সার্ভেন্টিস

মিগেল দে সার্ভেন্টিস (১৫৪৭-১৬১৬) ছিলেন স্পেনের একজন বিশিষ্ট লেখক এবং বিশ্বসাহিত্যের অন্যতম শ্রেষ্ঠ রচয়িতা। তিনি বিশেষভাবে বিখ্যাত তার উপন্যাস ‘ডন কুইক্সোড’-এর জন্য, যা প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিভিন্ন ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সার্ভান্তেসের সাহিত্যকর্মে সমাজ, মানব প্রকৃতি এবং আদর্শবাদের প্রতি তীক্ষ্ণ দৃষ্টিভঙ্গি ফুটে ওঠে। তিনি রেনেসাঁ যুগের শেষের দিকে সক্রিয় ছিলেন এবং স্প্যানিশ সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করার ক্ষেত্রে অমূল্য অবদান রেখেছেন।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিস

ঐতিহাসিক চরিত্রসার্ভেন্টিস
পূর্ণ নামমিগেল দ্য সার্ভেন্টিস সাভেদ্রা
জন্ম২৯ সেপ্টেম্বর, ১৫৪৭, আলকালা দে হেনারেস, স্পেন
বিখ্যাত কাজডন কুইক্সোড
পেশালেখক, সৈনিক, কর সংগ্রাহক
সাহিত্যে অবদানআধুনিক উপন্যাসের প্রবর্তনকারী
প্রধান সাহিত্যিক যুগস্প্যানিশ স্বর্ণযুগ
প্রভাবমানব প্রকৃতি, সমাজ, আদর্শবাদ নিয়ে বিশ্লেষণ
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যিক প্রভাবনবজাগরণ বা রেনেসাঁ ও মানবতাবাদী চিন্তাধারা
মৃত্যু২৩ এপ্রিল, ১৬১৬, মাদ্রিদ, স্পেন
সার্ভেন্টিস

ভূমিকা :- কৌতুক-করুণ কাহিনী ডন কুইক্সোড-এর রচয়িতা হলেন সার্ভেন্টিস। এমন প্রতীকী রচনা বিশ্ব সাহিত্যের ভান্ডারে খুব কমই আছে। তাই তাঁর ডন কুইক্সোড গ্রন্থটিকে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ সৃষ্টি বলে স্বীকার করা হয়। কয়েক শতাব্দী অতিক্রম করে আজও এই কাহিনীর সমাদর বিন্দুমাত্র কমে নি। হতাশার বেদনায় দীর্ণ, আজীবন ভাগ্য বিড়ম্বিত সার্ভেন্টিস ডন কুইক্সোড চরিত্র চিত্রণ করেছিলেন যেন নিজেরই জীবনের আদলে। তাঁর জীবন যেন এক বিপদ-করুণ আলেখ্য। তাঁর সম্পূর্ণ নাম মিগেল দ্য সার্ভেন্টিস।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের জন্ম

তিনি জন্মগ্রহণ করেছিলেন ১৫৪৭ খ্রিস্টাব্দে স্পেনের এক দরিদ্র পরিবারে। তিনি ছিলেন পিতামাতার চতুর্থ সন্তান।

কল্পনাবিলাসী সার্ভেন্টিস

ছেলেবেলা থেকেই সার্ভেন্টিস ছিলেন কল্পনাবিলাসী। সব সময় নিজের ভাবনাচিন্তা নিয়েই মগ্ন থাকতেন। তবে চারণকবিদের মুখে অতীত যোদ্ধাদের বীরত্বব্যঞ্জক কাহিনী শুনতে ভালবাসতেন। বীরগাথা শুনতে শুনতে স্বপ্ন দেখতেন, তিনি একদিন বীর নাইটদের মতো অভিযানে বের হবেন।

নাবিক কলম্বাসের গল্প শুনে অভিভূত সার্ভেন্টিস

স্পেন যখন ইহুদি মুরদের কবলমুক্ত হয়ে শক্তিশালী সমৃদ্ধ রাষ্ট্র রূপে গড়ে উঠেছে, স্পেনের গৌরব ঘোষিত হচ্ছে দিকে দিকে, ইতিহাসের সেই গৌরবময় যুগে জন্ম সার্ভেন্টিসের। ছেলেবেলায় বয়স্কদের মুখে তিনি গল্প শুনতেন, স্পেনের রানী ইসাবেলার বদান্যতায় কী করে কলম্বাস আবিষ্কার করেছেন আমেরিকা মহাদেশ। রোমাঞ্চিত হতেন যখন শুনতেন, কী অপরিসীম বীরত্বে স্পেনের সেনাবাহিনী আফ্রিকার উপকূলের বিস্তৃত অঞ্চল অধিকার করে স্পেন রাষ্ট্রের সীমা বর্ধিত করেছে। স্বদেশের গৌরবে গৌরবান্বিত উদ্দীপিত বালক সার্ভেন্টিস স্বপ্ন দেখতেন, তিনি নিজেও একদিন দেশে দেশে বিস্তৃত করবেন স্পেনের অধিকার।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের পরিবারের অভাব

সাভোন্টিসের বাবা রোদ্রিগো পেশায় ছিলেন ডাক্তার। কিন্তু আয়-রোজগার তেমন হত না। তাই কায়ক্লেশে চলত তাঁর সংসার। সংসারের অভাব অনটন সত্ত্বেও রোদ্রিগো গ্রামের স্কুলে ভর্তি করিয়ে দিয়েছিলেন পুত্রকে। কিন্তু সেখানে বেশিদিন পড়াশুনা করার সুযোগ পেলেন না সার্ভেন্টিস। রোজগারপাতি বাড়াবার উদ্দেশ্যে রোদ্রিগো সপরিবারে উঠে গেলেন অন্য এক শহরে। কিন্তু মানুষটির ভাগ্য ছিল প্রতিকূল। স্থান পরিবর্তন করেও আর্থিক সমস্যার সুরাহা করতে পারলেন না। আশায় আশায় কিছুকাল এক শহর থেকে আরেক শহরে কেবল ঘুরে বেড়ালেন। শেষ পর্যন্ত মাদ্রিদ শহরে এসে স্থায়ীভাবে বসবাস আরম্ভ করলেন।

