ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ হিসেবে পোপ ও গির্জার দুর্নীতি বিষয়ে সম্পত্তি বৃদ্ধি, বৈষম্যমূলক কর, পোপ ও তার অনুচরদের ব্যাভিচার, রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ, ধর্মের অপব্যাখ্যা, মার্জনা পত্র বিক্রি, পাপের মাত্রা বৃদ্ধি; নবজাগরণের প্রভাব, নগরের উন্মেষ, পোপ ও রাজতন্ত্রের সংঘর্ষ, গির্জার ধন-সম্পদ, জন ওয়াইক্লিফের ভূমিকা, জন হাসের ভূমিকা, জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব ও মার্টিন লুথারের প্রতিবাদ সম্পর্কে জানবো।

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ প্রসঙ্গে ইউরোপে প্রচলিত পোপতন্ত্র ও রোমান ক্যাথলিক ধর্মের কুসংস্কার, দুর্নীতি, অনাচার, স্বৈরাচার, দুর্নীতির কেন্দ্রস্থল চার্চ, নবজাগরণের প্রভাব, ইউরোপে নগরের উন্মেষ, পোপ ও রাজতন্ত্রের দ্বন্দ্ব, গীর্জার ধনসম্পদ, ইউরোপের ধর্ম সংস্কার আন্দোলনে মার্টিন লুথার, ঔয়াইক্লিফ ও জন হাসের ভূমিকা সম্পর্কে জানব।

ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ
সময়কালষোড়শ শতক
স্থানইউরোপ
পথিকৃৎমার্টিন লুথার
প্রতিপক্ষপোপ ও ক্যাথলিক চার্চ
ফলাফলপোপের আধিপত্য বিনষ্ট
নতুন ধর্মমতপ্রোটেস্ট্যান্ট
ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

ভূমিকা :- ইউরোপের রোমান ক্যাথলিক চার্চের বিভিন্ন অনাচার ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে মানুষের মনে যে ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছিল তারই বহিঃপ্রকাশ ছিল ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন। দীর্ঘকাল ধরে ক্যাথলিক চার্চের বিরুদ্ধে মানুষের মনে এই ক্ষোভ পুঞ্জিভূত হয়েছিল।

ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ

বিভিন্ন কারণে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের পটভূমি তৈরি হয়েছিল। যেমন –

(ক) গির্জা ও পোপের দুর্নীতি

বিভিন্নভাবে গির্জা ও পোপের দুর্নীতি দিন দিন বেড়েই চলেছে। যেমন –

(১) সম্পত্তি বৃদ্ধি

খ্রিস্টানদের ধর্মগুরু ছিলেন পোপ। তিনি নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করতেন। যুগ যুগ ধরে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিদের দানে পোপ ও গির্জার সম্পত্তি প্রচুর পরিমাণে বৃদ্ধি পেয়েছিল।

(২) বৈষম্যমূলক কর

পশ্চিম ইউরোপের অধিকাংশ আবাদি জমির মালিক ছিল গির্জা এবং এর জন্য গির্জাকে কোনও কর দিতে হত না। খ্রিস্টানদের ‘টাইদ’ বা ধর্মকর, ‘অ্যানেট’ বা বার্ষিক কর, ‘পিটারস্ পেন্স এবং জন্মকর, মৃত্যুকর প্রভৃতি বেশ কিছু ধর্মীয় কর দিতে হত এবং এই টাকা রোম-এ চলে যেত।

(৩) পোপ ও তার অনুচরদের ব্যাভিচার

গির্জার নানা পদ তখন বিক্রি করা হত। এর ফলে ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কহীন ব্যক্তিরা গির্জার উপর কর্তৃত্ব করত। গির্জায় যে বিপুল পরিমাণ অর্থ সংগৃহীত হত, তা ধর্মকার্যে ব্যয় করা হত না। পোপ ও তাঁর অনুচরেরা এই টাকা নিজেদের ভোগ, সুখ ও বিলাস-বাসনে ব্যয় করতেন এবং অনৈতিক জীবনযাপন করতেন। মদ্যপান, ব্যভিচার প্রভৃতি ছিল তাদের নিত্যসঙ্গী।

(৪) রাজনৈতিক ক্ষেত্রে হস্তক্ষেপ

পোপ ও যাজকেরা তখন নানা রাজনৈতিক ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করতেন এবং ধ্যান, উপবাস, প্রার্থনা, শাস্ত্রপাঠ, আর্তের সেবা প্রভৃতি বাদ দিয়ে জাঁকজমক-সহ তাঁরা বহু উচ্চ রাজনৈতিক পদে নিযুক্ত হতেন। ইংল্যান্ড-এর রাজা অষ্টম হেনরি-র প্রধানমন্ত্রী কার্ডিনাল উলসি ছিলেন এমনই এক সন্ন্যাসী। তিনি বহু উৎকোচ গ্রহণ করেন।

(৫) রাষ্ট্র ও পোপতন্ত্রের সংঘর্ষ

পোপ নিজেকে ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করে রাজার উপর কর্তৃত্ব করতে চাইলে রাষ্ট্র ও পোপতন্ত্রের মধ্যে সংঘর্ষ শুরু হয়।

