ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি

মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি -র উদ্দেশ্য, রাজনৈতিক কারণ, জয়সিংহের মৃত্যু, মারওয়াড় দখল, রাজপুতদের আবেদন, মারওয়াড়-মেবার জোট, মেবার আক্রমণ, আকবরের বিদ্রোহ, মেবারের সাথে সন্ধি, মারওয়াড়ের সাথে সন্ধি, ঔরঙ্গজেব-রাজপুত সম্পর্কের নতুন ব্যাখ্যা এবং ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানবো।

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি

বিষয়ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি
রাজত্বকাল১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিশাহজাহান
উত্তরসূরিপ্রথম বাহাদুর শাহ
মৃত্যু১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ
ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি

ভূমিকা :- ঔরঙ্গজেব -এর রাজপুত নীতি মোগল ইতিহাসে এক অতি জটিল ও বিতর্কিত বিষয়। সম্রাট ঔরঙ্গজেব অনুদার নীতি গ্ৰহণ করে রাজপুতদের মোগল বিরোধী করে তোলেন।

আকবরের সময় রাজপুত নীতি

স্যার যদুনাথ সরকার, ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ, ডঃ শ্রীরাম শর্মা, ডঃ ভিনসেন্ট স্মিথ, ডঃ উলস্‌লীহেইগ, ডঃ পার্সিভ্যাল স্পিয়ার, ডঃ শ্রীবাস্তব প্রমুখ ঐতিহাসিকরা বলেন যে, আকবর রাজপুতদের প্রতি উদার নীতি গ্রহণ করে তাদেরকে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান মিত্র ও সহযোগীতে পরিণত করেন। মোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সংরক্ষণে তাদের ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ। এক কথায়, তারা ছিল মোগল সাম্রাজ্য-এর স্তম্ভস্বরূপ।

ঔরঙ্গজেবের সময় রাজপুত নীতি

ঐতিহাসিকরা বলেন যে, সম্রাট ঔরঙ্গজেব আকবরের উদারনীতি থেকে বিচ্যুত হন এবং ভারত -এ ‘ঐস্লামিক ধর্মতন্ত্র’ প্রতিষ্ঠার সংকীর্ণ নীতি গ্রহণ করে রাজপুতদের মোগল সাম্রাজ্যের শত্রুতে পরিণত করেন।

হিন্দু সমাজের রক্ষক ও নেতা রাজপুত শক্তি

বলা হয় যে, প্রবল সামরিক ও রাজনৈতিক ক্ষমতার অধিকারী রাজপুতরাই ছিল হিন্দু সমাজের রক্ষক ও নেতা।

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির উদ্দেশ্য

মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের হিন্দুধর্ম ও সমাজ-বিরোধী আইনগুলি কার্যকর করার পথে প্রধান অন্তরায় ছিল রাজপুতরা। তাই তিনি রাজপুত-শক্তির মেরুদন্ড ভেঙ্গে দিতে উদ্যোগী হন এবং কেবলমাত্র ধর্মীয় সংকীর্ণতা দ্বারা পরিচালিত হয়ে মিত্র রাজপুতদের মোগল সাম্রাজ্যের ঘোরতর শত্রুতে পরিণত করেন।

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির রাজনৈতিক কারণ

সাম্প্রতিকালে ডঃ সতীশ চন্দ্র, ডঃ মহম্মদ আতাহার আলি, ডঃ ভার্গব প্রমাণ করতে চেষ্টা করেছেন যে, নিছক ধর্মীয় সংকীর্ণতা বা হিন্দু-বিরোধী নীতি নয়— ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির পশ্চাতে বিভিন্ন রাজনৈতিক কারণ এবং রাজপুতদের অন্তর্দ্বন্দ বিদ্যমান ছিল।

