আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ

আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ প্রসঙ্গে বিরাট সেনাদল পোষণ, মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি, ভবিষ্যত চিন্তা, মন্ত্রীদের পরামর্শ, সামরিক বাহিনীর স্বার্থ, সামরিক প্রয়োজন, ফিরিস্তার অভিমত, সুফি লেখকদের মত ও তার সমালোচনা, জরুরি অবস্থায় সরবরাহ রক্ষা, ন্যায্য হারে মূল্য স্থির, মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধ সম্পর্কে জানবো।

আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ

ঐতিহাসিক ঘটনাবাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ
প্রবর্তকআলাউদ্দিন খলজি
উদ্দেশ্যবিরাট সেনাদল পোষণ
চিতোর -এর যুদ্ধ১৩০৩ খ্রি:
সুফী লেখকনাসিরুদ্দিন চিরাগ
আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ

ভূমিকা :- আধুনিক জার্মানির নির্মাতা বিসমার্ক -এর মতো আলাউদ্দিনেরও বিশ্বাস ছিল, যে কোনো সমস্যার সমাধান করতে পারে একমাত্র তলোয়ার। এই বিশ্বাসেই তিনি বিশাল এক স্থায়ী সেনাবাহিনী গঠন করেন। জিয়াউদ্দিন বরণীর মতে, অল্প বেতনে এই বিশাল সেনা পালনের উদ্দেশ্যই ছিল আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ -এর প্রেরণা।

আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা প্রবর্তনের পশ্চাতে বিভিন্ন উদ্দেশ্য বা কারণ ছিল। এক্ষেত্রে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ও পণ্ডিত তাদের নিজস্ব মতামত দিয়েছেন।

বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে বরণির ব্যাখ্যা

জিয়াউদ্দিন বরণীর রচনা থেকে জানা যায় যে,

(১) বিরাট সেনাদল পোষণ

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন একাধারে চিতোর-এর যুদ্ধ ও মোঙ্গল আক্রমণের সম্মুখীন হন। যদিও তিনি নিজ বাহুবলে এই সংকট থেকে পরিত্রাণ পান, কিন্তু ভবিষ্যতে মোঙ্গল আক্রমণ এবং রাজ্যজয়ের জন্য আলাউদ্দিনকে বিরাট সেনাদল রাখতে হয়।

(২) মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধি

আলাউদ্দিনের রাজ্যজয় এবং বিজিত অঞ্চল থেকে সম্পদ লুণ্ঠনের ফলে রাজধানী দিল্লী ও সন্নিহিত অঞ্চলে বাজারে প্রচুর মুদ্রার আমদানী হয়। বাজারে মুদ্রার পরিমাণ বাড়ায় জিনিষ পত্রের দর দাম বৃদ্ধি পায়। তিনি সেনাদের যে হারে বেতন দিতেন তার দ্বারা তার সেনাদলের ও কর্মচারীদের পক্ষে দ্রব্যমূল্য বাড়ায় জীবনধারণ দুস্কর হয়।

(৩) ভবিষ্যত চিন্তা

যদিও তিনি ভূমি রাজস্বের হার বাড়ান এবং দেবগিরি হতে বহু অর্থ আনেন, হিসেব করে দেখা যায় যে ৫/৬ বৎসরের মধ্যে বাড়তি খরচ মেটাতে এই সকল অর্থ নিঃশেষ হয়ে যাবে। এমতাবস্থায় তিনি বিশ্বাসভাজন মন্ত্রীদের পরামর্শ নেন।

(৪) মন্ত্রীদের পরামর্শ

তার মন্ত্রীরা বলেন যে, যদি আলাউদ্দিন বেতন না বাড়িয়ে, জিনিষপত্রের দাম নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারেন তবে তার সরকারের বর্তমান আয় অনুসারে সেনাদলের প্রতি সেনাকে বছরে ২৩৪ টঙ্কা হারে বেতন দিলেই চলবে। জিনিষপত্রের দাম কম থাকলে এই টাকায় সেনাদল তাদের জীবনযাত্রার ব্যয় নির্বাহ করতে পারবে।

(৫) সামরিক বাহিনীর স্বার্থ

বরণীর মতে, সামরিক বাহিনীর স্বার্থেই সুলতান মূল্য নিয়ন্ত্রণ চালু করেন। বরণীর মতে এজন্য আলাউদ্দিন নিয়ম করেন যে, একটি অশ্বযুক্ত এক অশ্বারোহী সেনার বেতন হবে বছরে ২৩৪ টঙ্কা। যদি সেই ব্যক্তির একটি অতিরিক্ত অশ্ব থাকে তবে তাকে অতিরিক্ত ৭৮ টঙ্কা দেওয়া হবে। বরণীর এই মতই বেশীর ভাগ ঐতিহাসিক গ্রহণ করেন।