(৬) ধর্মের অপব্যাখ্যা

সাধারণ মানুষের কুসংস্কার ও অজ্ঞতার সুযোগ নিয়ে পোপ ও যাজকেরা ধর্মের নানা অপব্যাখ্যা করতেন ও স্বর্গের লোভ দেখিয়ে তাদের কাছে একপ্রকার ‘ছাড়পত্র’ (‘Indulgence’) বিক্রি করে অর্থ আদায় করতেন।

(৭) মার্জনাপত্র বিক্রি

তাঁরা প্রচার করতেন যে, কেউ কোনও পাপ করে থাকলে, পোপের ভাণ্ডারে সাধ্যমতো অর্থদান করে এই ‘ছাড়পত্র’ ক্রয় করলে পাপের মার্জনা হবে এবং মৃত্যুর পর স্বর্গে পৌঁছতে অসুবিধা হবে না।

(৮) পাপের মাত্রা বৃদ্ধি

এইভাবে পাপের মাত্রা ক্রমশ বাড়তেই থাকে। ধর্মের নামে এইসব অধর্ম দেখে ধর্মপ্রাণ ব্যক্তিরা ভীত হয়ে ওঠেন এবং অধর্ম রোধ করতে সচেষ্ট হন। এইভাবে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের সূচনা হয়।

(খ) নবজাগরণের প্রভাব

  • (১) মধ্যযুগে মানুষের জীবনের কেন্দ্রস্থলে ছিল ধর্ম, এবং মানব জীবনের উপর পোপ ও গির্জার কর্তৃত্ব ছিল সর্বাত্মক। গির্জার কর্তৃত্বের বিরুদ্ধে কোনও প্রশ্ন তোলা যেত না।
  • (২) অসীম ক্ষমতার অধিকারী পোপ ও গির্জা সেদিন ধর্মের নামে অধর্মের উপাসনায় রত ছিল। দুর্নীতি, অনাচার এবং মানুষের উপর অত্যাচার সাধারণ নিয়মে পরিণত হয়।
  • (৩) এই অবস্থায় নবজাগরণ মানুষের মনে অনুসন্ধিৎসা, যুক্তিবাদ এবং জগৎ ও জীবন সম্পর্কে এক বিশ্লেষণী দৃষ্টিভঙ্গির সূচনা করে।
  • (৪) নবজাগরণ মানুষের মনে বিজ্ঞানভিত্তিক মৌলিক ও স্বাধীন চিন্তার জন্ম দেয়, এবং মানুষ পোপের একচেটিয়া কর্তৃত্ব ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে শুরু করে।

(গ) হিব্রু বাইবেল

  • (১) নবজাগরণের ফলে ইউরোপে গ্রিক, ল্যাটিন ও হিব্রু ভাষার চর্চা বৃদ্ধি পায়। আদি বাইবেল হিব্রুতে রচিত হয়েছিল। হিব্রু ভাষার চর্চার ফলে সাধারণ মানুষ বাইবেলের প্রকৃত নির্দেশগুলি সম্পর্কে অবহিত হয়।
  • (২) বাইবেলের শিক্ষা ও ধর্মযাজকদের শিক্ষার পার্থক্য তাদের কাছে সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। এই সময় মুদ্রণযন্ত্রের আবিষ্কার বাইবেলকে সহজেই সর্বসাধারণের কাছে পৌঁছে দেয়।

(ঘ) নগরের উন্মেষ

  • (১) মধ্যযুগের কৃষিভিত্তিক সমাজে ধর্ম, গির্জা ও পোপের প্রাধান্য ছিল প্রশ্নাতীত। দরিদ্রও মুর্খ কৃষক বিনা দ্বিধায় পোপ ও ধর্মযাজকদের নির্দেশ মেনে নিত। কালক্রমে শিল্প ওবাণিজ্যের প্রসার ঘটে এবং নগর জীবনের বিকাশ হতে থাকে।গ্রামের মানুষ শহরে চলে আসতে থাকে।
  • (২) এইভাবে নগর জীবনের বিকাশ মানুষের সামাজিক ও অর্থনৈতিক জীবনে নানা পরিবর্তন নিয়ে আসে। শহরের স্বাধীনচেতা নাগরিকরা অন্ধভাবে পোপ ও ধর্মযাজকদের নির্দেশ না মেনে তাঁদের দুর্নীতি ও একাধিপত্যের বিরুদ্ধে প্রশ্ন তুলতে থাকে।

(ঙ) পোপ ও রাজাদের দ্বন্দ্ব

  • (১) মধ্যযুগে পোপ ও ধর্মযাজকরা নিজেদের ঈশ্বরের প্রতিনিধি বলে দাবি করতেন। তাঁরা মনে করতেন রাজারা তাঁদের অধীনস্থ এবং তাঁদের নির্দেশ মেনে চলতে বাধ্য।
  • (২) রাজাদের পক্ষে সর্বদা এই দাবি মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না। এর ফলে তারা বিদেশি পোপের বিরুদ্ধে সংঘর্ষে অবতীর্ণ হন।
  • (৩) রাষ্ট্র ও পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে এই সংঘর্ষের ফলে বিভিন্ন রাষ্ট্রে জাতীয়তাবোধ বৃদ্ধি পায় এবং জনসাধারণ নিজ নিজ রাষ্ট্রের পক্ষ অবলম্বন করে। এইভাবে জাতীয় রাষ্ট্র গড়ে ওঠে এবং জাতীয় রাষ্ট্র থেকে ‘জাতীয় গির্জা’-র ধারণা জন্ম নেয়।

(চ) গির্জার ধন-সম্পদ

  • (১) গির্জার হাতে প্রভূত অর্থ ও সম্পদের মালিকানা রাজা, জমিদার, সামন্তপ্রভু এবং সাধারণ মানুষ মেনে নিতে পারে নি। ইউরোপের বিভিন্ন দেশ থেকে সংগৃহীত এই অর্থ পোপ ও যাজকদের বিলাসিতা এবং রোম নগরীর সৌন্দর্য-সাধনের জন্য ব্যয়িত হত।
  • (২) ইউরোপীয় রাজন্যবর্গ এই বিপুল সম্পদ ও অর্থ নিজেদের অধীনে আনতে তৎপর ছিলেন। গির্জার ক্রমবর্ধমান অর্থের চাহিদায় সাধারণ মানুষও প্রবল ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে। এই কারণে তারাও এই সংস্কার আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানায়।

(ছ) ওয়াইক্লিফের ভূমিকা

ইংল্যান্ডের জন ওয়াইক্লিফ সর্বপ্রথম ক্যাথলিক চার্চ ও পোপতন্ত্রের দুর্নীতির প্রতিবাদ করেন।তিনি বলেন প্রতিটি মানুষ ঈশ্বরের কাছে সমান। মানুষ নিজ কর্মের দ্বারাই ঈশ্বরের সান্নিধ্য লাভ করতে পারে। এজন্য পোপের মধ্যস্থতার কোনো প্রয়োজন নেই। তার এই প্রচারে দেশের সর্বত্র চার্চের বিরুদ্ধে জনমত গড়ে ওঠে।

(জ) জন হাসের ভূমিকা

বোহেমিয়ার প্রাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক জন হাস ঘোষণা করেন যে, ধর্মীয় অনুষ্ঠান পরিচালনায় অধার্মিক যাজকদের কোনো অধিকার নেই। ক্যাথলিক চার্চ ও পোপতন্ত্রের দুর্নীতি ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে তিনি প্রতিবাদে সোচ্চার হন। পোপতন্ত্রের বিরুদ্ধে পরিচালিত তার আন্দোলন হুসাইট আন্দোলন নামে পরিচিত।

(ঝ) জাতীয় রাষ্ট্রের উদ্ভব

ষোড়শ শতকে ইউরোপে বিভিন্ন শক্তিশালী জাতীয় রাষ্ট্রের উত্থান ক্যাথলিক চার্চ বিরোধী আন্দোলনের পটভূমি তৈরিতে সহায়তা করেছিল। জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ফলে সাধারণ মানুষ ও শাসকরা রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও পোপের নিয়ন্ত্রণের বাইরে নিজেদের জাতীয় চার্চব্যবস্থা গড়ে তুলতে আগ্রহী ছিলেন।

(ঞ) লুথারের প্রতিবাদ

ধর্মসংস্কার আন্দোলনে সবচেয়ে অগ্রগণ্য ভূমিকা পালন করেন জার্মানির উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের ধর্মতত্ত্বের অধ্যাপক মার্টিন লুথার। তিনি ১৫১৭ খ্রিস্টাব্দে পোপের অনৈতিক কার্যকলাপের বিষয়ে ৯৫ টি প্রশ্ন লিখে তা উইটেনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের দরজায় ঝুলিয়ে দেন এবং পোপের কাছ থেকে এগুলির উত্তর দাবি করেন। এখান থেকেই শুরু হয় ধর্মসংস্কার আন্দোলন।

উপসংহার :- জার্মানির মার্টিন লুথার ছিলেন ধর্ম সংস্কার আন্দোলনের পথিকৃত। তার প্রতিবাদের মধ্যে দিয়েই জার্মানি থেকে ক্রমে ফ্রান্স, ইংল্যান্ড, ডেনমার্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড প্রভৃতি দেশে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের ঢেউ আছড়ে পড়ে।

(FAQ) ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলনের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. ইউরোপে ধর্মসংস্কার আন্দোলন শুরু হয় কখন?

ষোড়শ শতকে।

২. ইউরোপের ধর্মসংস্কার আন্দোলনের প্রধান কারণ কি ছিল?

গির্জা ও পোপের দুর্নীতি।

৩. প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন কি?

ক্যাথলিক গির্জাকে দুর্নীতি মুক্ত করার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয় তাকে প্রতি-ধর্মসংস্কার আন্দোলন বলে।

৪. ক্যাথলিক ধর্মমতের বিরুদ্ধে কোন ধর্মমতের উত্থান ঘটে?

প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মমত।

Leave a Comment