রাজপুত রাজা জয়সিংহের মৃত্যু

  • (১) অম্বরের রানা জয়সিংহ ও মারওয়াড়-রাজ যশোবন্ত সিংহ মোগল দরবারে দু’জন প্রভাবশালী সামন্ত ছিলেন। শিবাজির বিরুদ্ধে জয়সিংহকে নিয়োগ করে ঔরঙ্গজেব যথেষ্ট সুফল লাভ করেন।
  • (২) তিনি শিবাজির বহু দুর্গ মোগল অধিকারে নিয়েআসেন এবং তাঁর উদ্যোগেই শিবাজি পুরন্দরের সন্ধি (১৬৬৫ খ্রিঃ) স্বাক্ষরে বাধ্য হন।
  • (৩) এরপর তাঁকে বিজাপুরের বিরুদ্ধে নিয়োগ করা হয়। এখানেই তাঁকে বিষ-প্রয়োগে হত্যা করা হয়। রাজপুত সেনাপতিদের অনেকেই এর মধ্যে ঔরঙ্গজেবের হাত দেখতে পান। তাঁরা সচকিত হয়ে ওঠেন।

ঔরঙ্গজেবের মারওয়াড় দখল

  • (১) এরপর ঔরঙ্গজেব মারওয়াড়-রাজ যশোবন্ত সিংহের দিকে নজর দেন। রাজপুতানার মধ্যবর্তী স্থানে স্বশাসিত শক্তিশালী মারওয়াড় রাজ্যের অস্তিত্ব ঔরঙ্গজেবের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব ছিল না।
  • (২) দিল্লির সঙ্গে পশ্চিম ভারতের বন্দরগুলির যোগাযোগের পথও ছিল মারওয়াড়ের নিয়ন্ত্রণে। এছাড়া, মারওয়াড়-অধিপতি যশোবন্ত সিংহ সম্পর্কেও ঔরঙ্গজেব যথেষ্ট সন্দিগ্ধ ছিলেন, কারণ উত্তরাধিকার যুদ্ধের সময় একটি পর্বে তিনি দারার একনিষ্ঠ সমর্থক ছিলেন, যদিও পরে তিনি ঔরঙ্গজেবের পক্ষে যোগদান করেন।
  • (৩) যশোবন্ত সিংহকে তিনি দিল্লি থেকে বহু দূরে জামরুদে উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত রক্ষার কাজে নিয়োগ করেন। সেখানে রহস্যজনকভাবে তাঁর মৃত্যু (২৮শে নভেম্বর, ১৬৭৮ খ্রিঃ) ঘটলে১৬৭৯ খ্রিস্টাব্দে মোগল বাহিনী বিনা বাধায় মারওয়াড় দখল করে।
  • (৪) ৩৬ লক্ষ টাকার বিনিময়ে ঔরঙ্গজেব জনৈক ইন্দর সিংহকে মারওয়াড়ের রাজা বলে ঘোষণা করেন এবং মুসলিম ফৌজদার, কিল্লাদার, কোতয়াল, আমিন প্রভৃতি কর্মচারী নিয়োগ করে সেখানে মোগল শাসন কায়েম করা হয়।
  • (৫) সেখানে বহু হিন্দু মন্দির ধ্বংস করা হয় এবং হিন্দুদের ওপর ‘জিজিয়া কর’ চাপানো হয়। এই ইন্দর সিংহ ছিলেন যশোবন্ত সিংহের জ্যেষ্ঠভ্রাতা অমর সিংহের পৌত্র এবং এই দুই পরিবারের মধ্যে প্রবল শত্রুতা ছিল।

মুঘল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের প্রতি রাজপুতদের আবেদন

  • (১) যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুকালে তাঁর দুই পত্নী সন্তানসম্ভবা ছিলেন। স্বামীর মৃত্যুর দু’মাস পরে তাঁরা দু’টি সন্তান প্রসব করলে পরিস্থিতি নতুন মোড় নেয়।
  • (২) জন্মের কয়েকদিন পরে এক সন্তানের মৃত্যু হয় এবং অপর পুত্র জীবিত থাকে। তাঁর নাম অজিত সিংহ। যশোবন্ত সিংহের অনুগামী রাঠোর বংশীয় রাজপুত বীর দুর্গাদাস যশোবন্ত সিংহের দুই বিধবা-পত্নী ও শিশুপুত্র অজিত সিংহকে নিয়ে দিল্লিতে উপস্থিত হন এবং অজিত সিংহকে তাঁর পিতৃরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করার অনুরোধ জানান।
  • (৩) উত্তরে ঔরঙ্গজেব বলেন যে, অজিত সিংহ মোগল হারেমে প্রতিপালিত হবেন এবং তিনি সাবালকত্ব অর্জন করলে তাঁকে মারওয়াড়ের সিংহাসনে বসানো হবে। অপর একটি মতানুসারে বলা হয় যে, অজিত সিংহের ইসলাম ধর্ম গ্রহণের শর্তে ঔরঙ্গজেব তাঁকে তাঁর পিতৃরাজ্য ফিরিয়ে দিতে সম্মত হন।
  • (৪) যাই হোক, দুর্গাদাস এই প্রস্তাব ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করে দিল্লি ত্যাগের উদ্যোগ গ্রহণ করলে ঔরঙ্গজেব শিশু অজিত সিংহ এবং দুই রানিকে বন্দি করেন। রাঠোর-বীর দুর্গাদাস বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে তাঁদের উদ্ধার করে রাজধানী যোধপুরে ফিরে আসেন।

ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে মারওয়াড়-মেবার জোট

  • (১) ক্রুদ্ধ ঔরঙ্গজেব এবার তাঁর তিন পুত্রের (আজম, মুয়াজ্জম, আকবর) নেতৃত্বে মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে ত্রিমুখী অভিযান শুরু করেন এবং তিনি নিজে আজমীরে উপস্থিত হন।
  • (২) মোগল বাহিনী যোধপুর-সহ বড় বড় শহরে লুণ্ঠন চালায় এবং বহু মন্দির ধ্বংস করে সেগুলিকে মসজিদে পরিণত করে। অজিত সিংহের মা ছিলেন মেবারের শিশোদিয় রাজবংশের কন্যা। তিনি মেবার-রাজ রাজসিংহের সাহায্য প্রার্থনা করেন।
  • (৩) রাজসিংহ সঠিকভাবেই উপলব্ধি করেছিলেন যে, মারওয়াড়ের পতন ঘটলে মেবারও মোগল আগ্রাসনের হাত থেকে রক্ষা পাবে না। ঔরঙ্গজেব মেবারে জিজিয়া কর’ আরোপের নির্দেশ দেওয়ায় রাজসিংহ পূর্ব থেকেই ক্ষুব্ধ ছিলেন। এই অবস্থায় মোগলদের বিরুদ্ধে মেবার-মারওয়াড় যুগ্ম-প্রতিরোধ গড়ে ওঠে এবং যুদ্ধের প্রস্তুতি শুরু হয়।

সম্রাট ঔরঙ্গজেবের মেবার আক্রমণ

  • (১) রাজসিংহের মনোভাব বুঝতে পেরে সম্রাট ঔরঙ্গজেবই প্রথমে মেবার -এর ওপর আক্রমণ হানেন। আকস্মিক আক্রমণে বিপর্যস্ত রাজসিংহ সম্মুখ-যুদ্ধ পরিত্যাগ করে ‘গেরিলা’ যুদ্ধ-কৌশল অবলম্বন করেন এবং আত্মরক্ষার জন্য আরাবল্লীর পার্বত্য অঞ্চলে আশ্রয় গ্রহণ করেন (১৬৮০ খ্রিঃ)।
  • (২) মোগল বাহিনী উদয়পুরচিতোর জয় করে প্রায় দু’শ মন্দির ধ্বংস করে। মেবার জয় সম্পূর্ণ মনে করে ঔরঙ্গজেব পুত্র আকবরের ওপর মেবারের দায়িত্ব অর্পণ করে নিজে আজমীর জয়ের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।
  • (৩) সম্রাটের অনুপস্থিতিতে মেবারের গেরিলা বাহিনী অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে মোগল বাহিনীকে ব্যতিব্যস্ত করে তোলে। ক্ষুব্ধ ঔরঙ্গজেব পুত্রআকবরকে তিরস্কার করে মেবার থেকে মারওয়াড়ে সরিয়ে দেন এবং মেবারের দায়িত্ব অর্পণ করেন অপর পুত্র আজমের ওপর।

