১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ প্রসঙ্গে গ্ৰিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব হিসেবে গ্ৰোটোর গির্জার কর্তৃত্ব, ফ্রান্স ও রাশিয়ার কর্তৃত্ব, ফ্রান্সের পুরোনো অধিকার দাবি, রাশিয়ার অধিকার দাবি, মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল, আনুষ্ঠানিক সূচনা, রুশ সম্প্রসারণ হিসেবে তুরস্ক বণ্টন, ইউরোপীয় শক্তিবর্গের আপত্তি, ইউরোপীয় রাষ্ট্রসমূহের স্বার্থ হিসেবে ইংল্যান্ডের স্বার্থ, ফ্রান্সের স্বার্থ, অস্ট্রিয়ার স্বার্থ, ইতালির স্বার্থ, ভিয়েনা নোট ও রাশিয়ার পরাজয় সম্পর্কে জানবো।
ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ
ঐতিহাসিক ঘটনা | ক্রিমিয়ার যুদ্ধ |
সময়কাল | ১৮৫৪-৫৬ খ্রিস্টাব্দ |
বিবাদমান পক্ষ | রাশিয়া বনাম ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, ইতালি, অস্ট্রিয়া |
ফলাফল | রাশিয়ার পরাজয় |
ভূমিকা:- ক্রিমিয়ার যুদ্ধ পূর্বাঞ্চল সমস্যার এক গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়। এক অতি তুচ্ছ কারণকে উপলক্ষ্য করে এই যুদ্ধের সূত্রপাত। অনেকেই এই যুদ্ধকে অনাবশ্যক ও অপ্রয়োজনীয় যুদ্ধ বলে ব্যাখ্যা করেছেন।
(ক) গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্ব
গ্রিক ও ল্যাটিন খ্রিস্টানদের দ্বন্দ্বের বিভিন্ন দিক গুলি হল –
(১) গ্ৰোটোর গির্জার কর্তৃত্ব
তুরস্ক সাম্রাজ্য-এর অন্তর্ভুক্ত খ্রিস্টের স্মৃতি-বিজড়িত পবিত্র জেরুজালেমের গ্ৰোটোর গির্জার কর্তৃত্ব নিয়ে ল্যাটিন বা রোমান ও গ্রিক ধর্মযাজকদের মধ্যে বিরোধ ছিল। ফ্রান্স ল্যাটিন ধর্মযাজকদের এবং রাশিয়া গ্রিক ধর্মযাজকদের সমর্থন করত।
(২) ফ্রান্স ও রাশিয়ার কর্তৃত্ব
১৭৪০ খ্রিস্টাব্দে তুরস্কের সঙ্গে ক্যাপিচুলেসন সন্ধি দ্বারা ফ্রান্স জেরুজালেমের পবিত্র স্থান ও ল্যাটিন বা রোমান ধর্মযাজকদের উপর অভিভাবকত্ব করার অধিকার পায়। আবার, ১৭৭৪ খ্রিস্টাব্দের কুসুক-কাইনাডর্জির সন্ধি দ্বারা রাশিয়া উক্ত স্থানগুলি ও গ্রিক ধর্মযাজকদের উপর কর্তৃত্বাধিকার পায়।
(৩) ফ্রান্সের পুরোনো অধিকার দাবি
ফরাসি বিপ্লব চলাকালে ফ্রান্স এই ব্যাপারে চিন্তার অবকাশ পায় নি। রাশিয়াও এই ব্যাপারে নীরব ছিল। বিপ্লব-অবসানে ১৮৫২ খ্রিস্টাব্দে ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন জেরুজালেম সম্পর্কে ফ্রান্সের পুরোনো অধিকার দাবি করলে তুরস্ক তা মেনে নেয়।
(৪) রাশিয়ার অধিকার দাবি
এই অবস্থায় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে রাশিয়াও তুরস্কের কাছে গ্রিক ধর্মপ্রতিষ্ঠান ও প্রজাবর্গের উপর অধিকার দাবি করে বসে। তুরস্ক গ্রিক ধর্মপ্রতিষ্ঠানগুলির উপর রুশ অধিকার স্বীকার করলেও গ্রিক ধর্মাধিষ্ঠান-ভুক্ত প্রজাদের উপর রুশ অধিকার মানতে রাজি ছিল না, কারণ এর ফলে কয়েক লক্ষ প্রজা রুশ শাসনাধীনে চলে যেত।
