গুপ্ত যুগে বাংলা

গুপ্ত যুগে বাংলা প্রসঙ্গে শ্রীগুপ্তের বাংলায় অবস্থান, সমতটের উল্লেখ, পুষ্কর্ণ রাজ্য, প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় বাংলা, সমুদ্রগুপ্তের সময় বাংলা, দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় বাংলা, কুমারগুপ্তের সময় বাংলা, স্কন্দগুপ্তের সময় বাংলা, বুধগুপ্তের সময় বাংলা ও বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে জানবো।

গুপ্ত যুগে বাংলা

বিষয়গুপ্ত যুগে বাংলা
মৃগশিখাবনমুর্শিদাবাদ বা মালদহ
পুষ্কর্ণবাঁকুড়া জেলা
মান্দাশোর লিপিযশোধর্মন
বন্দরতাম্রলিপ্ত
গুপ্ত যুগে বাংলা

ভূমিকা :- তৃতীয় খ্রিস্ট পূর্ব থেকে চতুর্থ খ্রিস্টাব্দের প্রথম পর্যন্ত বাংলার ইতিহাস সম্পর্কে তেমন কিছু জানা যায় নি। তবে পরবর্তী ইতিহাসের আলোকে অনুমান করা যায় যে, বাংলায় এই সময় কয়েকটি রাজ্য গড়ে ওঠে।

শ্রীগুপ্তের বাংলায় অবস্থান

  • (১) কোনো কোনো ঐতিহাসিকের মতে, বাংলার মুর্শিদাবাদ জেলায় অথবা মালদহ জেলায় গুপ্ত রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা শ্রীগুপ্ত বসবাস করতেন। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়েছে চীন -এর পর্যটক ই-সিং-এর বিবরণ থেকে।
  • (২) তিনি বলেছেন যে, শ্রীগুপ্ত মৃগশিখাবনের স্তূপের জন্য কয়েকটি গ্রাম দান করেন। মৃগশিখাবনের অবস্থান সম্পর্কে ই-সিং বলেছেন যে, স্থানটি নালন্দা হতে ২৪০ মাইল দূরে ছিল। এই হিসেব ধরে স্থানটি মালদহ বা মুর্শিদাবাদে অবস্থিত বলে পণ্ডিতেরা অনুমান করেন।
  • (৩) যদিও গুপ্তবংশের আদি বাসস্থান সম্পর্কে অন্য প্রকার মতও আছে এবং যদিও মগধ -এ গুপ্তবংশের আদি বাস ছিল বলে অনেকে মনে করেন, তবুও ওপরের মতটিই বেশী প্রামাণ্য। এজন্য মনে করা যায় যে, বাংলার সঙ্গে গুপ্তবংশের গোড়া থেকে যোগাযোগ ছিল।

সমতটের উল্লেখ

পূর্ব বাংলায় সমতট নামে একটি রাজ্য গড়ে উঠেছিল। সমুদ্রগুপ্ত -এর প্রশস্তিতে এর উল্লেখ আছে।

পুষ্কর্ণ রাজ্য

বাঁকুড়া জেলায় পুস্কর্ণ রাজ্য নামে এক রাজ্য স্থাপিত হয়েছিল বলে জানা যায়। এই রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা ছিলেন সিংহবর্মন এবং সমুদ্রগুপ্তের সময় এখানে চন্দ্রবর্মন রাজত্ব করতেন। তিনি তাঁর রাজধানী রক্ষার জন্য চন্দ্রবর্মন কোটা নামে এক গড় তৈরি করেন। চন্দ্রবর্মনের শুশুনিয়া লিপি পাওয়া যায়

প্রথম চন্দ্রগুপ্তের সময় বাংলা

আগেই উল্লেখ করা হয়েছে যে, মুর্শিদাবাদ জেলা ছিল শ্রীগুপ্তের অধীনে। প্রথম চন্দ্রগুপ্ত -এর আমলে বাংলা গুপ্ত সাম্রাজ্য -এর ভেতরে ছিল। দিল্লীর মেহরৌলি লৌহস্তম্ভের লিপিতে যে বাংলা জয়ের কথা আছে তা অনেক ঐতিহাসিক প্রথম চন্দ্রগুপ্তের কাহিনী বলে মনে করেন। তবে এ বিষয়ে বিতর্ক আছে।

