ক্যাভুর

আধুনিক ইতালির স্রষ্টা কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুরের জন্ম, উদারনৈতিক মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক আদর্শে শ্রদ্ধা, ইতালির ঐক্য সম্পর্কে আগ্ৰহী, সমিতি গঠন, পত্রিকা প্রকাশ, পার্লামেন্টের সদস্য, প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত, ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নতুন পথ, ম্যাৎসিনি ও ক্যাভুরের পার্থক্য।

ক্যাভুরের নীতি ও কর্মপন্থা, সংস্কার সাধন, ক্যাভুরের বিদেশ নীতির ভিত্তি, ক্রিমিয়ার যুদ্ধ, স্বদেশী বাহিনীর প্রতি ক্যাভুরের মন্তব্য, ইতালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করা, প্লোমবিয়ারের চুক্তি, চুক্তির শর্ত, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ, লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার, ভিল্লাফ্রাঙ্কার সন্ধি, জুরিখের সন্ধি, সন্ধির শর্ত, ক্যাভুরের পুনরায় প্রধানমন্ত্রী পদ গ্ৰহণ, ফ্রান্সের সাথে বোঝাপড়া, গণভোট, গ্যারিবল্ডির পরিকল্পনা বানচাল, সিসিলি ও নেপলস জয়, ইতালির জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন, ক্যাভুরের মৃত্যু ও তার অবদান।

ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক ক্যাভুর প্রসঙ্গে ক্যাভুরের জন্ম, ক্যাভুরের উদারনৈতিক মতাদর্শ, গণতান্ত্রিক আদর্শে ক্যাভুরের শ্রদ্ধা, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুরের আগ্ৰহ, ক্যাভুরের পত্রিকা প্রকাশ, ক্যাভুরের প্রধানমন্ত্রী পদ অর্জন, ম্যাৎসিনি ও ক্যাভুরের পার্থক্য, ক্যাভুরের নীতি ও পন্থা, ক্যাভুরের সংস্কারসাধন, ক্যাভুরের বিদেশ নীতির ভিত্তি, ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুরের ভুমিকা ও ক্যাভুরের মৃত্যু।

ক্যাভুর

ঐতিহাসিক চরিত্রক্যাভুর
জন্ম১৮১০ খ্রিস্টাব্দ
পরিচিতিপিডমন্ট সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী
অবদানইতালির ঐক্য আন্দোলনে নেতৃত্ব প্রদান
পূর্ববর্তী আন্দোলনইয়ং ইতালি আন্দোলন
মৃত্যু১৮৬১ খ্রিস্টাব্দ
ক্যাভুর

ভূমিকা:- ‘ইয়ং ইতালি’ আন্দোলনের ব্যর্থতার পর বাস্তববাদী ও দক্ষ কূটনীতিক কাউন্ট ক্যামিলো বেনসো ডি ক্যাভুর ইতালির ঐক্য আন্দোলন -এর নেতৃত্ব গ্রহণ করেন। তাকে ‘ইতালির ঐক্য আন্দোলনের মস্তিষ্ক’ বলে অভিহিত করা হয়।

লিপসন ও গ্ৰেনভিলের মন্তব্য

অধ্যাপক লিপসন-এর মতে, কাভ্যুরের জীবন কাহিনিই ছিল ইতালির মুক্তি আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্বের ইতিহাস। অধ্যাপক গ্রেনভিল-এর মতে, কাভ্যুরের রাজনৈতিক বাস্তববাদিতার ফলেই ইতালির ঐক্য প্রতিষ্ঠা সম্ভব হয়।

ক্যাভুরের জন্ম

১৮১০ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্টের এক অভিজাত পরিবারে তাঁর জন্ম। প্রথম জীবনে একজন ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে তিনি পিডমন্টের সামরিক বাহিনীতে যোগ দেন।

