বেলুড় মঠ

বেলুড় মঠ প্রসঙ্গে অবস্থান, দুটি মঠের গোড়াপত্তন, মঠ দুটি স্থাপনের উদ্দেশ্য, মিশনের কাজের সূচনা, ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিবেকানন্দের ভ্রমণ, বেলুড় মঠের পূর্ব পরিকল্পনা, মন্দিরের নকশা, ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন, স্থাপত্য নিদর্শন, সদর কার্যালয়, সংগ্ৰহশালা, শিক্ষা কেন্দ্র, পবিত্র স্থান, বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন, ধর্মীয় অনুষ্ঠান, বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণ, পূণ্যার্থিদের দর্শন, সারদা দেবীর দ্রব্য সামগ্রী প্রর্দশন, বিবেকানন্দের বৃহদাকার মূর্তি সম্পর্কে জানবো।

বেলুড় মঠ

ঐতিহাসিক নিদর্শনবেলুড় মঠ
প্রতিষ্ঠাতাস্বামী বিবেকানন্দ
প্রতিষ্ঠাকাল১৮৯৭ খ্রি:
অবস্থানবেলুড়
রাজ্যপশ্চিমবঙ্গ
দেশভারত
বেলুড় মঠ

ভূমিকা :- রামকৃষ্ণ পরমহংসের প্রধান শিষ্য স্বামী বিবেকানন্দ কর্তৃক প্রতিষ্ঠিত রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কার্যালয় হল বেলুড় মঠ।

অবস্থান

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের নিকটবর্তী বেলুড় অঞ্চলে হুগলি নদীর পশ্চিম পাড়ে অবস্থিত বেলুড় মঠ কলকাতা সন্নিহিত অঞ্চলের অন্যতম দ্রষ্টব্যস্থল।

দুটি মঠের গোড়াপত্তন

১৮৯৭ সালে পাশ্চাত্য থেকে কয়েকজন অনুগামী সঙ্গে নিয়ে স্বামী বিবেকানন্দ কলম্বো প্রত্যাবর্তন করেন। এরপর ভারতে ফিরেই তিনি দুটি মঠের গোড়াপত্তন করেন – একটি আলমোড়ার নিকট হিমালয়ে অবস্থিত মায়াবতীতে অদ্বৈত আশ্রম ও অন্যটি কলকাতার সন্নিকটস্থ বেলুড়ে রামকৃষ্ণ মিশন।

মঠ দুটি স্থাপনের উদ্দেশ্য

এই মঠদুটি স্থাপনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য ছিল রামকৃষ্ণ মিশনে যোগদানে ইচ্ছুক যুবকদের গ্রহণ ও প্রশিক্ষণ এবং তাদের মিশনের কাজকর্মের উপযুক্ত করে তোলা।

মিশনের কাজের সূচনা

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দেই দুর্ভিক্ষের সময় জনসেবার মাধ্যমে মিশনের কাজের সূচনা হয়।

ভারতের বিভিন্ন স্থানে বিবেকানন্দের ভ্রমণ

পরিব্রাজক জীবনে স্বামী বিবেকানন্দ ভারতের বিভিন্ন অঞ্চল পর্যটন করেছিলেন। এই সময় তিনি তাজমহল, ফতেপুর সিক্রি, দেওয়ান-ই-খাস, রাজপুতানার প্রাসাদ এবং মহারাষ্ট্র, গুজরাত, তামিলনাড়ু, কর্ণাটক ও অন্যান্য অঞ্চলের প্রাচীন মন্দিরগুলি দর্শন করেন।

বেলুড় মঠের পূর্ব পরিকল্পনা

যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপ ভ্রমণকালে সেখানকার আধুনিক, মধ্যযুগীয়, গথিক ও নবজাগরণ বা রেনেসাঁ স্থাপত্যের বৈশিষ্ট্যগুলিও অবগত হন। কথিত আছে, এই সকল স্থাপত্যের সংমিশ্রণে স্বামী বিবেকানন্দই বেলুড় মঠ স্থাপত্যের পূর্বপরিকল্পনা রচনা করেছিলেন।

