চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম, বংশপরিচয়, সিংহাসনে আরোহণ, মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা, গ্রীকদের বিতাড়ন, দাক্ষিণাত্য জয়, পশ্চিম ভারত জয়, শাসন ব্যবস্থা ও তাঁর অবদান সম্পর্কে জানুন।

প্রাচীন ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম পরিচয়, পিতৃ পরিচয়, বাল্যকাল, আলেকজান্ডার এর সাথে সাক্ষাৎ, কোটিল্যের সাহায্যলাভ, মগধ এর বিরুদ্ধে প্রথম অভিযান, ধননন্দ এর উচ্ছেদ, গ্রীকদের বিতাড়ন, দাক্ষিণাত্য জয়, সেলুকাস এর সাথে যুদ্ধ, শাসন ব্যবস্থা, অমাত্য সেনাপতি, সাম্রাজ্যের প্রদেশ, রাজধানী পাটলিপুত্র এর শাসন ব্যবস্থা, গুপ্তচর ব্যবস্থা, আয়ের উৎস, প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্য এবং তাঁর শেষ জীবন ও মৃত্যু সম্পর্কে জানবো।

মৌর্য সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

ঐতিহাসিক চরিত্রচন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
রাজত্ব৩২৪ খ্রীষ্টপূর্ব – ২৯৮ খ্রীষ্টপূর্ব
পূর্বসূরিনন্দ বংশ -এর ধননন্দ
উত্তরসূরি বিন্দুসার (পুত্র)
জন্মআনুমানিক ৩৪০ খ্রিস্টপূর্ব, পাটলিপুত্র
মৃত্যু  ২৯৮ খ্রিস্টপূর্ব, শ্রাবণবেলাগল
পত্মীহেলেনা (সেলুকাস -এর কন্যা), দুর্ধরা, নন্দিনী (মহাপদ্মনন্দ -এর কন্যা)
রাজবংশ  মৌর্য সাম্রাজ্য
মাতা মুরা
ধর্ম  জৈন ধর্ম
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

ভূমিকা :- মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধু দক্ষ যোদ্ধা ও বিশাল সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, তিনি একজন সফল প্রশাসকও ছিলেন।

প্রাচীন ভারতের প্রথম সাম্রাজ্য

প্রাচীন ভারতে খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে সাম্রাজ্যের বিকাশ ঘটে। মৌর্য সাম্রাজ্যই ভারত -এর ইতিহাসে প্রথম সর্বভারতীয় সাম্রাজ্য।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও অশোক

মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য। মৌর্য সম্রাটরা বহু-বিভক্ত ভারতকে ঐক্যবদ্ধ করে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। রাজ্য জয়, সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা এবং ধর্ম প্রচারের ক্ষেত্রে মৌর্য বংশের দুজন সম্রাট – চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও সম্রাট অশোক বিশ্বব্যাপী খ্যাতি অর্জন করেছিলেন।

আলেকজান্ডারের মৃত্যু

৩২৩ খ্রিস্টপূর্বাব্দে ব্যাবিলনে আলেকজান্ডারের মৃত্যু হলে তাঁর অধিকৃত ভারতীয় অঞ্চলে গ্রিকদের মধ্যে আতঙ্ক, অনিশ্চয়তা এবং বিরোধ দেখা দেয়।

অত্যাচারী ধননন্দ

এই সময়ে মগধে নন্দবংশীয় সম্রাট ধননন্দ রাজত্ব করছিলেন। প্রজাদেরকে দমন পীড়ন করতেন বলে তিনি মোটেও জনপ্রিয় ছিলেন না।

মৌর্য সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা

এই পরিস্থিতিতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য মগধ -এর সিংহাসন দখল করেন এবং উত্তর পশ্চিম ভারত থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করে ভারতে এক বিশাল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রতিষ্ঠিত সাম্রাজ্য ইতিহাসে মৌর্য সাম্রাজ্য নামে বিখ্যাত।

ড. রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাকে প্রাচীন ভারতের ইতিহাসে এক অনন্য ঘটনারূপে বর্ণনা করেছেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয়

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বংশপরিচয় সর্ম্পকে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে।

  • (১) হিন্দু সাহিত্যিক উপাদানের প্রমাণানুসারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন নন্দ বংশোদ্ভূত। তাঁর মায়ের নাম ছিল মূরা এবং তিনি ছিলেন এক নন্দ রাজার পত্নী বা উপ-পত্নী। অনেকে মনে করেন যে মাতা মূরার নামানুসারেই তাঁর প্রতিষ্ঠিত বংশের নাম হয় মৌর্য। কিন্তু সংস্কৃত ব্যাকরণ -এর নিয়ম অনুসারে মূরার পুত্র হয়‘মৌরেয়’, মৌর্য নয়।
  • (২) মধ্যযুগীয় শিলালিপিতে মৌর্যদের ক্ষত্রিয় বলে উল্লেখ করা হয়েছে। বৌদ্ধ লেখকদের মত অনুসারে, মৌর্যরা ছিলেন ক্ষত্রিয়। গৌতম বুদ্ধ -এর আমলে তাঁরা পিপ্পলিবন নামক প্রজাতান্ত্রিক রাজ্যের শাসক ছিলেন বলে জানা যায়।
  • (৩) মুদ্রারাক্ষস নামক নাটকে চন্দ্রগুপ্তকে ‘বৃষল’ বলা হয়েছে। তাই অনেকে মনে করেন যে তিনি শূদ্র ছিলেন। তবে ‘বৃষল’ শব্দটি শুধু শূদ্রকেই বোঝায় না। এ শব্দটির অন্য দুটি অর্থ আছে –