উদারনৈতিক মতাদর্শ

তাঁর উদারনৈতিক মতাদর্শের জন্য তিনি কর্তৃপক্ষের বিরাগভাজন হন এবং ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে চাকরিতে ইস্তফা দিয়ে পৈতৃক জমিদারি দেখাশোন ও কৃষিকাজে আত্মনিয়োগ করেন। এই সময়েই তিনি ইংল্যান্ডফ্রান্স -এর বিভিন্ন অঞ্চল পরিভ্রমণ করেন।

গণতান্ত্রিক আদর্শে শ্রদ্ধা

তিনি ইংল্যান্ডের ব্যাপক শিল্পায়ন ও নিয়মতান্ত্রিক রাজস্ব সম্পর্কে যথেষ্ট জ্ঞান অর্জনে সক্ষম হন। এই সময় দিনের পর দিন এবং রাত্রির পর রাত্রি শ্রোতা হিসেবে তিনি ব্রিটিশ পার্লামেন্টে উপস্থিত থাকতেন। এর ফলে গণতান্ত্রিক আদর্শের প্রতি তাঁর শ্রদ্ধা জন্মায়। ফ্রান্সের উদারনৈতিক মতাদর্শও তাঁকে যথেষ্ট উদ্বুদ্ধ করে।

ইতালির ঐক্য সম্পর্কে আগ্ৰহী

বিভিন্ন কারণে তাঁর রাজনৈতিক চেতনা বিকশিত হতে থাকে এবং তিনি ইতালির ঐক্য সম্পর্কে প্রবল আগ্রহী হয়ে ওঠেন। বিদেশ ভ্রমণকালে তিনি বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ইতালির ঐক্যের কথা লিখতে থাকেন।

সমিতি গঠন

১৮৩২ খ্রিস্টাব্দে তিনি ‘অ্যাসোসিয়জন অ্যাগ্ৰারিয়া’ নামে একটি সমিতি গঠন করে জনসংযোগের কাজ শুরু করেন। লর্ড অ্যাক্টন বলেন যে, এই সমিতি পরবর্তীকালে তাঁর রাজনৈতিক প্রভাবের হাতিয়ারে পরিণত হয়।

পত্রিকা প্রকাশ

১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি রিসঅর্গিমেন্টো নামে একটি পত্রিকা সম্পাদনা করতে শুরু করেন। এই পত্রিকায় বিভিন্ন দেশাত্মবোধক রচনাদি প্রকাশিত হতে থাকে এবং তিনি ইতালির বিভিন্ন রাজ্যে শাসকদের ঐক্যবদ্ধভাবে ইতালি থেকে অস্ট্রিয়াকে বিতাড়িত করার আহ্বান জানান। এছাড়া তিনি এই পত্রিকা মারফত দেশবাসীর সামনে স্বাধীনতা, ঐক্য, উদারপন্থী সংস্কার প্রভৃতি কথা বলতে থাকেন।

পার্লামেন্টের সদস্য

১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ায় উদারনৈতিক শাসনতন্ত্র প্রবর্তিত হলে তিনি পার্লামেন্টের সদস্য নির্বাচিত হন।

প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত

১৮৫০ খ্রিস্টাব্দে তিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার মন্ত্রিসভায় যোগদান করেন এবং ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে রাজা ভিক্টর ইমান্যুয়েল তাঁকে প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত করেন।

ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নতুন পথ

বাস্তববাদী ও ধুরন্ধর রাজনীতিক কাভ্যুরের নেতৃত্বে ইতালির ঐক্য আন্দোলন নতুন পথে পরিচালিত হতে থাকে।

