অটো ফন বিসমার্ক

অটো ফন বিসমার্ক এর জীবনী প্রসঙ্গে তাঁর জন্ম, শিক্ষাজীবন, কর্মজীবন, প্রাশিয়ার চ্যান্সেলর পদ গ্রহণ, রক্ত লৌহ নীতি, অভ্যন্তরীণ নীতি, জার্মানির ঐক্য আন্দোলনে ভূমিকা, ডেনমার্কের যুদ্ধ, স্যাডোয়ার যুদ্ধ ও সেডানের যুদ্ধে ভূমিকা, আধুনিক জার্মানির প্রতিষ্ঠা ও তাঁর প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণে ভূমিকা।

প্রাশিয়ার অটো ফন বিসমার্কের জীবনী

ঐতিহাসিক চরিত্রঅটো ফন বিসমার্ক
জন্ম১৮১৫ খ্রিস্টাব্দ
জন্মস্থানপ্রাশিয়ার ব্রান্ডেনবার্গ
ডেনমার্কের যুদ্ধ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দ
স্যাডোয়ার যুদ্ধ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দ
সেডানের যুদ্ধ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দ
বিসমার্কের জন্ম পরিচয়

বিসমার্ক কে ছিলেন?

১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের সেপ্টেম্বর মাসে অটো ফন বিসমার্ক নামে এক ধুরন্ধর রাজনীতিবিদ্ প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণ করলে জার্মানির ঐক্য আন্দোলন -এ এক নবযুগের সূচনা হয়।

অটো ফন বিসমার্কের জীবনী (সূচনা)

আজকের ইউরোপ -এর অন্যতম অর্থনৈতিক শক্তি জার্মানি দুটি বিশ্বযুদ্ধে পরাজিত হওয়া সত্ত্বেও নিজের শক্তি দিয়ে মিত্রপক্ষকে প্রবল চাপে রাখতে সক্ষম হয়েছে।

উনিশ শতকে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র অংশে বিভক্ত জার্মানিকে একত্র করে ইউরোপের অন্যতম শ্রেষ্ঠ শক্তিতে রূপান্তরিত করার কৃতিত্ব যার, তার নাম অটো ফন বিসমার্ক। তিনি শুধু জার্মানির প্রথম চ্যান্সেলরই নন, জার্মানির সার্থক ভাগ্যবিধাতা।

ঐক্যবদ্ধ জার্মানির প্রথম প্রধানমন্ত্রী অটো ফন বিসমার্ক ১৮৭১-১৮৯০ খ্রিষ্টাব্দ পর্যন্ত ইউরোপীয় রাজনীতির প্রধান নিয়ন্ত্রক ছিলেন। তাঁর অঙ্গূলিহেলনে ইউরোপীয় রাজনীতি পরিচালিত হত।

বিসমার্কের জন্ম পরিচয়

বিসমার্ক ১৮১৫ খ্রিস্টাব্দের ১লা  এপ্রিল প্রাশিয়ার ব্রান্ডেনবার্গ এ জন্মগ্রহণ করেন। তিনি এক ধনী জমিদার বাড়ির সন্তান ছিলেন।

বিসমার্কের শিক্ষাজীবন

বিসমার্ক বার্লিন ও গেটিং জেন বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন।

ছাত্রজীবনে তিনি তেমন কোনো প্রতিভার পরিচয় দিতে পারেননি। তবে তিনি ইংরেজি, ফরাসি ও রুশ ভাষা জানতেন।

বিসমার্কের চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য

  • বংশ পরম্পরাগত ভাবে জমিদার পরিবারের সন্তান বিসমার্ক সর্বপ্রকার পরিবর্তনের বিরোধী ছিলেন।
  • বিসমার্ক ছিলেন গোঁড়া, রক্ষণশীল ও প্রতিক্রিয়াশীল।
  • গণতন্ত্র, বিপ্লব ও উদারনীতির প্রতি বিসমার্কের বিদ্বেষ ছিল সীমাহীন।
  • বিসমার্ক বাস্তববাদী রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন এবং মনে করতেন যে, লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য মহৎ হলে নৈতিকতা কোনও প্রতিবন্ধক হতে পারে না।
  • অধ্যাপক হ্যাজেন বলেন যে, বিসমার্কের কাছে ন্যায় নীতি ছিল গৌণ এবং বাস্তব রাজনীতিই ছিল আসল।
  • খ্রিস্ট ধর্মের প্রতি বিশ্বাস ছিল বলে তিনি রাষ্ট্রবিপ্লব ও সমাজতন্ত্রের পক্ষপাতী হতে পারেননি।
  • বিসমার্ক একদিন বলেছিলেন, “আমি খ্রিস্টান না হলে সাধারণতন্ত্রের উপাসক হতাম।”
  • বিসমার্ক যুদ্ধের পক্ষপাতী হলেও যুদ্ধে তার নেশা ছিল না।

