পলাশীর যুদ্ধ (Battle of Palashi in Bengali)

পলাশীর যুদ্ধ (polashir juddho) কি, কখন ও কত সালে সংগঠিত হয়ে ছিল? পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি, পলাশীর যুদ্ধের কারণ ও গুরুত্ব ও ফলাফল নিয়ে আলোচনা করবো। এই প্রসঙ্গে পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব ইতিহাস , গুরুত্ব ও বিবরণ নিয়ে আলোচনা করা হবে।

১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন নদীয়া জেলার পলাশী নামক স্থানে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব ইতিহাস, পটভূমি, নবাবের কলকাতা অভিযান, অন্ধকূপ হত্যা, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ মতিঝিল, পলাশীর যুদ্ধের প্রকৃত কারণ, যুদ্ধের সূচনা, যুদ্ধের বিবরণ, নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিণতি, নবাবের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের হাল, পলাশীর লুণ্ঠন, পলাশী দিবস এবং পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব।

বাংলার নবাব ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে সংঘটিত পলাশীর যুদ্ধের সময়কাল, স্থান, ইংরেজদের পক্ষে অংশগ্রহণকারী সৈন্য সংখ্যা, নবাবের পক্ষে অংশগ্রহণকারী সৈন্য সংখ্যা, যুদ্ধে অংশগ্রহণকারী ইংরেজ সেনাপতি, বাংলার নবাবের সেনাপতি, যুদ্ধের পটভূমি, যুদ্ধের ঘটনা বিবরণ, যুদ্ধের ইতিহাস, যুদ্ধের গুরুত্ব ও ফলাফল।

১৭৫৭ সালের পলাশীর যুদ্ধ (Battle of Palasi of 1757)

প্রথমেই দেখে নেওয়া যাক পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি-

পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয় (Important issues of the Battle of Palashir)

তারিখ  ২৩ জুন ১৭৫৭
স্থানভাগীরথী নদীর তীরে, পলাশী, পশ্চিমবঙ্গ, ভারত
ফলাফলব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বিজয়।
অধিকৃত এলাকার পরিবর্তন  ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি কর্তৃক কার্যত বাংলা অধিকৃত হয়
পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্বপূর্ণ বিষয়

পলাশীর যুদ্ধে বিবাদমান পক্ষ (Disputing parties in the Battle of Palashi)

ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বনাম বাংলা এবং ফরাসি ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি।
পলাশীর যুদ্ধের বিবাদমান পক্ষ

  পলাশীর যুদ্ধে বাংলার সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী (General and leader of Bengal in the battle of Palashi)

বাংলার নবাব  সিরাজউদ্দৌলা
প্রধান সেনাপতি  মোহন লাল
ভ্যানগার্ড   মির মদন
বিশ্বাসঘাতক / অশ্বারোহী মিরজাফর
বিশ্বাসঘাতক   খুদা-ইয়ার লুৎফ খান
বিশ্বাসঘাতকরায় দুর্লভ
অস্ত্রাগারসিনফ্রে
পলাশীর যুদ্ধে বাংলার সেনাধিপতি ও নেতৃত্ব প্রদানকারী

পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষ ও বাংলা পক্ষের নেতৃত্ব (British side and Bengali side leadership in the battle of Palashi)

ইংরেজ  বাংলা
কর্নেল রবার্ট ক্লাইভ   সিরাজউদ্দৌলা (বাংলার নবাব)
মেজর কিলপ্যাট্রিক   মোহন লাল (প্রধান সেনাপতি)
মেজর গ্র্যান্ট   মির মদন (ভ্যানগার্ড)
মেজর আইরি কুট   মির জাফর (অশ্বারোহী) (বিশ্বাসঘাতক)
ক্যাপ্টেন গপ     খুদা-ইয়ার লুৎফ খান (বিশ্বাসঘাতক)
ক্যাপ্টেন রিচার্ড নক্স রায় দুর্লভ (বিশ্বাসঘাতক), সিনফ্রে (অস্ত্রাগার)
পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজ পক্ষ ও বাংলা পক্ষের নেতৃত্ব

  পলাশীর যুদ্ধে অংশ গ্রহণকারী সৈন্য (Soldiers who took part in the Battle of Plassey)

ইংরেজ পক্ষে    বাংলার পক্ষে
১,০০০ ইউরোপীয় সৈন্যপ্রাথমিকভাবে ৫০,০০০ সৈন্য
( মাত্র ৫,০০০ যুদ্ধে অংশ নেয়)
২,১০০ ভারতীয় সিপাহি ৫৩টি কামান
১০০ বন্দুকবাজ৯ টি কামান
(আটটি ৬ পাউন্ডার ও একটি হাওইটজার)
পলাশীর যুদ্ধের শক্তি

পলাশীর যুদ্ধে হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি (Casualties and losses in the Battle of Palashi)

  ইংরেজ পক্ষে  বাংলার পক্ষে
২৩ সৈন্য নিহত
(৭ ইউরোপীয় সৈন্য এবং ১৬ দেশীয় সৈন্য)   
৫০০ সৈন্য নিহত
৪৯ সৈন্য আহত
(১৩ ইউরোপীয় সৈন্য এবং ৩৬ দেশীয় সৈন্য)
৫০০ সৈন্য আহত
পলাশীর যুদ্ধের হতাহত ও ক্ষয়ক্ষতি

ভূমিকা :- বর্তমান ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদীয়া জেলার পলাশীর আম্রকানন অবস্থিত- সৌন্দর্যের দিক থেকে এক আকর্ষণীয় স্থান। এই স্থানেই সংঘটিত হয় এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ।

আজ থেকে প্রায় ২৭০-৭৫ বছর আগে ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ জুন ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও বাংলার নবাব সিরাজ-উদ-দৌলা -র মধ্যে ঘটে যায় এক ঐতিহাসিক যুদ্ধ। ইতিহাসে এই যুদ্ধ পলাশীর যুদ্ধ নামে খ্যাত। সেদিন ছিল বৃহস্পতিবার। কিন্তু তা অন্য সব দিনের মধ্যে ছিল আলাদা।