ম্যাৎসিনী ও ক্যাভুরের পার্থক্য

  • (১) আদর্শবাদী ম্যাৎসিনির সঙ্গে নানা দিক থেকে তাঁর পার্থক্য ছিল। ম্যাৎসিনি ছিলেন আদর্শবাদী। অপরদিকে ক্যাভুর ছিলেন বাস্তববাদী। ইতালির যুবসম্প্রদায়ের উপর ম্যাৎসিনির প্রবল আস্থা ছিল। তিনি ইতালিবাসীর আত্মশক্তি ও আত্মবিশ্বাসের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন।
  • (২) ম্যাৎসিনি ইতালির ঐক্য আন্দোলনে বিদেশি শক্তির সাহায্য গ্রহণের বিরোধী ছিলেন। তার স্বপ্ন ছিল যে, স্বাধীন ও ঐক্যবদ্ধ ইতালিতে প্রজাতান্ত্রিক সরকার প্রতিষ্ঠিত হবে।
  • (৩) অপরপক্ষে ক্যাভুরের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল বিদেশি সাহায্য ব্যতীত ইতালির ঐক্যসাধন অসম্ভব। প্রজাতন্ত্র নয়, তিনি নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্রের সমর্থক ছিলেন।

নীতি ও কর্মপন্থা

ক্যাভুরের নীতি ও কর্মপন্থাকে মোটামুটি পাঁচভাগে ভাগ করা যায়। যথা –

  • (১) তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, ইতালীয় ঐক্যের প্রধানতম ও একমাত্র প্রতিবন্ধক হল অস্ট্রিয়া। সুতরাং তাঁর কাজ হল অস্ট্রিয়ার আধিপত্য থেকে ইতালিকে মুক্ত করা।
  • (২) পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে ইতালির ঐক্য আন্দোলনের নেতৃত্বে প্রতিষ্ঠা করা।
  • (৩) অর্থনৈতিক ও শাসনতান্ত্রিক সংস্কারের মাধ্যমে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে নেতৃত্ব গ্রহণের উপযুক্ত করে গড়ে তোলা।
  • (৪) বিদেশি সাহায্য ব্যতীত ইতালির ঐক্যসাধন সম্ভব নয়। এই উদ্দেশ্যে ইতালীয় সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় রূপান্তরিত করা।
  • (৫) ঐক্যবদ্ধ স্বাধীন ইতালিতে নিয়মতান্ত্রিক রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে-প্রজাতন্ত্র নয়।

সংস্কার সাধন

নেতৃত্বের উপযুক্ত করে গড়ে তোলার উদ্দেশ্যে তিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ায় নানাবিধ সংস্কার প্রবর্তন করেন। যেমন –

  • (১) কৃষি, শিল্প ও বাণিজ্যের সম্প্রসারণ, সড়ক যোগাযোগ, পোতাশ্রয় ও রেলপথ নির্মাণ, মুদ্রা ও ব্যাঙ্ক ব্যবস্থার সংস্কার, কর, বিমা ও শুল্ক কাঠামোর পরিবর্তন এবং সামরিক ও নৌ-শক্তি বৃদ্ধি করে তিনি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে একটি আধুনিক ও শক্তিশালী রাজ্যে পরিণত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন।
  • (২) অবাধ বাণিজ্য নীতি অনুসরণ করে তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও বেলজিয়ামের সঙ্গে বাণিজ্যিক চুক্তি সম্পাদন করেন। ইংল্যান্ডের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে রেলপথ নির্মাণ শুরু হয়। সড়ক ব্যবস্থার উন্নতি ঘটিয়ে এবং পোতাশ্রয় নির্মাণ করে ব্যবসা-বাণিজ্যের উন্নতির দিকে নজর দেওয়া হয়।
  • (৩) গির্জার সম্পত্তি ও ছোটো ছোটো মঠগুলি রাষ্ট্রায়ত্ত করে তিনি রাষ্ট্রের আয় বৃদ্ধি করেন। কৃষিব্যবস্থারও সম্প্রসারণ ঘটানো হয়। এইভাবে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার অর্থনীতি ও বেসামরিক প্রশাসনের ক্ষেত্রে অভাবনীয় উন্নতি ঘটে।

হ্যাজেনের মন্তব্য

অধ্যাপক হ্যাজেন বলেন যে, রেলপথ সম্প্রসারণের ফলে ইতালির প্রাদেশিক সংকীর্ণতা দূর হয় এবং জাতীয় ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয়।