বিভিন্ন মানুষের সংস্পর্শে সার্ভেন্টিস

এই দেশভ্রমণ ভাগ্যের বিরূপতায় ঘটলেও সার্ভেন্টিসের জীবনে তা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করল। তিনি স্পেনের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্য ও বিভিন্ন ধরনের মানুষের সংস্পর্শে আসার সুযোগ পেলেন। মাদ্রিদ ছিল স্পেনের সাংস্কৃতিক কেন্দ্রস্থল। তিনি যখন এখানে এলেন তখন তাঁর বয়স উনিশ বছর।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের সাহিত্য চর্চা

প্রকৃতপক্ষে সাহিত্যপাঠে সার্ভেন্টিসের আগ্রহ ছিল বরাবর। হাতের কাছে যে বই পেতেন আগ্রহের সঙ্গে পড়তেন। কবিতা লেখার হাতেখড়িও হয়েছিল কিশোর বয়সেই। এই সূত্রেই পরিচয় হল মাদ্রিদের কয়েকজন তরুণ কবির সঙ্গে।একটি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেওয়া হলো সার্ভেন্টিসকে। অল্পদিনের মধ্যেই তাঁর কবিত্বশক্তি ও বুদ্ধিমত্তার পরিচয় পেয়ে স্কুলের প্রধান শিক্ষক তাঁর প্রতি আগ্রহান্বিত হলেন। তিনি তাঁকে সাহিত্য চর্চায় উৎসাহ দিতেন, পরামর্শ দিতেন। রচনার ভুল ত্রুটি সংশোধন করে দিতেন।

সার্ভেন্টিস কর্তৃক শোকগাথা রচনা

এই সময়ে স্পেনের যুবরাজ কার্লো হঠাৎ মারা গেলেন। সমস্ত দেশ হল শোকাহত। একটি শোকগাথা রচনা করলেন সার্ভেন্টিস। কবিতাটি খুবই প্রশংসিত হল। এই সাফল্যে অনুপ্রাণিত হয়ে তিনি স্থির করলেন সাহিত্য রচনাই হবে তাঁর জীবনের পথ।

রাজঅনুগ্রহ লাভের চেষ্টায় সার্ভেন্টিস

অভাবের সংসারে বাস্তব প্রয়োজনের তাগিদে তাঁকে অর্থ উপার্জনের জন্য কাজে নামতে হল। তবে তা প্রয়োজনের তুলনায় ছিল নগণ্য। ছোটভাই সৈন্যবিভাগে নাম লিখিয়েছিল। কিন্তু সৈনিকের কাজ সার্ভেন্টিসের পছন্দ ছিল না। তিনি ভাবতে লাগলেন, কোনওভাবে রাজঅনুগ্রহ লাভ করতে পারলে নিশ্চিন্তে সাহিত্য সাধনা করতে পারবেন। ততদিনে কবি হিসেবে তিনি সামান্য পরিচিতি লাভ করেছেন।

পোপের দরবারে সার্ভেন্টিস

সেই সময় ইতালিতে নতুন পোপ হলেন জুলিয়া অ্যাকোয়াভাইভা। তিনি ছিলেন শিল্পসাহিত্যের অনুরাগী। তাই দেশের শিল্পী সাহিত্যিকদের তাঁর দরবারে যোগদানের জন্য আহ্বান জানালেন। সার্ভেন্টিস যেন অন্ধকারের মধ্যে আশার আলো দেখতে পেলেন। একদিন ইউরোপ-এর শ্রেষ্ঠ কবি হবেন আশা ও স্বপ্ন নিয়ে একদিন তিনি উপস্থিত হলেন পোপের দরবারে। কিন্তু পোপের দরবারের পরিবেশ দেখে হতাশ হলেন সার্ভেন্টিস। অনুপ্রাণিত হবার মতো সাহিত্য-সংস্কৃতির কোনো চর্চা সেখানে নেই। আছে কেবল তোষামোদ আর চাটুকারিতা। গুণী ও গুণের কথা কেউ মাথায়ও রাখে না। হতাশ হয়ে পোপের দরবার ত্যাগ করলেন সার্ভেন্টিস।

স্পেনের যুদ্ধে সার্ভেন্টিসের যোগদান

কিন্তু রোজগারের একটা স্থায়ী ব্যবস্থা তো না করলেই নয়। বাধ্য হয়ে তিনি নাম লেখালেন সেনাবাহিনীতে। সেই সময় তুর্কীদের সঙ্গে স্পেনের আসন্ন যুদ্ধের সম্ভাবনায় সৈন্যবাহিনী সংগঠিত করা হচ্ছিল। এই বাহিনীর নেতৃত্বে ছিলেন স্পেনের রাজকুমার ডন জুয়ান। তাঁর বাহিনীতে যোগ দিলেন সার্ভেন্টিস। অনতি বিলম্বেই দুই পক্ষের সৈন্যবাহিনী মুখোমুখি যুদ্ধ শুরু করল। সাহসিকতার সঙ্গে যুদ্ধ করলেন সার্ভেন্টিস। ডন জুয়ানের নেতৃত্বে স্পেনের সৈন্যবাহিনী মরণপণ যুদ্ধ করে ধ্বংস করল তুর্কীদের। সার্ভেন্টিস গুরুতর আহত হলেন এই যুদ্ধে। ফলে তাঁর বাঁ হাতটি চিরতরে অকেজো হয়ে গেল।