(ক) রাজ-শ্রেষ্ঠ

বিশাল সাম্রাজ্য এবং সুশৃঙ্খল শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠার জন্য চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য রাজ-শ্রেষ্ঠ হিসাবেও ‘বৃষল’ রূপে আখ্যায়িত হতে পারেন।

(খ) জাতিচ্যুত

হিন্দু ধর্মাবলম্বী হয়েও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য গ্রিক কন্যাকে বিয়ে করেছিলেন। তাছাড়া শেষ জীবনে জৈন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন বলে জাতিচ্যুত হিসাবে তাঁকে ‘বৃষল’ বলা যেতে পারে।   

  • (৪) জৈন কিংবদন্তী অনুসারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন ময়ূর-পোষক এক গ্রাম-প্রধানের দৌহিত্র।
  • (৫) বৌদ্ধ উৎসসমূহে মৌর্যদের ক্ষত্রিয় বলে বর্ণনা করা হয়েছে।
  • (৬) মহাবংশে তাঁকে মৌর্য নামের ক্ষত্রিয় বংশের সন্তান বলে উল্লেখ করা হয়েছে।
  • (৭) দিব্যাবদানে বিন্দুসার ও অশোককে ক্ষত্রিয়রূপেই উল্লেখ করা হয়েছে।
  • (৮) মহাপরিনির্বাণ সূত্রে মৌর্যদের পিপ্পলিবনের শাসকগোষ্ঠীরূপে উল্লেখ করা হয়েছে।

উল্লেখিত উৎসগুলোর মধ্যে বৌদ্ধ উৎসগুলো সবচেয়ে প্রাচীন এবং এই কারণে পন্ডিতরা মনে করেন যে, মৌর্যরা ক্ষত্রিয় ছিলেন।

পিপ্পলিবনের মৌর্যরা

গৌতম বুদ্ধের সময়ে মৌর্যরা ছিলেন পিপ্পলিবনের শাসকগোষ্ঠী। পরবর্তীকালে পিপ্পলিবন মগধ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয় যায়। খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকে মৌর্যরা দুর্দশাগ্রস্ত হয়ে পড়ে।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম

বৌদ্ধ কিংবদন্তী থেকে জানা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পিতার মৃত্যুর পর তাঁর মাতা অন্তঃসত্তা অবস্থায় মগধের রাজধানী পাটলিপুত্রে আশ্রয় নেন। সেখানেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের জন্ম হয়। এক রাখাল চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে পোষ্যপুত্র হিসাবে গ্রহণ করে তাঁকে নিকটবর্তী এক গ্রামে নিয়ে যায়।

চন্দ্রিগুপ্ত মৌর্যের বাল্যকাল

কিংবদন্তী অনুসারে বাল্যকালে তিনি গো-পালক ও শিকারীদের মাঝে বড় হয়ে ওঠেন। সেখান থেকে কৌটিল্য নামে তক্ষশীলার এক ব্রাহ্মণ পন্ডিত তাঁকে তক্ষশীলায় নিয়ে গিয়ে রাজনৈতিক ও সামরিক শিক্ষা দান করেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ও আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎ

প্লুটার্ক ও জাস্টিনের বিবরণ থেকে জানা যায় যে আলেকজান্ডারের ভারত আক্রমণ -এর সময় চন্দ্রগুপ্ত মগধের অত্যাচারী নন্দরাজা ধননন্দকে উৎখাত করার জন্য আলেকজান্ডারকে আমন্ত্রণ জানাতে পাঞ্জাবে আলেকজান্ডারের শিবিরে গিয়েছিলেন।

আলেকজান্ডার কর্তৃক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যুদণ্ডের নির্দেশ

আলেকজান্ডার চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে তাঁর মৃত্যুদন্ডের আদেশ দেন। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পাঞ্জাব থেকে পালিয়ে আসেন। তখন থেকেই চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ভারত থেকে গ্রিক ও নন্দদের উৎখাত করার চেষ্টা করতে থাকেন।

কৌটিল্যের সাহায্য পান চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

ভারত থেকে গ্রিক-বিতাড়ন ও নন্দ-সাম্রাজ্যের ধ্বংস সাধনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য তক্ষশীলার ব্রাহ্মণ পন্ডিত কৌটিল্যের সাহায্যে পেয়েছিলেন। আর্থিক সাহায্যের আশায় কৌটিল্য পাটলিপুত্রে এসে নন্দরাজার কাছে অপমানিত হয়েছিলেন বলে তিনিও নন্দদের প্রতি ক্ষুব্ধ ছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রথম অভিযান