এডগার হোল্টের মন্তব্য

ঐতিহাসিক এডগার হোল্ট বলেন যে, ক্যাভুর হলেন পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার শিল্প বিপ্লব ও শিল্পোন্নয়নের নায়ক।

টমসনের অভিমত

ঐতিহাসিক ডেভিড টমসন-এর মতে, কাভ্যুরের অর্থনৈতিক সংস্কারগুলি হল তাঁর রাজনৈতিক সাফল্যের ভিত্তি।

ক্যাভুরের বিদেশনীতির ভিত্তি

  • (১) ইতালীয় সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করার উদ্দেশ্যে তিনি ইংল্যান্ড, ফ্রান্স ও ইউরোপ -এর বিভিন্ন পত্রিকায় ইতালির সমস্যাবলী সম্পর্কে নিয়মিত প্রবন্ধ লিখে জনমত গঠনে সচেষ্ট হন।
  • (২) এইসব পত্র-পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ইংল্যান্ডের ‘মর্নিং পোস্ট’, ‘দি টাইমস্’, ফ্রান্সের ‘লা মার্টিন’, ‘লা ইন্ডিপেন্ডেস বেলগি’ প্রমুখ। এই ধরনের প্রচারকার্যে তিনি একদল উৎসাহী সাংবাদিক ও লেখকের সাহায্য পান। এই ব্যাপারে তিনি সফল হন এবং ইতালির সমস্যাবলী ইউরোপের জনমানসে দাগ কাটতে সমর্থ হয়।
  • (৩) ইতালির মুক্তিসংগ্রামে বিদেশি সাহায্য গ্রহণের মতটি তখনও ইতালিতে জনপ্রিয় ছিল না। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় প্রকাশিত প্রবন্ধের মাধ্যমে তিনি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সাহায্য লাভের চেষ্টা করেন।

ক্রিমিয়ার যুদ্ধ

এই সময় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ (১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিঃ) শুরু হলে তিনি রাশিয়ার বিরুদ্ধে ইঙ্গ-ফরাসি পক্ষে যোগদান করেন। এই ব্যাপারে তাঁর দুটি উদ্দেশ্য ছিল।

  • (১) ইতালির ঐক্যের ব্যাপারে ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি অর্জন করা এবং
  • (২) বিদেশি যোগাযোগের মাধ্যমে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া সেনাবাহিনীর নতুন জ্ঞানার্জনে সহায়তা করা।

স্বদেশী বাহিনীর প্রতি ক্যাভুরের মন্তব্য

যুদ্ধে যোগদানকারী স্বদেশীয় বাহিনীর উদ্দেশ্যে ক্যাভুর বলেন “প্রাণ দিয়ে যুদ্ধ করো। ঈশ্বরের কৃপায় এই ক্রিমিয়ার মাটি থেকেই নতুন ইতালির জন্ম হবে”।

ইতালির সমস্যাকে আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত করা

যুদ্ধাবসানে ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে তিনি ভার্সাই সম্মেলন বা প্যারিসের শান্তি সম্মেলনে উপস্থিত থাকার সুযোগ পান। সেখানে তিনি ইতালির উপর অস্ট্রিয়ার নগ্ন দমননীতি ও অত্যাচার এবং ইতালীয় সমস্যার কথা তুলে ধরেন। এর ফলে তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের সহানুভূতি লাভে সক্ষম হন। এইভাবে ইতালীয় সমস্যা এক আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়।

লিপসনের মন্তব্য

ঐতিহাসিক লিপসন বলেন যে, ইতালিতে অস্ট্রিয়ার অত্যাচারের কাহিনি প্রকাশিত হওয়ায় অস্ট্রিয়ার দমননীতি কিছুটা শিথিল হয়।