কারণ ঐদিন মুর্শিদাবাদ থেকে ১৫ ক্রোশ দক্ষিণে ভাগিরথী নদীর তীরে পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যাসহ পুরো উপমহাদেশের স্বাধীনতার কবর রচিত হয়েছিল। এরপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তি দীর্ঘ ১৯০ বছর এদেশে শাসন শোষণ করে কোটি কোটি টাকার অর্থ সম্পদ ইংল্যান্ড -এ পাচার করে। বাংলা থেকে লুটকৃত পুঁজির সাহায্যে ইংল্যান্ডে শিল্প বিপ্লব ঘটে। আর এককালের প্রাচ্যের স্বর্গ সোনার বাংলা পরিণত হয় শ্মশান বাংলায়, স্থান পায় বিশ্বের দরিদ্রতম দেশে।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব ইতিহাস (Pre-History of the Battle of Palashi)

বাংলার মুঘল শাসকগণ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে বাংলায় বসবাসের অনুমতি দেয় এবং বছরে মাত্র তিন হাজার টাকা প্রদানের বিনিময়ে তারা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার অধিকার পায়। হুগলি ও কাশিমবাজারে বাণিজ্যকেন্দ্র গড়ে তোলার কয়েক বছরের মধ্যেই আকারে এবং মূলধন নিয়োগে কোম্পানির ব্যবসা-বাণিজ্য দ্রুত বাড়তে থাকে।

কিন্তু সপ্তদশ শতাব্দীর দ্বিতীয়ার্ধে বাংলার অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যে তাদের অনুপ্রবেশ বাংলার সুবাদার শায়েস্তা খান ও ইংরেজদের মধ্যে দ্বন্দ্বের কারণ হয়ে দাঁড়ায়। শায়েস্তা খানের পরবর্তীকালে ইংরেজরা কলকাতায় বসবাস করার অধিকার পায় এবং কলকাতা, গোবিন্দপুর ও সুতানটি নামে তিনটি গ্রাম কিনে তারা প্রথম জমিদারি প্রতিষ্ঠিত করে। ইংরেজরা কলকাতায় ফোর্ট উইলিয়ম নামে একটি দুর্গও নির্মাণ করে।

জমিদারি ক্রয় ও ফোর্ট উইলিয়ম প্রতিষ্ঠা ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে খুবই সুবিধাজনক বলে প্রমাণিত হয় এবং এগুলির মাধ্যমে যে কায়েমি স্বার্থের জন্ম নেয় তা কোম্পানিকে কলকাতার আশেপাশে আরও জমিদারি (৩৮ টি গ্রাম) কিনতে উৎসাহিত করে।

ইতিমধ্যে বাণিজ্যিক সুবিধার অপব্যবহারের জন্য বাংলার নওয়াবদের সঙ্গে তাদের সম্পর্কের দ্রুত অবনতি ঘটে। কলকাতার কোম্পানি কর্তৃপক্ষ এ সকল অন্যায় কাজ বন্ধের জন্য পরিচালক সভার নির্দেশাবলির প্রতি কোন গুরুত্বই দিচ্ছিল না। তাছাড়া দস্তক এর সুবিধা আমদানি রপ্তানি বাণিজ্য ক্ষেত্রের বাইরে অভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও অবৈধভাবে তারা ব্যবহার করতে থাকে। একই সঙ্গে কোম্পানির কর্মচারীগণ বাণিজ্যের ছাড়পত্র তাদের ব্যক্তিগত ব্যবসার ক্ষেত্রে ব্যবহার শুরু করে। ফলে যুদ্ধ পরিস্থিতি ঘনিয়ে আসে।

কোম্পানি আরও অধিক সুযোগ-সুবিধা আদায়ের প্রচেষ্টায় মুঘল সম্রাট ফারুখসিয়ার -এর নিকট হাজির হয়। সম্রাট ফারুখসিয়ার এক ফরমানের (১৭১৭ খ্রিস্টাব্দে ফারুখসিয়ারের ফরমান) মাধ্যমে ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানিকে কিছু গুরুত্বপূর্ণ সুবিধা প্রদান করেন। এ সকল সুবিধার মধ্যে ছিল শুল্কমুক্ত বাণিজ্য, কলকাতায় টাকশাল স্থাপন এবং কিছু শর্ত সাপেক্ষে ৩৮টি গ্রাম ক্রয় করার অধিকার।

যেহেতু অন্যান্য ব্যবসায়ীদের নির্দিষ্ট হারে শুল্ক দিতে হত, আর ইংরেজ ও তাদের সহযোগীরা শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করত, তাই স্থানীয় ব্যবসায়ীদের অভ্যন্তরীণ বাণিজ্য থেকে উৎখাত হওয়ার ভয় দেখা দেয়। সেই কারণে নবাব মুর্শিদকুলি খান এই ফরমানের বাস্তবায়নে বাধা দেন। তিনি অনুভব করেন যে, কোম্পানির আমদানি-রপ্তানি বাণিজ্য বহুগুণে বৃদ্ধি পেলেও এ ব্যবস্থায় কোম্পানি নামমাত্র বার্ষিক তিন হাজার টাকা সরকারকে দেবে এবং কোম্পানির এ বিশেষ সুবিধার ফলে সরকার তার আইনানুগ বাণিজ্য শুল্ক ও টাকশালের উপর প্রাপ্য কর থেকে বঞ্চিত হবে। এরপর ১৭৫৬ সালের এপ্রিল মাসে সিরাজউদ্দৌলার ক্ষমতা গ্রহণের সঙ্গে সঙ্গে নবাব এবং ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির মধ্যে বিরোধ অনিবার্য হয়ে পড়ে।

পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি (Background of the Battle of Palashi)

পলাশী যুদ্ধের এক সুদীর্ঘ পটভূমি আছে। ১৬৫০ এর দশকের প্রথম থেকে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি যখন বাংলায় স্থায়ীভাবে বসবাস শুরু করে তখন, থেকে এ পটভূমির সূচনা হয় বললে বেশি বলা হবে না। সিরাজ উদ দৌলার সিংহাসনে আরোহণের সময় ইংরেজদের সাথে বিরোধিতা চরমে ওঠে। এই বিরোধের কারণগুলি হল –