(৫) মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল
রাশিয়ার দাবি অস্বীকৃত হলে রাশিয়া কোনও রকম যুদ্ধ ঘোষণা না করেই দানিয়ুব উপত্যকায় অবস্থিত তুর্কি সাম্রাজ্যের দুটি প্রদেশ মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল করে নেয়। এর ফলে তুর্কি সুলতান ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।
(৬) আনুষ্ঠানিক সূচনা
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স এবং পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া তুরস্কের পক্ষে যুদ্ধে যোগদান করলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে আনুষ্ঠানিকভাবে ক্রিমিয়ার যুদ্ধ শুরু হয়। এই ধর্মীয় কারণই হল যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বা তাৎক্ষণিক কারণ।
(৭) থিয়ার্সের মন্তব্য
ফরাসি রাজনীতিক থিয়ার্স বলেন যে, কয়েকজন হতভাগ্য সন্ন্যাসীকে গ্রোটোর চাবি হস্তান্তর করার জন্য ক্রিমিয়ার যুদ্ধ বাধানো হয়।
(খ) রুশ সম্প্রসারণ
আসলে ধর্মীয় কারণ হল যুদ্ধের অজুহাত মাত্র। যুদ্ধের প্রকৃত কারণ হল তুরস্ক সাম্রাজ্যের অভ্যন্তরে রুশ সম্প্রসারণ এবং ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলির স্বার্থ-প্রণোদিত আচরণ। যেমন –
(১) তুরস্ক বন্টন
রাশিয়ার লক্ষ্য ছিল কৃষ্ণসাগরের উপর দিয়ে ভূমধ্যসাগরে পৌঁছানো। ইতিপূর্বে রুশ জার প্রথম নিকোলাস তুরস্ককে ‘ইউরোপ-এর রুগ্ন ব্যক্তি’ আখ্যা দিয়ে ১৮৪৫ খ্রিস্টাব্দে এবং পুনরায় ১৮৫৩ খ্রিস্টাব্দে ইংল্যান্ডের কাছে তুরস্ক বিভাজনের প্রস্তাব পাঠান। বলা হয় যে, দুর্বল তুরস্ককে নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিলেই পূর্বাঞ্চল সমস্যার সমাধান হবে এবং এতে তাঁরা নিজেরাও লাভবান হবেন।
(২) ইউরোপীয় শক্তিবর্গের আপত্তি
ইংল্যান্ড সরাসরি এই প্রস্তাব নাকচ না করে পরোক্ষভাবে আপত্তি জানায়। এর ফলে রাশিয়ার ধারণা হয় যে, তুরস্ক ব্যবচ্ছেদে ইংল্যান্ডের আপত্তি নেই। যাই হোক, রাশিয়া মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া দখল করলে তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ এই ব্যাপারে আপত্তি জানায়।
(গ) ইউরোপীয় রাষ্ট্রবর্গের স্বার্থ
এই ব্যাপারে ইউরোপীয় শক্তিবর্গ সকলেই নিজ নিজ স্বার্থ দ্বারা পরিচালিত হয়েছিল। যেমন –
(১) ইংল্যান্ডের স্বার্থ
ইংল্যান্ড তুরস্কের অখণ্ডতা রক্ষার পক্ষপাতী ছিল। কারণ, ভূমধ্যসাগরীয় অঞ্চলে রুশ অগ্রগতি ঘটলে ওই অঞ্চলে ব্রিটিশ বাণিজ্যিক স্বার্থ ও ভারতীয় সাম্রাজ্যের নিরাপত্তা বিঘ্নিত হওয়ার আশঙ্কা ছিল।
(২) ফ্রান্সের স্বার্থ
ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন তাঁর স্বৈরশাসনকে জনপ্রিয় করার উদ্দেশ্যে একটি জমকালো পররাষ্ট্রনীতি গ্রহণ করতে চাইছিলেন। রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধের সুযোগ তাঁর কাছে আকর্ষণীয় হয়ে ওঠে। তাই ফ্রান্সের গৌরব বৃদ্ধি এবং নেপোলিয়ন বোনাপার্ট -এর রাশিয়া অভিযানের ব্যর্থতার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য তিনি রুশ-বিরোধী নীতি গ্রহণ করেন। জার নিকোলাস তাকে প্রায়ই ব্যঙ্গ করে বলতেন যে, তিনি বংশানুক্রমিক অধিকারের ভিত্তিতে সিংহাসনে বসেন নি। রাশিয়াকে পরাজিত করে তিনি এই ব্যক্তিগত আক্রমণের প্রতিশোধ নিতে উদ্যোগী হন।
(৩) অস্ট্রিয়ার স্বার্থ
অস্ট্রিয়া নিজের বাণিজ্যিক স্বার্থ ও সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার কারণে বলকান অঞ্চলে রুশ সম্প্রসারণের বিরোধী ছিল।
(৪) ইতালির স্বার্থ
পিডমন্ট-সার্ডিনিয়া-র প্রধানমন্ত্রী ক্যাভুর আশা করেছিলেন যে এই যুদ্ধে অংশগ্রহণ করলে ইতালির ঐক্যের ব্যাপারে তিনি ইংল্যান্ড ও ফ্রান্সের কাছ থেকে প্রয়োজনীয় সাহায্য পাবেন। আসলে বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের বিবিধমুখী স্বার্থই ছিল ক্রিমিয়ার যুদ্ধের প্রকৃত কারণ।
(ঘ) ভিয়েনা নোট
- (১) রাশিয়া কর্তৃক মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া অধিকৃত হলে শঙ্কিত ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়া ভিয়েনাতে মিলিত হয় এবং সম্মিলিতভাবে তুরস্ক ও রাশিয়ার কাছে একটি প্রস্তাব পাঠায়। এই প্রস্তাব ‘ভিয়েনা নোট’ নামে খ্যাত।
- (২) এই প্রস্তাবে রাশিয়ার কাছে মোলডাভিয়া ও ওয়ালেশিয়া থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের দাবি জানানো হয়। রাশিয়া এই দাবি অগ্রাহ্য করলে, ইংল্যান্ড ও ফ্রান্স রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। ফলে ১৮৫৪ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে শুরু হয় ক্রিমিয়ার যুদ্ধ।
রাশিয়ার পরাজয়
১৮৫৪ (মার্চ) থেকে ১৮৫৬ (মার্চ) খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত দু’ বছর এই যুদ্ধ চলে। প্রথম দিকে কিছুটা সাফল্য অর্জন করলেও শেষ পর্যন্ত রাশিয়া পরাজিত হয়। সিনোপের নৌযুদ্ধে রাশিয়া তুরস্ককে পরাজিত করে। এরপর আলমা, বালাক্লাভা, ইনকারম্যান প্রভৃতি রণক্ষেত্র -এ রুশ বাহিনী পরাজিত হয়।
উপসংহার:- ১৮৫৫ খ্রিস্টাব্দে জার প্রথম নিকোলাসের মৃত্যু হলে রাশিয়ার পক্ষে যুদ্ধের আকাঙ্ক্ষা হ্রাস পায়। ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে ৩০ শে মার্চ প্যারিসের সন্ধি দ্বারা ক্রিমিয়ার যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটে।
(FAQ) ক্রিমিয়ার যুদ্ধের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?
১৮৫৪-১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দ।
ইংল্যান্ড, ফ্রান্স, প্রাশিয়া ও ইতালির সঙ্গে রাশিয়ার।
৩০ মার্চ, ১৮৫৬ খ্রিস্টাব্দে প্যারিসের সন্ধি।
কাউন্ট ক্যাভুর।