ইতালীয় দেশপ্রেমিকের মন্তব্য

দানিয়েল মানিন নামে জনৈক ইতালীয় দেশপ্রেমিক বলেন যে, “আমরা ইতালিতে অস্ট্রিয়ার আচরণের পরিবর্তন চাই না, আমরা চাই অস্ট্রিয়া ইতালি ত্যাগ করুক।

প্লোমবিয়ারের চুক্তি

১৮৫৮ খ্রিস্টাব্দে প্লোমবিয়ার নামক স্থানে ক্যাভুর ও ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের মধ্যে এক গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি ‘প্রোমবিয়ারের চুক্তি’ নামে খ্যাত। এই চুক্তিটি ছিল অলিখিত ও মৌখিক।

প্লোমবিয়ারের চুক্তির শর্ত

এই চুক্তির দ্বারা স্থির হয় যে,

  • (১) ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ফ্রান্স অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে পিডমন্টকে সর্বতোভাবে সাহায্য করবে।
  • (২) তবে অস্ট্রিয়া যদি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়াকে প্রথমে আক্রমণ করে, তবেই এই সাহায্য মিলবে।
  • (৩) এই সাহায্যের বিনিময়ে ফ্রান্স স্যাভয় ও নিস লাভ করবে।

অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ

ক্যাভুর দেশে ফিরে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের জোর প্রস্তুতি শুরু করেন এবং অস্ট্রিয়াকে নানাভাবে যুদ্ধের উস্কানি দিতে থাকেন। উত্তেজিত, অস্ট্রিয়া ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করলে ফ্রান্সও যুদ্ধে যোগ দেয়।

লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার

ম্যাজেন্টা ও সলফেরিনোর যুদ্ধে জয়লাভ করে পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া ও ফরাসি বাহিনী অস্ট্রিয়ার কবল থেকে লম্বার্ডি ও মিলান উদ্ধার করে।

ভিন্নাফ্রাঙ্কার সন্ধি

এই জয়ের মুহূর্তে তৃতীয় নেপোলিয়ন উপলব্ধি করেন যে, ঐক্যবদ্ধ ইতালি ফরাসি স্বার্থের অনুকূল হবে না। তাই তিনি ক্যাভুরের সঙ্গে কোনও আলোচনা না করেই এককভাবে অস্ট্রিয়ার সঙ্গে ভিন্নাফ্রাঙ্কার যুদ্ধবিরতি চুক্তি স্বাক্ষর করে যুদ্ধ থেকে সরে যান।

এককভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার পরামর্শ

ফরাসি-রাজ তৃতীয় নেপোলিয়নের এই বিশ্বাসঘাতকতায় ইতালির সর্বত্র ক্ষোভের সঞ্চার হয়। ক্ষুব্ধ ক্যাভুর পিডমন্ট-রাজ ভিক্টর ইমান্যুয়েলকে এককভাবে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন।

জুরিখের সন্ধি

বিচক্ষণ ও বাস্তববাদী পিডমন্ট-রাজ উপলব্ধি করেন যে, অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে এককভাবে যুদ্ধ চালানো সম্ভব নয়। ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে কাভ্যুরের পরামর্শ উপেক্ষা করে তিনি অস্ট্রিয়ার সঙ্গে জুরিখের সন্ধি স্বাক্ষর করেন। এর ফলে ক্ষুব্ধ ক্যাভুর পদত্যাগ করেন (জুলাই, ১৮৫৯ খ্রিঃ)।

জুরিখের সন্ধির শর্ত

এই সন্ধি দ্বারা স্থির হয় যে,

  • (১) সার্ডিনিয়ার সঙ্গে লম্বার্ডি যুক্ত হবে।
  • (২) ভেনিস থাকবে অস্ট্রিয়ার অধিকারে।
  • (৩) মধ্য ইতালির পার্মা, মডেনা, টাস্কেনি ও পোপ-শাসিত রোমানার বিতাড়িত শাসকবর্গ নিজ নিজ রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন।
  • (৪) মাঝপথে যুদ্ধ ত্যাগ করার জন্য তৃতীয় নেপোলিয়ন স্যাভয় ও নিসের উপর থেকে তাঁর দাবি ত্যাগ করেন।  পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার লম্বার্ডি লাভ হল ইতালীয় ঐক্যের প্রথম সোপান।

