গান্ধার শিল্প

গান্ধার শিল্প প্রসঙ্গে শিল্পের উৎপত্তি, বিতর্ক, গ্ৰীক শিল্পের প্রভাব, গান্ধার শিল্পের বৈশিষ্ট্য, শৈলীর বৈশিষ্ট্য, আঞ্চলিকতা ও সমালোচনা সম্পর্কে জানবো।

গান্ধার শিল্প

ঐতিহাসিক ঘটনাগান্ধার শিল্প
সময়কালকুষাণ সাম্রাজ্য
রাজাকণিষ্ক
রাজধানীপুরুষপুর বা পেশোয়ার
ধর্মবৌদ্ধ ধর্ম
গান্ধার শিল্প

ভূমিকা :- খ্রিস্ট পূর্ব ৫০ থেকে প্রায় ৫০০ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত উত্তর-পশ্চিম ভারত -এ একটি বিশেষ ভাস্কর্যের বিকাশ হয়। এর নাম ছিল গান্ধার শিল্প। ব্যাকট্রীয় যুগ থেকে এই শিল্পের সূচনা হলেও কুষাণ যুগে এই শিল্প বিশেষ পরিণতি পায়।

গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি

  • (১) উত্তর-পশ্চিম ভারত মৌর্য যুগের পর বহুবার বৈদেশিক জাতির দ্বারা অধিকৃত হয়। এর ফলে আগন্তুক বৈদেশিক জাতিগুলির সাংস্কৃতিক প্রভাব কিছুটা এই অঞ্চলে স্থায়িত্ব পায়। এর সঙ্গে ভারতীয় শিল্পরীতির মিশ্রণ ঘটে।
  • (২) ব্যাকট্রীয় গ্রীকগণ যে শিল্পনীতির সূচনা করে তা অজ্ঞাতসারে শক ও কুষাণরাও বহন করে। গ্রীক, শক, কুষাণরা তাদের উত্তরাধিকার সূত্রে প্রাপ্ত শিল্পরীতির সঙ্গে ভারতীয় শিল্পরীতির মিশ্রণ এড়াতে পারেনি। এই মিশ্রণের ফলেই গান্ধার শিল্পের উদ্ভব হয়।

গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি সম্পর্কে বিতর্ক

  • (১) পণ্ডিতদের মধ্যে গান্ধার শিল্পের উৎপত্তি সম্পর্কে বিভিন্ন মত দেখা যায়। কুমার স্বামীর মতে, ভারতীয় বিষয়ে গ্রীক শিল্পরীতির প্রয়োগের ফলে গান্ধার শিল্পের বিকাশ হয়। পার্সি ব্রাউনও একই কথা বলেছেন। এই শিল্পের বিষয়বস্তু হল ভারতীয়, প্রকরণ গ্রীক।
  • (২) অধ্যাপক সরসী কুমার সরস্বতীর মতে, মার্শাল প্রমুখ গন্ধার শিল্পের গ্রীক প্রভাব বড় করে দেখেছেন। গান্ধার শিল্পকে সেই যুগের ঐতিহাসিক পটভূমিকা থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেখা উচিত নয়। ব্যাকট্রীয় শক-কুষাণরা উত্তর-পশ্চিম ভারতে ঢুকার পর ভারতীয় সভ্যতায় প্রভাবিত হন।
  • (৩) তাঁরা ভাগবত ও বৌদ্ধধর্মের দ্বারা প্রভাবিত হন। গান্ধার শিল্প ছিল এই বিবর্তনের অধ্যায়। নিছক গ্রীক শিল্প বলতে যা বুঝায় গান্ধার শিল্প তা ছিল না। ভারতীয় বৌদ্ধধর্ম ও গ্রীক শিল্পরীতির মিলনে গান্ধার শিল্পের উদ্ভব হয়। শক-কুষাণ শিল্পও তাকে প্রভাবিত করে।