বিসমার্কের কর্মজীবন

শিক্ষা শেষে বিসমার্ক সরকারি চাকরিতে যোগদান করেন। কিছুদিন পর চাকরির একঘেয়েমিতে বিরক্ত হয়ে চাকরি ত্যাগ করেন। এরপর বিসমার্ক পৈত্রিক জমিদারি তদারক করতে থাকেন।

১৮১৫ খ্রিস্টাব্দে প্রথমে বিসমার্ক প্রাশিয়ারজাতীয় প্রতিনিধি সভার সভ্য এবং পরবর্তীকালে ফ্রাঙ্কফুর্ট পার্লামেন্ট সদস্য নির্বাচিত হন। ১৮৬২

প্রশাসনে বিসমার্কের যোগদান

পরবর্তীতে বিসমার্ক প্রাশিয়ার প্রশাসনে যোগ দান করেন। কিন্তু বিসমার্কের কাজের পদ্ধতি গতানুগতিক না হওয়ায় ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের বিরাগভাজন হন এবং ২৪ বছর বয়সে প্রশাসন থেকে ইস্তফা দেন। এরপর-

  • ১৮৪৭ খ্রিস্টাব্দে তিনি প্রাশিয়ার আইনসভার সদস্য হন।
  • ১৮৫১ খ্রিস্টাব্দে ফ্রাংকফুর্ট তিনি প্রাশিয়ার প্রতিনিধিত্ব করে আলোচনায় আসেন।
  • ১৮৫৯ খ্রিস্টাব্দে বিসমার্ককে রাশিয়ায় রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়।
  • ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দের মার্চ মাসে বিসমার্ককে ফেরত আনা হয় এবং ফ্রান্স -এ রাষ্ট্রদূত করে পাঠানো হয়।
  • ১৮৬২ খ্রিস্টাব্দে চরম সংকটের সময় ৪৭ বছর বয়সে তিনি প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী নিযুক্ত হন।

এরপর বিসমার্ক প্রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানিকে একত্রিত করার কাজে মনোনিবেশ করেন।

বিসমার্কের রাজনৈতিক চিন্তাধারা

বংশপরম্পরায় জাঙকার বা প্রাশিয়ার বড় জমিদার হওয়ার কারণে বিসমার্ক ছিলেন সকল প্রকার পরিবর্তনের বিরোধী এবং রাজতন্ত্রের সমর্থক। বিসমার্ক বিশ্বাস করতেন একমাত্র সামরিক শক্তির মাধ্যমে জার্মানির ঐক্য সম্ভব।

এই উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী বিসমার্ক প্রাশিয়ার পার্লামেন্টকে উপেক্ষা করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করতে থাকেন। সামরিক শক্তির প্রতি আস্থা রেখে বিসমার্ক যে ‘রক্ত ও লৌহ নীতি ‘ অনুসরণ করেন তা জার্মানিতে বাস্তববাদী রাজনীতি বা Real Politik নামে পরিচিত। পরবর্তীতে সামরিক শক্তির সাহায্যেই তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন।

বিসমার্ক ও জার্মানির ঐক্য

বিসমার্ক রাশিয়ার নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্য গড়ে তুলেছিলেন। সে কারণে প্রধানমন্ত্রীর পদ গ্রহণের পর প্রাশিয়ার সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করেন।

সর্বোপরি সামরিক শক্তির পাশাপাশি কূটনৈতিক পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। মাত্র ছয় বছরের মধ্যে তিনটি যুদ্ধের মাধ্যমে তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন।