মধ্য ইতালির রাজ্যগুলির ইচ্ছাপ্রকাশ

জুরিখের সন্ধি দ্বারা স্থির হয়েছিল যে মধ্য ইতালির পার্মা, মডেনা, টাস্কেনি, রোমানা প্রভৃতি রাজ্যগুলিতে তাদের পুরোনো শাসকরা পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হবেন। জনগণ এই শাসকদের পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করতে অস্বীকার করে এবং তারা পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে সংযুক্তির ইচ্ছা প্রকাশ করে।

ক্যাভুরের প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্ৰহণ

তৃতীয় নেপোলিয়ন ও অস্ট্রিয়া এই ব্যাপারে আপত্তি জানায়। জাতীয় জীবনের এই সংকটময় পরিস্থিতিতে দেশের স্বার্থের কথা চিন্তা করে ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি ক্যাভুর আবার প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করেন।

ফ্রান্সের সাথে বোঝাপড়া

ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে ক্যাভুর এক বোঝাপড়ায় আসেন। স্থির হয় যে, তৃতীয় নেপোলিয়ন মধ্য ইতালির ওই রাজ্যগুলির সংযুক্তিতে আপত্তি করবেন না। এর বিনিময়ে তিনি স্যাভয় ও নিস পাবেন। ব্রিটিশ পররাষ্ট্র দপ্তর এই সিদ্ধান্ত মেনে নেয়।

পিডমন্ট রাজ ও গ্যারিবল্ডির ক্ষোভ

এই সিদ্ধান্তে অবশ্য পিডমন্ট-রাজ ভিক্টর ইমান্যুয়েল ও গ্যারিবল্ডি প্রবল ক্ষুব্ধ হন। স্যাভয় ছিল পিডমন্ট রাজবংশের আদি বাসস্থান, আর নিস ছিল গ্যারিবল্ডির জন্মস্থল। ক্যাভুর এই ভাবাবেগের কোনও মুল্য দেন নি। তাঁদের কাছে ক্যাভুর ছিলেন কুচক্রী ও খলনায়ক। গ্যারিবল্ডি ক্ষোভের সঙ্গে বলেন “আপনি আমাকে নিজভূমে পরবাসী করলেন।

গণভোট

গণভোটের মাধ্যমে (১১-১২ই মার্চ, ১৮৬০ খ্রিঃ) মধ্য ইতালির এই রাজ্যগুলি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয় এবং ইতালির ঐক্য আন্দোলন আরেক ধাপ অগ্রসর হয়।

গ্যারিবল্ডির পরিকল্পনা বানচাল

গ্যারিবল্ডি রোম আক্রমণ করলে ইউরোপের ক্যাথলিক রাজ্যগুলি কখনোই তা মেনে নেবে না। এই অবস্থায় ক্যাভুর তৃতীয় নেপোলিয়নের সঙ্গে আলোচনায় বসেন এবং স্থির হয় গ্যারিবল্ডির পরিকল্পনা বানচাল করার জন্য পোপ-অধিকৃত রোম নগরী বাদ দিয়ে পোপের অবশিষ্ট রাজ্য ও দক্ষিণ ইতালি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া আগেই জয় করে নেবে, এবং সিসিলি ও নেপলসকে প্রজাতান্ত্রিক শাসন থেকে মুক্ত করা হবে। এজন্য সেখানে অভিযান পাঠানো হবে।

সিসিলি ও নেপলস জয়

গ্যারিবল্ডির আগমনের পূর্বেই ভিক্টর ইমান্যুয়েল রোম বাদে পোপের সমগ্র রাজ্য জয় করেন এবং নেপলস্-এ এসে নেপলস্ ও সিসিলির আনুগত্য দাবি করেন। গৃহযুদ্ধ এড়াবার জন্য গ্যারিবল্ডি রাজ্য দুটি ভিক্টর ইমান্যুয়েলের হাতে তুলে দেন (৭ই নভেম্বর, ১৮৬০ খ্রিঃ)। এক গণভোটের মাধ্যমে এই রাজ্যদুটি পিডমন্ট-সার্ডিনিয়ার সঙ্গে যুক্ত হয়।