তিনি প্রথমে নন্দবংশের উচ্ছেদ সাধন করেছিলেন নাকি গ্রিকদের বিতাড়িত করেছিলেন সে বিষয়ে পন্ডিতদের মধ্যে বিভিন্ন মত রয়েছে।

  • (১) গ্রিক ঐতিহাসিক জাস্টিনের বর্ণনা থেকে দেখা যায় যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথমে পাটলিপুত্র দখল করেন এবং পরে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন। ডঃ রায়চৌধুরী এবং ভিনসেন্ট স্মিথও এই মতকে সমর্থন করেন।
  • (২) ঐতিহাসিক রাধাকুমুদ মুখোপাধ্যায় অবশ্য মনে করেন যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পাঞ্জাবে গ্রিকদের পরাজিত করার পর মগধ-রাজ ধননন্দকে সিংহাসনচ্যুত করেন।
  • (৩) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রথমে পাটলিপুত্র অধিকার করেন এবং পরে গ্রিকদের বিতাড়িত করেন – এই মতই বর্তমানে অধিক গ্রহণযোগ্য।

চন্দগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনে আরোহন

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসনারোহণের তারিখ সম্পর্কে পন্ডিতদের মধ্যে মতভেদ আছে।

  • (১) গ্রিক উৎস থেকে জানা যায় যে, ৩২৬ অথবা ৩২৫ খ্রিস্টপূর্বাব্দে তিনি পাঞ্জাবে আলেকজান্ডারের সঙ্গে দেখা করেছিলেন। তবে তখনো তিনি রাজা হননি।
  • (২) জৈন পরিশিষ্ট পার্বণ গ্ৰন্থে বলা হয়েছে যে, মহাবীর -এর সিদ্ধি লাভের ১৫৫ বছর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসনে বসেন। কিন্তু মহাবীরের সিদ্ধি লাভের তারিখ অনিশ্চিত বলে এই সূত্র থেকে সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না।
  • (৩) বৌদ্ধ সাহিত্য থেকে জানা যায় যে গৌতম বুদ্ধের নির্বাণলাভের ১৬২ বছর পরে চন্দ্রগুপ্ত সিংহাসনে বসেছিলেন। ক্যান্টনের দিনপঞ্জি অনুসারে বুদ্ধের মৃত্যু হয়েছিল ৪৮৬ খ্রিস্টপূর্বাব্দে। সেদিক থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সিংহাসন লাভের সময় হল (৪৮৬ – ১৬২) = ৩২৪ খ্রিস্টপূর্বাব্দ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গ্রিক বিতাড়ন

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পরই ভারতে তাঁর অধিকৃত অঞ্চলে গ্রিক গভর্নরদের মধ্যে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব শুরু হলে সেখানে বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি হয়।

  • (১) সিন্ধুর গভর্নর ও পাঞ্জাবের গভর্নরের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।
  • (২) কিছুদিন পরে তক্ষশীলায় কৌটিল্যের নেতৃত্বে গ্রিক-বিরোধী বিদ্রোহ দেখা দেয়।
  • (৩) এই সময় আততায়ীর হাতে পুরু নিহত হলে স্থানীয় অধিবাসীরা ক্ষোভে ফেটে পড়ে।

এরকম পরিস্থিতিতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পক্ষে এদেশ থেকে গ্রিকদের বিতাড়িত করা সহজ হয়েছিল।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক ধননন্দের উচ্ছেদ

মগধের রাজা ধননন্দ ছিলেন অত্যাচারী। জনগণ তাঁর অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল। চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য এই পরিস্থিতিকে কাজে লাগিয়ে ধননন্দ তথা নন্দবংশের উচ্ছেদ করে সিংহাসন দখল করেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে জনগণের সাহায্য

দেশের বিশৃঙ্খল পরিস্থিতিতে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য নিজেকে দেশপ্রেমিক হিসাবে তুলে ধরেন। একদিকে বিদেশী শাসনের অবসান এবং অন্যদিকে অত্যাচারী শাসকের উচ্ছেদ উভয় লক্ষ্যেই তিনি জনগণের সাহায্য লাভ করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কর্তৃক ব্যর্থ পাটলিপুত্র আক্রমণ

পাটলিপুত্র দখলের উদ্দেশ্যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য পরিচালিত প্রথম দুটি সরাসরি আক্রমণ ব্যর্থ হয়।

কৌটিল্যের সাহায্যে পাটলিপুত্র আক্রমণে সফলতা

এর পর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কৌটিল্যের সাহায্যে মগধ সাম্রাজ্যের সীমান্ত এলাকা থেকে অভিযান শুরু করেন এবং রাজধানী পাটলিপুত্র অধিকার করতে সক্ষম হন। নন্দ সেনাপতি ভদ্রশাল বিপুল সংখ্যক সৈন্য নিয়ে চন্দ্রগুপ্তকে বাধা দিলেও পরাজিত হন।