আলজিয়ার্সে বন্দি সার্ভেন্টিস

তাঁর বীরত্বের পুরস্কার স্বরূপ ডন জুয়ান স্পেনের রাজদরবারে একটি চিঠি লিখে দিলেন যাতে তিনি একটি ভাল চাকরি পান। সার্ভেন্টিসের ছোট ভাইও সেই যুদ্ধে যোগ দিয়েছিলেন। ভাইকে সঙ্গে নিয়ে সার্ভেন্টিস জাহাজে চড়ে রওনা হলেন স্পেনের পথে। কিন্তু ভাগ্য ছিল বিরূপ। ইতালি থেকে স্পেনের সমুদ্র পথে কয়েকটি তুর্কী জাহাজের আক্রমণে বিধ্বস্ত হল স্পেনের সেনাদল। শক্তিশালী তুর্কীদের সঙ্গে যুদ্ধে যে কয়জন স্পেনের সৈন্য রক্ষা পেল তারা বন্দি হল। বন্দিদের মধ্যে ছিলেন সার্ভেন্টিস ও তাঁর ভাই। বন্দিদের নিয়ে আসা হল তুর্কী অধিকৃত আলজিয়ার্সে। সেখানে তাদের বন্দি করে রাখা হল একটি ছোট্ট আলো-বাতাসহীন কুঠুরিতে। খাবার দেওয়া হত খুবই সামান্য। সার্ভেন্টিস বুঝতে পারলেন পালাতে না পারলে এই বন্দিকূপে থেকে তাঁদের মরতে হবে। কিন্তু পালাবার কোনো পথই ছিল না।

সার্ভেন্টিসের ক্রীতদাস জীবন

কিছুদিনের মধ্যেই বন্দিদের বিভিন্ন তুর্কী নেতাদের বাড়িতে ক্রীতদাস হিসাবে বিক্রি করে দেওয়া হল। ফলে অন্ধকূপ থেকে বাইরে আসার সুযোগ পাওয়া গেল। কিন্তু সকলকেই বাধা করা হল হাড়ভাঙ্গা পরিশ্রম করতে।ছোট্ট শহর আলজিয়ার্স। সমুদ্র-ঘেরা শহরের চারদিক উচু পাঁচিলে ঘেরা। ওখান থেকে পালাবার কোনো পথ নেই। কিন্তু সার্ভেন্টিস ভাবতে থাকেন, যেমন করে হোক, অতি শীঘ্র এই বন্দিদশা থেকে মুক্ত হতে হবে। কেবল নিজে মুক্তি পেলেই চলবে না। স্পেনের যেসব অধিবাসী এখানে ক্রীতদাসের জীবন যাপন করছে, তাদেরও মুক্ত করতে হবে। বন্দিদের মধ্যে কেউ কেউ মাঝে মাঝে স্পেনে আত্মীয় পরিজনের কাছে খবর পাঠিয়ে মুক্তিপণের ব্যবস্থা করে স্পেনে ফিরে যাচ্ছিল। কিন্তু মোটা অঙ্কের মুক্তিপণ দেবার সামর্থ্য বেশির ভাগ মানুষেরই ছিল না। তাই সার্ভেন্টিস মুক্তি পাবার বিকল্প পথের সন্ধান করতে লাগলেন।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের পলায়নের পরিকল্পনা

সার্ভেন্টিসের ব্যবহারে সন্তুষ্ট হয়ে তাঁর মালিক তাঁকে শহরে ঘোরাফেরা করার অনুমতি দিয়েছিলেন। সার্ভেন্টিস এই সুযোগটাকে কাজে লাগাবেন মনস্থ করলেন। আলজিয়ার্সের অদূরেই ওরান নামে একটি ছোট শহর ছিল। সেই শহরটি ছিল স্পেনের সেনাবাহিনীর দখলে। কিন্তু দুই শহরের মাঝখানে ছিল দুর্ভেদ্য বিপদ-সঙ্কুল্য অরণা। ওরানে পৌঁছবার উদ্দেশ্যে পথের বিপদের সম্ভাবনাকেও তুচ্ছ জ্ঞান করলেন সার্ভেন্টিস। তাঁর মনে হল ক্রীতদাসের ঘৃণ্য জীবন থেকে বন্যজন্তুর হাতে মৃত্যু বরং অনেক সম্মানের। কথা বলে কয়েকজন সঙ্গীও জুটিয়ে নিলেন তিনি। পথ দেখিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য অর্থের লোভ দেখিয়ে একজন মুরকেও রাজি করা হলো।

পলায়নে ব্যর্থ সার্ভেন্টিস

একদিন রাতের অন্ধকারে প্রহরীদের দৃষ্টি এড়িয়ে সার্ভেন্টিস সঙ্গীদের নিয়ে বেরিয়ে পড়লেন। আলজিয়ার্সের সীমা অতিক্রম করে ওরানে পৌঁছবার পথ দুর্গম জঙ্গলের মধ্য দিয়ে। দুর্ভাগ্য ছিল সার্ভেন্টিসের নিত্যসঙ্গী। তাই জঙ্গলের মধ্যে পথ হারিয়ে ফেলল তাদের পথপ্রদর্শক। ফলে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে এগোতে সঙ্গীরা কেউই রাজি হল না। সার্ভেন্টিস দেখলেন, জঙ্গলের মধ্যে অনিশ্চিতভাবে ঘোরাঘুরি করলে বেঘোরে প্রাণ হারাতে হবে। বরং বেঁচে থাকলে ভবিষ্যতে কোনও এক সময় পালাবার সুযোগ পাওয়া যাবে। বাধ্য হয়ে সকলে মিলে ফিরে এলেন আলজিয়ার্সে এবং যথারীতি সামান্য শাস্তিও ভোগ করতে হল।

মায়ের কাছে সার্ভেন্টিসের চিঠি

বাড়ির দৈন্যদশার কথা জানতেন সার্ভেন্টিস। তাঁদের সহায়-সম্বলহীন দুঃখিনী মা সেখানে কায়ক্লেশে জীবনধারণ করছিলেন। তবুও মুক্তিপণের অর্থের কথা জানিয়ে তিনি স্পেনে মার কাছে চিঠি লিখলেন। ক্ষীণ একটা আশা ছিল সার্ভেন্টিসের মনে, যদি কোনও ভাবে মা টাকা সংগ্রহ করতে পারেন। সার্ভেন্টিস গোপনে ডন জুয়ানের কাছেও চিঠি লিখেছিলেন। ছেলের চিঠি পেয়ে বিধবা মা অস্থির হয়ে নানা জনের কাছে চেয়ে চিন্তে যা সংগ্রহ করতে পারলেন পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু ডন জুয়ানের কাছ থেকে কোনো সাড়াই পাওয়া গেল না। অবশ্য ডন জুয়ান সেই সময় নিজেই অত্যন্ত দূরবস্থার মধ্যে ছিলেন। মায়ের পাঠানো যৎসামান্য অর্থে ছোট ভাইয়ের মুক্তির ব্যবস্থা করে সার্ভেন্টিস তাকে স্পেনে পাঠিয়ে দিলেন। যাওয়ার আগে ভাইকে তিনি বলে দিলেন, স্পেনে তাঁর কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে যোগাযোগ করে গোপনে জাহাজ পাঠিয়ে দিতে। তিনি সেই জাহাজে করে স্পেনে পালিয়ে যেতে পারবেন।

পুনরায় কারাগারে বন্দি সার্ভেন্টিস

স্পেনে গিয়ে ছোট ভাই সার্ভেন্টিসের বন্ধুদের সঙ্গে যোগাযোগ করল। তারপর তাঁদের সাহায্য ও সহযোগিতায় জাহাজ পাঠিয়ে দিল আলজিয়ার্স অভিমুখে। গোপনে এই খবর পেয়ে সার্ভেন্টিস তাঁর সঙ্গীদের নিয়ে সঙ্কেত স্থানে গিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলেন। নির্দিষ্ট সময়ে জাহাজ এসে নোঙর করল সমুদ্রে, তীর থেকে খানিকটা দূরে। তারপর সকলকে জাহাজে নিয়ে আসার জন্য গোপনে নৌকো নামিয়ে দেওয়া হল। কিন্তু দুর্ভাগ্য সার্ভেন্টিসকে অনুসরণ করত পায়ে পায়ে। তাই নৌকো চেপে স্পেনের জাহাজে ফিরে যাওয়া সম্ভব হল না তাঁর ও তাঁর সঙ্গীদের পক্ষে। একদল জেলে বন্দিদের পালাতে দেখে চিৎকার করতে শুরু করল। সঙ্গে সঙ্গে ছুটে এলো প্রহরীরা। ফলে পালাবার সুযোগ হাতের নাগালে এসেও ভাগ্যদোষে ফস্কে গেল। তাঁদের না নিয়েই জাহাজ ফিরে গেল স্পেনে। আবার কারাগারে বন্দী হতে হল সার্ভেন্টিসকে।

সার্ভেন্টিসের মুক্তির অশা ত্যাগ

অকথ্য অত্যাচারেও মনোবল হারালেন না তিনি। কিছুদিন পরেই আবার পালাবার পথ খুঁজলেন। নিজেদের দুরবস্থার কথা জানিয়ে গোপনে পত্র পাঠালেন ওরানের শাসনকর্তার কাছে। এক বিশ্বস্ত মুরের হাতে পাঠানো হয়েছিল চিঠিটি। দুর্ভাগ্যক্রমে পথে তুর্কী প্রহরীর হাতে ধরা পড়ল সে। মৃত্যুদন্ডে দন্ডিত হওয়া সত্ত্বেও সার্ভেন্টিসের নাম সে প্রকাশ করে নি। সার্ভেন্টিস পালাবার চেষ্টা আরও কয়েকবার করেছিলেন। কিন্তু প্রতিবারেই ব্যর্থ হয়ে মুক্তির অশা ছেড়ে দিলেন।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের স্পেন আগমন

শেষ পর্যন্ত ঈশ্বরের আশীর্বাদের মতো জুয়ান গিল নামে এক দয়ালু পাদ্রি এসে বন্দিদের মুক্ত করে নিয়ে যান। নানা স্থান থেকে সংগ্রহ করে তিনি মুক্তিপণের টাকা মিটিয়েছিলেন। ফাদারের মহানুভবতায় দশ বছর পরে কারগারের অন্ধকার থেকে মুক্তি পেয়ে মাতৃভূমি স্পেনে ফিরে এলেন সার্ভেন্টিস। স্পেনের হয়ে যুদ্ধে গিয়ে অশেষ দুঃখ কষ্ট লাঞ্ছনা সইতে হয়েছিল তাঁকে। এই স্বার্থত্যাগের জন্য রাজসরকারের কাছ থেকে সামান্যতম মর্যাদাও দেখানো হয় নি তাঁকে।

সার্ভেন্টিসের চরম দারিদ্র্যের জীবন

চরম দারিদ্র্যের মধ্যে দিন কাটতে লাগল। এই দুঃসময়ে এককালের সঙ্গী বন্ধুরা কেউই মুখ ফিরে তাকায় নি। তিনি মর্মে মর্মে উপলব্ধি করেছিলেন অর্থ মানুষের মনুষ্যত্বকে হরণ করে। বিত্তবান মানুষ নিজের মাকেও প্রত্যাখ্যান করতে দ্বিধা করে না। জীবনের এই নির্মম অভিজ্ঞতার কথা তিনি তাঁর ডন কুইক্সোড বইতে পরে সবিস্তারে লিখেছেন। নিদারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে কয়েকমাস ধরে চেষ্টা করেও কোনও চাকরি জোটাতে পারলেন না সার্ভেন্টিস। নিঃসঙ্গ দিনগুলো ক্রমেই দুঃসহ হয়ে উঠতে লাগল। কি করবেন ভাবছেন। এক সময় মনে পড়ল, লেখার হাতটা ভালই ছিল। এবার আবার কলম ধরলে কেমন হয়।

