ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ক্ষেত্রে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণের কারণ, ইউসুফজাই উপজাতির বিদ্রোহ, আফ্রিদি উপজাতির বিদ্রোহ, খটক উপজাতির বিদ্রোহ, ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতির ফলাফল হিসেবে অর্থ ও সেনা হ্রাস, মোগল মর্যাদায় আঘাত, সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত, সাহায্য থেকে বঞ্চিত ও দাক্ষিণাত্যে মোগল শক্তির দুর্বলতা সম্পর্কে জানবো।

ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি প্রসঙ্গে উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতির আলোচনা, ঔরঙ্গজেবের আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ, মোগলদের বিরুদ্ধে ইউসুফজাই বিদ্রোহ, মোগলদের বিরুদ্ধে আফ্রিদি ও খটক উপজাতির বিদ্রোহ ও ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতির ফলাফল সম্পর্কে জানব।

ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি (North-West Frontier Policy)

ঐতিহাসিক ঘটনাঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি
রাজত্বকাল১৬৫৮-১৭০৭ খ্রিস্টাব্দ
ইউসুফজাই বিদ্রোহ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দ
আফ্রিদি উপজাতির বিদ্রোহ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দ
ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি

ভূমিকা :- ভারত-এর উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে পাঞ্জাব থেকে কাবুল পর্যন্ত বিস্তৃত অঞ্চলে ইউসুফজাই, আফ্রিদি, খটক প্রভৃতি দুর্ধর্ষ, হিংস্র ও স্বাধীনতা-প্রিয় আফগান উপজাতিরা বাস করত। তাদের মধ্যে গোষ্ঠী-স্বাতন্ত্র্য ছিল প্রবল এবং তারা কখনোই মোগলদের বশ্যতা স্বীকারে রাজি ছিল না।

আক্রমণাত্মক নীতি গ্ৰহণ

মোগল সম্রাট ঔরঙ্গজেব উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণ করেন। এর কারণ গুলি হল –

  • (১) অনুর্বর ও রুক্ষ পার্বত্য এলাকায় জীবনধারণের অন্য কোনও সুযোগ না থাকায় তারা সন্নিহিত শহর ও গ্রামগুলির ওপর লুঠতরাজ চালাত এবং গিরিপথে চলাচলকারী বণিকদের পণ্যসম্ভার লুঠ করত।
  • (২) অস্ত্রবলে তাদের দমন করা সহজসাধ্য নয় জেনে ঔরঙ্গজেব তাদের বাৎসরিক বৃত্তি ও ভাতা দিয়ে বশ করার চেষ্টা করেন—এমনকী ভারত ও কাবুলের মধ্যবর্তী অঞ্চলে তাদের শুল্ক আদায়ের অধিকারও দেওয়া হয়।
  • (৩) কিন্তু এ সব সত্ত্বেও তাদের লুন্ঠন অব্যাহত থাকে। এই অবস্থায় ঔরঙ্গজেব তাদের বিরুদ্ধে আক্রমণাত্মক নীতি গ্রহণে বাধ্য হন।

ইউসুফজাই বিদ্রোহ

  • (১) ১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে জনৈক ভাও-র নেতৃত্বে প্রায় পাঁচ হাজার ইউসুফজাই মোগলদের বিরুদ্ধে অভিযান শুরু করে এবং হাজারা, আটক ও পেশোয়ারে ব্যাপক লুঠতরাজ শুরু করে।
  • (২) তাদের তাণ্ডবে দিল্লি ও কাবুল এবং কাবুল ও কাশ্মীরের মধ্যে যোগাযোগ ছিন্ন হয়ে যায় এবং এই পথে সব ব্যবসা-বাণিজ্য বন্ধ হয়ে যায়।
  • (৩) মোগল সেনাপতি মহম্মদ আমিন খাঁ পর পর কয়েকবার আক্রমণ চালিয়ে এই বিদ্রোহ দমন করেন।