বিজয়ী বীর চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন একজন বিজয়ী বীর। ক্ষমতা লাভের পর তিনি ভারতের এক বিশাল অংশ জুড়ে তাঁর সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করেন।

  • (১) প্লুর্টাক বলেছেন যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছয়লক্ষ সৈন্য নিয়ে প্রায় সমগ্র ভারত দখল করেছিলেন।
  • (২) জাস্টিন বলেছেন যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য ছিলেন ‘ভারতের মালিক’।  

চন্দ্রগুপ্তের দাক্ষিণাত্য বিজয়

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দাক্ষিণাত্য বিজয় নিয়ে পন্ডিতদের মধ্যে মতাভেদ রয়েছে।

(১) ভিনসেন্ট স্মিথথের মত

ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথের মতে, চন্দ্রগুপ্ত নয়, দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন তাঁর পুত্র বিন্দুসার। তিনি বলেছেন যে সাধারণ অবস্থা থেকে সিংহাসন দখল, গ্রিকদের বিতাড়ন, পশ্চিম ভারত জয়, সেলুকাসকে পরাজিত করা – এত কিছু করার পর চন্দ্রগুপ্তের পক্ষে সুদূর দাক্ষিণাত্য জয় করা সম্ভব ছিল না।

(২) তারানাথের বক্তব্য

ঐতিহাসিক তারানাথের বক্তব্য থেকে জানা যায় যে, বিন্দুসার ষোলটি রাজ্যের রাজাকে পরাজিত করেছিলেন।

(৩) অধিকাংশ পন্ডিতের মত

তবে অধিকাংশ পণ্ডিতের মতে, বিন্দুসারের পক্ষে দাক্ষিণাত্য জয় করা সম্ভব ছিল না। কোনো উৎসেই বিন্দুসারের দাক্ষিণাত্য অভিযানের বিন্দুমাত্র ইঙ্গিত নেই।

(৪) বিন্দুসার যোদ্ধাসুলভ গুণের অধিকারী নয়

বিন্দুসার যোদ্ধাসুলভ কোনো গুণেরও অধিকারী ছিলেন না। তাঁর রাজত্বকালে তক্ষশীলায় বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি নিজে বিদ্রোহ দমন করতে না গিয়ে ছেলে অশোককে পাঠিয়েছিলেন। যে রাজা নিজের রাজ্যের অঞ্চলেই বিদ্রোহ দমন করতে যাননি, তিনি পর্বতাকীর্ণ দুর্গম দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন এ কথা মেনে নেওয়া কষ্টসাধ্য।

(৫) গ্রিক লেখকদের বর্ণনা

গ্রিক লেখকদের বিবরণ থেকে জানা যায় যে, বিন্দুসার ডুমুর ও মিষ্টি মদ পছন্দ করতেন এবং দরবারে বসে পন্ডিত ব্যক্তিদের সাথে দার্শনিক তত্ত্ব আলোচনা করতে ভালোবাসতেন। এ হেন চরিত্রের বিন্দুসার দাক্ষিণাত্য জয় করবেন এটা ভাবাই যায় না।

(৬) ড. রায়চৌধুরীর মত

ড. রায়চৌধুরী মনে করেন যে, মৌর্যদের দাক্ষিণাত্য জয় করার কোনো প্রয়োজনই ছিল না। তাঁর মতে দাক্ষিণাত্য ছিল নন্দদের সাম্রাজ্যভুক্ত। কাজেই নন্দ রাজাকে পরাজিত করে পাটলিপুত্র -এর সিংহাসন দখল করার সাথে সাথে নন্দ সাম্রাজ্যের অংশ হিসাবে দাক্ষিণাত্য মৌর্য সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়ে যায়।

(৭) ড. রায়চৌধুরীর মতের সাক্ষ্য

তাঁর মতের স্বপক্ষে ড. রায়চৌধুরী গোদাবরী নদীর তীরে নও-নন্দ-দেহরা নামে একটি শহরের অস্তিত্বের কথা উল্লেখ করেছেন। এই শহরের অস্তিত্ব থেকে তিনি মনে করেন যে, দাক্ষিণাত্যের একটা বিরাট অঞ্চল নন্দ সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত ছিল। প্রাচীন তামিল সাহিত্যেও নন্দদের বিপুল ধন-সম্পদের উল্লেখ পাওয়া যায়।

(৮) স্বাধীন দাক্ষিণাত্য

তবে এমনও হতে পারে যে নন্দদের শাসনকালে বা তাঁদের পতনের পর দাক্ষিণাত্য স্বাধীন হয়ে যায়। এই কারণেই মৌর্যদের জন্য নতুন করে দাক্ষিণাত্য জয় করা প্রয়োজন হয়ে পড়ে।