(১) আনুগত্যদানে বিলম্ব

সিরাজ উদ্দৌলা বাংলার সিংহাসনে বসলে প্রথা অনুযায়ী নবাবের প্রতি আনুগত্য জানিয়ে ফরাসি, ওলন্দাজ প্রভৃতি জাতিগুলি উপঢৌকন পাঠায়। কিন্তু ইংরেজরা ইচ্ছা করে উপঢৌকন পাঠাতে দেরি করে। এতে সিরাজউদ্দৌলা অপমানিত হন।

(২) ষড়যন্ত্রের সংবাদ

সিংহাসনে বসার সময় থেকে ঘষেটি বেগম, সৌকত জঙ্গ ও কয়েকজন, রাজকর্মচারী সিরাজের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত ছিলেন । সিরাজের কাছে খবর আসে যে, এই ষড়যন্ত্রে ইংরেজরা যুক্ত আছে এবং তাকে সরিয়ে অনুগত কাউকে সিংহাসনে বসানোর চক্রান্ত করছে ।

(৩) কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান

সিরাজ উদ্দৌলা ঘষেটি বেগমের প্রিয়পাত্র ঢাকার দেওয়ান রাজবল্লভকে রাজস্বের সঠিক হিসাব ও নবাবের প্রাপ্য অর্থ সহ মুর্শিদাবাদে হাজির হওয়ার নির্দেশ দেন।

কিন্তু আর্থিক তছরুপের দায়ে অভিযুক্ত রাজবল্লভ নবাবের নির্দেশ অমান্য করে প্রচুর ধনরত্নসহ পুত্র কৃষ্ণদাসকে কলকাতায় ইংরেজদের আশ্রয়ে পাঠিয়ে দেয়। নবাব কৃষ্ণদাসকে ফেরত পাঠানোর নির্দেশ দিলে ইংরেজরা তা অমান্য করে। এই ঘটনায় সিরাজ প্রচণ্ড ক্ষুব্ধ হন।

(4) দুর্গনির্মাণ

দাক্ষিণাত্য যুদ্ধের অজুহাতে ইংরেজ ও ফরাসিরা বাংলায় দুর্গনির্মাণ শুরু করে। সিরাজউদ্দৌলার নির্দেশ মতো ফরাসিরা দুর্গনির্মাণ বন্ধ করলেও ইংরেজরা নবাবের নির্দেশ বার বার অমান্য করে। এই ঘটনায় নবাব অত্যন্ত রেগে গিয়ে দুর্গনির্মাণে সামরিক হস্তক্ষেপ করেন।

(5) দস্তকের অপব্যবহার

ইংরেজরা ১৭১৭ সালে মোঘল সম্ব্রাট ফারুকসিয়ারের কাছ থেকে দস্তক অর্থাৎ বাণিজ্যিক ছাড়পত্র লাভ করে। এর ফলে তারা বাংলায় কয়েকটি পন্যের বিনাশুল্কে বানিজ্য করার অধিকার পায়।

কিন্তু কোম্পানি ও কোম্পানির কর্মচারীরা এর অপব্যবহার শুরু করে নিজেদের ব্যক্তিগত ব্যবসায় তা কাজে লাগাতে থাকে। এমনকি কোম্পানির কর্মচারীরা বাংলার আভ্যন্তরীণ বাণিজ্যেও অংশ নিতে থাকে। ফলে নবাবের ব্যাপক রাজস্বের ক্ষতি হয়। সিরাজউদ্দৌলা এর প্রতিবাদ করলে ইংরেজরা তাতে মোটেই কর্ণপাত করে নি।

(৬) নারায়ন দাসকে অপমান

কলকাতায় ইংরেজদের দুর্গনির্মাণ বন্ধ করা, ইংরেজদের বিনা শুল্কে বাণিজ্য, কৃষ্ণদাসকে আশ্রয়দান প্রভৃতি বিষয়ে আলোচনা করার জন্য সিরাজ নারায়ন দাসকে দুত হিসাবে কলকাতায় ইংরেজ কর্তৃপক্ষের কাছে প্রেরণ করেন। কিন্তু ইংরেজরা নারায়ন দাসকে গুপ্তচর ঘোষণা করে এবং অপমান করে তাড়িয়ে দেয় ।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে নবাবের কলকাতা অভিযান (Nawab’s Calcutta campaign before the Battle of Palashi)

নবাব সিরাজ উদ্দৌলা বিভিন্ন ঘটনায় ইংরেজদের ওপর ক্ষুব্ধ হয়ে তাদের উচিত শিক্ষা দেওয়ার মনস্থির করেন। একের পর এক ঘটনায় নবাব উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজরা তার সার্বভৌম ক্ষমতাকেই চ্যালেঞ্জ করছে। তিনি ইংরেজদের কাশিমবাজার কুঠি দখল (৪ জুন ১৭৫৬ খ্রিস্টাব্দ) করে কলকাতা অভিযানে অগ্ৰসর হন এবং ফোর্ট উইলিয়াম দুর্গ সহ কলকাতা দখল (২০ জুন ১৭৫৬ খ্রি.) করেন।

এই সময় কলকাতার অধিকাংশ ইংরেজ ফলতায় পালিয়ে যায়। কলকাতা দখলের পর সিরাজ কলকাতার নতুন নাম রাখেন ‘আলিনগর’। এরপর তিনি মানিক চাঁদকে কলকাতার শাসনকর্তা নিযুক্ত করে রাজধানী মুর্শিদাবাদে ফিরে আসেন।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে অন্ধকূপ হত্যা (Dungeon kills before the Battle of Plassey)

হলওয়েল নামে এক ইংরেজ কর্মচারী বলেন যে, কলকাতা দখলের পর নবাবের নির্দেশে কলকাতায় বন্দী ১৪৬ জন ইংরেজ সৈন্যকে ১৮ ফুট লম্বা ও ১৪ ফুট ১০ ইঞ্চি চওড়া একটি ছোটো ঘরে আটকে রাখা হয় (২০ জুন ১৭৫৬ খ্রি.)। পরের দিন সকালে দেখা যায় বন্দী সৈন্যদের মধ্যে ১২৩ জন শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা গেছে। এই ঘটনা ইতিহাসে অন্ধকূপ হত্যা নামে পরিচিত। কিন্তু আধুনিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, এত ছোটো ঘরে এত বেশি সংখ্যক সৈন্যকে আটকে রাখা সম্ভব নয়।

অ্যানি বেসান্ত বলেছেন যে,

“Geometry disproving arithmetic gave the lie to the story.”

