প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল

প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল প্রসঙ্গে আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতা, ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল, মধ্যস্বত্ব শ্রেণীর উদ্ভব, অত্যাচার, কৃষকদের প্রতিক্রিয়া, ব্যবসা বাণিজ্যে অবহেলা, গ্ৰামের অবস্থা, দারিদ্র্য ও অনাহার, বাড়তি কর ও সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি সম্পর্কে জানবো।

প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল

ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল
পরগাছামধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি
বদ্ধ অর্থনীতিগ্রাম
সামাজিক মাপকাঠিজমির মালিকানা
নতুন শ্রেণিসুবিধাভোগী শ্রেণি
প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল

ভূমিকা :- কেন্দ্রীয় সরকারের অনুপস্থিতির জন্য সামন্ত প্রথা আপাতত শাসনতান্ত্রিক ও সামরিক প্রয়োজন মেটাতে কার্যকরী হয়। কেন্দ্রীয় শাসন ভেঙে পড়লে সামন্তরাই শাসনদণ্ড পরিচালনা ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব তাদের কাঁধে তুলে নেয়।

সামন্ত প্রথার ফলে আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতা

  • (১) ব্যাপক অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায় থেকে সামন্তরা রাষ্ট্র ও সমাজকে রক্ষা করে। এই সাময়িক প্রয়োজন মিটে গেলে সামন্ত প্রথা তার উপযোগিতা হারিয়ে ফেলে। অধিকন্তু রাষ্ট্রের ভিতর রাষ্ট্র গঠনের চেষ্টা করে সামন্তরা রাষ্ট্র ও সমাজে একটি স্থায়ী বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে।
  • (২) সামন্তরা তাদের নিজ নিজ অঞ্চলে অর্ধ স্বাধীন বা প্রায় স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার চেষ্টা করায় দেশের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয়। আঞ্চলিকতা ও বিচ্ছিন্নতার প্রবণতা বাড়ে।

ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অঞ্চল

সামন্তরা রাষ্ট্রকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র স্বয়ং-শাসিত অঞ্চলে ভাগ করে। রাজশক্তির দুর্বলতা দেখা দিলে সামন্তরা নিজ নিজ এলাকায় স্বাধীনতা ঘোষণা করে। এর ফলে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্যে দেশ বিভক্ত হয়। এই রাজ্যগুলি ব্যক্তিগত উচ্চাকাঙ্ক্ষা পূরণের জন্য স্থাপিত হয়। জনসাধারণের সামগ্রিক কল্যাণের জন্য এই ধরনের সামন্ত রাজ্যগুলির স্থাপন হয়নি।

সামন্ত প্রথার ফলে মধ্যস্বত্ব শ্রেণীর উদ্ভব

এই সামন্ত প্রথার ফলে মধ্যস্বত্বভোগী সামন্তশ্রেণীর উদ্ভব হয়। বিভিন্ন বর্গের মধ্যস্বত্বভোগীদের চাপে জমির ওপর করের ভার ভয়ানক বেড়ে যায়। কৃষকরা এই চাহিদা মেটাতে স্বর্বস্বান্ত হয়। এই মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণী ছিল পরগাছা শ্রেণী। এদের দ্বারা প্রকৃত উৎপাদনমূলক ও গঠনমূলক কোনো কাজ হত না। কৃষকের শ্রমজাত ফসলের উদ্বৃত্ত এরা অন্যায়ভাবে ভোগ করত।

সামন্ত শ্রেণীর অত্যাচার

এই প্রথায় সামন্ত শ্রেণী ছিল একটি প্রগতিহীন, উদ্যমহীন, উৎপাদন ও পরিশ্রমবিমুখ পরগাছা শ্রেণী। তারা কেবলমাত্র কৃষকদের উদ্বৃত্ত ফসল বা আয় দখল করে তার সাহায্যে একটি বাহিনী পুষত। এই বাহিনীর সাহায্যে তারা নীচে প্রজা বা কৃষকদের দাবিয়ে রাখত।

সামন্ত প্রথার কৃষকের প্রতিক্রিয়া

এই ব্যবস্থায় সামন্ত প্রভু বা রাজাকে আনুগত্য দিলেও, সুবিধামত কৃষকরা নিজ স্বাধীনতা ঘোষণা করত। এই সামন্ত শ্রেণী কোনো উৎপাদনমূলক, প্রকৃত পরিশ্রমসাধ্য কাজ করত না। অপরের শ্রমের ফসল এরা জোর করে ভোগ করত।