লেখার ভাবনায় সার্ভেন্টিস

নতুন লেখার ভাবনা নিয়ে বসেও গেলেন একদিন। গদ্য পদ্য যা লিখতেন এসময়, পরিচিত কবি নাট্যকারদের তা পড়ে শোনাতেন। তাঁদের নিন্দা প্রশংসায় কখনও হতাশ হতেন, কখনও হতেন উল্লসিত তবে সংকল্পচ্যুত হন নি। এভাবেই এক বছরের চেষ্টায় গদ্য-পদ্যে লেখা লা গ্যালাটিয়া শেষ করলেন। এই বই প্রকাশিত হল ১৫৮৪ খ্রিস্টাব্দে। কিন্তু কোনওরকম সাড়া জাগাতে পারল না।

সার্ভেন্টিসের বিবাহ

এই সময় ক্যাটালিনা নামে এক তরুণীর সঙ্গে পরিচিত হন সার্ভেন্টিস। তাঁর ছোটবোনের শ্বশুরবাড়ির গ্রামের জমিদার তিনি। ভাগ্যের এমনই রসিকতা যে সহায় সম্বলহীন সার্ভেন্টিসকেই পছন্দ করে বিয়ে করে ফেললেন ক্যাটালিনা। এই অসম বিবাহের ফলে সাময়িকভাবে অর্থকষ্ট দূর হল সার্ভেন্টিসের। কিন্তু বেশি দিন স্থায়ী হল না এই বিবাহবন্ধন। দুজনের জীবনের দৃষ্টিভঙ্গির পার্থক্য অচিরেই দুজনকে দূরে সরিয়ে দিল। সার্ভেন্টিস ফিরে এলেন মাদ্রিদে।

নাটক রচনায় সার্ভেন্টিসের হাত

আবার দারিদ্র্য ও হতাশার অনিশ্চিত জীবন। কিন্তু মনের বল হারালেন না সার্ভেন্টিস। সেই সময় নির্মম নিয়তির আকস্মিক একঝলক হাসির মতোই যেন এক নাট্য প্রতিযোগিতায় সার্ভেন্টিসের নাটক প্রথম স্থান পেয়ে গেল। স্পেনের কয়েকটি নাট্যমঞ্চের তরফে সর্বসাধারণের জন্য এই প্রতিযোগিতা আহ্বান করা হয়েছিল। সার্ভেন্টিস স্বদেশের বীরদের সংগ্রামের কাহিনী নিয়ে লিখেছিলেন নাটকটি। অভাবনীয় ছিল এই সাফল্য। উৎসাহিত হয়ে নাটক রচনায় ঝুঁকলেন সার্ভেন্টিস। মঞ্চস্থ হতে লাগল তাঁর নাটক। লেখক হিসাবে খ্যাতি পেলেন। কিন্তু জনগণের মনোরঞ্জন করতে পারলেন না। তাঁর নাটকের নীতিপ্রধান গল্প সেইকালের আমোদপ্রিয় জনগণকে আকৃষ্ট করতে ব্যর্থ হল।

খাদ্যশস্য কেনার চাকরিতে সার্ভেন্টিস

নাটক লেখায় ইস্তফা দিয়ে এই সময় বেঁচে থাকার জন্য একটা চাকরি নিলেন। নৌবাহিনীর কাজ, গ্রামে গ্রামে ঘুরে চাষীদের কাছ থেকে খাদ্যশস্য কেনার চাকরি। মাইনে মনমতো না হলেও অনেকটাই স্বস্তি পেলেন সার্ভেন্টিস। কিন্তু দুর্ভাগ্য তাড়া করেই ফিরছিল তাঁকে। জীবনে শান্তি স্বস্তি কোনও দিনই স্থায়ী হয় নি তাঁর। নতুন এই চাকরিতেও কিছুদিন পরেই তাঁর বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠল, তিনি কম দামে কেনা বাড়তি শস্য বেশি দামে বাজারে বিক্রি করছেন। স্পেনের অন্ধকার কারাগারে কয়েকমাস কাটাতে হল সার্ভেন্টিসকে। তবে অচিরেই অভিযোগ মিথ্যা প্রমাণিত হলে তিনি মুক্তি পেলেন।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের খাজনা আদায়ের কাজ

এরপর এক বন্ধুর যোগাযোগে খাজনা আদায়ের কাজ নিলেন। এই কাজে তাঁকে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে ঘুরতে হত। এই সময় বিভিন্ন শ্রেণীর ও চরিত্রের মানুষ সম্পর্কে অভিজ্ঞতা লাভের সুযোগ হয় তাঁর। পরবর্তীকালে সাহিত্য সৃষ্টির ক্ষেত্রে এই অভিজ্ঞতা তিনি রূপায়িত করেছেন। ভাগ্যের বিরূপতায় এখানেও হিসাব গরমিলের অভিযোগে অভিযুক্ত হতে হল। ভাগ্যে জুটল কারাবাস। এই দফায় কারাকক্ষের নির্জতায় বসে সম্পূর্ণ এক নতুন আঙ্গিকে নতুন বিষয়বস্তু নিয়ে লিখতে বসলেন।