মন্দিরের নকশা

স্বামী বিবেকানন্দের পরিকল্পনা অনুসারে তার সন্ন্যাসী ভ্রাতা ও রামকৃষ্ণ পরমহংসের অপর সাক্ষাতশিষ্য স্বামী বিজ্ঞানানন্দ মন্দিরের নকশা প্রস্তুত করেন। বিজ্ঞানানন্দ ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার।

ভিত্তি প্রস্তর স্থাপন

১৯৩৫ খ্রিস্টাব্দের ১৬ মার্চ মন্দিরের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়। প্রখ্যাত ইঞ্জিনিয়ার ও শিল্পপতি স্যার রাজেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের তত্ত্বাবধানে মার্টিন বার্ন অ্যান্ড কোম্পানি মন্দিরটি নির্মাণ করেন।

স্থাপত্য নিদর্শন

এই বেলুড় মঠের রামকৃষ্ণ মন্দির রামকৃষ্ণ ভাব আন্দোলনের প্রাণকেন্দ্র। এই মঠ হিন্দু, ইসলামী, বৌদ্ধ ও খ্রিস্টান স্থাপত্যের মিশ্রণে নির্মিত একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থাপত্য নিদর্শন

সদর কার্যালয়

৪০ একর জমির উপর অবস্থিত মূল মঠপ্রাঙ্গণে রামকৃষ্ণ পরমহংসদেব, সারদা দেবী ও স্বামী বিবেকানন্দের দেহাবশেষের উপর অবস্থিত মন্দির ও রামকৃষ্ণ মিশনের সদর কার্যালয় অবস্থিত।

সংগ্ৰহশালা

স্বামী ব্রহ্মানন্দ মন্দির এবং রামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের ইতিহাসকে তুলে ধরার লক্ষ্যে একটি সংগ্রহশালাও এখানে স্থাপিত হয়েছে।

শিক্ষাকেন্দ্র

বেলুড় মঠ সন্নিহিত একটি প্রাঙ্গণে রামকৃষ্ণ মিশন অনুমোদিত বিভিন্ন শিক্ষাকেন্দ্র গড়ে উঠেছে।

পবিত্র তীর্থস্থান

বেলুড় মঠ ভারতের একটি প্রধান পর্যটন আকর্ষণ এবং ভক্তদের কাছে একটি পবিত্র তীর্থস্থান।

বিভিন্ন অনুষ্ঠানের আয়োজন

এই বেলুড় মঠ বিভিন্ন স্বাস্থ্য পরিষেবা, শিক্ষা, নারীকল্যাণ, শ্রমিক ও অনগ্রসর শ্রেণীর স্বার্থে গ্রামোন্নয়ন, ত্রাণ, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকে।

ধর্মীয় অনুষ্ঠান

বেলুড় মঠ রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দের জন্ম ও প্রয়াণতিথি, বিভিন্ন ধর্মীয় অনুষ্ঠান ও বড়দিন উৎসব উদযাপন করে। দুর্গাপূজা, বিশেষত মহাষ্টমীর কুমারীপূজা দেখতে এখানে প্রতি বছর প্রচুর জনসমাগম হয়।