ঔরঙ্গজেবের বিরুদ্ধে পুত্র আকবরের বিদ্রোহ

  • (১) পিতার এই ব্যবহারে আকবর প্রচণ্ড অপমানিত বোধ করেন। তিনি বিদ্রোহী রাজপুতদের সঙ্গে যোগ দেন এবং রাজপুত সহায়তায় ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দের ১১ই জানুয়ারি, নিজেকে হিন্দুস্থানের বাদশা বলে ঘোষণা করেন।
  • (২) পুত্র আকবরের বিদ্রোহে ঔরঙ্গজেব খুবই বিব্রত বোধ করেন এবং কূটকৌশলের মাধ্যমে রাজপুতদের সঙ্গে আকবরের বিচ্ছেদ ঘটাতে সচেষ্ট হন।
  • (৩) গুপ্তচর মারফৎ তিনি আকবরের উদ্দেশ্যে একটি জাল চিঠি পাঠান, যা পড়ে সহজেই অনুমিত হবে যে পিতার নির্দেশেই আকবর রাজপুতদের সঙ্গে মিত্রতা এবং পিতার বিরুদ্ধে বিদ্রোহের অভিনয় করে চলেছেন।
  • (৪) চিঠিটি এমনভাবে পাঠানো হয়েছিল, যাতে সেটি রাজপুতদের হাতে পড়ে। ঔরঙ্গজেবের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হয়। রাজপুতরা আকবরের পক্ষ ত্যাগ করে। দুর্গাদাস আসল ব্যাপারটি বুঝতে পারেন এবং তিনি নিজ দায়িত্বে তাঁকে শিবাজির পুত্র শম্ভুজির দরবারে পৌঁছে দেন।
  • (৫) এরপর রাজপুতানায় মোটামুটি একটি ব্যবস্থা করে আকবরকে শায়েস্তা করার জন্য ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্য-যাত্রার উদ্যোগ করলে আকবর পারস্যে পলায়ন করেন (১৬৮১ খ্রিঃ) এবং ভগ্ন হৃদয়ে সেখানেই প্রাণত্যাগ করেন (১৭০৪ খ্রিঃ)।

মেবারের সাথে ঔরঙ্গজেবের সন্ধি

  • (১) বিদ্রোহী পুত্র আকবরকে দমনের উদ্দেশ্যে বিব্রত ঔরঙ্গজেব মেবারের সঙ্গে সন্ধির ব্যাপারে উদ্যোগী হন। ইতিমধ্যে মেবার-রাজ রাজসিংহের মৃত্যুর পর (২২শে অক্টোবর,১৬৮০ খ্রিঃ) তাঁর পুত্র জয়সিংহ মেবারের সিংহাসনে বসেন।
  • (২) জয়সিংহও এই সংগ্রামের অবসান চাইছিলেন, কারণ দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধের ফলে মেবারের কৃষি-উৎপাদন ব্যাহত হওয়ায় সেখানে প্রবল খাদ্যাভাব দেখা দেয়। এছাড়া, এই সময় তাঁর সামরিক বলও কমে এসেছিল।
  • (৩) এই অবস্থায় জয়সিংহ মোগল সেনাপতি শাহজাদা আজমের সঙ্গে সাক্ষাৎ করে এক শান্তিচুক্তি স্বাক্ষর করেন (১৪ই জুন, ১৬৮১ খ্রিঃ)।

মেবারের সাথে ঔরঙ্গজেবের সন্ধির শর্ত

এই সন্ধি চুক্তির শর্তানুসারে,

  • (১) মোগল সেনাবাহিনী মেবার ত্যাগ করে।
  • (২) জয়সিংহ মেবারের ‘রানা’ বলে স্বীকৃতি পান এবং তাঁকে পাঁচ হাজারি মনসবদারের পদ দেওয়া হয়।
  • (৩) মেবার থেকে ‘জিজিয়া কর’ প্রত্যাহৃত হয় এবং এর বিনিময়ে জয়সিংহ তিনটি পরগণা মোগলদের ছেড়ে দেন।
  • (৪) যুদ্ধের ক্ষতিপূরণ বাবদ তিনি মোগলদের তিন লক্ষ টাকা দিতে সম্মত হন।
  • (৫) স্থির হয় যে, তিনি কোনও বিদ্রোহী রাঠোরকে কোনও প্রকার সাহায্য বা আশ্রয় দেবেন না।
  • (৬) চিতোর দুর্গের মেরামত বা সংস্কার করতে পারবেন না।

