নীল বিদ্রোহ

নীল বিদ্রোহের সময়কাল, স্থান, বিদ্রোহের কারণ, বিদ্রোহ ঘোষণা, বিদ্রোহের সূত্রপাত, বিদ্রোহের নেতৃত্ব, বিদ্রোহের পর্যায়, বিদ্রোহের প্রসার, বিদ্রোহের অবসান, বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, বিদ্রোহের চরিত্র, বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

নীল বিদ্রোহ প্রসঙ্গে নীল বিদ্রোহের সময়কাল, নীল বিদ্রোহের এলাকা বা স্থান, নীল বিদ্রোহের নেতা, নীল বিদ্রোহের প্রসার, নীল বিদ্রোহের কারণ, নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি, নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে টীকা, নীল বিদ্রোহের কাহিনী পত্র পত্রিকায় প্রকাশ, নীল বিদ্রোহের প্রথম সূচনা, নীল বিদ্রোহের চাষীদের পক্ষে সবচেয়ে বেশি সরব পত্রিকা, নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য, নীল বিদ্রোহের অঞ্চল, নীল বিদ্রোহের কেন্দ্র, নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব ও ফলাফল।

১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ

ঐতিহাসিক ঘটনানীল বিদ্রোহ
সময়কাল১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ
স্থাননদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহ খুলনা
নেতৃত্ববিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, বিশ্বনাথ সর্দার, রফিক মণ্ডল
ফলাফলব্যর্থতা
নীল বিদ্রোহ

ভূমিকা :- সর্বপ্রথম ভারত -এ নীলচাষ শুরু করেন ব্রিটিশ বণিক কার্ল ব্ল্যাম। পরবর্তীকালে ইউরোপ -এর নীলকরদের তীব্র অত্যাচারে অতিষ্ঠ হয়ে বাংলার চাষিরা বিদ্রোহ করে, যা নীল বিদ্রোহ নামে পরিচিত।

নীল বিদ্রোহের কারণ

বাংলায় এই নীল বিদ্রোহের বিভিন্ন কারণ ছিল। যেমন –

(১) নীলচাষের প্রণালী

বাংলায় মূলত দুটি পদ্ধতিতে নীলচাষ হত। এলাকা চাষ ও বে-এলাকা বা রায়তি চাষ। রায়তি চাষে জমি, লাঙ্গল, সার, বীজ ও অন্যান্য সব খরচ লাঙল, সার, বীজ ও অন্যান্য সব খরচ চাষিদের বহন করতে হত। তাই নীলকররা সর্বদা চাষিকে বে এলাকা বা রায়তি চাষে বাধ্য করত।

(২) দাদন প্রথা

নীলকররা নীলচাষের জন্য চাষিকে বিঘা পিছু মাত্র ২ টাকা অগ্রিম দাদন দিত। কোনো চাষি একবার দাদন নিলে তা আর কখনোই নীলকরের খাতায় পরিশোধ হত না। আবার দাদন না নিলে চাষির গোরুবাছুর নীলকুঠিতে আটকে রাখা হত।

(৩) জমির মাপে কারচুপি

নীলকরের কাছ থেকে দাদন নিয়ে যে জমিতে চাষিকে নীলচাষ করতে হত তা মাপের সময় নীলকররা ব্যাপক কারচুপি করত। তারা গড়ে প্রতি আড়াই বিঘা জমিকে ১ বিঘা বলে গণ্য করত। তাছাড়া নীল কেনার সময় নীলের ওজন কম দেখাত ও কম দামে নীল বিক্রি করতে বাধ্য করত।

(৪) চাষির লোকসান

নীলচাষ করে চাষির প্রচুর আর্থিক লোকসান হত। নীল কমিশনের হিসাব অনুযায়ী, এক বিঘা জমিতে নীলচাষে খরচ পড়ত ১৩ টাকা ৬ আনা। সেই নীল বিক্রি করে চাষি পেত মাত্র ৬ টাকা। অর্থাৎ প্রতি বিঘা নীলচাষে চাষির লোকসান হত ৭ টাকা ৬ আনা।

(৫) অত্যাচার

নীলকররা নীলচাষিদের নানাভাবে অত্যাচার করে নীলচাষ করতে বাধ্য করত। অনিচ্ছুক চাষিদের প্রহার করা, আটকে রাখা, স্ত্রী-কন্যার সম্মানহানি করা, চাষের সরঞ্জাম লুঠ করা, ঘরে আগুন লাগিয়ে দেওয়া নানাভাবে অত্যাচার করত।