(৯) ড. কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গারের মতামত

ড. কৃষ্ণস্বামী আয়েঙ্গার বলেছেন যে, একজন প্রাচীন তামিল গ্রন্থকার মৌর্যদের তিনেভেলী জেলা পর্যন্ত অগ্রসর হওয়ার কথা বারবার উল্লেখ করেছেন। তবে চন্দ্রগুপ্তের নাম উল্লেখ না করে তিনি এ রাজাকে ‘মৌর্যভূঁইফোড়’ বলে উল্লেখ করেছেন। এর থেকে মনে করা যায় যে, সাধারণ অবস্থা থেকে সিংহাসনে উন্নীত প্রথম মৌর্যসম্রাট চন্দ্রগুপ্তকেই বোঝানো হয়েছে।

(১০) মহিশুরে প্রাপ্ত শিলালিপি থেকে প্রমাণ

মহীশুরে প্রাপ্ত কিছু শিলালিপিতে উত্তর মহীশুরে চন্দ্রগুপ্তের শাসনের উল্লেখ পাওয়া যায়। একটি শিলালিপিতে বলা হয়েছে যে, শিকারপুর তালুকের অন্তর্গত নাগরখন্ড চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনাধীনে ছিল।

(১১) মুদ্রারাক্ষসের বর্ণনা

মুদ্রারাক্ষসেও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের দাক্ষিণাত্য অধিকারের ইঙ্গিত পাওয়া যায়। কাজেই প্লুটার্ক ও জাস্টিনের বর্ণনা, তামিল সাহিত্য এবং মহীশুরে প্রাপ্ত শিলালিপির সাক্ষ্য বিবেচনা করলে মনে হয় যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন।

(১২) বিভিন্ন জৈন কাহিনী

জৈন কাহিনীগুলোতেও দাক্ষিণাত্যের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যোগাযোগের উল্লেখ আছে। ঐ সব কাহিনীতে বলা হয়েছে যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন ত্যাগ করে একদল জৈন ভিক্ষুর সঙ্গে ভদ্রবাহুর নেতৃত্বে দাক্ষিণাত্যে চলে যান এবং জৈন বিধিমতে অনাহারে মহীশুরের শ্রাবণবেলাগোলায় দেহত্যাগ করেন।

এই সবকিছু বিবেচনা করে আধুনিক পন্ডিতরা মনে করেন যে, চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই দাক্ষিণাত্য জয় করেছিলেন।

পশ্চিম ভারত জয় করেন চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের পশ্চিম ভারত জয় সম্পর্কে কোনো সন্দেহের অবকাশ নেই। পশ্চিম ভারতের সৌরাষ্ট্র তাঁর শাসনাধীন ছিল। মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামন -এর ১৫০ খ্রিস্টাব্দে উৎকীর্ণ জুনাগড় শিলালিপিতে সৌরাষ্ট্রে চন্দ্রগুপ্তের প্রাদেশিক শাসনকর্তা পুষ্যগুপ্ত কর্তৃক বিখ্যাত সুদর্শন হ্রদ খননের উল্লেখ আছে।

সেলুকাসের ভারত অভিযান

আলেকজান্ডারের মৃত্যুর পর ম্যাসিডনীয় সাম্রাজ্য বিভক্ত হয়ে পড়লে তার সেনাপতি সেলুকাস প্রথমে ব্যাবিলন ও পরে সিরিয়া দখল করেন। এরপর তিনি ভারতে আলেকজান্ডারের বিজিত অঞ্চলগুলো দখল করার চেষ্টা করেন।

সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যুদ্ধ

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজত্বের শেষ ভাগে সেলুকাসের সঙ্গে যুদ্ধের ফলে উত্তর পশ্চিম ভারতে মৌর্য সাম্রাজ্যের আরো বিস্তৃতি ঘটে। গ্রিক লেখকদের বিবরণে সেলুকাসের সঙ্গে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের যুদ্ধের কোনো বিবরণ নেই।

সেলুকাস ও চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বন্ধুত্ব

গ্রিক ঐতিহাসিকদের বিবরণে সিন্ধু নদী অতিক্রম ও বৈবাহিক সম্পর্কের মাধ্যমে চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেলুকাসের বন্ধুত্ব স্থাপনের উল্লেখ রয়েছে।

  • (১) জাস্টিন চন্দ্রগুপ্তের সঙ্গে সেলুকাসের বন্ধুত্ব স্থাপনের কথা বলেছেন।
  • (২) প্লুটার্ক বলেছেন যে চন্দ্রগুপ্ত সেলুকাসকে ৫০০ হাতি উপহার দিয়েছিলেন।
  • (৩) স্ট্র্যাবোর মতে, তাদের এই বন্ধুত্বের ফলে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন এবং উত্তর পশ্চিম ভারতে আলেকজান্ডারের অধিকৃত চারটি প্রদেশ চন্দ্রগুপ্তকে দান করা হয়।
  • (৪) মনে করা হয় যে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিরুদ্ধে সেলুকাস সাফল্য লাভ করতে পারেন নি। তাই তিনি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সঙ্গে বন্ধুত্ব ও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেছিলেন। ঐতিহাসিক ভিনসেন্ট স্মিথ এই বিবাহের কথা স্বীকার করেন না।
  • (৫) ড. রায়চৌধুরী মনে করেন যে জামাতাকে যৌতুক হিসাবেই সেলুকাস চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যকে চারটি প্রদেশ দিয়েছিলেন। এ প্রদেশ চারটি ছিল হিরাট, কান্দাহার, মাকরান এবং বেলুচিস্থান। উত্তর পশ্চিমের এসব এলাকা যে মৌর্য সাম্রাজ্যভুক্ত ছিল তা অশোকের শিলালিপি দ্বারা প্রমাণিত।
  • (৬) বন্ধুত্বের এই সম্পর্কের সূত্র ধরেই সেলুকাস চন্দ্রগুপ্তের দরবারে দূত হিসাবে মেগাস্থিনিসকে পাঠিয়েছিলেন। গ্রিকদের সঙ্গে মৌর্যদের এই কূটনৈতিক সম্পর্ক পরবর্তীকালেও অব্যাহত ছিল।