গবেষক নোয়েল বারকারের (Noel Barker) মতে,

“অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি সত্যি, কিন্তু খুব বেশি লোকের মৃত্যু হয় নি এবং এই ঘটনার জন্য নবাব কোনো ভাবেই দায়ী ছিলেন না।”

নবাবের বদনাম ঘটানোর জন্যই হলওয়েল এই রকম একটি মিথ্যা ঘটনার আশ্রয় নিয়েছিলেন বলে মনে করা হয়।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে আলিনগরের সন্ধি (Treaty of Alinagar before the Battle of Palashir)

কাশিমবাজার ও কলকাতায় ইংরেজদের পতনের খবর মাদ্রাজে পৌঁছালে কর্নেল ক্লাইভ ও অ্যাডমিরাল ওয়াটসনের নেতৃত্বে একটি নৌবহর কলকাতা পুনরুদ্ধারের জন্য অগ্ৰসর হয়। অতি সহজেই, একরকম বিনা বাধায় কলকাতা ইংরেজদের দখলে চলে আসে (২ জানুয়ারি ১৭৫৭ খ্রি.)। বলা হয় মানিক চাঁদকে উৎকোচ দিয়ে খুব সহজেই তারা কলকাতা পুনর্দখল করে। এই পরিস্থিতিতে সিরাজ কলকাতা অভিযান করেন এবং কয়েক দিন যুদ্ধের পর তিনি ইংরেজদের সঙ্গে আলিনগরের সন্ধি (৯ ফেব্রুয়ারি ১৭৫৭ খ্রি.) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।

আলিনগরের সন্ধির শর্ত অনুসারে ইংরেজরা দুর্গ নির্মাণ, বিনা শুল্কে বাণিজ্য ও নিজ নামাঙ্কিত মুদ্রা চালু করার অধিকার পায়। বলা বাহুল্য, এই সন্ধির ফলে ইংরেজদের প্রভাব – প্রতিপত্তি বহুল পরিমাণে বৃদ্ধি পায়। এতদিন পর্যন্ত নবাবের অধিনস্থ একটি জমিদারি মাত্র ছিল কলকাতা। নবাবের পরাজয়ের ফলে কলকাতা হয়ে ওঠে প্রায় একটি স্বাধীন ভূখণ্ড, আর এর কর্তৃত্বের অধিকারী হয় ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি। তাছাড়া নবাবের পরাজয় ইংরেজদের উচ্চাকাঙ্ক্ষায় জোয়ার নিয়ে আসে।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে চন্দননগর দখল (Capture of Chandannagar before the Battle of Palashi)

দুই পক্ষের মধ্যে সন্ধি হলেও যথার্থ বন্ধুত্ব স্থাপিত হয় নি। এই সময় দাক্ষিণাত্যে কর্ণাটকের তৃতীয় যুদ্ধ চলাকালীন সুযোগে নবাবের প্রতিবাদ অগ্রাহ্য করে রবার্ট ক্লাইভ ফরাসি ঘাঁটি চন্দননগর দখল (২৩ মার্চ ১৭৫৭ খ্রি.) করেন। এইভাবে ক্লাইভ একদিকে নিজেদের প্রতিদ্বন্দ্বী ফরাসিদের ধ্বংস করেন আবার অন্যদিকে ইংরেজদের বিরুদ্ধে নবাব ও ফরাসি মৈত্রীর সম্ভাবনাকেও নির্মূল করেন। এদিকে পরাজিত ফরাসিরা মুর্শিদাবাদে আশ্রয় নেয়। এই সময় দাক্ষিণাত্যের ফরাসি শক্তির সাথে সিরাজের গোপন যোগাযোগ চলছিল। এর ফলে ক্লাইভ আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। তিনি উপলব্ধি করেন যে, ইংরেজদের ওপর নির্ভরশীল কোনো নবাবকেনবাবকে মুর্শিদাবাদের সিংহাসনে প্রতিষ্ঠিত না করা পর্যন্ত ইংরেজদের স্বার্থ নিরাপদ নয়।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে নবাব সিরাজ উদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র (Conspiracy against Nawab Siraj Uddaula before the Battle of Palashi)

ইতিপূর্বে জগৎ শেঠ, রাজবল্লভ, রায়দুর্লভ, উমিচাঁদ, মিরজাফর, ইয়ার লতিফ প্রমুখ মুর্শিদাবাদের হিন্দু-মুসলিম বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি সিরাজের অপরিণামদর্শী ও উদ্ধত আচার-আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে এবং তাঁকে সিংহাসন থেকে অপসারিত করার চক্রান্ত শুরু করে। এই চক্রান্তে ক্লাইভও যোগদান করেন। স্থির হয় যে, সিরাজকে সরিয়ে মিরজাফরকে সিংহাসনে বসানোর ক্ষেত্রে ইংরেজরা সর্বোতভাবে সাহায্য করবে। এর বিনিময়ে রবার্ট ক্লাইভ ও ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি বাংলায় বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা লাভ করবে।

পলাশীর যুদ্ধের পূর্বে মতিঝিল প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ (Motijheel Palace – Palace of Conspiracy before the Battle of Palashir)

ঘৃণিত কলঙ্কজনক মতিঝিল প্রাসাদ ষড়যন্ত্রের অধ্যায় সৃষ্টির পেছনে সক্রিয়ভাবে জড়িত ছিল। বিশ্বাসঘাতক জগৎ শেঠ, মীরজাফর, মাহতাব চাঁদ, উমিচাঁদ বা আমির চন্দ, মহারাজা স্বরূপচাঁদ, ইয়ার লতিফ, রায়দুর্লভ, ঘসেটি বেগমের ক্ষমতার লোভ এই ষড়যন্ত্রের পিছনে কাজ করেছিল। রাজা রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার, রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়, রানী ভবানী প্রমুখের কৌশলী চক্রও এর পেছনে প্রচ্ছন্ন ছিল। যুদ্ধক্ষেত্রে এই স্বার্থান্বেষী ষড়যন্ত্রীদের শিকার ছিলেন বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিপাহসালার নবাব সিরাজউদ্দৌলা এবং তার বিশ্বস্ত সেনাপতি বকসী মীরমদন, প্রধান আমাত্য মোহনলাল কাশ্মিরী ও নবে সিং হাজারী।