(৬) ইংরেজ শাসকদের অবিচার

অত্যাচারিত চাষিরা নীলকরদের বিরুদ্ধে ইংরেজ শাসকদের কাছে অভিযোগ জানিয়ে কখনও ন্যায়বিচার পেত না। আইন ছিল নীলকরদের স্বার্থরক্ষার জন্য, চাষিদের জন্য নয়। তাছাড়া পুলিশ, প্রশাসন সবই ছিল নীলকরদের পক্ষে

(৭) পঞ্চম আইন

১৮৩০ খ্রিস্টাব্দে লর্ড বেন্টিঙ্ক পঞ্চম আইন পাশ করেন। এই আইনে বলা হয় দাদন নিয়ে নীল চাষ না করলে তা বে-আইনি বলে গণ্য হবে এবং অপরাধীর জেল হ‌বে।

(৮) পত্রপত্রিকার প্রভাব

নীলচাষিদের উপর নীলকরদের অবর্ণনীয় অত্যাচারের কথা সে সময়কার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় ও লেখায় প্রকাশিত হয়েছে। হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা এবং দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটক এই বিষয়ে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করেছে।

নীল বিদ্রোহ ঘোষণা

উপরোক্ত কারণগুলির ফলস্বরূপ নীলচাষিরা বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস ও দিগম্বর বিশ্বাসের নেতৃত্বে নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে।

নীল বিদ্রোহের সূত্রপাত

তীব্র শোষণ ও অত্যাচারে জর্জরিত হয়ে বাংলার প্রায় ৬০ লক্ষ নীলচাষি বিদ্রোহের পথে পা বাড়ায়।

নীল বিদ্রোহের নেতৃত্ব

এই নীল বিদ্রোহের বিখ্যাত নেতা ছিলেন কৃষ্ণনগরের দিগম্বর বিশ্বাস ও বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, আসাননগরের মেঘাই সর্দার, পাবনার মহেশ বন্দ্যোপাধ্যায়, বাংলাদেশ -এর খুলনা জেলার কাদের মোল্লা, মালদহের রফিক মণ্ডল, বাঁশবেড়িয়ার বৈদ্যনাথ সর্দার ও বিশে ডাকাত নামে পরিচিত বিশ্বনাথ সর্দার প্রমুখ।

নীল বিদ্রোহের পর্যায়

নীল চাষিদের চাষিদের বিদ্রোহকে তিনটি পর্যায়ে দেখা যেতে পারে। যথা –

(১) প্রথম পর্যায়

আন্দোলনের প্রথম পর্যায়ে তারা নীলকরদের শোষণ, অত্যাচার, নির্যাতন ও মিথ্যা মামলা চাপিয়ে তাদের সর্বস্বান্ত করা বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছে অভিযোগ করেন।

(২) দ্বিতীয় পর্যায়

অভিযোগের কোনো প্রতিকার না পেয়ে আন্দোলনের দ্বিতীয় পর্যায়ে চাষিরা দাদন নিতে অস্বীকার করে এবং নীলচাষ বয়কট করে।

(৩) তৃতীয় পর্যায়

আন্দোলনের তৃতীয় পর্যায়ে চাষিরা বর্শা, তরবারি প্রভৃতি নিয়ে নীলকরদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়।

নীল বিদ্রোহের প্রসার

এই নীল বিদ্রোহ দাবানলের মতো নদিয়া, যশোহর, পাবনা, ফরিদপুর, বরিশাল, রাজশাহ খুলনা, মালদহ, মুর্শিদাবাদ, দিনাজপুর প্রভৃতি জেলায় বিস্তার লাভ করে।

নীল বিদ্রোহের উপর শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণীর প্রভাব

বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্তশ্রেণির একাংশ নীলচাষিদের পক্ষ নিয়ে সরকারের বিরুদ্ধে সরব হন। হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকা চাষিদের পক্ষে কলম ধরে। দীনবন্ধু মিত্র তাঁর ‘নীলদর্পণ’ নাটকে নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের মর্মস্পর্শী চিত্র তুলে ধরেন।