সমুদ্রগুপ্তের সময় বাংলা

  • (১) সমুদ্রগুপ্তের আমলে বাংলায় তার অধিকার বিস্তার সম্পর্কে সুনির্দিষ্ট তথ্য পাওয়া যায়। এলাহাবাদ প্রশস্তিতে রাজা চন্দ্রবর্মনের নাম পাওয়া যায় যিনি সমুদ্রগুপ্তের বশ্যতা স্বীকার করেন। এই চন্দ্রবর্মন ছিলেন বাঁকুড়া জেলার পুষ্কর্ণের রাজা। তার দুর্গের নাম ছিল চন্দ্রবর্মন কোটা।
  • (২) সমতট বাদে বাংলার বাকি অংশ সমুদ্রগুপ্তের আমলে গুপ্ত সাম্রাজ্য-এর অন্তর্ভুক্ত হয়। সমতট সমুদ্রগুপ্তের করদ রাজ্য ছিল। অর্থাৎ আভ্যন্তরীণ শাসনের ক্ষেত্রে সমতট কিছুটা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করত।

দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের সময় বাংলা

যদি মেহরৌলি লিপির উল্লিখিত চন্দ্রকে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত ধরা হয় তবে সমুদ্রগুপ্তের পর বাংলা আবার স্বাধীনতা ঘোষণা করে বলা যায়। দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্ত পুনরায় বাংলার রাজাদের সম্মিলিত বাধা চূর্ণ করে বাংলা জয় করেন। তবে এ সম্পর্কে কোনো নিশ্চিত প্রমাণ নেই। যশোহরে দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের রৌপ্যমুদ্রা পাওয়া গেছে। ফরিদপুরের কোটালি পাড়ায় দ্বিতীয় চন্দ্রগুপ্তের স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে।

কুমারগুপ্তের সময় বাংলা

  • (১) কুমার গুপ্ত -এর আমলেও বাংলা গুপ্ত অধিকারে ছিল। প্রথম কুমার গুপ্তের লিপি দিনাজপুরের দামোদরপুরে এবং রাজশাহীর ধনিয়াদহতে পাওয়া গেছে। দিনাজপুরের বৈগ্রামেও আর একটি লিপি পাওয়া গেছে তাতে কুমার গুপ্তের নাম নেই।
  • (২) তবে কুমার গুপ্তের অন্য লেখগুলির সঙ্গে বৈগ্রাম লেখের বিশেষ সাদৃশ্য থাকায়, এই লেখটিকে কুমার গুপ্তের বলে মনে করা হয়। তাঁর শিলালিপিতে পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তির উল্লেখ আছে।
  • (৩) সম্রাট নিজে এই ভুক্তিকে প্রত্যক্ষ শাসন করতেন। তিনিই পুণ্ড্রবর্ধনের উপারিকদের নিজে নিয়োগ করতেন। প্রথম কুমারগুপ্তের মুদ্রা তমলুক, হুগলি, কালিকট ও যশোহরে পাওয়া গেছে।

স্কন্দগুপ্তের সময় বাংলা

ফরিদপুরের কোটালি পাড়ায় স্কন্দগুপ্ত -এর স্বর্ণমুদ্রা পাওয়া গেছে। সুতরাং সমতট বা পূর্ব বাংলা তখনও গুপ্ত সম্রাটদের অধীনতায় ছিল।

বুধগুপ্তের সময় বাংলা

বুধগুপ্তের আমল পর্যন্ত পুণ্ড্রবর্ধনভুক্তি গুপ্ত সাম্রাজ্যের ভেতরে ছিল। দামোদরপুর ও পাহাড়পুরে তাঁর লিপি পাওয়া গেছে। তিনিই ছিলেন বাংলায় শেষ প্রধান গুপ্ত সম্রাট। তার পর বাংলায় গুপ্ত শাসন ধীরে ধীরে ক্ষয় পায়।

গুপ্ত সাম্রাজ্য পতনের সময় বাংলা

  • (১) গুপ্ত শাসন দুর্বল হলে সমতট বা পূর্ব বাংলা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সমতটের শাসনকর্তা বৈন্যগুপ্ত এই সুযোগে নিজেকে সমতটের স্বাধীন রাজা বলে ঘোষণা করেন। নালন্দা শীল থেকে দেখা যায় যে, বৈন্যগুপ্ত ছিলেন গুপ্তবংশের লোক।
  • (২) নালন্দা শীলে তিনি মহারাজাধিরাজ উপাধি নিয়েছেন দেখা যায়। তিনি দ্বাদশাদিত্য উপাধিও নেন। তাঁর অধীনে বিজয়সেন ও রুদ্রদত্ত নামে দুই সামন্ত মহারাজা ছিলেন। গুনাইধর লিপিতে তাদের নাম পাওয়া যায়। তারা বৈন্যগুপ্তের পক্ষে ত্রিপুরা জয় করেন।
  • (৩) গুনাইধর লিপি থেকে জানা যায় যে, তিনি মহাদেব বা শিবের উপাসক ছিলেন। তাঁর রাজধানী ত্রিপুরা অঞ্চলে অবস্থিত ছিল। তার কর্মচারীরা মহারাজা, মহাসামন্ত উপাধি ধারণ করত। তিনি অবলোকিতেশ্বর মন্দিরের জন্য বহু দান ধ্যান করেন।