(ক) বিসমার্কের কূটনীতি

জার্মানির ঐক্যসাধন বিষয়ে বিসমার্কের উল্লেখযোগ্য কূটনীতিক দৃষ্টান্তগুলি হল —

  • ১. বিসমার্ক কেন্দ্রীয় আইনসভায় অস্ট্রিয়ার মর্যাদা নষ্ট করে অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে জার্মানির ক্ষুদ্র রাজ্যগুলিকে সংগঠনে উদ্দোগ নেন,
  • ২. বিসমার্ক ফ্রান্সের সাথে প্রাশিয়ার বাণিজ্যচুক্তি সম্পাদন করে ফ্রান্সকে বন্ধু রাষ্ট্রে পরিণত করেন,
  • ৩. বিসমার্ক পোলদের বিদ্রোহ দমনে রাশিয়াকে সাহায্য করে রাশিয়ার আস্থা অর্জন করেন।

(খ) রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy)

রাজতন্ত্রের ঘাের সমর্থক রক্ষণশীল বিসমার্ক মনে করতেন যে, প্রাশিয়ার রাজতন্ত্রের অধীনেই জার্মানি ঐক্য সম্ভব হবে। গণতান্ত্রিক পদ্ধতির উপর তাঁর মোটেই আস্থা ছিল না। বিসমার্ক বলেন যে, বক্তৃতা দিয়ে বা সংখ্যাগরিষ্ঠের প্রস্তাব পাস করিয়ে দেশের সমস্যার সমাধান হয় না, এর জন্য গ্রহণ করা দরকার রক্ত ও লৌহ নীতি (Blood and Iron Policy)। বিসমার্কের রক্ত ও লৌহ নীতি ছিল সামরিক শক্তির উপর নির্ভরশীল। সামরিক শক্তির দ্বারাই জার্মানির ঐক্যলাভ সম্ভব -এ কথা বিসমার্ক মনেপ্রাণে বিশ্বাস করতেন। শেষ পর্যন্ত সামরিক শক্তির সাহায্যে তিনটি যুদ্ধের (ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ, অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধ, ফ্রাঙ্কো-প্রাশিয়া যুদ্ধ) মাধ্যমে তিনি জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করেন।

(গ) ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধ (১৮৬৪ খ্রিঃ)

হলস্টেন ও শ্লেজউইগ ডচি দুটিকে কেন্দ্র করে ডেনমার্কের সাথে প্রাশিয়ার যুদ্ধ শুরু হয় ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দে।

(১) ডেনমার্কের সঙ্গে যুদ্ধের পটভূমি

হলস্টেন ও স্লেজউইগ ডাচি দুটি ডেনমার্কের অধীনে থাকলেও স্বায়ত্তশাসন শাসন ভোগ করতো। হলস্টেন এর অধিবাসীরা ছিল জার্মান এবং জার্মান রাজ্যসমবায়ের সদস্য ছিল। কিন্তু স্লেজউইগ অধিবাসীরা দুই-তৃতীয়াংশ জার্মানি ছিল। তারা জার্মান রাজ্য সমবায়ের সদস্য পদ পেতে ইচ্ছুক ছিল। ১৮৪৮ খ্রিস্টাব্দে এই ডাচি দুটি ডেনমার্কের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে জার্মানির সঙ্গে সংযুক্তির জন্য। এই সময় বিসমার্ক অস্ট্রিয়ার সঙ্গে মিলিত হয়ে ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের ফেব্রুয়ারি মাসে ডেনমার্কের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেন।

(২) ভিয়েনা চুক্তি

অস্ট্রিয়া ও প্রাশিয়ার মিলিত বাহিনীর কাছে ডেনমার্ক পরাজিত হয়। এরপর ১৮৬৪ খ্রিস্টাব্দের অক্টোবর মাসে উভয় পক্ষের মধ্যে ভিয়েনা চুক্তি সম্পাদিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে ডেনমার্ক শ্লেজউইগ ও হলস্টেন – এর উপর থেকে সমস্ত দাবি ত্যাগ করে এবং স্থান দুটির উপর প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার যৌথ কর্তৃত্ব স্বীকৃত হয়।

(৩) গ্যাস্টিনের সন্ধি

অচিরেই জায়গা দুটিকে কেন্দ্র করে প্রাশিয়া ও অস্ট্রিয়ার মধ্যে বিরোধ বাধে। শেষ পর্যন্ত ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে গ্যাস্টিনের সন্ধি দ্বারা বিসমার্ক ১৮৬৫ খ্রিষ্টাব্দ গ্যাস্টিনের সন্ধির মাধ্যমে অস্ট্রিয়া হলস্টেন ও প্রাশিয়া স্লেজউইগ লাভ করে। বিসমার্কের মতে এই সন্ধি ছিল ‘ফাটলের উপর কাগজের প্রলেপ’ (Paper over the cracks’।