প্রশাসক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য শুধু দক্ষ যোদ্ধা ও সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতাই ছিলেন না, তিনি ছিলেন একজন সফল প্রশাসকও। বিশাল সাম্রাজ্য সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য তিনি একটি সুবিন্যস্ত শাসনব্যবস্থাও প্রতিষ্ঠা করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে জানার উপাদান

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা সর্ম্পকে জানতে বেশ কিছু উৎস রয়েছে।

  • (১) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র গ্ৰন্থ।
  • (২) গ্রিক রাষ্ট্রদূত মেগাস্থিনিসের বিবরণ – ইন্ডিকা গ্ৰন্থ।
  • (৩) অশোকের শিলালিপিগুলো এ প্রসঙ্গে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য উৎস।
  • (৪) মহাক্ষত্রপ রুদ্রদামনের জুনাগড় প্রস্তরলিপি ও কিছু সাহিত্যিক রচনা থেকেও তাঁর শাসনব্যবস্থা সম্পর্কে কিছু তথ্য জানা যায়।

মৌর্য সাম্রাজ্যের শাসন ব্যবস্থা

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শাসনব্যবস্থা দুই ভাগে বিভক্ত ছিল – কেন্দ্রীয় ও প্রদেশিক।

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থা

কেন্দ্রীয় শাসনব্যবস্থায় তিনটি অংশ ছিল – রাজা, অমাত্য বা সচিব এবং মন্ত্রীপরিষদ।

(ক) রাজা

রাজা ছিলেন রাজ্যের সর্বোচ্চ ক্ষমতাশীল ব্যক্তি। বিশাল সাম্রাজ্যের সম্পদের মালিকানা এবং বিশাল সেনাবাহিনীর ওপর কর্তৃত্ব ছিল তাঁর ক্ষমতার উৎস।

(খ) অমাত্যদের প্রধান মহামন্ত্রী

সচিব বা অমাত্যদের মধ্যে যারা সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিলেন তাদের বলা হতো ‘মন্ত্রিণ’ বা ‘মহামন্ত্রী’। অশোকের শিলালিপিতে উল্লেখিত মহামাত্রগণই সম্ভবত চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আমলে ‘মন্ত্রিণ’ বা ‘মহামন্ত্রী’ নামে অভিহিত হতেন।

(গ) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সাম্রাজ্যে ছিল উপদেষ্টা পরিষদ – মন্ত্রিপরিষদ

মন্ত্রিণগণ ছাড়াও মন্ত্রীপরিষদ নামে একটি উপদেষ্টা পরিষদ ছিল। মৌর্য শাসন ব্যবস্থায় গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসাবে এই পরিষদের অবস্থান অশোকের শিলালিপি থেকে প্রমাণিত।

মন্ত্রীণদের পরামর্শ নিতেন রাজা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

শাসন সম্পর্কিত কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করার আগে রাজা তিন -চারজন মন্ত্রিণের সঙ্গে আলোচনা করতেন। জরুরি অবস্থায় মন্ত্রী পরিষদের সঙ্গে মন্ত্রিণগণকেও ডাকা হতো।  কৌটিল্য ছিলেন এমনি একজন মন্ত্রিণ।

অন্যান্য অমাত্য

মন্ত্রিণ ও মন্ত্রীপরিষদের সদস্যগণ ছাড়াও তৃতীয় এক শ্রেণির অমাত্য বিভিন্ন ধরনের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে নিযুক্তি পেতেন। এদের মধ্যে সমাহর্ত্রী (রাজস্ব আদায় বিভাগের কর্মকর্তা), সন্নিধাত্রী (কোষাগারের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা) উল্লেখযোগ্য।

পুরোহিতের স্থান সর্বোচ্চ

পদস্থ অন্যান্য রাজকর্মচারীদের মধ্যে পুরোহিতের স্থান ছিল সর্বোচ্চ। তিনি ছিলেন রাজার ধর্মীয় বিষয়ে উপদেষ্টা। রাজদ্রোহের অপরাধেও তাঁকে মৃত্যুদন্ড দেওয়া যেতো না।