পলাশীর যুদ্ধের প্রকৃত কারণ (The real cause of the Battle of Plassey)

এই পলাশীর যুদ্ধ সৃষ্টি করার জন্য কাকে দায়ী করা যায়- এ নিয়ে ঐতিহাসিকদের মধ্যে বিতর্কের শেষ নেই।

  • ইংরেজ ঐতিহাসিক এস. সি. হিল বলেছেন, পলাশীর যুদ্ধের জন্য সিরাজই দায়ী ছিলেন। তাঁর মতে নবাবের ‘অহমিকা ও লোভ’-ই যুদ্ধ সৃষ্টি করেছিল। তিনি আরও বলেন যে, নবাবের প্রকৃত লক্ষ্য ছিল কোম্পানির অর্থ লুন্ঠন করা – দুর্গ নির্মাণ ও অন্যান্য বিষয়কে তিনি উপলক্ষ হিসেবে ব্যবহার করেন।
  • আধুনিক ঐতিহাসিক পি. জে. মার্শাল, ক্রিস বেইলি প্রমুখের রচনাতেও হিলের বক্তব্যের প্রতি সমর্থন পাওয়া যায়।
  • অন্যদিকে ইংরেজ ঐতিহাসিক রবার্ট ওরম্ এবং পার্শিভ্যাল স্পিয়ার তাদের লেখনীতে আলাদা বক্তব্য রেখেছেন।
  • রবার্ট ওরম্ বলেছেন, ইংরেজরা আর্কটের মতো বাংলাতেও নিজেদের পছন্দের কোনো ব্যক্তিকে সিংহাসনে বসানোর জন্য সিরাজের সাথে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়।
  • আবার পার্শিভ্যাল স্পিয়ার বলেন যে, বাংলার সম্পদ কোম্পানির বার্ষিক লগ্নিতে নিয়োগ করে বিপুল মুনাফা অর্জনের সম্ভাবনা তৈরি করার উদ্দেশ্যেই রবার্ট ক্লাইভ দরবারের ষড়যন্ত্রে মুখ্য ভূমিকা পালন করেন।
  • ড. ব্রিজেন গুপ্তের মতে, ঐশ্বর্য ও ক্ষমতার মোহে আচ্ছন্ন হয়ে ইংরেজ কোম্পানিই সাম্রাজ্যবাদী কার্যকলাপে লিপ্ত হয়ে পড়ে। আর এর ফলশ্রুতিতেই শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধ।

পলাশীর যুদ্ধের সূচনা (Beginning of the Battle of Palashi)

ষড়যন্ত্রের প্রস্তুতি শেষ হলে রবার্ট ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধির শর্ত ভঙ্গের অভিযোগ এনে নবাবকে এক চরমপত্র পাঠিয়ে বিরাট পরিমাণ ক্ষতিপূরণ দাবি করেন। এই চরমপত্রের উত্তর আসার আগেই রবার্ট ক্লাইভ সৈন্য নিয়ে মুর্শিদাবাদ অভিযানে অগ্ৰসর হয়।

এরপর ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের ২৩ শে জুন মুর্শিদাবাদের ২৩ মাইল দূরে নদিয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে ইংরেজ ও বাংলার নবাব সিরাজউদ্দৌলার মধ্যে যুদ্ধ হয়, ইতিহাসে যা পলাশীর যুদ্ধ নামে পরিচিত।

ইংরেজদের পক্ষে ছিল ৮০০ ইউরোপীয় এবং ২২০০ দেশীয় সৈন্য। অন্যদিকে বাংলার নবাবের পক্ষে ছিল ১৮০০০ অশ্বারোহী এবং ৫০০০০ পদাতিক সৈন্য।

বীর সেনাপতি মিরমদন ও মোহনলাল যুদ্ধক্ষেত্রে প্রাণ দেন। অন্যদিকে মিরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখ বিশিষ্ট সেনাপতিরা যুদ্ধক্ষেত্রে পুতুলের মতো দাঁড়িয়ে থাকেন।

তাছাড়া মিরজাফরের চরম বিশ্বাসঘাতকতায় নবাবের সেনাবাহিনী ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। এই যুদ্ধে ইংরেজদের মাত্র ২৩ জন নিহত ও ৪৯ জন আহত এবং নবাবের পক্ষে প্রায় ৫০০ জন নিহত ও তারও বেশি সৈনিক আহত হয়।

পলাশী যুদ্ধের বিবরণ (Description of the Battle of Palashi)

পরিকল্পিত ‘বিপ্লব’ বাস্তবায়নের জন্য ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ভীষণ অস্থির হয়ে পড়ে। সরাসরি মুর্শিদাবাদের দিকে অগ্রসর হওয়া সর্বোত্তম হবে, না মিরজাফরের নিকট থেকে আরও পরামর্শ এবং অভিযান পরিচালনার কৌশল বিষয়ে জানার জন্য অপেক্ষা করবে এ নিয়ে ১১ জুন তারা ধীর ও সতর্ক চিন্তাভাবনা করতে থাকে।

সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত হয় বর্তমান সন্ধিক্ষণে সর্বোত্তম সুবিধাজনক কাজ হবে মিরজাফরের পক্ষে বিপ্লব বাস্তবায়িত করার জন্য পদক্ষেপ গ্রহণ। কারণ, আরও বিলম্ব হলে নবাবের নিকট ষড়যন্ত্র প্রকাশ হয়ে যাবে এবং মিরজাফরকে সরিয়ে দেওয়া হবে। এর ফলে ইংরেজদের সমস্ত পরিকল্পনা ভন্ডুল হবে এবং ব্রিটিশরা একা সম্মিলিত দেশিয় শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য মাঠে থাকবে।