সার্ভেন্টিসের বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ডনকুইক্সোড

বিশ্ববিখ্যাত গ্রন্থ ডন কুইক্সোড রচনার সূত্রপাত হল এভাবে। এই রচনা সম্পূর্ণ করতে কয়েক বছর সময় লেগেছিল তাঁর। হাস্যরস আর কৌতুক মিশিয়ে বিচিত্র এক চরিত্রকে নিয়ে শ্লেষাত্মক কিন্তু বেদনাঘন কাহিনী রচনা করেছেন সার্ভেন্টিস। এই সরস রচনা কেবল তাঁর সমকালের মানুষেরই মন জয় করে নি। শত শত বছর পরে আজও সব মানুষের কাছেই সমাদৃত। সার্ভেন্টিসের ডনকুইক্সোড সব যুগের সব কালের শ্রেষ্ঠ এক সাহিত্যসৃষ্টি। এই রচনায় তিনি দুর্ভাগ্য লাঞ্ছিত যে রূপক চরিত্রটি সৃষ্টি করেছেন সে যেন তাঁরই আশাহত জীবনের প্রতিরূপ।

ডন কুইক্সোড গ্রন্থের কাহিনী

  • (১) পঞ্চাশ বছরের এক প্রৌঢ়, তার নাম কুইক্সাডা। সংসারে নিজের বলতে আছে কেবল এক বোন। তাই ঝাড়া হাত-পা। কুইক্সাডার দিন কাটে প্রাচীন নাইটদের বীরত্বের কাহিনী পড়ে। একদিন সে ঠিক করল, নাইটদের মতোই সে দেশ ভ্রমণে বেরবে। তাই সবার আগে নাম পাল্টে একটা গালভরা নাম নিল ডন কুইক্সোড। বাড়িতে ছিল একটা বুড়ো ঘোড়া আর কিছু মরচে ধরা পুরনো সৈনিকের পোশাক, বর্ম, বর্শা ইত্যাদি। সবকিছু জড়ো করে তাপ্পি-তাপ্পা দিয়ে বিচিত্র সাজসজ্জা করে বুড়ো ঘোড়ার পিঠে চেপে একদিন গভীর রাতে সে বেরিয়ে পড়ল বাড়ি থেকে।
  • (২) নিজেকে একজন পুরোদস্তুর নাইট ভেবে সে খুবই আনন্দ পাচ্ছিল। সারারাত সে পথ চলল। সকাল হলে তার বিচিত্র সাজসজ্জা দেখে লোকজন অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখতে লাগল। অনেকে ভূত ভেবে ভয়ে পালিয়ে গেল। সে বইতে পড়েছিল, যেখানে সেখানে বিশ্রাম করা নাইটরা নিরাপদ মনে করত না। তাই সে-ও কোথাও বিশ্রাম না নিয়ে দিনভর পথ চলল।
  • (৩) এক চাষী শুয়োর চরাচ্ছিল। সন্ধ্যা হলে সে তার শুয়োরগুলোকে জড়ো করবার জন্য শিঙা বাজাতে আরম্ভ করল। শিঙার শব্দ শুনে ডন কুইক্সোডের মনে হল, আশপাশে নিশ্চয়ই কোনো দুর্গ আছে। সেখানকার প্রহরী শিঙা বাজাচ্ছে। সামনেই পড়ল একটা সরাইখানা। সেটাকে দুর্গ ভেবে সে ঘোড়া নিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়ল।
  • (৪) গ্রামের দু’টি মেয়ে দাঁড়িয়েছিল দরজার সামনে। তাদের দেখে ডন কুইক্সোড ভাবল, মেয়েদের সম্মান জানানো উচিত। কেননা সে বইতে পড়েছিল নাইটরা সব মেয়েদের সম্মান জানায়। সে ঘোড়া থেকে নেমে মেয়েদের সামনে গিয়ে নতজানু হয়ে অভিবাদন জানিয়ে বলল, বলুন আপনাদের জন্য আমি কি করতে পারি। কেউ কি আপনাদের মনোকষ্টের কারণ ঘটিয়েছে?
  • (৫) বিচিত্র পোশাকে সজ্জিত ডন কুইক্সোডের নাটকীয় কথাবার্তা এবং ভাবভঙ্গি দেখে মেয়েরা হাসি সামলাতে পারে না। সরাইওয়ালা ভাবল লোকটার নিশ্চয় মাথায় গন্ডগোল আছে। তাই তাকে না ঘাঁটিয়ে সে যেমন বলল, তেমনই ব্যবহার করল। রাত হলে সকলে ঘুমিয়ে পড়ল। কিন্তু ডন কুইক্সোড জেগে রইল। সে বর্শা হাতে সরাইখানা পাহারা দিতে লাগল।
  • (৬) কাছেই একটা কুয়ো ছিল। তার পাশের পথ দিয়ে একদল ফেরিওয়ালা যাচ্ছিল। তাদের একজন ঘোড়ার জন্য জল নিতে এসেছিল কুয়োয়। তাকে দেখে কুইক্সোডের মনে হল এ নিশ্চয়ই দৈত্য। কোনও মতলব নিয়ে এসেছে। কেননা সে বইতে পড়েছে রাতেই আনাগোনা করে দৈত্যদানোর দল। আর সামনে পড়ে গেলে নাইটরা সবিক্রমে তাদের ঘায়েল করে।
  • (৭) কুইক্সোড চুপি চুপি পেছন থেকে লোকটার মাথায় হাঁকড়ালো বর্শার ডান্ডার বাড়ি। সঙ্গে সঙ্গে সে অজ্ঞান হয়ে গেল। খানিক পরেই আর একজন ফেরিওয়ালা ঘোড়াকে খাওয়াবার জন্য জল নিতে এলো। তাকেও দৈত্য ভেবে কুইক্সোড বর্শার খোঁচা মারল। সঙ্গে সঙ্গে ফেরিওয়ালা চিৎকার জুড়ে দিল। সেই চিৎকার শুনে তার সঙ্গী অন্য ফেরিওয়ালারা ছুটে এলো।
  • (৮) কুইক্সোড ভাবল দুর্গ দখল করার জন্য শত্রু সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। সে বর্শা বাগিয়ে তাদের তাড়া করল। আচমকা আক্রান্ত হয়ে ফেরিওয়ালারাও কুইক্সোডকে লক্ষ্য করে পাথরের টুকরো ছুঁড়তে লাগল। গোলমাল শুনে ছুটে এলো সরাইওয়ালা। সে দেখল ঢিলের ঘায়ে তার সরাইখানা ভেঙ্গেচুরে তছনচ হবে। তাড়াতাড়ি বুঝিয়ে শুঝিয়ে দু’পক্ষকে শান্ত করল।
  • (৯) পরদিন সকালে আবার তার ঘোড়ায় চেপে কুইক্সোড চলতে লাগল। সেই পথে যাচ্ছিল একদল বণিক। সে এগিয়ে গিয়ে তাদের পথ অবরোধ করল। বইতে সে পড়েছিল, প্রাচীনকালে প্রত্যেক নাইটের একজন করে প্রিয় নারী থাকত। কুইক্সোডের তেমন কেউ ছিল না।
  • (১০) তাই সে ভেবে চিন্তে তার গ্রামেরই এক চাষীর মেয়ে ডালসিনিয়াকেই নিজের প্রিয়তম নারী বলে সাব্যস্ত করেছিল। এখন সে সওদাগরদের বলল, তোমরা স্বীকার করো ডালসিনিয়াই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠতম নারী, না হলে আমার সঙ্গে লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত হও।
  • (১১) তার বিচিত্র অঙ্গভঙ্গি আর কথা শুনে মজা পেয়ে সওদাগররা হাসি-মস্করা শুরু করল। অমনি কুইক্সোড তার বর্শা তুলে ঘোড়া ছুটিয়ে দিল। বেচারা হাড় জিরজিরে বুড়ো ঘোড়া, কয়েক পা গিয়েই মুখ থুবড়ে পড়ল। আর তার শরীরের তলায় চাপা পড়ল কুইক্সোড। অনেক চেষ্টা করেও উঠে দাঁড়াতে পারল না।
  • (১২) এই কান্ড দেখে সওদাগররা হেসে গড়িয়ে পড়ল। তাদের হাসতে দেখে কুইক্সোড রেগে গালাগাল দিতে শুরু করল। এতে আরও মজা পেয়ে সওদাগররা হাসতে লাগল। তাদের এক বদরাগী চাকর কিন্তু সহ্য করতে পারল না। সে ছুটে গিয়ে কুইক্সোডকে কিল ঘুসি মেরে আধমরা করে ফেলল।
  • (১৩) সেই পথ দিয়ে তখন যাচ্ছিল কুইক্সোডের গ্রামের এক লোক। সে ধরাধরি করে তাকে বাড়িতে পৌঁছে দিল। কিছুদিন বিছানায় পড়ে থেকে কুইক্সোড বোনের সেবা যত্নে একরকম সুস্থ হয়ে উঠল। কিছুদিন ভালভাবেই কাটল। কিন্তু নাইটের ভূত তখনো তার ঘাড়ে চেপে ছিল। তাই আবার বেরিয়ে পড়বে বলে ঠিক করল।
  • (১৪) কুইক্সোড বইতে পড়েছিল নাইটদের সঙ্গে অনুচর থাকত। সে অনুচর পাবে কোথায়? গ্রামের একজন চাষী, তার নাম সাংকো পাঞ্জা। কুইক্সোড তাকে বলল, তুমি আমার অনুচর হয়ে সঙ্গে চলো, তোমাকে আমি একটা দ্বীপের শাসনকর্তা করে দেব। খুশি হয়ে সাংকো তার সঙ্গ নিল। শুরু হলো তাদের দুজনের অভিযান। সে কাহিনী যেমন মজার তেমনি বেদনার। একের পর এক ঘটনার মধ্য দিয়ে ঘোর কাটতে থাকে কুইক্সোডের।
  • (১৫) একসময় সে উপলব্ধি করতে পারে, এতকাল কল্পনার জগতেই বিচরণ করেছে, বাস্তবের সঙ্গে যার কোনো সম্বন্ধ নেই। কুইক্সোডের শেষ পর্যন্ত সব আকাঙ্ক্ষাই অপূর্ণ থেকে যায়। আর এই বেদনা নিয়েই এক সময় মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে এই স্বপ্নবিলাসী মানুষটি।

