগে বিভক্ত ছিল। মুণ্ডাদের সভ্যতা ছিল অনুন্নত। যেহেতু হরপ্পা সভ্যতা প্রাক আর্য যুগের সেহেতু দ্রাবিড়রাই ছিল ভারতের সেই জনগোষ্ঠী যারা এই সভ্যতা সৃষ্টি করে।

দ্রাবিড় জাতির ক্ষেত্রে বিরোধিতা

  • (১) উপরোক্ত মতের বিপক্ষে বলা হয় যে, দক্ষিণে দ্রাবিড় জাতির বসবাস থাকলেও দক্ষিণে আজ পর্যন্ত সিন্ধুর নগর সভ্যতার তুল্য কোনো নিদর্শন পাওয়া যায় নি।
  • (২) ব্রাহুই উপজাতি যারা বালুচিস্থানে বসবাস করে তারা তুর্কী ও ইরানীয় মিশ্রিত উপজাতি এবং তাদের ভাষা প্রকৃত দ্রাবিড় ভাষা নয়। সুতরাং উত্তর-পশ্চিম ভারতে দ্রাবিড়দের বসবাসের কোনো নির্ভরযোগ্য প্রমাণ নেই।
  • (৩) সিন্ধুলিপির সাথে প্রাচীন তামিল লিপির প্রকৃত সম্পর্ক আছে কিনা তা নিশ্চিতভাবে জানা যায় নি। প্রাচীন তামিল লিপির পাঠোদ্ধার করা গেলেও, হরপ্পালিপির পাঠোদ্ধার করা যায় নি।
  • (৪) দ্রাবিড় জাতির মৃতদেহের অন্তেষ্টি ক্রিয়ার পদ্ধতি হরপ্পা অধিবাসীদের অপেক্ষা আলাদা ছিল। দ্রাবিড়দের সভ্যতা ঠিক কতটা প্রাচীন তা বলা যায় না। কারণ দক্ষিণ ভারতে দ্রাবিড়দের তৈরি পাথরের স্থাপত্যগুলির প্রাচীনতা বেশী দিনের নয়। এবং তার তৈরির ভঙ্গির সঙ্গে হরপ্পার পাথরের কাজের মিল নেই।
  • (৫) প্রত্নতত্ববিদ এইচ ডি শাঙ্খালিয়ার মতে, যদি দ্রাবিড়রাই সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা হয়, তবে তারা দক্ষিণ ভারতে সিন্ধুর নগর সভ্যতার মত কোনো সভ্যতা কেন দক্ষিণে গঠন করেনি, এই প্রশ্ন করা যেতে পারে। যাই হোক এখনও পর্যন্ত বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা হিসেবে দ্রাবিড়দের দাবীকে স্বীকৃতি দেন।

নৃতাত্ত্বিক ও প্রত্নতাত্ত্বিক প্রমান

  • (১) নৃতাত্বিক ও প্রত্নতাত্বিক প্রমাণের সাহায্যে সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টাদের সম্পর্কে জানতে চেষ্টা করা হয়েছে। মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পায় যে নরকঙ্কালগুলি পাওয়া গেছে সেগুলির মাথার খুলি ও চোয়াল পরীক্ষা করে নৃতাত্বিকেরা চারটি মানব গোষ্ঠীর পরিচয় পেয়েছেন – প্রোটো-অস্ট্রালয়েড, ভূমধ্যসাগরীয়, আলপাইন ও মোঙ্গোলীয়।
  • (২) এই গোষ্ঠীর প্রকৃত কারা এই সভ্যতা সৃষ্টি করেছিল তা জানা যায় নি। প্রত্নতাত্বিক প্রমাণ যথা মনুষ্যাকৃতি পুতুলগুলির গঠন পরীক্ষা করে দেখা যায় যে, সিন্ধু অঞ্চলে বিভিন্ন জাতির লোক বসবাস করত। এই কারণে পণ্ডিতেরা মনে করেন যে, সিন্ধু সভ্যতা কোন বিশেষ জাতি গোষ্ঠীর দ্বারা সৃষ্ট হয় নি। বিভিন্ন জাতির যৌথ চেষ্টায় এই সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।