এই পরিস্থিতিতে রবার্ট ক্লাইভ ১৩ জুন মুর্শিদাবাদ অভিমুখে যাত্রা শুরু করেন। ১৯ জুন ক্লাইভ কাটোয়া পৌঁছান।আগের দিন এই স্থানটি কর্নেল কুট দখল করে নেয়। ২১ জুন ক্লাইভ ‘সমর পরিষদের’ সভা ডাকেন এবং ‘তাৎক্ষণিক পদক্ষেপ’ না নেওয়ার সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেন। কিন্তু ক্লাইভ পরে মত পরিবর্তন করেন এবং পরদিন অগ্রসর হওয়ার জন্য মনস্থ করেন। ২২ জুন সকালে ব্রিটিশ বাহিনী ক্লাইভের নেতৃত্বে পলাশীর পথে যাত্রা করে। অবশ্য ২২ তারিখ দুপুরের পরই ক্লাইভ মিরজাফরের কাছ থেকে দীর্ঘ প্রতীক্ষিত বার্তা পান এবং পলাশীর পথে তার যাত্রা অব্যাহত রেখে মধ্যরাতের পর সেখানে পৌঁছেন।

ইতিমধ্যে নবাব মুর্শিদাবাদ থেকে রওনা দেন এবং শত্রুকে মোকাবিলা করার জন্য পলাশীতে শিবির স্থাপন করেন। ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন সকাল ৮টার সময় যুদ্ধ শুরু হয়। মীর মর্দান, মোহন লাল, খাজা আব্দুল হাদী খান, নব সিং হাজারী প্রমুখের অধীন নবাব সেনা বীরত্বের সঙ্গে যুদ্ধ চালায়। অন্যদিকে মীরজাফর, ইয়ার লতিফ এবং রায় দুর্লভের অধীন নবাবের প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ সেনা নিষ্ক্রিয়ভাবে দাঁড়িয়ে থাকে ও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ করে। এমনকি বেশ কয়েক ঘণ্টা যুদ্ধের পরও চূড়ান্ত কিছু ঘটে নি। ক্লাইভ এমন প্রতিরোধ পাবেন আশা করেন নি। এই সময় জানা যায় যে, দিনে যথাসম্ভব তীব্র যুদ্ধ চালিয়ে’ রবার্ট ক্লাইভ রাতের অন্ধকারে কলকাতা পালিয়ে যাওয়ার চিন্তা করছিলেন। কিন্তু বেলা তিনটার পর কামানের গোলা মীর মদনের ওপর আঘাত হানে এবং তাঁর মৃত্যু হয়।

মীর মদনের মৃত্যুতে হতভম্ব নবাব মিরজাফরকে ডেকে পাঠান এবং তাঁর জীবন ও সম্মান রক্ষার জন্য তাকে সনির্বন্ধ অনুরোধ করেন। মিরজাফর নবাবকে ঐ দিনের মতো যুদ্ধ বন্ধ করতে এবং পরদিন সকালে নতুন উদ্যমে যুদ্ধ শুরু করার পরামর্শ দেন। আর এই খবর শীঘ্র ক্লাইভের কাছে পৌঁছানো হয়। পরামর্শমত নবাবের সেনানায়কেরা পিছু হটতে থাকলে ইংরেজ সেনারা নতুন করে প্রচন্ড আক্রমণ চালায়। এই অতর্কিত আক্রমণের ফলে নবাব বাহিনী বিশৃঙ্খলভাবে যত্রতত্র পালিয়ে যায়। বিকেল ৫টার সময় যুদ্ধ শেষ হয়ে যায় এবং বিজয়ী ক্লাইভ বীরদর্পে তখনই মুর্শিদাবাদ যাত্রা করেন। জন উড নামে জনৈক ব্রিটিশ সৈন্য পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্রে উপস্থিত ছিলেন। তার মতে ‘এটাই ছিল সেই বিশিষ্ট ও চূড়ান্ত যুদ্ধ যেখানে কোন ব্যাপক আক্রমণ ছাড়াই রাজ্য জয় করা হয়েছিল’।

ষড়যন্ত্র এবং পরবর্তীকালে ‘পলাশী-বিপ্লব’ ইংরেজদের দ্বারা শুধু উদ্ভাবিত ও উৎসাহিতই হয় নি, বরং পলাশীর যুদ্ধের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত তারা দেশিয় ষড়যন্ত্রকারীদের ব্রিটিশ পরিকল্পনা সমর্থন করতে প্রলুব্ধ করে। সাধারণ ধারণায় মনে করা হয় ষড়যন্ত্রটি ছিল ভারতজাত, এর পেছনে ব্রিটিশদের পরিকল্পিত কোন কূটকৌশল ছিল না, ষড়যন্ত্রের মূলে বা এর উত্তরণে তাদের অতি সামান্য ভূমিকা ছিল কিংবা কোন ভূমিকাই ছিল না, এটি ছিল বাংলার আভ্যন্তরীণ সমস্যা, যা অবশ্যম্ভাবীভাবে ব্রিটিশদের জড়ায় এবং বাংলায় ব্রিটিশ বিজয় ছিল প্রায় সম্পূর্ণআকস্মিক ঘটনা মাত্র। কিন্তু এই কথাগুলি এখন ধোপে টেকে না। ইংরেজরা তাদের ষড়যন্ত্রের জোরে ও সিরাজউদ্দৌলার সভাসদদের বিশ্বাসঘাতকতার কারণেই পলাশীতে বিজয়ী হয়। তাই বলা হয় নবাবের পরাজয় ছিল রাজনৈতিক, সামরিক নয়।

পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের পর সিরাজউদ্দৌলার পরিণতি (Fate of Sirajuddaula after his defeat at the Battle of Palashi)

পলাশীর যুদ্ধের করুন পরিস্থিতি সিরাজকে আশাহত করে। পলাশীর যুদ্ধে যুদ্ধ পরিচালনার নীতির পরিবর্তে বিশ্বাসঘাতকতার নীতি জয়ী হয়।