পুরোহিতের পরই যুবরাজের স্থান

পুরোহিতের পরেই স্থান ছিল যুবরাজের। তিনি কার্য-নির্বাহী বিভাগের অন্তর্গত কোনো নির্দিষ্ট বিভাগের ভারপ্রাপ্ত ছিলেন নাকি সাধারণভাবে শাসনকাজের সঙ্গে যুক্ত থেকে রাজনৈতিক শিক্ষালাভ করতেন তা স্পষ্ট নয়।

সেনাপতি

সেনাপতি ছিলেন সেনাবাহিনীর ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। তবে তিনি সেনা-প্রধান না যুদ্ধমন্ত্রী ছিলেন তা বলা কঠিন।

প্রতিহার

রাজার ব্যক্তিগত নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকতেন প্রতিহার।

অধ্যক্ষ

বিভিন্ন বিভাগের দায়িত্ব পালন করতেন অধ্যক্ষগণ। এদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নগরাধ্যক্ষ (নগর), বলাধ্যক্ষ (সেনাবিভাগ), সুতাধ্যক্ষ (কৃষি), সূত্রাধ্যক্ষ (বয়ন), শুল্কাধ্যক্ষ (শুল্ক) ইত্যাদি।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রদেশ

তাঁর সাম্রাজ্যের আয়তন ছিল বিশাল। মৌর্য সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পাটলিপুত্র। রাজধানী পাটলিপুত্র থেকে সুষ্ঠুভাবে শাসন করা সম্ভব ছিল না। তাই তিনি তাঁর সাম্রাজ্যেকে কয়েকটি প্রদেশে ভাগ করেছিলেন।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৌর্য সাম্রাজ্যের চারটি প্রদেশ

অশোকের শিলালিপিতে উত্তরাপথ, অবন্তী, দক্ষিণাপথ, কলিঙ্গ এবং প্রাচ্য নামে মোট পাঁচটি প্রদেশের উল্লেখ দেখা যায়। কলিঙ্গ যুদ্ধ -এর পর সম্রাট অশোক কলিঙ্গ প্রদেশটি যুক্ত করেন ।

পাঁচটি প্রদেশের রাজধানী

উত্তরাপথ প্রদেশের রাজধানী তক্ষশীলা। অবন্তী প্রদেশের রাজধানী উজ্জয়িনী। দক্ষিণাপথ প্রদেশের রাজধানী সুবর্ণগিরি। প্রাচ্য প্রদেশের রাজধানী পাটলিপুত্র এবং কলিঙ্গ প্রদেশের রাজধানী তোষালি।

প্রদেশপাল – রাজকুমার

দূরবর্তী প্রদেশগুলোতে সাধারণত রাজকুমারদের প্রদেশপাল হিসাবে নিয়োগ করা হত। কৌটিল্যের অর্থশাস্ত্র থেকে জানা যায় যে, প্রদেশপালের উপাধি ছিল ‘কুমার’।

বৃহৎ শহরে মহামাত্র নিয়োগ

সাম্রাজ্যের কেন্দ্রস্থলে অবস্থিত প্রাচ্য প্রদেশটি ছিল সম্রাটের প্রত্যক্ষ শাসনাধীন। প্রাচ্যের রাজধানী পাটলিপুত্র ছিল মৌর্য সাম্রাজ্যের কেন্দ্রীয় রাজধানী। এই প্রদেশের শাসনকাজে সাহায্যের জন্য সম্রাট মহামাত্র নিয়োগ করেন।

জনপদ

মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রদেশগুলি কয়েকটি জনপদে বিভক্ত ছিল। জনপদের শাসন পরিচালনা করতেন সমাহর্ত্রী।

প্রদেষ্ট্রি

প্রদেষ্ট্রি নামক এক শ্রেণির কর্মচারী ছিল সমাহর্ত্রীর ভ্রাম্যমাণ সহকারী।

স্থানিক

জনপদের এক-চতুর্থাংশের শাসনভার স্থানিক নামক কর্মচারীর ওপর ন্যস্ত ছিল।  

গোপ

পাঁচ থেকে দশটি গ্রামের শাসনভার গোপ নামক কর্মচারীর ওপর ন্যস্ত ছিল।

গ্রামিক

প্রতি গ্রামের অধিবাসীরা গ্রামিক উপাধিকারী একজন কর্মচারীকে নির্বাচিত করতেন, যার ওপর গ্রামের শাসনভারের দায়িত্ব ছিল।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামরিক বাহনী

মেগাস্থিনিসের বর্ণনা থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের সামরিক বাহিনীর সংগঠন সম্পর্কে জানা যায়। চন্দ্রগুপ্তের সেনাবাহিনীতে পদাতিক, অশ্বারোহী, রথারোহী ও হস্তি আরোহী সৈন্য ছিল। এছাড়া তাঁর একটি নৌ-বাহিনীও ছিল।

সামরিক পরিষদ

ত্রিশজন সদস্য নিয়ে গঠিত একটি পরিষদের ওপর ন্যস্ত ছিল সামরিক বিভাগ পরিচালনার দায়িত্ব। এই পরিষদ আবার পাঁচজন সদস্য নিয়ে ছয়টি বোর্ডে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বোর্ড একটি নির্দিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে নিয়োজিত ছিল।