ভারতের গান্ধার শিল্পের উপর গ্ৰীক প্রভাব

  • (১) গান্ধার শিল্পের পশ্চাতে ছিল ভারত-রোম বাণিজ্য। প্রাচীন গ্রীক শিল্পের প্রকরণ ভারতীয় বিষয়ে বিশেষত বুদ্ধ মূর্তি নির্মাণে প্রযুক্ত হলে এই শিল্প তার নতুনত্বে সকলকে চমকিত করে। এই শিল্পের আদি নিদর্শন শক-পার্থিয় রাজা প্রথম এ্যাজেসের রাজত্বকালে পাওয়া যায়। সুতরাং খ্রিস্ট পূর্ব প্রথম শতকেই এই শিল্পের বিকাশ ঘটে। তবে কণিষ্কের আমলেই এই শিল্পের পূর্ণ বিকাশ ঘটে।
  • (২) শক ও কুষাণরা ভারতে এসে মহাযান বৌদ্ধধর্ম গ্রহণ করলে তাদের শিল্প-ভাবনায় বৌদ্ধধর্মের প্রভাব অনিবার্যভাবে পড়ে। যেহেতু মহাযান ধর্মে বুদ্ধমূর্তি, বোধিসত্ব, মায়াদেবী প্রভৃতির মূর্তি পুজোর নিয়ম ছিল, সুতরাং গান্ধার-রীতিতে বুদ্ধ, বোধিসত্ব প্রভৃতি মূর্তি নির্মাণ আরম্ভ হয়।

গান্ধার শিল্পের বৈশিষ্ট্য

  • (১) গান্ধার শৈলীর বৈশিষ্ট্য এই ছিল যে, গ্রীক বা রোমক রীতিতে বুদ্ধ, বোধিসত্ত্বের মূর্তি গঠিত হয়। গ্রীক এ্যাপোলো দেবতার অনুকরণে বুদ্ধ মূর্তি তৈরি করা হলেও, এই মূর্তির চক্ষু, ওষ্ঠ, মুখমণ্ডলে ভারতীয় কমনীয়তা বজায় রাখার চেষ্টা করা হয়।
  • (২) গ্রীক শিল্পরীতিতে দেবতার মূর্তিতে পৌরুষ ও তার মাংসপেশী, উন্নত গ্রীবা প্রভৃতি ফুটিয়ে তোলা ছিল প্রধান বৈশিষ্ট্য। বুদ্ধের দৈহিক গঠনের ক্ষেত্রে গ্রীক রীতি অনুসারে কুঞ্চিত কেশ, ঝোলা কান, সিংহ গ্রীবা, উন্নত স্কন্ধদেশ, মাংসপেশী বহুল বাহু দেখা যায়।
  • (৩) এর সঙ্গে যুক্ত হয় ধ্যানী বুদ্ধের ভারতীয় রীতি অনুসারে অর্ধনিলিত অক্ষি, স্মিতহাস্যময় ওষ্ঠ, ভূমিস্পর্শ অথবা বরাভয় মুদ্রা, প্রশান্ত মুখমণ্ডল। গ্রীক দৈহিকতার সঙ্গে যুক্ত হয় ভারতীয় আধ্যাত্মিকতা।

ভারতের গান্ধার শৈলীর বৈশিষ্ট্য

গান্ধার শিল্পশৈলীর কয়েকটি বৈশিষ্ট্য হল –

  • (১) পাথর, চূণ, বালি বা প্লাষ্টার অফ প্যারিস, পোড়ামাটি ও মাটি নিয়ে মূর্তি গঠন।
  • (২) মূর্তিগুলির উপর সোনালী বা অন্য রং-এর গাঢ় বৈশিষ্ট্য প্রলেপ দান।
  • (৩) কখনও কখনও মূর্তিগুলিতে স্থানীয় বৈশিষ্ট্য দানের জন্য গোঁফ বা পাগড়ী পরান হত। এমনকি গুম্ফ সমন্বিত বুদ্ধমূর্তিও নির্মিত হয়।
  • (৪) যক্ষ, গরুড় প্রভৃতির মূর্তি গ্রীক দেবতা জিউস, ব্যাকাস প্রভৃতির অনুকরণে তৈরি করা হয়।