ডঃ সেনের অভিমত

  • (১) ডঃ ডি কে সেন নামক নৃতাত্বিক সম্প্রতি সিন্ধু নগরগুলিতে পাওয়া নরকঙ্কালগুলিকে নতুন করে পরীক্ষা করে স্বতন্ত্র অভিমত দিয়েছেন। ডঃ সেনের মতে, এই নরকঙ্কালগুলি পরীক্ষা করে সিন্ধু শহরে বিভিন্ন জাতির অস্তিত্ব দেখা যায়। তাই প্রচলিত মত সঠিক নয়।
  • (২) তিনি মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, চানহুদারো ও লোথালের নরকঙ্কাল পরীক্ষা করেছেন। তার মতে, এই সকল স্থানে একটি জাতি গোষ্ঠীর লোক বাস করত, যাদের উচ্চতা ছিল মাঝারি, মাথার খুলি উঁচু এবং নাখ চওড়া।
  • (৩) এদের সংখ্যাই সিন্ধু উপত্যকায় বেশী ছিল। এরা একই জাতি গোষ্ঠীর লোক ছিল। সম্ভবতঃ এই জাতি গোষ্ঠী এই অঞ্চলের আদিম অধিবাসীদের বংশধর ছিল। এই জাতি গোষ্ঠী হয়ত সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা হতে পারে।

স্থানীয় আদিবাসীরা সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা

উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলের স্থানীয় আদি অধিবাসীরা হরপ্পা সংস্কৃতির জন্ম দিয়েছিল – এই মত এখন অনেক গবেষক পোষণ করেন। তাঁরা বলেন যে, উৎখননের কাজ চালালে হয়ত এমন স্থান পাওয়া যাবে যেখানে হরপ্পা সংস্কৃতির আদি বিকাশ হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে তা পরিণত অবস্থায় মহেঞ্জোদারো, হরপ্পা, চানহুদারো প্রভৃতি অঞ্চলে ছড়িয়ে পড়ে। সেই নাভিকেন্দ্র এখনও আবিষ্কৃত হয় নি।

চাইল্ড -এর অভিমত

গর্ডন চাইল্ড বলেন যে, হরপ্পা সংস্কৃতি পরিণত হয়ে বিস্তৃত হওয়ার আগে ভ্রুণ অবস্থায় ছিল। এই স্তরে হরপ্পার সংস্কৃতি ছিল গ্রামীণ। পরে বিবর্তনের পথে তা আপনা থেকে নাগরিক সংস্কৃতিতে পরিণত হয়।

আমরি সংস্কৃতি

কেউ কেউ বলেন যে, মহেঞ্জোদারোর সাতটি স্তরের নীচে জলের তলায় যে আমরি সংস্কৃতির অস্তিত্ব দেখা যায়, তা হল হরপ্পা সংস্কৃতির মাতৃজঠর। কিন্তু আমরি সংস্কৃতির সঙ্গে হরপ্পা সংস্কৃতির পার্থক্যের কথা অনেকে বলেন। সিন্ধু ও বেলচিস্থানের আদি কৃষি সংস্কৃতির জঠর হতে হরপ্পার নগর সংস্কৃতির উদ্ভব হয় বলে অনেকে মনে করেন।

উপসংহার:- সিন্ধু সভ্যতা বা হরপ্পা সংস্কৃতির স্রষ্টা কারা তা নিয়ে বিতর্কের শেষ নেই। এ সম্পর্কে তেমন কোনো জোরালো প্রমাণ নেই। তবে সিন্ধু লিপি পাঠোদ্ধার হলে এরকম বহু তথ্যই জানা সম্ভব হবে।

(FAQ) সিন্ধু বা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সিন্ধু লিপিকে কোন লিপির আদি রূপ বলা হয়?

ব্রাহ্মী লিপি।

২. সিন্ধু সভ্যতার স্রষ্টা কারা?

আর্য জাতি, সুমেরীয় বা দ্রাবিড় জাতি।

৩. নৃতাত্ত্বিকরা হরপ্পায় কটি মানব গোষ্ঠীর অস্তিত্ব লক্ষ্য করেছেন?

চারটি।

৪. সুমেরীয়রা হরপ্পা সভ্যতার স্রষ্টা এই মতের প্রধান প্রবক্তা কে?

হরতাল মার্টিমার হুইলার।

Leave a Comment