নীল বিদ্রোহের অবসান

বাংলার ছোটোলাট পিটার গ্রান্ট পূর্ববাংলা সফরে এলে হাজার হাজার নীলচাষি নদীর তীরে দাঁড়িয়ে তাদের করুণ অবস্থার কথা তাঁকে জানান। শেষপর্যন্ত তিনি নীল কমিশন (১৮৬০ খ্রি.) গঠন করেন। এই কমিশনের রিপোর্টের ভিত্তিতে বাংলায় জোরপূর্বক নীলচাষ নিষিদ্ধ হলে নীল বিদ্রোহ থেমে যায়।

নীল বিদ্রোহের বৈশিষ্ট্য

নীলকর সাহেবদের তীব্র শোষণ ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে বাংলার বিভিন্ন জেলায় চাষিরা নীল বিদ্রোহ শুরু করে। এই বিদ্রোহের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্য লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) শক্তিশালী বিদ্রোহ

অত্যাচারিত নীলচাষিদের ব্যাপক অংশগ্রহণের ফলে অন্যান্য কৃষকবিদ্রোহের তুলনায় নীল বিদ্রোহ তীব্র আকার ধারণ করে। তৎকালীন বড়োেলাট লর্ড ক্যানিং স্বীকার করেছেন যে, তাঁদের কাছে নীল বিদ্রোহ ১৮৫৭ খ্রিস্টাব্দের মহাবিদ্রোহ বা সিপাহি বিদ্রোহের চেয়েও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে উঠেছিল।

(২) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য

হিন্দু ও মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের অত্যাচারিত কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহে অংশগ্রহণ করে। ফলে বিদ্রোহীদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক ঐক্য দেখা যায়।

(৩) জমিদারদের যোগদান

বাংলার কৃষকদের সঙ্গে বহু জমিদারও নীলকরদের বিরুদ্ধে নীল বিদ্রোহে যোগ দেয়। এইসব জমিদারদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিলেন নড়াইলের রামরতন রায়, রানাঘাটের শ্রীগোপাল পালচৌধুরী, চণ্ডীপুরের শ্রীহরি রায় প্রমুখ।

(৪) সংবাদপত্রের ভূমিকা

নীলচাষিদের ওপর নীলকরদের অত্যাচার ও শোষণ এবং নীল বিদ্রোহের নানা ঘটনা তৎকালীন সংবাদপত্রগুলিতে গুরুত্ব দিয়ে প্রকাশ করা হত। এই সব পত্রিকার মধ্যে উল্লেখযোগ্য ছিল ‘হিন্দু প্যাট্রিয়ট’, ‘বামাবোধিনী‘, ‘গ্রামবার্ত্তা প্রকাশিকা‘, ‘সমাচার চন্দ্রিকা‘, ‘সমাচার দর্পণ‘ প্রভৃতি।

(৫) ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ

ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহ -এর অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহে তা  ছিল না। নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ।

(৬) শিক্ষিত মধ্যবিত্তদের যোগ

উনিশ শতকে বাংলার বিভিন্ন কৃষক ও উপজাতি বিদ্ৰোহগুলির মধ্যে একমাত্র নীল বিদ্রোহই কলকাতা তথা বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণির সমর্থন ও সহযোগিতা পায়।

(৭) অন্যান্য বৈশিষ্ট্য

  • (১) এটি শুরুতেই হিংসাত্মক বিদ্রোহ ছিল না,
  • (২) নীল বিদ্রোহ শুরুর পরেও বাংলার গভর্নর পিটার গ্রান্টের সরকারি সমর্থন লাভ করেছিল,
  • (৩) এই বিদ্রোহ জমিদার ও মহাজন বিরােধী ছিল না। বরং তা ছিল নীলকর বিরােধী বিদ্রোহ।

নীল বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র

১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দের নীল বিদ্রোহ ছিল উনিশ শতকে বাংলার সবচেয়ে শক্তিশালী কৃষক বিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের প্রকৃতি বা চরিত্র নিয়ে পণ্ডিতদের মধ্যে মতভেদ লক্ষ্য করা যায়। যেমন –

(১) জমিদার-নীলকর বিরোধ

অধ্যাপক চিত্তব্রত পালিত মনে করেন যে, নীল বিদ্রোহ ছিল বাঙালি জমিদারদের সঙ্গে বিদেশি নীলকরদের সংঘাত। গ্রামবাংলায় নীলকরদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হলে বাঙালি জমিদারদের স্বার্থে আঘাত লাগে। তাই জমিদারদের নির্দেশে কৃষকরা নীলকরদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহে শামিল হয়।