(ঘ) অস্ট্রো -প্রাশিয়া যুদ্ধ (১৮৬৬ খ্রিঃ)

জার্মানির ঐক্যের প্রধান বাধা ছিল অস্ট্রিয়া। তাই যে কোনো ভাবেই অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধের সুযোগ খুঁজতে থাকেন বিসমার্ক।

(১) স্যাডোয়ার যুদ্ধের পটভূমি

বিসমার্ক জানতেন যে, জার্মানির ঐক্যের জন্য অস্ট্রিয়ার সাথে যুদ্ধ অপরিহার্য। তাই তিনি অস্ট্রিয়াকে পরাজিত করার উদ্দেশ্যে ইউরোপীয় রাজনীতিতে তাকে মিত্রহীন করতে সচেষ্ট হন। পোল বিদ্রোহের সময় রাশিয়া প্রাশিয়ার সাহায্য পেয়েছিল। তাই রাশিয়া অষ্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকার প্রতিশ্রুতি দেয়। ইটালি অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যোগ দিলে তাকে ভেনেসিয়া পেতে প্রাশিয়া সাহায্য করবে।

(২) বিয়ারিৎসের গোপন চুক্তি

১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়া ও ফ্রান্সের মধ্যে বিয়ারিৎসের গোপন চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়। এই চুক্তি অনুসারে ঠিক হয় যে, ফরাসি সম্রাট তৃতীয় নেপোলিয়ন অস্ট্রো-প্রাশিয়া যুদ্ধে নিরপেক্ষ থাকবেন। আর এর বিনিময়ে জার্মানির কিছু ভূখণ্ড ফ্রান্স লাভ করবে।

(৩) স্যাডোয়ার যুদ্ধ

অস্ট্রিয়াকে নির্বান্ধব করে বিসমার্ক গ্যাস্টিনের সন্ধি ভঙ্গির অজুহাতে ১৮৬৬ খ্রিস্টাব্দের ১৪ জুন অস্ট্রিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করেন। এই যুদ্ধ মাত্র সাত সপ্তাহ স্থায়ী হয়েছিল। এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়া শোচনীয়ভাবে পরাজিত হয়।

(৪) প্রাগের সন্ধি

পরাজিত অস্ট্রিয়া প্রাশিয়ার সাথে প্রাগের সন্ধি স্থাপনে বাধ্য হয়। এই সন্ধি অনুসারে জার্মান রাষ্ট্রসংঘের বিলুপ্তি ঘটে। হ্যানোভার, হেসি, ক্যাসেল ও শ্লেজউইগ হলস্টাইন প্রাশিয়ার অন্তর্ভুক্ত হয়। প্রাশিয়ার নেতৃত্বে উত্তর জার্মান রাষ্ট্রসংঘ গঠিত হয়।

(৫) স্যাডোয়ার যুদ্ধের ফলাফল

সমসাময়িক ইউরোপের ইতিহাসে স্যাডোয়ার যুদ্ধের গুরুত্ব অপরিসীম। এই যুদ্ধ জার্মান ঐক্যের প্রধান শত্রু অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের ফলে জার্মানির ঐক্যের পথ প্রশস্ত হয়।

ঐতিহাসিক হ্যাজেনের মতে,

“The year 1866 was a turning point in the history of Prussia, Austria, France and Europe.”

এই যুদ্ধে অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের ফলে মধ্য ইউরোপের রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দু ভিয়েনা থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়।

(“The center of interest in Central Europe shifted from Vienna to Berlin.” – Hazen)

(ঙ) ফ্রাঙ্কো -প্রাশিয়া যুদ্ধ (১৮৭০ খ্রিঃ)

অস্ট্রিয়ার পরাজয়ের পর ফ্রান্সের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জন্য অগ্রসর হয় প্রাশিয়া। অস্ট্রিয়া, ইতালি ও রাশিয়াকে নিরপেক্ষ রেখে বিসমার্ক ফ্রান্সকে যুদ্ধের জন্য প্ররোচিত করেন।