ইতালির জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের জানুয়ারি মাসে পিডমন্টের রাজধানী তুরিনে ইতালির জাতীয় সংসদের প্রথম অধিবেশন বসে এবং সেখানে ভিক্টর ইমান্যুয়েল ‘ইতালির রাজা’ হিসেবে ঘোষিত হন। ভেনেশিয়া ও রোম ব্যতীত সমগ্র ইতালি তখন ঐক্যবদ্ধ।

ক্যাভুরের মৃত্যু

১৮৬১ খ্রিস্টাব্দের ৬ই জুন মাত্র একান্ন বছর বয়সে ক্যাভুর মৃত্যুমুখে পতিত হন।

ক্যাভুরের অবদান

  • (১) ইতালির ঐক্য আন্দোলনে ক্যাভুর এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী। ম্যাৎসিনি ইতালিবাসীর মনে যে ঐক্যের প্রেরণা সঞ্চার করেন, ক্যাভুর কূটনীতির দ্বারা তা বাস্তবায়িত করেন।
  • (২) তাঁর উদ্যোগ অবশ্য পুরোপুরি সফল হয় নি। ভেনেশিয়া তখনও অস্ট্রিয়ার অধিকারে ছিল, রোম ছিল পোপের অধীনস্থ এবং স্যাভয় ও নিস ছিল ফরাসি সাম্রাজ্যভুক্ত।
  • (৩) নানা সাফল্য সত্ত্বেও ক্যাভুর কিন্তু কখনোই ম্যাৎসিনির আদর্শবাদ ও আত্মত্যাগের মহিমায় মণ্ডিত নন – ‘জাতির জনক’ হওয়ার মতো প্রতিভা বা নৈতিক গুণাবলীও তাঁর ছিল না।
  • (৪) সমকাল ও পরবর্তী যুগে তাঁকে ম্যাকিয়াভেলির কূটনীতি ও ধূর্ততায় পারঙ্গম একজন ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ বলেই গণ্য করা হয়েছে। অপরদিকে ম্যাৎসিনিকে বলা হয়েছে ‘স্বাধীন ইতালির আত্মা’।

ক্যাভুরের নিন্দা

গর্ডন ক্রেইগ, ডেনিস ম্যাকস্মিথ, এডগার হোল্ট, ডেভিড টমসন, গ্রেনভিল প্রমুখ ঐতিহাসিক ক্যাভুরের কাজকর্মের নিন্দা করেছেন। তা সত্ত্বেও তাঁর অবদানকে অস্বীকার করা যায় না।

উপসংহার:- ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী লর্ড পামারস্টোন তাঁকে ‘রূপকথার রাজপুত্র’ বলে অভিহিত করেছেন। তার মতে, “Cavour left a name to point a moral and adorn a tale.” হ্যাজেনের মতে, “জাতি হিসেবে ইতালি হল ক্যাভুরের সৃষ্টি।” বলা হয় যে, “ক্যাভুরই হলে আধুনিক ইতালির স্রষ্টা।”


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “ক্যাভুর” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) ক্যাভুর সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ক্যাভুর কে ছিলেন?

পিডমন্ট সার্ডিনিয়ার প্রধানমন্ত্রী ও ইতালির ঐক্য আন্দোলনের বিখ্যাত নেতা।

২. ক্যাভুর কবে প্রধানমন্ত্রীর পদ লাভ করেন?

১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে।

৩. আধুনিক ইতালির স্রষ্টা কাকে বলা হয়?

ক্যাভুরকে।

৪. ক্রিমিয়ার যুদ্ধ কখন হয়?

১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment