বৌদ্ধ ধর্ম

বৌদ্ধ ধর্ম প্রসঙ্গে ত্রিপিটক, জন্মান্তর ও কর্মফলবাদ, আর্যসত্য, অষ্টাঙ্কিক মার্গ, মঝঝিম পন্থা, বৌদ্ধ ধর্মে অহিংসা, বৌদ্ধ ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য ও নির্বাণ লাভ সম্পর্কে জানবো।

গৌতম বুদ্ধ প্রচারিত বৌদ্ধ ধর্ম

ঐতিহাসিক ঘটনাবৌদ্ধ ধর্ম
প্রবর্তকগৌতম বুদ্ধ
ধর্মগ্ৰন্থত্রিপিটক
আর্যসত্যচারটি
সমকালের অন্য ধর্মজৈন ধর্ম
বৌদ্ধ ধর্ম

ভূমিকা :- ভারত -প্রায় সমকালে বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উত্থান ঘটে। গৌতম বুদ্ধ প্রচার করেন বৌদ্ধ ধর্ম ও মহাবীর প্রচার করেন জৈন ধর্ম। তৎকালীন সময়ে বৌদ্ধ ধর্ম ব্যাপক বিস্তার লাভ করেছিল।

বৌদ্ধ ধর্মগ্রন্থ ত্রিপিটক

  • (১) গৌতম বুদ্ধের প্রচারিত ধর্মমত বা আদি বৌদ্ধধর্মের কথা বৌদ্ধ পিটকে পাওয়া যায়। বৌদ্ধ পিটক হল তিনটি। এজন্য এর নাম ত্রিপিটক – বিনয় পিটক, সূত্র বা সুত্তপিটক এবং অভিধর্ম পিটক। শেষের দুইটি পিটকে যথাক্রমে বৌদ্ধধর্মের নৈতিক ও আধ্যাত্মিক তত্ত্বের ব্যাখ্যা পাওয়া যায়।
  • (২) কোনো কোনো পণ্ডিতের মতে, বুদ্ধের শিষ্যদের নিজস্ব কিছু মতামত বুদ্ধের নামে সুত্তপিটকে চালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এখন এগুলিকে স্বতন্ত্র করা খুব কষ্টকর।’ যাই হোক, পিটক গ্রন্থে বুদ্ধের মূল বাণীগুলির বেশীর ভাগ রক্ষিত হয়েছে বলে মনে করা হয়।

গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধ ধর্মে পুনর্জন্ম ও কর্মফলবাদের ব্যাখ্যা

  • (১) বৌদ্ধ মহাপরিনির্বাণসূত্র থেকে জানা যায় যে বোধিলাভের পর বুদ্ধ বৈশালীতে সর্বপ্রথম তাঁর ধর্মতত্ত্ব প্রচার করেন। বৌদ্ধধর্মের মূল লক্ষ্য ছিল মানুষের জীবনকে দুঃখের হাত থেকে মুক্ত করা।
  • (২) বুদ্ধ মনে করতেন যে, মানুষের মৃত্যুর পর তার আত্মা পুনরায় নতুন দেহে জন্মলাভ করে। নতুন জন্মলাভ করলেও, তাকে গত জন্মের কর্মফল ভোগ করতে হয়। জন্মগ্রহণ করলেই মানুষকে কর্ম করতে হয় এবং কর্মের ফল মানুষকে ভোগ করতে হয়। কর্ম থেকে আসে আসক্তি ও তৃষ্ণা এবং তার থেকে আসে দুঃখ।
  • (৩) মানুষ নিরন্তর বিভিন্ন জন্মে কর্ম করছে, আর তাঁর কর্মের ফল হিসেবে দুঃখ ভোগ করছে। সুতরাং যদি তার পুনরায় জন্মগ্রহণকে রদ করা সম্ভব হয় তবে মানুষ দুঃখের হাত থেকে মুক্তি পাবে। তার আত্মা নির্বাণ লাভ করে।

বৌদ্ধ ধর্মের আর্যসত্য

বুদ্ধ এই প্রত্যয়ে স্থির হন যে, কর্মফল ও জন্মান্তর হল ধ্রুব। কর্মফল এবং তার পরিণাম মানুষের দুঃখ সম্পর্কে বুদ্ধ চারটি সত্য বা আর্যসত্য উপলব্ধি করেন। এই চারটি আর্যসত্য হল –

  • (১) মানুষের জীবনে দুঃখ আছে, মানুষের জন্মই তার দুঃখের কারণ। মনুষ্য জন্মগ্রহণের জন্যই মানুষকে রোগ, জরা, অপ্রিয় বস্তু বা ব্যক্তির সংসর্গ ভোগ এবং অভীষ্ট বস্তু লাভে বাধা পেয়ে দুঃখভোগ করতে হয়।
  • (২) মানুষের জীবনে দুঃখের কারণও আছে। জীবনে দুঃখের কারণ হল তার কামনা, বাসনা, আসঙ্গলিপ্সা, তৃষ্ণা, আসক্তি প্রভৃতি বিভিন্ন প্রবৃত্তি। এই দ্বিতীয় সত্য হল দুঃখের কারণ।
  • (৩) মানুষের কামনা, বাসনা, আসক্তি নিরোধের উপায় আছে। দুঃখ নিরোধের উপায় হল তৃতীয় সত্য।
  • (৪) দুঃখ নিরোধের জন্যে সঠিক মার্গ বা পথ অনুসরণ করতে হবে। এই চার সত্যকে বুদ্ধ আর্যসত্য বলেন।

বুদ্ধের মতে তার বৌদ্ধ ধর্মের মূল

বুদ্ধের মতে তার ধর্মমতের মূল হল এই চারটি আর্যসত্য। মানবজীবনকে দুঃখ ছেয়ে রেখেছে। এই তত্ত্বের উপলব্ধি হলে তবেই এই দুঃখ থেকে মানুষ মুক্তির কথা ভাববে। এই আর্যসত্যকে উপলব্ধি করার জন্য প্রকৃত দৃষ্টি বা দেখার চোখ থাকা চাই (সৎদৃষ্টিকা)। এই উপলব্ধি বা সৎদৃষ্টি থেকে উচ্চতর উপলব্ধির ফলে মনুষ্যরূপে জন্মগ্রহণের জন্য বার্ধক্য, আত্মীয় বিয়োগ, দারিদ্র্য, আকাঙ্খিত দ্রব্যের অপ্রাপ্তি প্রভৃতি দুঃখ মানুষকে অভিভূত করে।

গৌতম বুদ্ধের বৌদ্ধ ধর্মের আর্যসত্য প্রসঙ্গে কোশাম্বীর অভিমত

  • (১) বিখ্যাত গবেষক ধর্মানন্দ কোশাম্বী আর্যসত্যের ব্যাখ্যায় বলেছেন যে ধনী, দরিদ্র, ক্ষমতাবান ও দুর্বল সকলেই দুঃখের অধীন। প্রত্যেকেই নিজ নিজ দুঃখ দূর করার চেষ্টা করে। যারা হিংস্র প্রকৃতির বা বুদ্ধিমান তারা অপরের ক্ষতি করে নিজেকে সুখী করার ব্যর্থ চেষ্টা করে। এভাবেই লোকে দুঃখ থেকে পরিত্রাণের ব্যর্থ চেষ্টা চালায়।
  • (২) মানব জীবনের বিভিন্ন দুঃখ থেকে পরিত্রাণের জন্য বুদ্ধ এক সম্পূর্ণ নতুন পথ দেখান। তিনি বলেন যে, দুঃখের প্রকৃত কারণ হল মানুষের আসক্তি বা তৃষ্ণা। আসক্তি যতদিন থাকবে ততদিন দুঃখ-ভোগ অনিবার্য। আসক্তির বিনাশ হলে দুঃখ থেকে মুক্তি লাভ হবে। এই হল আর্যসত্য। আসক্তির বিনাশের জন্য বুদ্ধ অষ্টাঙ্গিক মার্গ বা অষ্টপথের কথা বলেছেন।

বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গ

  • (ক) যে অষ্টপথ বা মার্গের কথা বুদ্ধ বলেছেন তা হল – (১) সৎবাকা, (২) সৎকার্য, (৩) সৎজীবন বা সৎজীবিকা, (৪) সৎচেষ্টা, (৫) সৎচিন্তা, (৬) সৎ-চেতনা, (৭) সৎ-সঙ্কল্প বা সৎপ্রতিজ্ঞা, (৮) সৎদর্শন বা সম্যক সমাধি।
  • (খ) বুদ্ধ বলেন যে, প্রথম তিনটি মার্গ পালন করলে সৎ-শীল বা শুদ্ধশীল হওয়া যাবে। শীল বলতে নৈতিক শুদ্ধতা বুঝায়। দ্বিতীয় তিনটি মার্গ পালন করলে সমাধি অর্থাৎ চিত্তের প্রশান্তি আসবে, কামনা-বাসনা দূর হবে। শেষের দুটি মার্গ পালন করলে উদিত হবে প্রজ্ঞা অর্থাৎ পরম জ্ঞান। প্রজ্ঞা বা পরম জ্ঞান উদিত হলে আপনা থেকেই আসবে আসক্তিহীনতা, অহিংসা। তাহলে মুক্তিলাভ সহজতর হবে।

বৌদ্ধ ধর্মের অষ্টাঙ্গিক মার্গ প্রসঙ্গে কোশাম্বীর ব্যাখ্যা

ধর্মানন্দ কোশাম্বী অষ্টাঙ্গিক মার্গের সামাজিক তাৎপর্য ব্যাখ্যা করেছেন। যেমন –

  • (১) সৎ-বাকা বলতে মিথ্যা কথা না বলা, যাতে সমাজের ও অপরের অকল্যাণ হয় এমন কথা না বলা বুঝায়। মিথ্যা কথা বা পরনিন্দা করলে সমাজ সংগঠনের ক্ষতি হয়।
  • (২) সৎকার্য বলতে চুরি, হত্যা থেকে বিরত থাকা বুঝায়। সৎকার্য বলতে অহিংসাকে কায়মনোবাক্যে পালন করা বুঝায়। অহিংসা পালন না করলে ক্ষতি হবে বলে বুদ্ধ বিশ্বাস করতেন। সম্যক কর্ম অর্থাৎ সমাজের কল্যাণকর কাজ করা হল সৎকর্ম বা সৎকার্য।
  • (৩) সৎ-জীবিকা বা সৎ-জীবন বলতে সমাজের অনিষ্ট না করে নিজের জীবিকা অর্জন করা বুঝায়। পশু হত্যা না করা, মাংসের ব্যবসা না করা, মদ্য বিক্রয় না করাও সৎ-জীবিকার অঙ্গ।
  • (৪) বুদ্ধ বলেছেন সমাজে প্রতি ব্যক্তি যদি নিজ ঐশ্বর্য বাড়াবার চেষ্টা করে তাহলে সমাজও ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য অপরের প্রতি সদ্ভাব রেখে নিজ উন্নতির চেষ্টাকেই তিনি সৎ চেষ্টা বলেছেন।
  • (৫) অপরের ক্ষতি না করে নিজ উন্নতির সঙ্কল্পকে তিনি সৎ সঙ্কল্প বলেছেন।
  • (৬) সৎ চিন্তা বলতে তিনি মন থেকে কুচিন্তা দূর করা এবং সুচিন্তাকে গ্রহণ করা বলেছেন।
  • (৭) সৎ-চেতনার অর্থ হল মানুষের দেহে ও মনে বহু অপরিচ্ছন্ন ও অপবিত্র দিক আছে, তা থেকে মুক্ত থাকার ইচ্ছা হল সৎ চেতনা।
  • (৮) সৎ-দর্শন বা সম্যক সমাধি হল সত্য, প্রেম, অহিংসার সঙ্গে সকল কিছুকে দর্শন বা ধ্যান করা। মানুষের অপরিমিত লোভ ও বাসনা পৃথিবীকে ও জীবনকে দুঃখ-কষ্টে পূর্ণ করেছে। এই বাসনার নিবৃত্তি হল শান্তির পথ। এই নিবৃত্তির জন্য দরকার প্রেম, অহিংসা ও সত্যের উপলব্ধি। একেই তিনি সৎ-দর্শন বলেছেন।

বৌদ্ধ ধর্মের মঝঝিম পন্থা

বুদ্ধ মঝঝিম পন্থা বা মধ্য পন্থার ওপর বিশেষ জোর দিতেন। তিনি তাঁর শিষ্য সারিপুত্তকে মঝঝিম পন্থা বুঝাবার সময় বলেন যে, “দুই অন্তের মাঝের পথই হল মধ্যম মার্গ বা মধ্যপথ।” একটি অন্ত হল অত্যধিক ভোগ, বিষয়-আশয়ের প্রতি আসক্তি। আর অপর অন্তটি হল অত্যধিক কৃচ্ছ্রসাধন ও দেহকে ক্লেশ দান করা। এই দুই অন্ত ত্যাগ করে অত্যধিক ভোগ-বাসনা, অংসযম এবং অত্যধিক কৃচ্ছ্রসাধন না করে মাঝামাঝি পথ অনুসরণ করাকেই তিনি মঝঝিম পন্থা বলেছেন।

বৌদ্ধধর্মে অহিংসা

বুদ্ধ অহিংসাকে কায়মনোবাক্যে পালনের আহ্বান জানান। সমাজে ও ব্যক্তি জীবনে শান্তি ও সাম্যের প্রতিষ্ঠা একমাত্র অহিংসার দ্বারাই সম্ভব বলে তিনি মনে করতেন।

বৌদ্ধ ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য

বুদ্ধ মনে করতেন যে, তাঁর ধর্মের চূড়ান্ত লক্ষ্য হল দুঃখ ভোগ থেকে মানুষের মুক্তি লাভের পথ নির্দেশ করা। বুদ্ধ বলেছেন যে, “সমুদ্র জলের যেমন মাত্র একটিই স্বাদ, তা হল লবণের স্বাদ, তাঁর ধর্মের একটিই লক্ষ্য – তা হল দুঃখের হাত থেকে মানুষের মুক্তি।”

বৌদ্ধ ধর্ম অনুসারে নির্বাণ

  • (১) অষ্টমার্গ অনুসরণ করে এবং শুদ্ধ শীল ও শুদ্ধ চিত্ত দ্বারা মানুষ প্রজ্ঞা লাভ করতে পারে। প্রজ্ঞা থেকে আসবে নির্বাণ। নির্বাণ হল অনন্ত ও মুক্তি। জন্ম থেকে জন্মান্তরে মানুষ যে কর্মফলের ভার বয়ে বেড়ায় তার থেকে আত্মার মুক্তি হল নির্বাণ।
  • (২) জন্ম হল দুঃখের কারণ। নির্বাণ লাভ করলে আর পুনর্জন্ম হবে না। নির্বাণ হল পুনর্জন্মের আকাঙ্খার নিবৃত্তি। উপনিষদে যাকে যোগক্ষেমা বলা হয় মানুষ তা লাভ করে মহত্তর হবে। নির্বাণ লাভ করলে আর মানুষকে দুঃখ স্পর্শ করতে পারে না।

উপসংহার :- গৌতম বুদ্ধ বারাণসীর কাছে সারনাথে প্রথম ধর্ম প্রচার করেন। তিনি সমাজের দরিদ্র পতিতদেরও তার করুণা থেকে বঞ্চিত করেন নি। এর ফলে বৌদ্ধ ধর্ম সমাজের সর্বস্তরে ছড়িয়ে পড়ে।

(FAQ) বৌদ্ধ ধর্ম সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বৌদ্ধধর্মের প্রবর্তক কে?

গৌতম বুদ্ধ।

২. বৌদ্ধ ধর্মগ্ৰন্থের নাম কি?

ত্রিপিটক।

৩. বৌদ্ধ ধর্মে আর্যসত্য কটি?

চারটি।

৪. প্রথম বৌদ্ধ সংগীতি কোথায় আয়োজিত হয়?

রাজগৃহে।

Leave a Comment