আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রসঙ্গে আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী আদর্শ, সিংহাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দান, সুলতানই রাষ্ট্র, অভিজাতদের দমন, স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা, পৃথিবীর প্রভূ, প্রয়োজন ভিত্তিক নিরপেক্ষতা ও সামরিক স্বৈরতন্ত্র সম্পর্কে জানবো।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ঐতিহাসিক ঘটনাআলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
রাজত্ব১২৯৬-১৩১৬ খ্রি:
বংশখলজি বংশ
উপাধিসিকান্দার-ই-সানি
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ভূমিকা :- দিল্লি সুলতানির ইতিহাসে খলজি বংশের শ্রেষ্ঠ সুলতান আলাউদ্দিন খলজি। তিনিই প্রথম দক্ষিণ ভারত -এ অভিযান চালিয়ে প্রচুর ধনরত্ন লুন্ঠন করেন।

আলাউদ্দিনের পূর্ববর্তী আদর্শ

  • (১) আলাউদ্দিন খলজির আগে যে সকল সুলতান দিল্লীর সিংহাসনে বসেন তাদের মধ্যে একমাত্র গিয়াসউদ্দিন বলবন ছাড়া আর কেউ কোনো বিশেষ রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রবর্তনের চেষ্টা করেন নি।
  • (২) বলবন অবশ্য এক স্বৈরাচারী রাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করেন। কিন্তু বলবন সিংহাসনকে কোন আলাদা প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দেওয়ার চেষ্টা না করে সুলতানের ব্যক্তিগত মর্যাদা ও দৈবসত্বের ওপর জোর দেন।

সিংহাসনকে প্রাতিষ্ঠানিক মর্যাদা দান

আলাউদ্দিন প্রথম থেকেই সিংহাসনকে একটি স্বতন্ত্র মর্যাদা ও অধিকারের ওপর স্থাপনের চেষ্টা করেন। তিনি নিজে সীমাহীন স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। সুতরাং সিংহাসনের অধিকারী হিসেবে সুলতানের কেউ বৈধভাবে বিরোধিতা করতে পারে একথা তিনি স্বীকার করতেন না।

সুলতানই রাষ্ট্র

ফ্রান্স -এর রাজা চতুর্দশ লুই যেরূপ রাজার অসীম স্বৈর ক্ষমতার প্রকাশ হিসেবে বলেন “আমি অর্থাৎ রাজাই হল রাষ্ট্র” (I am the state) আলাউদ্দিন খলজীও সেইরূপ মনে করতেন যে, রাষ্ট্রে রাজাই হলেন সকল শক্তির আধার। তাঁকে কোনো পার্থিব শক্তি নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না।

আলাউদ্দিন খলজি কর্তৃক অভিজাতদের দমন

  • (১) সুলতানি ক্ষমতাকে প্রধানত দুটি শক্তি নিয়ন্ত্রণ করত – অভিজাত শ্রেণী ও শরিয়তের ব্যাখ্যাকারী উলেমাশ্রেণী। মালিক ও আমীর উপাধিধারী অভিজাতরা সুলতানি শাসনের কাঠামো ছিল। তারাই শাসনকার্য, সামরিক নেতৃত্ব, রাজস্ব আদায়, বিদ্রোহ দমন প্রভৃতি সকল কাজ করত।
  • (২) ইলতুৎমিস-এর আমলে অভিজাত শ্রেণী সুলতানের সমকক্ষতা দাবী করত। বলবন গুপ্ত হত্যা ও দমননীতির দ্বারা অভিজাত পরিষদ বন্দেগী-ই-চাহালগানীকে দমন করেন। জালালউদ্দিন ফিরোজ খলজি অভিজাতদের ক্ষমতা মোটামুটি বহাল রাখেন।
  • (৩) আলাউদ্দিন তার সিংহাসনের ওপর অভিজাতদের নিয়ন্ত্রণ সহ্য করতে রাজী ছিলেন না। তিনি পুরাতন বা প্রবীণ অভিজাত (Old Aristocracy) যারা জালাউদ্দিনকে ত্যাগ করে অর্থ লোভে তাঁর পক্ষ নিয়েছিল, তাদের একে একে হয় নিহত, নয় পদচ্যুত করেন।
  • (৪) তিনি যে সকল নতুন অভিজাত, দাস কর্মচারী নিয়োগ করেন যথা- আলাপ খান, উজীর সৈয়দ খান, দাস সেনাপতি মালিক কাফুর তাদের সঙ্গে তার নিতান্তই প্রভু ভৃত্য সম্পর্ক ছিল। আলাউদ্দিনের স্বৈর শাসনের প্রভাবে তারা কখনও সুলতানের সঙ্গে ক্ষমতা ভাগ করার কথা ভাবতে পারেনি।