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির প্রসঙ্গে মারওয়াড়ের সঙ্গে সন্ধি

  • (১) মেবার মোগলদের সঙ্গে শান্তিচুক্তিতে আবদ্ধ হলেও মারওয়াড় কিন্তু তার সংগ্রাম অব্যাহত রাখে। মেবারের সঙ্গে শাস্তি স্থাপন করে বিদ্রোহী পুত্র আকবর এবং মারাঠাদের দমনের জন্য ১৬৮১ খ্রিস্টাব্দে ঔরঙ্গজেব দাক্ষিণাত্যে রওনা হন।
  • (২) তাঁর পক্ষে আর উত্তর ভারতে ফেরা সম্ভব হয় নি —সেখানেই তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (১৭০৭ খ্রিঃ)।
  • (৩) পরবর্তী মোগল বাদশা প্রথম বাহাদুর শাহ ১৭০৯ খ্রিস্টাব্দে এক চুক্তির দ্বারা অজিত সিংহকে মারওয়াড়ের রানা বলে মেনে নেন। এর ফলে ত্রিশ বৎসরব্যাপী মোগল-মারওয়াড় সংঘর্ষের অবসান ঘটে।

ঔরঙ্গজেব-রাজপুত সম্পর্কের নতুন ব্যাখ্যা

সাম্প্রতিককালে ঐতিহাসিকরা স্যার যদুনাথ সরকার, ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ, ডঃ শ্রীবাস্তব প্রমুখ প্রদত্ত ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ধর্মীয় ব্যাখ্যা মানতে রাজি নন। এ সম্পর্কে তাঁরা বেশ কিছু রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারণের উল্লেখ করেছেন। যেমন –