সামন্ত প্রথার ফলে ব্যবসা বাণিজ্যে অবহেলা

এই সময় সামন্তরা ব্যবসা, বাণিজ্য, শিল্প প্রভৃতির কাজকে ছোট কাজ মনে করত। এদিকে তারা আদপেই আগ্রহ দেখাত না। অথচ দেশের সম্পদ বৃদ্ধি ও জনসাধারণের জীবিকার জন্য এই কাজকে অগ্রাধিকার দেওয়ার দরকার ছিল। সামন্ত যুগে জমির মালিকানাই ছিল সামাজিক মর্যাদার মাপকাঠি। এতে মানুষের উদ্যম, কর্মক্ষমতা ও অগ্রগতি ব্যাহত হত।

সামন্ত প্রথার ফলে গ্রামের অবস্থা

এই সামন্ত প্রথার ফলে গ্রামগুলি বদ্ধ অর্থনীতির প্রভাবে পড়ে। দেশের বিভিন্ন অঞ্চলের মধ্যে মাল চলাচলের অসুবিধার জন্য গ্রামগুলি স্বয়ংসম্পূর্ণ ক্ষুদ্র স্থানীয় অর্থনীতির কবলে পড়ে। গ্রামের বাজারে যা পাওয়া যায় একমাত্র তার দ্বারাই গ্রামবাসীদের চাহিদা মেটাতে হয়। তার বেশী কোনো কিছু তাদের ভোগ করার সুযোগ-সুবিধা নষ্ট হয়।

সামন্ত প্রথার ফলে দারিদ্র্য ও অনাহার

খাদ্য উৎপাদনকারী শূদ্র কৃষক ও পণ্য উৎপাদনকারী শূদ্র কারিগর সামন্ত প্রভুদের শোষণে দারিদ্র্য ও অনাহারে দিন কাটাত। এই শ্রেণীর লোকেদের বেগার দিতে হয়।

সামন্ত প্রথায় বাড়তি কর

এই সামন্ত প্রথার অন্যতম কুফল ছিল জমির ওপর করের হার বৃদ্ধি। সামন্ত প্রভুরা মন্দির নির্মাণ, দাতব্য প্রতিষ্ঠান স্থাপন, জনহিতকর কাজের জন্য প্রজাদের ওপর বাড়তি কর ও বেগার চাপিয়ে দিত। মন্দির কর্তৃপক্ষ মন্দিরের অধীন কৃষকদের উৎসব ও অন্যান্য ব্যয় নির্বাহের জন্যে বাড়তি কর চাপিয়ে দিত। সামন্তরা কৃষকদের ফসলের ১/৩ ভাগ নিত মূল প্রাথমিক কর। তার উপরে বাড়তি কর আদায় করা হত।

সামন্ত প্রথার ফলে সুবিধাভোগী শ্রেণীর সৃষ্টি

  • (১) সামন্ত প্রথার ফলে সমাজে একটি বিশেষ শ্রেণী সুবিধা ভোগ করায় এবং বৃহত্তম শ্রেণী শোষিত হওয়ায় সমাজের ঐক্য ও সংহতি নষ্ট হয়ে যেত। বেশীর ভাগ লোক পুরুষানুক্রমে শোষণমূলক সমাজ ব্যবস্থায় থাকার জন্য জীবনের লক্ষ্য ও রাষ্ট্র সম্পর্কে উদাসীন হয়ে পড়ত।
  • (২) ব্যক্তিগত উদ্যম, পরিশ্রম করে ভাগ্য ফেরাবার ইচ্ছা, দেশের ও রাষ্ট্রের জন্য মমত্ব লোপ পেত। লোকে অদৃষ্টবাদী হয়ে পড়ত। সমাজের বৃহত্তর শ্রেণী এরূপ উদ্দেশ্যহীন, উদ্যমহীন, অদৃষ্টবাদীতে পরিণত হলে রাষ্ট্র ও সমাজ স্বভাবতই ভেঙে পড়ত।

উপসংহার :- এই সব কারণে তুর্কী আক্রমণের সময় দেশের বৃহত্তর জনসাধারণ দেশ রক্ষায় এগিয়ে আসেনি। তারা নীরব ঔদাসীন্যে রাষ্ট্রের উত্থান-পতন লক্ষ্য করে।

(FAQ) প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলাফল সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. প্রাচীন ভারতে সামন্ত প্রথার ফলে কোন শ্রেণির উদ্ভব ঘটে?

সুবিধাভোগী শ্রেণি।

২. সামন্তপ্রথায় পরগাছা শ্রেণি কাদের বলা হত?

মধ্যস্বত্বভোগী শ্রেণি।

৩. অরাজকতা ও মাৎস্যন্যায় থেকে রাষ্ট্রকে রক্ষা করে কারা?

সামন্তরা।

৪. সামন্ত প্রথার অন্যতম কুফল কি?

জমির উপর করের হার বৃদ্ধি।

Leave a Comment