(২) কৃষক বিদ্রোহ

নীল বিদ্রোহ ছিল একটি কৃষকবিদ্রোহ। কোনো কোনো জমিদার বিদ্রোহে অংশ নিলেও মূলত কৃষকদের স্বার্থেই এই বিদ্রোহ শুরু হয়েছিল এবং তারাই বিদ্রোহের অগ্রভাগে ছিল।

(৩) গণ আন্দোলন

অনেকে নীল বিদ্রোহকে প্রকৃত গণ আন্দোলন বলে অভিহিত করেছেন। তৎকালীন বাংলার ছোটোলাট জন পিটার গ্রান্ট একে ‘লক্ষ লক্ষ মানুষের তীব্র অসন্তোষের বহিঃপ্রকাশ’ বলে অভিহিত করেছেন। ‘ক্যালকাটা রিভিউ পত্রিকায় লেখা হয়েছে, “এটা একটা বিদ্রোহ, সমগ্র দেশই এতে যোগ দিয়েছে।”

(৪) ধর্মনিরপেক্ষ আন্দোলন

ওয়াহাবি আন্দোলন, ফরাজি আন্দোলন, সাঁওতাল বিদ্রোহ, মুণ্ডা বিদ্রোহের অন্যতম প্রধান চালিকাশক্তি ছিল ধর্ম। কিন্তু নীল বিদ্রোহ ছিল মূলত ধর্মনিরপেক্ষ বিদ্রোহ। হিন্দু-মুসলিম কৃষকরা সমবেত ভাবে এই বিদ্রোহ করেছিল।

(৫) জাতীয় আন্দোলন

কেউ কেউ নীল বিদ্রোহকে জাতীয় আন্দোলনের সমান বলে মনে করেন। ইতিহাসবিদ সতীশচন্দ্র মিত্র বলেছেন, “এই বিদ্রোহ স্থানিক বা সাময়িক নয়, উহার নিমিত্ত যে কত গ্রাম্য বীর ও নেতাদের উদয় হইয়াছিল ইতিহাসের পাতায় তাহাদের নাম নাই।”

নীল বিদ্রোহের গুরুত্ব

বাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিদের উদ্যোগে ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ উনিশ শতকে ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম। যেমন –

(১) স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ

নীল বিদ্রোহ ছিল নীলকরদের বিরুদ্ধে সংঘটিত একটি স্বতঃস্ফূর্ত গণবিদ্রোহ। এই বিদ্রোহের গুরুত্ব সম্পর্কে অমৃতবাজার পত্রিকায় মন্তব্য করা হয়েছে যে, নীল বিদ্রোহ দেশের মানুষকে রাজনৈতিক চেতনা ও ঐক্যবদ্ধ আন্দোলনের শিক্ষা দিয়েছিল।

(২) শিক্ষিত সম্প্রদায়ের নজর

নীল বিদ্রোহকে উপলক্ষ্য করে বাংলার শিক্ষিত মধ্যবিত্ত শ্রেণি গ্রামগঞ্জের সাধারণ গরিব মানুষ ও কৃষকদের প্রতি নজর দেয়। ফলে শিক্ষিত সমাজের সঙ্গে নীল বিদ্রোহ ও বিদ্রোহীদের সংযোগ ঘটে।

(৩) রাজনৈতিক চেতনা

নীল আন্দোলনকে কেন্দ্র করে ইংরেজ সরকারের অত্যাচার ও শোষণের আসল রূপ শিক্ষিত সমাজের চোখে ধরা পড়ে। এর ফলে দেশবাসীর রাজনৈতিক চেতনাও বৃদ্ধি পায়।

(৪) হিন্দু-মুসলিম ঐক্য

নীল বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বাংলায় হিন্দু মুসলিম উভয় সম্প্রদায়ের চাষিরা ঐক্যবদ্ধ হয় এবং একসঙ্গে আন্দোলনে শামিল হয়।

(৫) গান্ধিজির আন্দোলনের অগ্রদূত

নীল বিদ্রোহকে বিশ শতকে মহাত্মা গান্ধির নেতৃত্বে পরিচালিত অহিংস অসহযোগ আন্দোলন ও আইন অমান্য আন্দোলনের অগ্রদূত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। সম্ভবত নীল বিদ্রোহের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই গান্ধিজি বিহারের চম্পারনে নীলকর সাহেবদের বিরুদ্ধে চম্পারণ সত্যাগ্রহ করেছিলেন।