স্থাপত্যের ঐক্যতান

রামকৃষ্ণ মিশন এই মন্দিরের বর্ণনা দেয় “স্থাপত্যের ঐকতান” রূপে।

স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য

  • (১) মন্দির, মসজিদ ও গির্জার স্থাপত্যের বিভিন্ন বৈশিষ্ট্যের মিশ্রণে আধুনিক ধর্মস্থান বেলুড় মঠ নির্মিত হয়েছে। রামকৃষ্ণ ভাবান্দোলনের বিশ্বাস অনুযায়ী বিশ্বধর্মের আদর্শকে তুলে ধরার জন্য একাধিক ধর্মের স্থাপত্য ও প্রতীক তত্ত্ব থেকে মন্দিরের এই স্থাপত্য বৈশিষ্ট্য সংকলিত হয়েছে।
  • (২) ধর্মের রূপতাত্ত্বিক দিকের একটি গুরুত্বপূর্ণ নিদর্শন এই মন্দির। মন্দিরের মূল প্রবেশপথটি বৌদ্ধ আদর্শে নির্মিত। মূল প্রবেশপথের উপরের অংশটি উচ্চ স্তম্ভযুক্ত দক্ষিণ ভারতীয় মন্দিরের আদর্শে নির্মিত।
  • (৩) উত্তর ভারতের রাজপুত ও মুঘল স্থাপত্যের আদর্শে মন্দিরের ভিতরের জানালা ও অলিন্দ তৈরি করা হয়েছে। মন্দিরের কেন্দ্রীয় গম্বুজটি ইউরোপীয় রেনেসাঁ স্থাপত্যের নিদর্শন। ভিতরের মেঝেটি কিছুটা খ্রিস্টান ক্রসের আকারে বিন্যস্ত।

বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণ

এই বেলুড় মঠের অভ্যন্তরে দ্রষ্টব্য স্থানগুলি হল শ্রীরামকৃষ্ণ মন্দির, পুরনো ঠাকুরঘর, স্বামী বিবেকানন্দের বাসকক্ষ, স্বামী ব্রহ্মানন্দ মন্দির, শ্রী সারদাদেবী মন্দির, স্বামী বিবেকানন্দ মন্দির, সমাধি পীঠ, পুরনো মঠ, রামকৃষ্ণ মিউজিয়াম ইত্যাদি।

পুণ্যার্থীদের দর্শন

প্রতিদিন নির্দিষ্ট সময়ের জন্য বহিরাগত দর্শক ও পূণ্যার্থীদের দর্শনের জন্য মঠ ও মন্দিরের দ্বার খোলা রাখা হয়। দেশ ও বিদেশ থেকে বহু মানুষ প্রতিদিন এই মন্দিরে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে আসেন।

শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দির

  • (১) বেলুড় মঠ প্রাঙ্গণে অবস্থিত একটি জাদুঘর হল ‘শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দির’। রামকৃষ্ণ পরমহংস, সারদা দেবী, স্বামী বিবেকানন্দ ও তাদের কয়েক জন শিষ্যের ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রী এই জাদুঘরে রক্ষিত আছে।
  • (২) রক্ষিত দ্রব্যগুলির মধ্যে আছে পাশ্চাত্যে বিবেকানন্দের পরিহিত লং কোট, ভগিনী নিবেদিতার টেবিল এবং শ্রীমতী সেভিয়ারের একটি অরগ্যান। রামকৃষ্ণ আন্দোলন ও সমকালীন বাংলার ইতিহাসের কালপঞ্জি রক্ষিত হয়েছে এই জাদুঘরে।

শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দিরের ভবন

  • (১) শ্রীরামকৃষ্ণ সংগ্রহ মন্দিরের ভবনটি দোতলা। এই ভবনের ভিতরে দক্ষিণেশ্বর কালীবাড়ির কাছে অবস্থিত রামকৃষ্ণ পরমহংসের সাধনস্থল ‘পঞ্চবটী’র অবিকল প্রতিকৃতি নির্মিত হয়েছে।
  • (২) গলার ক্যান্সারে আক্রান্ত রামকৃষ্ণ পরমহংস তার শেষ জীবনে যে কালো পাথরবাটিতে করে পায়েস খেতেন, যে বালিশটি ব্যবহার করতেন, সেগুলি কলকাতায় তিনি যে বাড়িতে শেষ দিনগুলি কাটিয়েছিলেন, সেই বাড়ির আদলে নির্মিত একটি কক্ষে রক্ষিত আছে।
  • (৩) রামকৃষ্ণ পরমহংস তার ১২ জন শিষ্যকে যে ঘরটিতে সন্ন্যাসীর গৈরিক বস্ত্র দান করেন এবং বিবেকানন্দকে (নরেন্দ্রনাথ) তার সন্ন্যাসী শিষ্যবর্গের নেতা নির্বাচিত করেন, সেই ঘরের একটি মডেলও আছে। এই ঘরে রামকৃষ্ণ পরমহংসের কল্পতরু মূর্তি রাখা আছে।
  • (৪) রামকৃষ্ণের কল্পতরু মূর্তির পায়ে রামকৃষ্ণ পরমহংসের ব্যবহৃত পাদুকাটি পরানো আছে। দক্ষিণেশ্বরে রামকৃষ্ণ পরমহংস যে ঘরটিতে থাকতেন সেই ঘরটিরও একটি প্রতিরূপ প্রদর্শিত হয়েছে। এই ঘরে তার ব্যবহৃত কাপড় ও অন্যান্য দ্রব্যসামগ্রী আছে।
  • (৫) সেই সঙ্গে এখানে বিবেকানন্দ যে তানপুরাটি বাজিয়ে তার গুরুকে গান শোনাতেন সেই তানপুরাটি রাখা আছে এবং রামকৃষ্ণ পরমহংস কর্তৃক চারকোল দ্বারা অঙ্কিত দুটি ছবিও রাখা আছে।