(১) সেডানের যুদ্ধের পটভূমি

স্যাডোয়ার যুদ্ধের পর ফ্রান্সের পাশে শক্তিশালী রাষ্ট্র হিসেবে প্রাশিয়ার উত্থান ফ্রান্সের নিরাপত্তার পক্ষে যথেষ্ট ক্ষতিকারক ছিল। তাছাড়া স্যাডোয়ার যুদ্ধের পর ফ্রান্স তার প্রাপ্য স্থান গুলি পায়নি। অন্যদিকে দক্ষিণ জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ করতে হলে ফ্রান্সের বিরুদ্ধে প্রাশিয়াকে যুদ্ধ করতেই হত।

(২) সেডানের যুদ্ধ

ফ্রান্স বিসমার্কের কূটনৈতিক জালে জড়িয়ে ১৮৭০ খ্রিস্টাব্দে প্রাশিয়ার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে। সমগ্ৰ ইউরোপের চোখে ফ্রান্স আক্রমণকারী হিসেবে প্রতিপন্ন হয়। নির্বান্ধব ফ্রান্স সেডানের যুদ্ধে চূড়ান্তভাবে পরাজিত হয়।

(৩) ফ্রাঙ্কফোর্ট সন্ধি

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের ১০ মে ফ্রাঙ্কফোর্টের সন্ধি দ্বারা এই যুদ্ধের অবসান ঘটে। জার্মানির রাজনৈতিক ঐক্য সম্পন্ন হয়। এইভাবে বিসমার্ক কূটনীতি ও যুদ্ধনীতির মাধ্যমে জার্মানিকে ঐক্যবদ্ধ করতে সক্ষম হন। প্রাশিয়া-রাজ প্রথম উইলিয়াম ঐক্যবদ্ধ জার্মানির সম্রাট বা কাইজার বলে ঘোষিত হন।

(৪) সেডানের যুদ্ধের ফলাফল

ইউরোপের ইতিহাসে সেডানের যুদ্ধ বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধের ফলে ফ্রান্সের দ্বিতীয় সাম্রাজ্যের পতন হয় এবং জার্মানির ঐক্য সম্পূর্ণ হয়। এই যুদ্ধের ফলে ইউরোপীয় রাজনীতির প্রাণকেন্দ্র প্যারিস থেকে বার্লিনে স্থানান্তরিত হয়।

তাই বলা হয়ে যে,

“Europe had lost a mistress and gained a master.”

ঐতিহাসিক কেটেলবি (ketelbey) তাঁর ‘History of Modern Times‘ গ্ৰন্থে বলেছেন যে,

“The Franco-German War made Germany mistress of Europe and Bismarck master of Germany.”

ঐতিহাসিক এ. জে. পি. টেলর বলেন যে,

“European diplomacy took a new character after the battle of Sedan.”

নতুন রূপে বিসমার্ক

বিসমার্ক ছিলেন নতুন জার্মান সাম্রাজ্যের নায়ক। তাকে চ্যান্সেলর উপাধি দেওয়া হয়। বিসমার্ক জার্মানির প্রশাসনের সংস্কার সাধন করেন।

গোটা জার্মানির জন্য একই ধরনের মুদ্রা, একটি কেন্দ্রীয় ব্যাংক, এবং একই দেওয়ানী ও ফৌজদারী আইনের প্রবর্তন করেন।

বিসমার্ক ১৮৭৮ সালে বার্লিন কংগ্রেসের সভাপতিত্ব করেন এবং বৃহৎ শক্তিগুলির মধ্যস্থতাকারী হিসবে পরিচয় লাভ করেন।

১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত তার নীতিগুলির বিরোধীর সংখ্যা বাড়তে থাকে এবং তিনি পদত্যাগে বাধ্য হন। জীবনের শেষ বছরগুলি তিনি আত্মজীবনী রচনায় ব্যস্ত থাকেন।

বিসমার্কের বিদেশ নীতি

১৮৭১ খ্রিস্টাব্দের পর বিসমার্ক জার্মানিকে একটি পরিতৃপ্ত দেশ হিসেবে ঘোষণা করে  ইউরোপে শান্তি-শৃঙ্খলা বজায় রাখার জন্য। যা জার্মানীর অভ্যন্তরীণ বিকাশের জন্য প্রয়োজন ছিল। কূটনীতিকে তিনি শিল্পের পর্যায়ে উন্নীত করেন। বিসমার্ক এর নেতৃত্বে জার্মানি ইউরোপের শ্রেষ্ঠ শক্তিতে পরিণত হয়। তার এই অপ্রতিহত শক্তির জন্য ১৮৭০ থেকে ১৮৯০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত কালপর্বকে ‘বিসমার্কের যুগ ‘বলে চিহ্নিত করা হয়।

রাজতন্ত্র সম্বন্ধে বিসমার্ক

বিসমার্ক বলতেন আমাদের রাজার ক্ষমতা অপরিসীম, কোন নির্দিষ্ট নিয়মের অধীনে তাঁর রাজত্ব সীমাবদ্ধ নয়। প্রজাদের অনুগ্রহের ফলে আমাদের দেশের রাজা সিংহাসন অধিকার করেন নি। বিসমার্ক ভগবানের আশীর্বাদেই প্রাশিয়ার রাজদণ্ড পরিচালনা করে চলেছেন। আমাদের অসীম ক্ষমতাশালী, ভগবানের দ্বারা নির্বাচিত, মহামান্য রাজা স্বেচ্ছা-প্রণোদিত হয়ে আমাদের কিছু অধিকার প্রদান করেছেন। ইতিহাসে এরূপ দৃষ্টান্ত বিরল।

খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বী রাজ্য সম্বন্ধে বিসমার্ক

বিসমার্কের মতে, যে রাজ্যের মূলে ধর্মের সংস্রব নেই, তা কখনও স্থায়ী হতে পারে না। তাঁর দৃঢ়বিশ্বাস ছিল যে, যীশু খ্রীষ্টের উপদেশের অনুভূতিই রাজ্যের চরম উদ্দেশ্য। বিসমার্কের মতে রাজ্যের মূলভিত্তি হল খ্রিস্টধর্ম। আর তা যদি আমাদের রাজ্য থেকে ক্রমশ অন্তর্হিত হয়, তাহলে কিছুই অবশিষ্ট থাকবে না। খ্রিস্টধর্ম থেকেই আমাদের দেশের রাজবিধানের উদ্ভব হয়েছে। তাই তিনি খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের অনিষ্টসাধন করতে নিষেধ করেছেন।

বিসমার্কের ধর্ম সংস্কার

প্রোটেস্ট্যান্ট ও ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সংমিশ্রণে একটা নতুন সম্প্রদায় গঠনের চেষ্টা করেছিলেন বিসমার্ক। কিন্তু দু- দু’বার চেষ্টা করেও বিসমার্ক কৃতকার্য হতে পারেননি। প্রোটেস্ট্যান্ট ধর্মাবলম্বী রাজনীতিকের বিরোধিতায় বিসমার্কের উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়। বিসমার্কের এই ধর্ম সমন্বয়ের চেষ্টার ফলে সরকারের সাথে জার্মানির ধর্ম সম্প্রদায়ের অত্যন্ত মনোমালিন্য জন্মায়। ধর্ম সম্প্রদায়ের সাথে বিরোধ ক্রমশই দেশ মধ্যে পরিব্যাপ্ত হয়ে পড়ে। এরপর রোমান ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের প্রভাব জার্মানি থেকে তিরোহিত করার উদ্যোগ শুরু হয়।

বিসমার্কের অর্থনৈতিক সংস্কার   

জার্মানিতে বিনা শুল্কে বাণিজ্যের প্রসার বন্ধ করার জন্য বিসমার্ক প্রানপণ চেষ্টা করতে থাকেন। ১৮৭৬ খ্রিস্টাব্দে লৌহ-ব্যয়-সমস্যা গুরুতর হয়ে উঠে। এর ফলে বহু কলকারখানার কাজ বন্ধ করতে হয়। শ্রম-শিল্পীরাও বেকার অবস্থায় দিনযাপন করতে থাকে। শুধু লোহা নয়, অন্যান্য শ্রমশিল্পের অবস্থাও শোচনীয় হয়ে উঠে। বিসমার্ক উপলব্ধি করেন যে, বাণিজ্য শুল্ক রদ করায় দেশের লোক ক্রমশ নিঃস্ব হয়ে পড়ছে এবং সরকারের অর্থাগম হচ্ছে না। আবার জার্মানির অর্থ বিদেশে চলে যাচ্ছে অথচ জার্মানজাত দ্রব্যাদি ইউরোপ, ইংল্যান্ডআমেরিকায় কোন স্থান অধিকার করতে পারছে না। শিল্প – বাণিজ্যের এই অবস্থা দেখে বিসমার্ক বাণিজ্য-শুল্ক পুনরায় চালু করেন।