আফ্রিদি ও খটক উপজাতির বিদ্রোহ

  • (১) কয়েক বছর পর ১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে আজমল খাঁ-র নেতৃত্বে আফ্রিদি উপজাতি বিদ্রোহ ঘোষণা করে। তিনি নিজেকে স্বাধীন ‘সুলতান’ বলে ঘোষণা করে মোগলদের বিরুদ্ধে ‘পবিত্র ধর্মযুদ্ধ’ শুরু করেন।
  • (২) ‘আলি মসজিদের যুদ্ধে’ মহম্মদ আমিন খাঁ পরাজিত হনএবং মোগল বাহিনীর প্রভূত ক্ষয়-ক্ষতি হয়। এর ফলে আটক থেকে কান্দাহারের মধ্যবর্তী স্থলে সমগ্র আফগান জাতিগোষ্ঠীর মধ্যে এক অভূতপূর্ব জাতীয় চেতনার সঞ্চার হয়।
  • (৩) এই অবস্থায় খটক উপজাতিও আফ্রিদিদের সঙ্গে যোগ দেয়। তাদের নেতা খুশহল ছিলেন কবি ও যোদ্ধা। তাঁর কবিতা ও গান আফগানউপজাতিদের উদ্বুদ্ধ করে।
  • (৪) বিদ্রোহ দমনের জন্য মোগল সাম্রাজ্য-এর প্রথম শ্রেণীর সেনাপতিদের সেখানে পাঠানো হয়। ১৬৭৪ খ্রিস্টাব্দে সেনাপতি সুজায়েত খাঁ বিদ্রোহীদের হাতে নিহত হন।
  • (৫) শেষ পর্যন্ত ঔরঙ্গজেব নিজে এই অঞ্চলে হাসান আবদাল নামক স্থানে উপস্থিত হতে বাধ্য হন (জুন, ১৭৭৪ খ্রিঃ)। বাদশার উপস্থিতি সেনাবাহিনীর মনে উৎসাহের সঞ্চার করে।
  • (৬) কূটনীতির মাধ্যমে এবং ভাতা, জায়গির ও সম্মানজনক চাকরির লোভ দেখিয়ে ঔরঙ্গজেব বহু উপজাতীয় নেতাকে দলে টানেন।
  • (৭) খুশহল কিন্তু যুদ্ধ অব্যাহত রাখেন। শেষ পর্যন্ত পুত্রের বিশ্বাসঘাতকতায় তিনি পরাস্ত হন (১৬৭৫ খ্রিঃ) এবং তাকে গোয়ালিয়র দুর্গে বন্দি করে রাখা হয়।
  • (৮) উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত সমস্যার মোটামুটি সমাধান করে ঔরঙ্গজেব ১৬৭৫ খ্রিস্টাব্দে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করেন এবং মহম্মদ আমিন খাঁ এই অঞ্চলের সুবাদার নিযুক্ত হন।

ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতির ফলাফল

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের যুদ্ধে মোগল বাহিনী জয়যুক্ত হলেও, সাম্রাজ্য-এর পক্ষে তা ছিল যথেষ্ট ক্ষতিকর। এর ফলাফল গুলি হল –

(১) অর্থ ও সেনা হ্রাস

এই যুদ্ধে অংশগ্রহণের ফলে মোগল সেনাবাহিনীর কয়েক সহস্র সৈন্য নিহত হয় এবং যুদ্ধের ব্যয় ও উপজাতীয় নেতাদের উৎকোচ দান করতে গিয়ে মোগল রাজকোষ একরকম শূন্য হয়ে যায়।

(২) মোগল মর্যাদায় আঘাত

১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে আফ্রিদি নেতা আজমল খাঁ-র হাতে মোগল বাহিনীর পরাজয় মোগল মর্যাদায় চরম আঘাত হানে।

(৩) সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত

উত্তর-পশ্চিম সীমান্তের দুর্ধর্ষ উপজাতিরা মোগল সেনাবাহিনীতে কাজ করত। তিক্ত সম্পর্কের ফলে এই স্থান থেকে আর সেনা সংগ্রহ করা মোগলদের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এর ফলে মোগল সেনাবাহিনী ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

(৪) সাহায্য থেকে বঞ্চিত

রাজপুতদের বিরুদ্ধে যুদ্ধে এই আফগান সৈন্যরা অনেক বেশি কার্যকর হতে পারত। কিন্তু ঔরঙ্গজেব তাদের সাহায্য থেকে বঞ্চিত হন।

(৫) দাক্ষিণাত্যে দুর্বল মোগল শক্তি

বিদ্রোহী আফগানদের দমনের জন্য দক্ষিণ ভারতে নিযুক্ত দক্ষ সেনা ও সেনাপতিদের উত্তর-পশ্চিম সীমান্তে স্থানান্তরিত করা হয়। এর ফলে দাক্ষিণাত্যে মোগল শক্তি দুর্বল হয়ে পড়ে এবং শিবাজির পক্ষে গোলকুণ্ডা, বিজাপুর ও কর্ণাটকে আধিপতা স্থাপন সহজতর হয়ে ওঠে।

উপসংহার :- ডঃ যদুনাথ সরকার বলেন যে, “আফগান যুদ্ধ মোগল অর্থনীতির পক্ষে বিপর্যয়কর ছিল এবং এই যুদ্ধের রাজনৈতিক ফল ছিল আরও মারাত্মক।”

(FAQ) ঔরঙ্গজেবের উত্তর পশ্চিম সীমান্ত নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সম্রাট ঔরঙ্গজেব উত্তর পশ্চিম সীমান্তের ক্ষেত্রে কি ধরনের নীতি গ্রহণ করেন?

আক্রমণাত্মক নীতি।

২. ইউসুফজাই উপজাতিরা কখন বিদ্রোহ করে?

১৬৬৭ খ্রিস্টাব্দে।

৩. আফ্রিদি উপজাতিরা কখন বিদ্রোহ করে?

১৬৭২ খ্রিস্টাব্দে।

Leave a Comment