সার্ভেন্টিসের ডনকুইক্সোড গ্রন্থ প্রকাশ

বিশ্বসাহিত্যের বহু মহৎ সাহিত্যসৃষ্টির মতো ডনকুইক্সেডের আত্মপ্রকাশও নির্বিঘ্ন ছিল না। কোনো প্রকাশকই বইটি প্রথমে ছাপাতে রাজি হয় নি। অনেক ঘোরাঘুরির পর দয়াপরবশ এক প্রকাশক যদিও বা বই প্রকাশে রাজি হলেন, লেখকের ভাগ্যে জুটল নামমাত্র অর্থ। দ্য অ্যাডভেঞ্চার অব দ্য ইনজিনিয়াস ডন কুইক্সোড দ্য লা মাঞ্চা নামে ১৬০৫ খ্রিস্টাব্দে সার্ভেন্টিসের বই ছাপা হয়ে বেরল।

দুর্ভাগা সার্ভেন্টিস

প্রকাশের সঙ্গে সঙ্গেই পাঠকমহলে সাড়া পড়ে গেল। হু হু করে বিক্রি হতে লাগল বই। তবে লেখক হিসেবে আর এক পয়সাও জোটেনি সার্ভেন্টিসের কপালে, যা পেয়েছিলেন প্রথমেই। এমন একটা পাঠকসমাদৃত বই লিখেও দারিদ্র্য ঘুচল না হতভাগ্য লেখকের। উপেক্ষিত হলেন তিনি সরকার থেকেও। এমনই দুর্ভাগা যে, সার্ভেন্টিসের এই মহান সৃষ্টিকে তাঁর দেশের মানুষও উপেক্ষা করেছে। এই পরিস্থিতিতে মানসিকভাবে ভেঙ্গে পড়ার মুখেও সার্ভেন্টিস তাঁর লেখা বন্ধ করেন নি।