সারদা দেবীর দ্রব্য সামগ্রী প্রর্দশন

সারদা দেবীর ১৯১১ সালে মাদ্রাজ (অধুনা চেন্নাই), মাদুরাই ও ব্যাঙ্গালোর (অধুনা বেঙ্গালুরু) তীর্থযাত্রার মডেলগুলি তার ব্যবহৃত দ্রব্যসামগ্রীর সঙ্গে প্রদর্শিত হয়েছে।

বিবেকানন্দের বৃহদাকার মূর্তি

জাদুঘরের মধ্যে শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনের একটি মডেলের সামনে স্বামী বিবেকানন্দের একটি বৃহদাকার মূর্তি আছে। এই শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনেই ১৮৯৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে আয়োজিত বিশ্ব ধর্ম মহাসভায় বিবেকানন্দ ভাষণ দিয়েছিলেন।

জামসেদজী টাটার চিঠি

শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনের মডেলের পাশে যাত্রাপথে বিবেকানন্দের সহযাত্রী জামশেদজি টাটার একটি চিঠি রক্ষিত হয়েছে। এই চিঠিটি জামশেদজি টাটার একটি গুরুত্বপূর্ণ ও বিখ্যাত রচনা। স্বামী বিবেকানন্দের অনুপ্রেরণাতেই তিনি বেঙ্গালুরুতে ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অফ সায়েন্স স্থাপন করেন।

জোসেফাইন ম্যাকলাউড সংক্রান্ত একটি প্রদর্শনী

শিকাগো আর্ট ইনস্টিটিউশনের মডেলের কাছেই রাখা আছে কুমারী জোসেফাইন ম্যাকলাউড সংক্রান্ত একটি প্রদর্শনী। ১৮৯৫ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে কুমারী ম্যাকলাউডের সঙ্গে বিবেকানন্দের সাক্ষাৎ হয়েছিল। তিনি ৪০ বছর ভারতে কাটিয়েছিলেন। রামকৃষ্ণ আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন।

বিবেকানন্দের স্ফটিকমূর্তি

প্যারিসের মণিকার রেনে ল্যালিকের নির্মিত বিবেকানন্দের একটি স্ফটিকমূর্তি জাদুঘরের কক্ষে আছে।

উপসংহার :- চেন্নাইয়ের ভিক্টোরিয়া হলের কাঠের সিঁড়ি ও কাঠের পদ্ম এই বেলুড় মঠে নিয়ে আসা হয়েছে। এই হলেই স্বামী বিবেকানন্দ কয়েকটি জনপ্রিয় বক্তৃতা দিয়েছিলেন।

(FAQ) বেলুড় মঠ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. বেলুড় মঠ কে প্রতিষ্ঠা করেন?

স্বামী বিবেকানন্দ।

২. বেলুড় মঠ কবে প্রতিষ্ঠিত হয়?

১৮৯৭ খ্রিস্টাব্দে।

৩. বেলুড় মঠ কোথায় অবস্থিত?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের হাওড়া শহরের নিকটবর্তী বেলুড় অঞ্চলে।

৪. বেলুড় মঠ কোন নদীর তীরে অবস্থিত?

হুগলি নদী।

Leave a Comment