বিসমার্কের রেলপথ সংস্কার

বিসমার্ক উপলব্ধি করেন যে বাণিজ্যের উন্নতি ও সংস্কার করতে হলে রেলপথের উন্নতি অতি আবশ্যক। বিসমার্ক প্রথমেই সমগ্র রেলপথ সরকার দ্বারা পরিচালিত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু  বিভিন্ন রাজ্য এর বিরোধিতা করতে শুরু করে। তাই শুধু প্রাশিয়ায় বিসমার্কের নীতি-অনুসারে সমগ্র রেলপথ রাজকোষের অর্থে সরকারের অধীনে নিয়ে আসা হয়। ফলে রেলের মাশুল কমে গেল এবং ব্যবসায়ীদের আমদানি রপ্তানিতে সুবিধা হল। এরপর থেকে দেশের ব্যবসা-বাণিজ্য ক্রমশ উন্নতির পথে অগ্রসর হয় এবং দেশের ঐশ্বর্যও বাড়তে থাকে।

বিসমার্ক কর্তৃক উপনিবেশ বিস্তার

অতঃপর বিসমার্ক জার্মান উপনিবেশ স্থাপনে মনসংযোগ করেন। ১৮৭৪ খ্রিস্টাব্দে জার্মান পর্যটকরা বিসমার্কের নিকট দক্ষিণ আফ্রিকায় উপনিবেশ স্থাপন করার প্রস্তাব করেছিলেন। বিসমার্ক তখন এ প্রস্তাব গ্রহণ করেও বিশেষ আগ্রহ দেখাননি। তিনি ভেবেছিলেন আফ্রিকার নির্দিষ্ট স্থানে জার্মান উপনিবেশ স্থাপন করতে গেলে ইংল্যান্ডের সাথে বিরোধ বাধতে পারে। পরবর্তীতে অবস্থার পরিবর্তন হলে আফ্রিকায় ইংরেজ উপনিবেশের পাশেই জার্মান ঔপনিবেশিকগণ যেতে শুরু করে। বিসমার্ক প্রথমে ভেবেছিলেন ইংরেজ কর্তৃপক্ষ জার্মান ঔপনিবেশিকগণকে যথেষ্ট সাহায্য করবেন। কিন্তু ইংল্যান্ডের ফিজি দ্বীপ দখলের সময় বিসমার্কের এই আশা ব্যাহত হয়। তাই বিসমার্ক ঔপনিবেশিকগণকে সরকার থেকে সাহায্য দানের ব্যবস্থা করেন।

বিসমার্ক কর্তৃক সমাজতন্ত্র বিরোধী আইন প্রণয়ন

বিসমার্ক বহুদিন থেকেই সমাজতন্ত্রবাদীদের সন্দেহের চোখে দেখছিলেন। ১৮৭৮ খ্রিস্টাব্দে সমাজতন্ত্রবদীদের দ্বারা সম্রাটকে হত্যার চেষ্টা করা হলে তিনি তাদেরকে সমূলে ধ্বংস করার জন্য উঠে পড়ে লাগেন। নতুন আইন প্রণয়ন করে তিনি সমাজতন্ত্রবাদীদের বক্তৃতার পথ একেবারে বন্ধ করে দেবার চেষ্টা করেন। কিন্তু আইনসভায় রক্ষণশীল দল ব্যতীত এই আইনের পক্ষে কেউই মত দেয়নি।

সম্রাটের উপর দ্বিতীয়বার আক্রমণ হলে বিসমার্ক বলে উঠেন, “এবার রাইখষ্টাগ বিলুপ্ত হোক।” এরপর নতুন পার্লামেন্টে নতুন সদস্য নির্বাচিত হল এবং সমাজতন্ত্রীদের দমন করার জন্য নতুন আইন প্রচারিত হল। জার্মান সাম্রাজ্যের যে কোনো স্থানে সমাজতন্ত্রবাদীরা বক্তৃতা অথবা লিখিত প্রবন্ধ প্রচার করলে পুলিশের সাহায্যে তাদেরকে বিতাড়িত করা হবে। তাদের প্রচারিত সংবাদপত্র, পুস্তিকা অথবা গ্রন্থাদি সরকার দ্বারা বাজেয়াপ্ত করা হয়। আইন জারি করা হয় যে, ভবিষ্যতে এই সম্প্রদায়ের কোনো গ্রন্থাদি প্রচারিত হতে পারবে না। এর ফলে সমাজতন্ত্রীদের প্রভাব খর্ব হয়।