ভগ্ন হৃদয়ে সিরাজউদ্দৌলা পালিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি ধরা পড়ে যান। তাঁকে বন্দী করে মুর্শিদাবাদে আনা হয় এবং মিরজাফরের পুত্র মিরনের নির্দেশে তিনি নিহত (২ জুলাই ১৭৫৭ খ্রি.) হন। এইভাবে বাংলার নবাবি আমলের স্বাধীনতার সূর্যাস্ত ঘটে।

পলাশীর যুদ্ধে সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীদের হাল (The fate of the conspirators against Sirajuddaula in the battle of Palashi)

পলাশীর যুদ্ধে ষড়যন্ত্রকারীরা কেউই সুখে ছিলেন না।

রবার্ট ক্লাইভ -পলাশীর যুদ্ধের পরবর্তীতে রবার্ট ক্লাইভ আত্মহত্যা করেন,

উমিচাঁদ -পাগল হয়ে যায়, নিদারুণ কুষ্ঠরোগের যন্ত্রণা ভুগে শেষ পর্যন্ত কিরীটেশ্বরীর চরণামৃতপানে একজনের প্রাণ যায়, একজন মারা যায় বজ্রাঘাতে।

আর শেঠ-ভ্রাতৃদ্বয়কে বুকে পাথর চাপা দিয়ে মুঙ্গের দুর্গের চূড়া থেকে গঙ্গায় ফেলে ডুবিয়ে মারা হয়। এইভাবে প্রত্যেক ষড়যন্ত্রীর মর্মান্তিক পরিণতি লক্ষ্য করা যায়।

পলাশীর লুন্ঠন (Plunder of Palashi)

বাংলার মসনদে বসে মিরজাফর ইংরেজ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি ও রবার্ট ক্লাইভকে প্রচুর অর্থ ও বিভিন্ন উপঢৌকন দান করেন। ফলে বাংলার রাজকোষ শূন্য হয়ে যায়। তাছাড়াও কোম্পানি বিভিন্ন উপায়ে বাংলার আর্থিক সম্পদ শোষণ করতে থাকে।

ব্রিটিশ ঐতিহাসিক টমসন ও গ্যারাট বলেছেন যে, বাংলার মানুষের শেষ রক্তবিন্দু শুষে না নেওয়া পর্যন্ত ইংরেজরা তাদের শোষণ অব্যাহত রেখেছিল। এই ঘটনাকে ‘পলাশীর লুন্ঠন‘ বা ‘Plassey Plunder’ বলা হয়।

ঐতিহাসিক থিওডোর মরিসন, পি. জে. মার্শাল প্রমুখ এই লুন্ঠন তত্ত্ব মানতে রাজি নন। তাদের মতে, মুঘল আমলেও রাজস্ব হিসেবে বাংলার অর্থ বাইরে যেত।

তাছাড়া পলাশীর যুদ্ধের পর কোম্পানি বিভিন্ন ভাবে বাংলার সামরিক ও প্রশাসনিক সেবা করেছে। আর এই সেবার বিনিময়েই বাংলার কিছু অর্থ বাইরে গেছে।

ভারতীয় ঐতিহাসিকরা এই যুক্তি মানতে রাজি নন। তাঁদের মতে মুঘল আমলে বাংলার অর্থ ভারতের এক স্থান থেকে অন্যস্থানে গেছে মাত্র – ভারতের বাইরে যায় নি। পলাশীর যুদ্ধের পরই বাংলার অর্থ ও সম্পদের বহির্গমন পরিলক্ষিত হয়।

পলাশী দিবস (Palashi Day)

প্রতি বছর ২৩ জুন পালিত হয় পলাশী দিবস । ১৭৫৭ সালের ২৩ জুন পলাশীর আমবাগানের যুদ্ধে বাংলার স্বাধীন নবাব ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির কাছে পরাজিত হয়। ফলে প্রায় ২০০ বছরের জন্য বাংলা তথা ভারতবর্ষ স্বাধীনতা হারায়।

তাই প্রতি বছর ২৩ জুন পলাশী দিবস হিসাবে পালন করা হয়। ১৭৫৭ খ্রিস্টাব্দের এই দিনে নদিয়া জেলার পলাশীর প্রান্তরে রবার্ট ক্লাইভ, মীরজাফর, রায়দুর্লভ, ইয়ার লতিফ প্রমুখের চক্রান্ত এই কালো দিবসের জন্ম দেয়।

পলাশীর যুদ্ধের গুরুত্ব (Significance of Battle of Palashi)

পলাশীর যুদ্ধে হতাহতের সংখ্যা ও যুদ্ধের ব্যাপকতার দিক থেকে বিচার করলে পলাশীর যুদ্ধ কে সামান্য একটি খন্ডযুদ্ধ ব্যতীত আর কিছু বলা যায় না।

কিন্তু ভারতের ইতিহাসে পলাশীযুদ্ধের গুরুত্ব ছিল অপরিসীম।

  • ঐতিহাসিক ম্যালেসনের মতে,

“There never was a battle in which the consequences were so vast, so immediate and  so permanent.”

  • অধ্যাপক পি. জে. মার্শালের মতে,

“পলাশী কেবল একটি যুদ্ধ ই ছিল না – পলাশীর ঘটনা হল একটি বিপ্লব।”

  • আবার ড. বিপান চন্দ্রের মতে,

“The battle of Plassey was of immense of historical significance.”