(৬) সামরিক প্রয়োজন

যাই হোক বরণীর মতে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির দ্বারা বাজারে জিনিষ পত্রের দাম কমান হলে এই বেতন দ্বারা আলাউদ্দিনের সেনা ও কর্মচারীরা জীবিকা নির্বাহ করতে পারে। সামরিক প্রয়োজনই ছিল আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির উদ্দেশ্য।

বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে ফিরিস্তার অভিমত

  • (১) ফিরিস্তার মতে আলাউদ্দিনকে প্রায় ৫০ হাজার ক্রীতদাস কর্মচারীর ভরণ-পোষণ করতে হত। ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দের পর আলাউদ্দিন বেশ কয়েকটি ব্যয়বহুল প্রাসাদ তৈরি করেন। এই সকল কারণে তার বিরাট পরিমাণ অর্থের দরকার হয়।
  • (২) তবে ফিরিস্তার বিবরণ থেকে জানা যায় যে আলাউদ্দিন পদাতিক সেনার বাৎসরিক বেতন ৭৮ টঙ্কা ধার্য করেন। সরকার থেকে অশ্বারোহী সেনাকে একটি ঘোড়া দিলে সেই অশ্বারোহীর বেতন হয় ১৫৬ টঙ্কা। যদি সেই ব্যক্তি আরও একটি ঘোড়া নিজে আনে তবে আরও ৭৮ টঙ্কা। মোট ২৩৪ টঙ্কা সেক্ষেত্রে বেতন হয়।

বাজার দর নিয়ন্ত্রণ সম্পর্কে সুফী লেখকের ব্যাখ্যা

এক্ষেত্রে বিভিন্ন মতামত হল –

(১) চিরাগের অভিমত

  • (ক) সুফী সন্ত শেখ নাসিরুদ্দিন চিরাগ তার খয়ের-উল-মজলিসে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক দ্বিতীয় ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলাউদ্দিন মনে করতেন যে, জনসাধারণ হল খালক-ই-খুদাই। জনসাধারণের স্বার্থরক্ষা ছিল তার ব্রত।
  • (খ) তিনি মনে করতেন যে, ন্যায্য অথবা নিম্ন দামে প্রয়োজনীয় দ্রব্যসম্ভার জনসাধারণকে সরবরাহ করতে পারলে তার নৈতিক কর্তব্য পালন করা হবে। এই উদ্দেশ্য পূরণের জন্যই তিনি মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।

(২) আমীর খসরুর অভিমত

আমীর খসরু তার রচনা খাজাইন-উল-ফুতুহাতেও মোটামুটি একই অভিমত দিয়েছেন। তার মতে “জাহাঙ্গীর” বা রাজ্যবিজেতা অপেক্ষা “জাহান্দার” বা কল্যাণকামী প্রশাসক শ্রেষ্ঠ। আলাউদ্দিনের দ্বিতীয় ভূমিকার তিনি প্রশংসা করেছেন। এই ভূমিকার মধ্যে ছিল জনসাধারণের জন্য সস্তা দরে খাদ্যশস্য ও অন্যান্য দ্রব্য সরবরাহ।

সুফী লেখকদের মতের সমালোচনা

আধুনিক গবেষক কে এস লাল বলেন যে সুফী লেখকের এই ব্যাখ্যা খুব নির্ভরযোগ্য নয়। কারণ,

  • (১) এই রচনা আলাউদ্দিনের মৃত্যুর ৫০ বৎসর পরে শোনা কথার ওপর নির্ভর করে রচিত হয়। অন্য কোনো সমকালীন লেখক সুফী ব্যাখ্যাকে সমর্থন করে মত প্রকাশ করেননি। তাই তাদের ব্যাখ্যা নির্ভুল তার বলা যায় না।
  • (২) একমাত্র নির্ভরযোগ্য সমকালীন লেখক বরণী মূল্যনিয়ন্ত্রণ নীতির সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। আলাউদ্দিনের স্তুতিবাচনের জন্য তিনি তাঁর রচনা লিপিবদ্ধ করেন। খাজাইন-উল-ফুতুহা আলাউদ্দিনের দরবারে পাঠের উদ্দেশ্যে রচিত হয়। আমীর খসরু ছিলেন আলাউদ্দিনের দরবারী সাহিত্যিক। তিনি খুব নিরপেক্ষ লেখক ছিলেন বলে অনেকে মনে করেন। না।

জরুরি অবস্থায় সরবরাহ রক্ষায় বাজার দর নিয়ন্ত্রণ

ডঃ কে এস লালের মতে আলাউদ্দিনের রাজত্বকাল ছিল যুদ্ধ-বিগ্রহে পূর্ণ। যুদ্ধ-বিগ্রহের জন্য পণ্য চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা খুবই বিপর্যস্ত হত। যেমন –