বিসমার্ক কর্তৃক পার্লামেন্টের সংস্কার

পার্লামেন্টের প্রত্যেক সদস্যের মধ্যে যাতে সদ্ভাব বজায় থাকে তার জন্য বিসমার্ক বিশেষ ব্যবস্থা করেছিলেন। সপ্তাহে একদিন পার্লামেন্টের সকল সদস্য তাঁর বাড়িতে সমবেত হতেন। গ্রামের বহু যুবক-সদস্য এই বিচক্ষণ প্রভাবশালী রাজনীতিকের সাথে একাসনে বসে পান, ভোজন, আলাপ, আপ্যায়নের মাধ্যমে নিজেকে পরম সৌভাগ্যশালী বলে মনে করতেন।

বিসমার্ক কর্তৃক ফৌজদারি আইনের কঠোরতা

প্রধানমন্ত্রি বিসমার্কের আমলে একমাত্র দুর্বলতা ছিল ফৌজদারি আইনের দুর্বলতা। রাজনীতির ক্ষেত্রে যারা তাঁর বিরুদ্ধে ছিলেন তাদেরকে দমন করার জন্য তিনি অতি কঠোর বিধিসমূহের প্রচলন করেছিলেন। গুপ্তহত্যার জন্য যারা চেষ্টা করত বা এরকম ষড়যন্ত্রে যারা লিপ্ত থাকত তাদের তিনি কখনও দয়া করতেন না।

বিসমার্কের সমালোচনা

অনেকেই বিসমার্ক এর নেতৃত্বে জার্মানির ঐক্য আন্দোলনকে সমালোচনা করেছেন। তারা জার্মানির ঐক্যকে ‘প্রাশিয়ার বিজয়‘ বলে অভিহিত করেছেন। অনেকেই বিসমার্কের জটিল সন্ধি ব্যবস্থাকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ -এর জন্য দায়ী করেছেন। কিন্তু একথা ঠিক নয় কারণ সন্ধি ব্যবস্থা  টিকিয়ে রাখার জন্য যে যোগ্যতার প্রয়োজন ছিল তা তার উত্তরাধিকারীদের ছিল না। তাঁর নিজের সময়ে দাঁড়িয়ে তিনি ছিলেন একজন সফল যোদ্ধা – নিঃসন্দেহে আজ আমরা একথা বলতেই পারি।

উপসংহার :- পরিশেষে বলা যায় বিসমার্ক ছিলেন তাঁর সমকালীন যুগের একজন সফল রাজনীতিক। জার্মানির ঐক্য, আভ্যন্তরীণ পুনর্গঠন, সর্বোপরি জার্মানিকে ইউরোপের শ্রেষ্ঠ রাষ্ট্রে পরিণত করার কৃতিত্ব বিসমার্কের। তাঁর নেতৃত্বে জার্মানি ইউরোপের প্রাণকেন্দ্রে পরিণত হয়।

১৮৭১ সালের পরে বিসমার্ক কতগুলি মিত্ররাষ্ট্রসংঘ গড়ে তোলেন । এবং বেশ কিছু কূটনৈতিক পদক্ষেপের মাধ্যমে ইউরোপে শান্তি নিশ্চিত করে সেখানে জার্মানির নিজস্ব স্থান প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন।

(FAQ) বিসমার্ক সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বিসমার্ক কে ছিলেন?

প্রাশিয়ার প্রধানমন্ত্রী।

২. ভারতের বিসমার্ক কাকে বলা হয়?

বল্লভ ভাই প্যাটেলকে।

৩. বিসমার্ক কোথাকার প্রধানমন্ত্রী ছিলেন?

প্রশিয়ার।

৪. বিসমার্ক কোন দেশের চ্যান্সেলর ছিলেন?

জার্মানির।

৫. কত সালে বিসমার্ক জার্মানির চ্যান্সেলর পদ থেকে পদত্যাগ করেছিলেন?

১৮৯০ সালে।

৬. বিসমার্ক কোন দেশের শাসক ছিলেন?

জার্মানির।

৭. আধুনিক জার্মানির প্রতিষ্ঠাতা কে?

অটো ফন বিসমার্ক।

৮. অটো ফন বিসমার্ক এর লেখা বইয়ের নাম কি?

Gedanken und Erinnerungen, New Chapters of Bismarck’s Autobiography.

৯. জার্মানির প্রথম প্রধানমন্ত্রীর নাম কি?

অটো ফন বিসমার্ক।

Leave a Comment