(৬) জাতীয়তাবোধ

নীল বিদ্রোহ সামন্তপ্রথা ও ঔপনিবেশিক শাসনের ভিত্তিমূলে কুঠারাঘাত করে। এই বিদ্রোহ শিক্ষিত মধ্যবিত্ত বাঙালির জাতীয়তাবোধ জাগ্রত করে শেষপর্যন্ত তা স্বাধীনতা সংগ্রামে পরিণত করে।

নীল বিদ্রোহের ফলাফল

বাংলার অত্যাচারিত নীলচাষিদের উদ্যোগে ১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দে সংঘটিত নীল বিদ্রোহ উনিশ শতকে ভারতের কৃষক আন্দোলনের ইতিহাসে এক গৌরবময় অধ্যায়। এই বিদ্রোহের ফলাফল ছিল সুদূর প্রসারী। যেমন –

(১) নীল কমিশন গঠন

বিদ্রোহের পর সরকার ১৮৬০ খ্রিস্টাব্দে নীল কমিশন গঠন করে। কমিশনের রিপোর্ট থেকে নীলকরদের চরম অত্যাচার ও নির্যাতনের কাহিনি প্রকাশিত হয়।

(২) অষ্টম আইন

সরকার ১৮৬৮ খ্রিস্টাব্দে ‘অষ্টম আইন’-এর দ্বারা ‘নীলচুক্তি আইন’ বাতিল বলে ঘোষণা করে এবং নীলচাষ সম্পূর্ণভাবে চাষিদের ইচ্ছাধীন হিসেবে বর্ণনা করে।

(৩) যোগসূত্র

নীল বিদ্রোহ নীলকরদের এবং তাদের রক্ষক ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হয়। এই বিদ্রোহকে কেন্দ্র করে বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের চাষিদের মধ্যে, চাষি ও জমিদারদের মধ্যে, শিক্ষিত ও অশিক্ষিতদের মধ্যে যোগসূত্র গড়ে ওঠে।

(৪) জাতীয় চেতনার উন্মেষ

নীল বিদ্রোহ পরোক্ষভাবে জাতীয় চেতনার উন্মেষ ঘটাতে সাহায্য করে। নীলকরদের অত্যাচার, ‘নীলদর্পণ’ নাটকের মর্মস্পর্শী বিবরণ, লং সাহেবের কারাবাস, হরিশচন্দ্র মুখোপাধ্যায় -এর মৃত্যু প্রভৃতি ঘটনা এই জাতীয় চেতনাকে শক্তিশালী করে।

(৫) মহাজনদের কর্তৃত্ব বৃদ্ধি

মার্কিন ইতিহাসবিদ ব্লেয়ার ক্লিং মনে করেন যে, নীলকরদের পতনের ফলে নিম্নবর্ণের কর্তৃত্ব সুদখোর মহাজনদের হাতে চলে যায়।

উপসংহার :- নীলবিদ্রোহের ব্যাপকতা ও বিদ্রোহের প্রতি বিপুল গণসমর্থন নীলচাষ সম্পর্কে ইংরেজ সরকারকে সিদ্ধান্ত বদল করতে বাধ্য করেছিল। এই বিদ্রোহ যেভাবে বাংলার সর্বস্তরের মানুষকে ঐক্যবন্ধ করে, তা পরবর্তীকালে জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের পটভূমি প্রস্তুত করেছিল।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “নীল বিদ্রোহ” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) নীল বিদ্রোহ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. নীল বিদ্রোহের দুজন নেতার নাম লেখ।

বিষ্ণুচরণ বিশ্বাস, দিগম্বর বিশ্বাস, বিশ্বনাথ সর্দার, রফিক মণ্ডল।

২. নীল বিদ্রোহ প্রথম কোথায় শুরু হয়?

নদিয়া জেলায়।

৩. নীল বিদ্রোহের সময়কাল কত?

১৮৫৯-৬০ খ্রিস্টাব্দ।

৪. নীল বিদ্রোহের কাহিনী কোন পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছিল?

হরিশ্চন্দ্র মুখোপাধ্যায়ের হিন্দু প্যাট্রিয়ট পত্রিকায়।

৫. নীল বিদ্রোহের কাহিনী কোন গ্ৰন্থে উল্লেখ করা হয়েছে?

দীনবন্ধু মিত্রের ‘নীলদর্পণ’ নাটকে।

অন্যান্য ঐতিহাসিক ঘটনা বা গল্পগুলি

Leave a Comment