  • (১) ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালের প্রথম কুড়ি বছর তাঁর রাজপুত বিরোধিতার কোনও নজির নেই। তাঁর রাজত্বকালের প্রথম দু’বছরে নতুন ‘মনসবের’ ১৯ শতাংশ দেওয়া হয় রাজপুতদের—অন্য কোনও ভারতীয় জাতিগোষ্ঠী এত পদ পায় নি।
  • (২) শাহজাহানের রাজত্বকালে কোনও রাজপুত সাত হাজার ‘মনসব’ পান নি। ঔরঙ্গজেবের রাজত্বকালে জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহ সাত হাজার ‘মনসব’ পদে উন্নীত হন।
  • (৩) স্যার যদুনাথ ও তাঁর অনুগামী ঐতিহাসিকরা বলেন যে জয়সিংহ ও যশোবন্ত সিংহকে বিষ প্রয়োগে হত্যা করা হয়েছিল। সাম্প্রতিক গবেষণায় প্রমাণিত হয়েছে যে, তাঁদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয় এবং তাঁরা উভয়েই ছিলেন ঔরঙ্গজেবের আস্থাভাজন।
  • (৪) অধ্যাপক আতাহার আলি রাজপুত বিদ্রোহের চরিত্র বিশ্লেষণ করে দেখিয়েছেন যে, এই বিদ্রোহটি কখনোই রাজপুতদের ‘জাতীয় বিদ্রোহ’ নয়। মেবার ও মারওয়াড় ছাড়া অপর কোনও রাজপুত রাজ্য এই বিদ্রোহে যোগ দেয় নি।
  • (৫) এই বিদ্রোহ ছিল মূলত রাঠোর ও শিশোদিয় গোষ্ঠীর বিদ্রোহ। কুছওয়া, হাড়া, ভাটি বা বিকানীরের রাঠোররা মোগলদের প্রতি অনুগতই ছিল। এদের মধ্যে অনেকে আবার বিদ্রোহ দমনে মোগলদের সাহায্য করেছে।
  • (৬) অম্বরের বিষেণ সিংহ, বিকানীরের অনুপ সিংহ, বুন্দির অনিরুদ্ধ কিশোর সিংহ প্রমুখ সেনাপতিরা ঔরঙ্গজেবের অধীনে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হন। সুতরাং মেবার-মারওয়াড়ের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে ঔরঙ্গজেব রাজপুত মিত্রতা নীতি ত্যাগ করেন এ বক্তব্য সঠিক নয়।
  • (৭) ডঃ আতাহার আলি বলেন যে, মোগল আইন অনুসারে কোনও ‘মনসব’ অপুত্রক অবস্থায় মারা গেলে তাঁর রাজ্য (‘ওয়াতন’) মোগল সাম্রাজ্যভুক্ত (‘খালিসা’) হত। মোগল আইনে কোনও ‘ওয়াতন’-এর অধিকার নারী বা ভৃত্যের ওপর বর্তায় না। এই দিক থেকে মারওয়াড় দখল করে ঔরঙ্গজেব কোনও অন্যায় করেন নি। এছাড়া, যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর জামরুদে অবস্থানরত রাঠোর সর্দাররা এই ব্যবস্থা মেনে নিয়েছিলেন।
  • (৮) যশোবন্ত সিংহের মৃত্যুর পর ঔরঙ্গজেব যখন জানলেন যে, তাঁর দুই পত্নী সন্তানসম্ভবা তখন তিনি কিছুদিন অপেক্ষা করেন এবং তাঁর যথার্থ উত্তরাধিকারীকেই ‘মনসব’ হিসেবে মেনে নিতে চান। পরে অবশ্য তিনি ৩৬ লক্ষ টাকা ‘পেশকশ’-এর বিনিময়ে ইন্দর সিংহকে রানা বলে মেনে নেন।
  • (৯) ডঃ আতাহার আলি -র মতে মেবার ও মারওয়াড়ের সঙ্গে ঔরঙ্গজেবের বিরোধের মূল কারণ হল রাজপুত সর্দারদের মধ্যে অন্তর্দ্বন্দ্ব। এই দ্বন্দ্বে ঔরঙ্গজেব হস্তক্ষেপ করলে তা মোগল-রাজপুত দ্বন্দ্বে পরিণত হয়।
  • (১০) যশোবন্ত সিংহ ও তাঁর অগ্রজ অমর সিংহের পরিবারের মধ্যে তীব্র দ্বন্দ্ব ছিল। যশোবন্ত সিংহের সমর্থকরা অমর সিংহের পৌত্র ইন্দর সিংহকে মেনে নিতে রাজি ছিল না।
  • (১১) ইন্দর সিংহের নিয়োগে মৃত যশোবন্ত সিংহের প্রধান মহিষী রানি হরি ও তাঁর অনুগামীরা মনে করেন যে, এর চেয়ে মারওয়াড়কে ‘খালিসার’অন্তর্ভুক্ত করা ভালো ছিল।
  • (১২) তাঁরা যোধপুরের মোগল প্রশাসকের কাছে এই মর্মে আবেদন জানান যে, অজিত সিংহকে মেনে নিলে তাঁরা নিজেরাই মারওয়াড়ের সব দেবমন্দির ভেঙ্গে ফেলবেন এবং ‘জিজিয়া করও দেবেন। বলা বাহুল্য, ইন্দর সিংহ কিন্তু এ ধরনের কোনও প্রস্তাব দেন নি।
  • (১৩) তাহলে দেখা যায় যে, অজিত সিংহকে সিংহাসনে বসালেই ঔরঙ্গজেবের ধর্মীয় আদর্শ বাস্তবায়িত হত। সুতরাং নিছক ধর্মীয় কারণে ঔরঙ্গজেব মারওয়াড়ে হস্তক্ষেপ করেন এই বক্তব্য যুক্তিগ্রাহ্য নয়।
  • (১৪) তাহলে ঔরঙ্গজেব ইন্দর সিংহকে পছন্দ করলেন কেন? স্যার যদুনাথ-এর মতে ইন্দর সিংহ অযোগ্য ছিলেন। এই বক্তব্য সঠিক নয়, কারণ তাঁর নিয়োগকালে ইন্দর সিংহ এক হাজারি মনসবদার ছিলেন এবং দাক্ষিণাত্যে যথেষ্ট দক্ষতার সঙ্গে কাজ করেছিলেন।
  • (১৫) অজিত সিংহ ছিলেন শিশু। মারওয়াড়ের মতো একটি গুরুত্বপূর্ণ রাজ্যে ঔরঙ্গজেব একজন দক্ষ লোকই চেয়েছিলেন। সুতরাং ধর্মনীতি নয়—রাজনৈতিক উদ্দেশ্যেই ঔরঙ্গজেব তাঁর রাজপুত নীতি পরিচালিত করেন।