বাংলায় গুপ্ত শাসনের পতন

যশোধর্মণের মান্দাশোর লিপি থেকে জানা যায় যে, বাংলার কিছু অংশ তার সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত হয়। হয়ত তার অধীনে যে গুপ্ত রাজা বাংলায় সামন্ত ছিলেন তাঁর নাম ছিল বিষ্ণু গুপ্ত। তবে এ সম্পর্কে সঠিক কিছু বলা যায় নি। বাংলার রাঢ় অঞ্চলে গুপ্ত যুগের কোনো লিপি পাওয়া যায়নি। ডঃ মজুমদারের মতে, হয়ত বৈন্যগুপ্তের সামন্ত বিজয় সেন রাঢদেশ শাসন করতেন।

দুটি স্বাধীন রাজ্য

গুপ্ত সাম্রাজ্য ৫৫১ খ্রিস্টাব্দ নাগাদ বাংলায় লুপ্ত হলে বাংলায় দুটি স্বাধীন রাজ্য গড়ে ওঠে। যথা – সমতট এবং গৌড়

(১) সমতট

সমতট ছিল পূর্ব বাংলা, দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পশ্চিম বাংলা। সমতটের তুলনায় উত্তর বাংলা বা গৌড়ে গুপ্ত অধিকার দৃঢ় ছিল।

(২) গৌড়

ডঃ এস চ্যাটার্জীর মতে, কামরূপ রাজ্য -এর রাজার আক্রমণে উত্তর বাংলায় গুপ্ত অধিকার ধ্বংস হয়। এরপর উত্তর বাংলায় যে স্বাধীন রাজ্য স্থাপিত হয় তার নাম ছিল গৌড়।

বাংলার অর্থনৈতিক অবস্থা

  • (১) গুপ্ত যুগে বাংলার আর্থিক উন্নতি হয়েছিল বলে প্রমাণ পাওয়া যায়। এর মূলে ছিল বাংলার বাণিজ্যের বিস্তার। কথাসরিৎসাগর থেকে এই যুগের বাংলার ব্যাপক অন্তর্বাণিজ্য ও বহির্বাণিজ্যের কথা জানা যায়। বাৎসায়ন ও ফা-হিয়েনও এই বিষয়ে সাক্ষ্য দিয়েছেন।
  • (২) বাংলার তুলা ও রেশমের কাপড়ের ব্যাপক চাহিদা ছিল। অমরকোষে রেশমের গুটিপোকার মুখের লালায় রেশম তন্তু তৈরি হওয়ার কথা বলা হয়েছে। এছাড়া সুপারি, নারকেল, চিনি, লবণ ও মাছ বাংলা হতে রপ্তানি হত। জাহাজ নির্মাণ শিল্পের জন্যও বাংলা বিখ্যাত ছিল।
  • (৩) জাতকের কাহিনী ও ফা-হিয়েনের বিবরণ থেকে তাম্রলিপ্ত বন্দরের সমৃদ্ধির কথা জানা যায়। সমতটের গঙ্গা বন্দরের খুব খ্যাতি ছিল। দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া ও চীনের সঙ্গেই বাণিজ্য বেশী চলত। সিংহল, দক্ষিণ ভারত -এও বাংলার মাল রপ্তানি হত। মালয়ে একটি সংস্কৃত ভাষার লিপি পাওয়া গেছে। এর থেকে পঞ্চম খ্রিস্টাব্দে ভারত-মালয় বাণিজ্যের কথা জানা যায়।

উপসংহার :- গুপ্ত যুগে বাণিজ্য -এর ফলে বণিকদের হাতে অর্থ জমা হলে বাংলার পুরাতন সামাজিক কাঠামো ভেঙে পড়ে। বিষয় ও জনপদ-এর শাসন পরিষদে শ্রেষ্ঠী বা বণিকদের প্রতিনিধি রাখার নিয়ম করা হয়। ধনী বুর্জোয়া বা বণিকরা সামাজিক পদমর্যাদার অংশীদার হয়। বাংলার প্রাচীন কৃষিকেন্দ্রিক অর্থনীতির পরিবর্তে মিশ্র অর্থনীতির উদ্ভব হয়।

(FAQ) গুপ্ত যুগে বাংলা সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বাংলার মৃগশিখাবনে কোন গুপ্ত রাজা অবস্থান করেছিলেন?

শ্রীগুপ্ত।

২. সমুদ্রগুপ্ত -এর প্রশস্তিতে বাংলার কোন স্থানের উল্লেখ আছে ?

সমটত

৩. পুস্কর্ণ রাজ্য কোন জেলায় ছিল?

বাঁকুড়া জেলায়

Leave a Comment