  • (১) ১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে মালিক তার্ঘি দিল্লী আক্রমণ করলে যমুনা পার হয়ে দিল্লীতে খাদ্য সরবরাহ ব্যবস্থা বিপর্যন্ত হয়। এর ফলে শহরে যে সকল বণিকের গুদামে খাদ্য মজুত থাকত তারা অনেক বেশী দরে খাদ্য বিক্রি করত। যাতে রাজধানীতে এরূপ অবস্থা ভবিষ্যতে না দেখা দেয় এবং বাজার দরের স্বাভাবিক হার বজায় থাকে এই উদ্দেশ্যে আলাউদ্দিন মূল্য নিয়ন্ত্রণ করেন।
  • (২) এজন্য তিনি সরকারী গুদামে খাদ্য মজুত। নিয়মিত পরিমাণে খাদ্য ক্রয়ের ব্যবস্থা এবং নিয়ন্ত্রিত দরে জিনিষপত্র বিক্রয়ের ব্যবস্থা চালু করেন।

ন্যায্য হারে মূল্য স্থিরকরনে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ

ডঃ ইউ এন দে আলাউদ্দিনের মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতির এক স্বতন্ত্র ব্যাখ্যা দিয়েছেন। তাঁর মতে,

  • (১) আলাউদ্দিন সেনাদলকে কম হারে বেতন দিতেন বরণীর এই সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। ষোড়শ শতকে আকবর ২৪০ টঙ্কা এবং শাহজাহান ২০০ টঙ্কা বেতন দিতেন। সেই তুলনায় চতুর্দশ শতকে আলাউদ্দিনের ২৩৪ টঙ্কা বেতনকে কম হার বলা চলে না।
  • (২) আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্য অপেক্ষা কম হারে দ্রব্যমূল্য ধার্য করেন একথাও ঠিক নয়। বরণী স্বীকার করেছেন যে, ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর আমলে খাদ্যদ্রব্যের দাম যা ছিল আলাউদ্দিনের আমলে তাই ছিল।

মূল্যবৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতি রোধে বাজার দর নিয়ন্ত্রণ

  • (১) ডঃ ইউ এন দের মতে, আলাউদ্দিনের আমলে দিল্লী ছিল একটি জনবহুল নগরী। রাজধানীতে সর্বদা একটি শক্তিশালী সেনাদল হাজির থাকত। নানা অঞ্চল থেকে লোকজন রাজধানীতে আসত এবং বাণিজ্য উপলক্ষে বহু বণিক ও নগরে আসত। এর ফলে দিল্লীতে লোকসংখ্যা বৃদ্ধি এবং মুদ্রাস্ফীতি দেখা দেয়।
  • (২) লোকসংখ্যা বৃদ্ধি ও মুদ্রাস্ফীতির জন্য খাদ্য ও অন্যান্য দ্রব্যের দাম বৃদ্ধি পায়। আলাউদ্দিন এই মূল্যবৃদ্ধি রোধ ও জনসাধারণের মধ্যে খাদ্য সরবরাহ অব্যাহত রাখার জন্যই তাঁর মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন। তিনি উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখেই এই মূল্যমান ধার্য করেন।
  • (৩) ডঃ নিজামীও বলেছেন যে, বরণী তারিখ-ই-ফিরোজশাহী গ্রন্থে “বাব-আবাদ” কথাটি ব্যবহার করেছেন যার অর্থ হল উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা। সুতরাং এই সিদ্ধান্তে আসা যায় যে, সামরিক প্রয়োজন এবং মুদ্রাস্ফীতিজনিত মূল্যবৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য আলাউদ্দিন উৎপাদন মূল্যের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিন খলজির মূল্য নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা তিনটি নীতির ওপর প্রতিষ্ঠিত ছিল। – সৈন্য ও কর্মচারীদের ২৩৪ টঙ্কা হারে নির্দিষ্ট বেতন প্রদান, দ্রব্যমূল্য নির্ধারিত মূল্য তালিকার মধ্যে সীমাবদ্ধ রাখা এবং নিয়মিতহারে নির্ধারিত মূল্যে খাদ্যদ্রব্যের যোগান দেওয়া।

(FAQ) আলাউদ্দিন খলজির বাজার দর নিয়ন্ত্রণের কারণ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. কোন সুলতান বাজার দর নিয়ন্ত্রণ চালু করেন?

আলাউদ্দিন খলজি।

২. কোন গ্ৰন্থ থেকে আলাউদ্দিনের বাজার দর নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা সম্পর্কে জানতে পারা যায়?

জিয়াউদ্দিন বরণীর তারিখ-ই-ফিরোজশাহী ও ফুতুহা-ই-জাহান্দারি।

৩. আলাউদ্দিনের সময় চিতোরের যুদ্ধ কখন হয়?

১৩০৩ খ্রিস্টাব্দে।

৪. আলাউদ্দিনের বাজার দর নিয়ন্ত্রণের প্রধান কারণ কি ছিল?

বিরাট সেনাদল পোষণ।

Leave a Comment