এই পলাশীর যুদ্ধের রাজনৈতিক ফলাফল ছিল ধ্বংসাত্মক ও সুদূরপ্রসারী। এই যুদ্ধের পরে বক্সারের যুদ্ধ জয়ের মাধ্যমে ধীরে ধীরে বাংলা ব্রিটিশদের অধিকারে চলে আসে। বাংলা অধিকারের পর ক্রমান্বয়ে ব্রিটিশরা পুরো ভারতবর্ষ এমনকি এশিয়ার অন্যান্য অংশও নিজেদের দখলে নিয়ে আসে। পলাশীর যুদ্ধের ফলে ইংরেজ কোম্পানি কার্যত বাংলার নবাবি শাসনের পরোক্ষ পরিচালকে পরিণত হয় ।

যুদ্ধের সাফল্যকে সামনে রেখে ইংরেজ কোম্পানি ভারতের অন্যান্য অঞ্চলে আধিপত্য প্রসারের স্বপ্ন দেখতে থাকে। ইংরেজরা এই যুদ্ধে জয় লাভের ফলে বাংলা থেকে ফরাসিরা বিতাড়িত হয়। বাংলার অর্থ কাজে লাগিয়ে দাক্ষিণাত্যে ফরাসিদের বিরুদ্ধে জয়ী হয়।

যুদ্ধে নবাবের পরাজয়ের ফলে বাংলার রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক ক্ষেত্রে এক ভয়াবহ শূন্যতা ও জটিলতা সৃষ্টি হয়। এই যুদ্ধে জিতে ইংরেজ কোম্পানি বাংলায় দস্তক বা বিনাশুল্কে বানিজ্যিক অধিকারের সফল প্রয়োগ ঘটায়। ফলে বাংলার ব্যবসা-বানিজ্যে কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্য প্রতিষ্ঠিত হয়। কোম্পানির একচেটিয়া প্রাধান্যের ফলে দেশীয় ব্যাবসা-বানিজ্য ক্রমে ধ্বংসের পথে এগিয়ে যায়।

যুদ্ধের রক্তাক্ত ইতিহাস, পরাধীনতার ইতিহাস, মুক্তিসংগ্রামীদের পরাজয়ের ইতিহাস, ষড়যন্ত্র ও বিশ্বাসঘাতকতার ইতিহাস, ট্রাজেডি ও বেদনাময় এক শোক স্মৃতির ইতিহাস। এই নৃশংস ও কলঙ্কজনক ঘটনার মাধ্যমে কলকাতা কেন্দ্রিক একটি নতুন উঠতি পুজিঁপতি শ্রেণী ও রাজনৈতিক শক্তির উত্থান ঘটে। ইংরেজ ও তাদের এ দেশীয় দালালগোষ্ঠী দেশবাসীর ওপর একের পর এক আগ্রাসন চালায়। ফলে দেশীয় কৃষ্টি-সংস্কৃতি, শিল্প ও সামাজিক জীবনে ব্যাপক বিপর্যয় নেমে আসে। বিকাশমান ব্যবসা-বাণিজ্য ও চাকরির ক্ষেত্রে তারা মরণ কামড় দেয়।

পলাশী যুদ্ধের পর শোষিত বঞ্চিত শ্রেণী একদিনের জন্যও স্বাধীনতা সংগ্রাম বন্ধ রাখেনি। এ জন্যই ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষ সাধারণ জনগণকেই একমাত্র প্রতিপক্ষ মনে করত। ফলে দীর্ঘ ২০০ বছর ধরে আন্দোলন সংগ্রামের ফলে ব্রিটিশরা লেজ গুটাতে বাধ্য হয় এবং ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান ও ভারত নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র জন্মলাভ করে। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ -এর অভ্যুদয় ঘটে।

উপসংহার :- এইভাবে মুর্শিদাবাদের বহু বিশিষ্ট ব্যক্তি, যেমন – জগতশেঠ, রায়দুর্লভ, রাজবল্লভ, ঊর্মিচাঁদ ইয়ার লতিফ, মিরজাফর প্রমুখের ষড়যন্ত্রে এবং ইংরেজদের ক্ষমতার মোহ  পলাশীর যুদ্ধের পটভূমি তৈরি করে। আর এই পটভূমিতেই লর্ড ক্লাইভ আলিনগরের সন্ধি ভঙ্গের অজুহাতে মুর্শিদাবাদ আক্রমন করে। ২৩ জুন ১৭৫৭ সালে শুরু হয় পলাশীর যুদ্ধ।

এই পলাশীর যুদ্ধে পরাজয়ের ফলে বাংলার স্বাধীনতার সূর্য প্রায় ২০০ বছরের জন্য অস্তমিত হয় । নবাব সিরাজউদ্দৌলাকে নিয়ে নানা রকমের রটনা থাকলেও প্রকৃতপক্ষে তিনি ছিলেন বাংলা বিহার উড়িষ্যার অন্যতম স্বাধীনচেতা নবাব। যিনি বিশ্বাসঘাতকদের ষড়যন্ত্রের কারণে স্বাধীনতা রক্ষা করতে পারেননি।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “পলাশীর যুদ্ধ (Battle of Palashi in Bengali)” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যেকোনো প্ৰশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে  তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) পলাশীর যুদ্ধ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. পলাশীর যুদ্ধ কত সালে হয়?

১৭৫৭ সালে।

২. পশ্চিমবঙ্গের কোন জেলায় পলাশীর যুদ্ধক্ষেত্র টি অবস্থিত?

পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলায়।

৩. পলাশীর যুদ্ধ কখন সংঘটিত হয়?

২৩ জুন, ১৭৫৭ সালে।

৪. পলাশীর যুদ্ধে ইংরেজদের পক্ষে কতজন সৈন্য ছিল?

আনুমানিক ৩০০০

৫. পলাশীর যুদ্ধের সময় মোগল সম্রাট কে ছিলেন?

দ্বিতীয় আলমগীর।

৬. সিনফ্রে কে ছিলেন?

সিনফ্রে ছিলেন পলাশীর যুদ্ধে নবাব সিরাজউদ্দৌলার পক্ষে ফরাসি সেনাপতি।

৭. পলাশীর যুদ্ধ কোথায় হয়েছিল?

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরের প্রায় ৫০ কিলোমিটার উত্তরে ভাগীরথী নদীর তীরে অবস্থিত পলাশী গ্রাম গ্রামেই বিখ্যাত পলাশীর যুদ্ধ হয়েছিল। 

৮. পলাশীর যুদ্ধ কবে কাদের মধ্যে হয়েছিল?

১৭৫৭ সালে ব্রিটিশ ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির সাথে নবাব সিরাজউদ্দৌলার।

৯. পলাশীর আম্রকানন কোথায় অবস্থিত?

কৃষ্ণনগর ও মুর্শিদাবাদের মাঝামাঝি নদীয়া জেলার পলাশী গ্রামে ।

পলাশীর যুদ্ধ (polashir juddho)

Leave a Comment