আলাউদ্দিন খলজির স্বৈরতন্ত্র প্রতিষ্ঠা

তিনি নিজ মর্যাদাকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য বলবনের মতই স্বর্গীয় অধিকার দাবী করতেন। তার মতে এই স্বর্গীয় অধিকার বলে সুলতান জাগতিক সকল আইন ও নিয়ন্ত্রণের ঊর্ধ্বে ছিলেন। তিনি বলবনের মত কোনো বংশগত অথবা জাতিগত শ্রেষ্ঠত্ব দাবী করতেন না।

পৃথিবীর প্রভূ আলাউদ্দিন খলজি

যদিও তিনি ইয়ামিন-উল-খিলাফৎ অর্থাৎ খলিফার সহকারী উপাধি নেন, তথাপি তিনি তাঁর পূর্ববর্তী সুলতানদের মত কখনও নিজেকে খলিফার ভৃত্য বলেন নি। রাষ্ট্রের প্রভূ হিসেবে তিনি নিজেকেই গণ্য করতেন। আমীর খসরুর মতে, “আলাউদ্দিন ছিলেন পৃথিবীর প্রভূ বা মালিক।”

প্রয়োজন ভিত্তিক নিরপেক্ষতা

  • (১) ডঃ আর পি ত্রিপাঠী প্রমুখ গবেষকের মতে আলাউদ্দিনকে প্রকৃত ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বলা যায় না। যে অর্থে আকবরকে ধর্মনিরপেক্ষ শাসক বলা যায় সেই অর্থে আলাউদ্দিনকে ধর্মনিরপেক্ষ বলা যায় না। তার ধর্মনিরপেক্ষতা ছিল প্রয়োজনভিত্তিক, আদর্শভিত্তিক নয়।
  • (২) উলেমাদের নিয়ন্ত্রণ হতে তার স্বৈরাচারী ক্ষমতাকে রক্ষা করার জন্যই তিনি উলেমাদের হস্তক্ষেপের বিরোধিতা করেন। তিনি রাষ্ট্র ব্যবস্থাকে ধর্মীয় ব্যবস্থা থেকে স্বতন্ত্র করেন। তার স্বৈরতন্ত্রকে রক্ষার জন্যই তিনি ধর্ম নিরপেক্ষতা নীতি নেন।

সামরিক স্বৈরতন্ত্র

  • (১) আলাউদ্দিন মূলত সামরিক স্বৈরতন্ত্রে বিশ্বাস করতেন। তিনি মনে করতেন যে, যতক্ষণ তার বাহিনী শক্তিশালী ও অনুগত থাকবে ততক্ষণ তাঁর কারও সাহায্যের দরকার নেই। তিনি তাঁর সামরিক ক্ষমতার দাপটে অভিজাত ও উলেমাদের স্তব্ধ করে দেন।
  • (২) তিনি জনকল্যাণমূলক কাজ দ্বারা তার শাসনকে উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্রে পরিণত করার চেষ্টা করেন। যদি সুফী লেখকদের রচনায় বিশ্বাস করা হয় তবে তিনি জনকল্যাণের জন্যই তার মূল্যনিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন।

উপসংহার :- আলাউদ্দিন খলজির স্বৈরতন্ত্র ছিল কঠোর। তিনি কোনো অনুগত দক্ষ প্রশাসন তৈরি করার চেষ্টা করেন নি। তাঁর মৃত্যুর সঙ্গে সঙ্গেই তাঁর স্বৈরতন্ত্র ধ্বংস হয়। কারণ, ডঃ কে কে দত্তের মতে, চোরাবালির ওপরে আলাউদ্দিন তাঁর স্বৈরতান্ত্রিক প্রাসাদ তৈরি করেন।

(FAQ) সুলতান আলাউদ্দিন খলজির রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিন খলজির পূর্বে কে রাজতান্ত্রিক আদর্শ স্থাপনে উদ্যোগী হয়েছিলেন?

গিয়াসউদ্দিন বলবন।

২. মূল্য নিয়ন্ত্রণ নীতি চালু করেন কে?

আলাউদ্দিন খলজি।

৩. দিল্লীর কোন সুলতানের স্বৈরতন্ত্র ছিল কঠোর?

আলাউদ্দিন খলজি।

৪. ইয়ামিন-উল-খিলাফৎ অর্থাৎ খলিফার সহকারী উপাধি নেন কে?

আলাউদ্দিন খলজি।

Leave a Comment