গান্ধার শিল্পে আঞ্চলিকতা

  • (১) বিমারান অঞ্চলে পাওয়া বৌদ্ধ মূর্তিগুলির বৈশিষ্ট্য হল কাঁধের উত্তরীয় প্রভৃতি দেহ হতে স্বতন্ত্রভাবে দেখান হয়েছে। উত্তরীয়ের নীচে দেহের অংশ প্রস্ফুটিত। উত্তরীয়ের ভাঁজগুলি আন্দোলিত।
  • (২) উত্তর-পশ্চিম ভারতের চরসন্দা অঞ্চলে যে মূর্তিগুলি পাওয়া যায় তাতে উত্তরীয় ও বসনকে স্বচ্ছ দেখাবার চেষ্টা করা হয়েছে।
  • (৩) কুষাণ যুগের মূর্তিগুলিতে উত্তরীয়গুলি খাটো এবং মূর্তিগুলির আকৃতি ছোট ও পালিশ বেশ খারাপ।
  • (৪) চতুর্থ খ্রিস্টাব্দ থেকে যে সকল মূর্তি গঠিত হয় সেগুলিতে খাবার শৈল্পিক উন্নতি লক্ষ্য করা যায়।

ভারতের গান্ধার শিল্পের সমালোচনা

  • (১) স্যার জন মার্শালের মতে, বুদ্ধ মূর্তির চাহিদা বৃদ্ধির ফলে মূর্তিগুলির শিল্পরুচির উন্নতি না করে যান্ত্রিকভাবে তৈরির ব্যবস্থা করা হয়। এর ফলে মূর্তিগুলিতে শিল্পীর ব্যক্তিগত শিল্পভাবনা প্রতিফলিত হয় নি। মূর্তিগুলি অনেকটা ছাঁচে ঢালা হয়ে যায়।
  • (২) মার্শালের মতে, ভারতে গান্ধার শিল্প কোনো স্থায়ী প্রভাব রাখতে পারেনি। কারণ ভারতবাসীর কাছে মূর্তির দৈহিক সৌন্দর্য অপেক্ষা আধ্যাত্মিক আবেদন অনেক বেশী গ্রহণীয়। সুতরাং মার্শালের মতে, গান্ধার শিল্প ছিল অনুকরণের অনুকরণ। অর্থাৎ রোমের শিল্পের ওপর যে প্রাচীন গ্রীক প্রভাব ছিল তা অনুকরণ করে রোমের উপনিবেশগুলি। গান্ধার শিল্প ছিল সেই ঔপনিবেশিক শিল্পের অনুকরণ।
  • (৩) এই কারণে ভারতের মূল শিল্পের ওপর তা কোনো ছাপ ফেলতে পারেনি। এই শিল্প ছিল ভারহুত ও সাঁচির শিল্প অপেক্ষা অনেক নিকৃষ্ট। এই শিল্প ছিল যান্ত্রিক, একঘেয়েমিতে আক্রান্ত। এতে কোনো বৈচিত্র্য ছিল না।

উপসংহার :- পাশ্চাত্য শিল্পরীতির অনুরাগী ব্যক্তিরা বলেন যে, গান্ধার শিল্প ছিল প্রথম সার্থক ভারতীয় শিল্প। ভারতীয় বিষয়বস্তুতে পাশ্চাত্য রীতি প্রয়োগের পরীক্ষা গন্ধার শিল্পে প্রত্যক্ষ করা যায়।

(FAQ) গান্ধার শিল্প সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. গান্ধার শিল্প কোন সময়ে বিকাশ লাভ করে?

কুষাণ যুগে।

২. গান্ধার শিল্পের প্রধান কেন্দ্র কোথায় ছিল?

তক্ষশীলা

৩. গান্ধার শিল্পে কোন কোন রীতির মিশ্রণ ঘটেছে?

গ্ৰীক ও ভারতীয়।

৪. কে বলেছেন গান্ধার শিল্প ছিল অনুকরণের অনুকরণ?

স্যার জন মার্শাল।

Leave a Comment