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলাফল

ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি সম্পূর্ণভাবে ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়। স্যার যদুনাথ সরকার তাঁর রাজপুত নীতিকে ‘চূড়ান্ত রাজনৈতিক অজ্ঞতা’ (‘height of political unwisdom’) বলে অভিহিত করেছেন। তাঁর মতে এই যুদ্ধের ফল ছিল‘বিপর্যয়কারী’ (‘disastrous’)।

(১) ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলে প্রাণ ও অর্থ বিনষ্ট

এই যুদ্ধের ফলে রাজপুতানার মরুভূমিতে হাজার হাজার প্রাণ বিনা কারণে বলি যায় এবং সাম্রাজ্যের প্রচুর অর্থ বিনষ্ট হয়, যা প্রজা-কল্যাণে ব্যয় করা যেত।

(২) ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলে মোগল-গরিমা ম্লান

এই যুদ্ধ মোগল-মহিমার ওপর প্রচণ্ড আঘাত হানে। মারওয়াড়ের মরুভূমি ও মেবারের গিরিকন্দরে মোগল-গরিমা ম্লান হয়ে যায়। এতদিন পর্যন্ত ধারণা ছিল যে, মোগল শক্তি অপরাজেয়। রাজপুত-যুদ্ধ এই ধারণায় পরিবর্তন ঘটায়।

(৩) ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলে অর্থ ও জনসম্পদের নির্গমন

ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন যে, রাজপুত যুদ্ধ সাম্রাজ্যের অর্থ ও জন সম্পদের নির্গমন ঘটায় এবং সমগ্র হিন্দুস্থানে মোগল-মহিমার বিনষ্টি সাধন করে।

(৪) ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফল সম্পর্কে যদুনাথ সরকারের অভিমত

ঐতিহাসিক স্যার যদুনাথ সরকার বলেন যে, “ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতির ফলে কেবলমাত্র সাম্রাজ্যের রাজনৈতিক মর্যাদাই ক্ষুণ্ণ হয় নি, সাম্রাজ্যের বস্তুগত প্রতিক্রিয়াও ছিল মারাত্মক।”

(৫) রাজপুতরা ঔরঙ্গজেবের শত্রুতে পরিণত

মহামতি আকবরের আমলে রাজপুতরা ছিল সাম্রাজ্যের স্তম্ভ-স্বরূপ। ঔরঙ্গজেব তাঁর ভ্রান্ত নীতির দ্বারা তাদের শত্রুতে পরিণত করেন।

(৬) রাজপুতদের সাহায্য লাভে বঞ্চিত ঔরঙ্গজেব

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাঠান এবং দক্ষিণ ভারতে মারাঠাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে রাজপুতদের সাহায্য একান্ত প্রয়োজনীয় ছিল। ঔরঙ্গজেব তাঁর অদূরদর্শী নীতির ফলে সেই সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন এবং এর ফলে সাম্রাজ্যের পতন ত্বরান্বিত হয়।

উপসংহার :- রাজপুত যুদ্ধের ফলে মোগল সাম্রাজ্য প্রবল আর্থিক ক্ষতির সম্মুখীন হয়। রাজপুতানা থেকে রাজস্ব সংগ্রহ হ্রাস পাওয়ায় এবং রাজপুতানার মধ্য দিয়ে বাণিজ্য চলাচল বন্ধ হওয়ায় রাজকোষে বিপুল পরিমাণ অর্থের ঘাটতি পড়ে। এই আর্থিক সংকট মোগল সাম্রাজ্যের পতনকে ত্বরান্বিত করে।

(FAQ) ঔরঙ্গজেবের রাজপুত নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. শিবাজির বিরুদ্ধে যুদ্ধে মোগল সেনাপতি কে ছিলেন?

জয়সিংহ।

২. ঔরঙ্গজেব রাজপুতদের সাথে কী ধরনের নীতি গ্রহণ করেন?

অনুদার বা আক্রমণাত্মক নীতি।

৩. কখন কোথায় ঔরঙ্গজেবের মৃত্যু হয়?

১৭০৭ খ্রিস্টাব্দে দাক্ষিণাত্যে।

Leave a Comment