খুনের দায়ে গ্রেপ্তার সার্ভেন্টিস

ডনকুইক্সোডের পর লিখেছেন এগজেমপ্লারি টেলস, জার্নি টু পার্নাসাস, পাসাইলস অ্যান্ড সিগিসমুণ্ডা। কিন্তু এসব কোন রচনাতেই তাঁর প্রতিভার বিশেষ পরিচয় ছিল না। উপর্যুপরি ভাগ্যের বিপর্যয়ে সার্ভেন্টিসের শরীর মন দুইই ভেঙ্গে পড়েছিল। চরম দরিদ্র দশার মধ্যে ছোট বোন মারা গেলেন। তাঁকে সমাহিত করার জন্য ভিক্ষা করে অর্থ সংগ্রহ করতে হয় তাঁকে। সেই সময়েই ভাগ্যের চক্রান্তে আবার কারাবন্দি হতে হয় তাঁকে। তাঁর কাছে এসে আশ্রয়প্রার্থী হয়েছিল ছুরিকাহত এক যুবক। সার্ভেন্টিস তাকে ঘরে নিয়ে সেবা শুশ্রূষা করেন। কিন্তু শেষ পর্যন্ত যুবকটি মারা গেল। খুনের দায়ে গ্রেপ্তার হলেন সার্ভেন্টিস। কয়েকমাস পরে নির্দোষ প্রমাণিত হওয়ায় ছাড়া পান।

সার্ভেন্টিসের বাড়িতে ফ্রান্সের রাজদূত

আজীবন দুর্ভাগ্যের শিকার সার্ভেন্টিস জীবনের অন্তিম লগ্নে অসুস্থ অবস্থায় লেখেন ডন কুইক্সোডের দ্বিতীয় পর্ব। সেটি প্রকাশিত হয় তাঁর মৃত্যুর একবছর আগে ১৬১৫ খ্রিস্টাব্দে। তাঁর নিজের দেশের মানুষ জীবিতকালে সার্ভেন্টিসকে মর্যাদা দেয় নি। কিন্তু বিদেশের মানুষ একজন মহান সাহিত্যস্রষ্টা হিসেবে তাঁর প্রতিভাকে পরম শ্রদ্ধায় বরণ করে নিয়েছিল। একবার ডন কুইক্সোড পড়ে ফ্রান্স-এর রাজদূত এমনই মুগ্ধ হয়েছিলেন যে তাঁকে সম্মান জানাবার জন্য মাদ্রিদে দরিদ্র সার্ভেন্টিসের বাড়িতে উপস্থিত হন।

মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের মৃত্যু

ডন কুইক্সোডের দ্বিতীয় খণ্ড প্রকাশের কিছুদিন পরে ১৬১৬ খ্রিস্টাব্দে ২৩ এপ্রিল তিনি মৃত্যুবরণ করেন। একজন অতি সাধারণ মানুষের মতোই অজ্ঞাত অবস্থায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন সার্ভেন্টিস।

উপসংহার :- তাঁর দরিদ্রদশা দেখে অভিভূত রাজদূত একসময় বলেন, এমন মহান সৃষ্টির জন্যই ঈশ্বর আপনাকে এরূপ চরম দারিদ্র্যের মধ্যে রেখেছেন। আপনার দারিদ্র্য বিশ্বের সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করবে। জীবনযুদ্ধে হতমান প্রতিভাবান এই মানুষটিকে মহাকাল কিন্তু অবহেলা করতে পারে নি। বিশ্বসাহিত্যের ইতিহাসে অমরত্ব লাভ করেছেন সার্ভেন্টিস।

(FAQ) সার্ভেন্টিস সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মিগেল দ্য সার্ভেন্টিসের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ কী?

মিগেল দে সার্ভান্তেসের সবচেয়ে বিখ্যাত কাজ হলো ‘ডন কুইক্সোড’। এটি প্রথম আধুনিক উপন্যাস হিসেবে বিবেচিত হয় এবং বিশ্বসাহিত্যে একটি মাইলফলক।

২. সার্ভেন্টিস কেন বিখ্যাত?

সাহিত্যিক প্রতিভা ও ‘ডন কুইক্সোড’ উপন্যাসের মাধ্যমে সার্ভেন্টিস বিশ্বব্যাপী পরিচিতি লাভ করেন। তিনি আধুনিক উপন্যাসের ভিত্তি স্থাপন করেন এবং তার রচনাগুলোতে সমাজ, আদর্শবাদ এবং মানব প্রকৃতির গভীর বিশ্লেষণ করেন।

৩. সার্ভেন্টিস কখন এবং কোথায় জন্মগ্রহণ করেন?

সার্ভেন্টিস ২৯ সেপ্টেম্বর, ১৫৪৭ সালে স্পেনের আলকালা দে হেনারেসে জন্মগ্রহণ করেন।

৪. সার্ভেন্টিস কি শুধুই লেখক ছিলেন?

না, তিনি একজন সৈনিক ও কর সংগ্রাহকও ছিলেন। সৈনিক হিসেবে তিনি লেপান্তোর যুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছিলেন।

৫. সার্ভেন্টিসের সাহিত্যিক যুগ কী?

তিনি স্প্যানিশ স্বর্ণযুগে (Siglo de Oro) সাহিত্য রচনা করেছিলেন, যা স্প্যানিশ সংস্কৃতির জন্য একটি উজ্জ্বল সময় ছিল।

৬. সার্ভেন্টিসের মৃত্যু কবে হয়েছিল?

সার্ভেন্টিস ২৩ এপ্রিল, ১৬১৬ সালে মাদ্রিদে মারা যান।

Leave a Comment