রাজধানী পাটলিপুত্রের শাসন ব্যবস্থা

রাজধানী পাটলিপুত্রের পরিচালনার ভার ছিল একটি নগর পরিষদের ওপর। এই পরিষদ পাঁচ জন সদস্য নিয়ে ছয়টি বোর্ডে বিভক্ত ছিল। প্রতিটি বোর্ড একটি নির্দিষ্ট বিভাগের দায়িত্বে নিযুক্ত থাকত।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের বিচারব্যবস্থা

মৌর্য সাম্রাজ্যে রাজা ছিলেন প্রধান বিচারক। দরবারে বসে তিনি বিচার করতেন।

  • (১) শহর ও গ্রামাঞ্চলে পৃথক বিচারালয় ছিল। শহরে বিচার করতেন মহামাত্রগণ এবং গ্রামাঞ্চলে বিচার করতেন রাজুকগণ।
  • (২) গ্রিক লেখকদের বিবরণে বিদেশীদের জন্য পৃথক বিচারকের কথা পাওয়া যায়।
  • (৩) অর্থশাস্ত্রে ধর্মীয়-দেওয়ানি আদালতকে ‘ধর্মস্থির’ এবং ফৌজদারি আদালতকে ‘কন্টকশোধন’ আখ্যা দেওয়া হয়েছে।
  • (৪) মেগাস্থিনিস এবং কৌটিল্য দুজনই ফৌজদারি আইনের বিশেষ কঠোরতার কথা বলেছেন। জরিমানা ছিল সাধারণ অপরাধের শাস্তি। বড় ধরনের অপরাধের শাস্তি ছিল অঙ্গচ্ছেদ ও শিরচ্ছেদ।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের গুপ্তচর

অর্থশাস্ত্রে গুপ্তচরদের সংস্থা এবং সঞ্চারা— এই দুই শ্রেণিতে ভাগ করা হয়েছে।

(১) সংস্থা

যারা নির্দিষ্ট স্থানে থাকত তাঁরা সংস্থা নামে পরিচিত। তাদের মধ্যে গৃহী, ব্যবসায়ী এবং সন্ন্যাসীরা অন্তর্ভুক্ত ছিল।

(২) সঞ্চারা

এক স্থান থেকে স্থানান্তরে সঞ্চরণরতদের বলা হতো সঞ্চারা। এই দলে ছিল ভিক্ষুণী সাপুড়ে, পরিব্রাজিকা, গণিকা এবং নর্তকী। স্ট্র্যাবো এবং কৌটিল্যের বর্ণনাতে গুপ্তচর বৃত্তিতে বহু সংখ্যক মহিলা নিয়োগের উল্লেখ আছে।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৌর্য সাম্রাজ্যের আয়ের উৎস

মৌর্য সাম্রাজ্যের আয়ের প্রধান উৎস ছিল ভূমি-কর। গ্রামাঞ্চলে সাধারণত দুধরনের কর ছিল- ভাগ এবং বলি।

(১) ভাগ

জমিতে উৎপন্ন ফসলের এক-ষষ্ঠাংশ রাজাকে দিতে হত, যা ভাগ নামে পরিচিত। তবে প্রয়োজনে এটা এক-চতুর্থাংশে উন্নীত বা এক অষ্টমাংশে হ্রাস করা হত।

(২) বলি

বলি ছিল অতিরিক্ত কর।

(৩) অন্যান্য কর

এছাড়াও শহরাঞ্চলে রাজস্ব-আয়ের প্রধান উৎস ছিল জন্ম-মৃত্যু কর, জরিমানা, বিক্রিত দ্রব্যের ওপর কর ইত্যাদি। গণিকা, পানশালা ইত্যাদি থেকেও রাজ্যের আয় হতো।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের শেষ জীবন

জৈন কাহিনী অনুসারে রাজত্বের শেষভাগে উত্তর ভারতে দুর্ভিক্ষ দেখা দিলে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সিংহাসন ত্যাগ করেন এবং জৈন সন্ন্যাসী ভদ্রবাহুকে অনুসরণ করে মহীশুরে চলে যান।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের মৃত্যু

মহীশুরের অর্ন্তগত শ্রাবণবেলগোলায় ২৯৮ খ্রিস্টপূর্বাব্দে জৈন বিধি অনুসারে অনাহারে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য প্রাণত্যাগ করেন।

উপসংহার :- মগধে মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য আজ পর্যন্ত প্রাচীন ভারতের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও প্রভাবশালী সম্রাটদের মধ্যে অন্যতম।

(FAQ) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য হতে জিজ্ঞাস্য?

১. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় আগত গ্রিক দূতের নাম কী ?

মেগাস্থিনিস ।

২. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন ?

কৌটিল্য বা চাণক্য বা বিষ্ণুগুপ্ত ।

৩. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কোন ধর্ম গ্রহণ করেছিলেন?

জৈন ধর্ম।

৪. মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে?

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

Leave a Comment