আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান প্রসঙ্গে আলাউদ্দিনের বিরাগভাজন, ইসামির বর্ণনা, নিজামীর মন্তব্য, অভিযানের দায়িত্বে মালিক কাফুর, সুকুমার রায়ের অভিমত, কাফুরের দেবগিরি জয়, ফিরিস্তার বর্ণনা, ভোজসভার আয়োজন, আলাউদ্দিনের উদার ব্যবহার, বৈবাহিক সম্পর্ক, রামচন্দ্রদেবের সক্রিয় সাহায্য ও দেবলাদেবীর উপাখ্যান সম্পর্কে আমরা জানবো।

সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান

বিষয়আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান
সুলতানআলাউদ্দিন খলজি
সময়কাল১৩০৬ খ্রিস্টাব্দ
সেনাপতিমালিক কাফুর
দেবগিরির রাজারামচন্দ্র দেব
সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান

ভূমিকা :- তিনিই প্রথম নরপতি, যিনি দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্য-এর সম্প্রসারণ প্রায় ভারত ব্যাপী ঘটাতে সক্ষম হয়েছিলেন।

আলাউদ্দিনের বিরাগভাজন

দেবগিরির যাদব নরপতি রামচন্দ্রদেব ১২৯৪ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিনকে ইলিচপুর প্রদেশের জন্য বার্ষিক কর দিতে স্বীকৃত হয়েছিলেন। কিন্তু বিগত তিন বছর ধরে প্রতিশ্রুত কর প্রদান করেন নি। উপরন্তু রামচন্দ্রদেব গুজরাটের পরাজিত রাজা কর্ণদেবকে আশ্রয় প্রদান করে তাঁর বিরাগভাজন হয়েছিলেন।

আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান সম্পর্কে ইসামির বর্ণনা

  • (১) ইসামির বর্ণনায় দেখা যায়, রামচন্দ্রদেব গোপনে আলাউদ্দিনের নিকট এক দূত পাঠিয়ে জানিয়েছিলেন যে, কর না দেওয়ার ব্যাপারে তিনি কত অসহায় । তাঁর এই অসহায় অবস্থার কারণ বিশ্লেষণে বলেছেন, “তাঁর পুত্র ভিল্লামা ও রাজ্যের অভিজাতরা সুলতানের প্রতি আনুগত্যে রাজি নয়।”
  • (২) অবশ্য রামচন্দ্রদেব পূর্বপ্রতিশ্রুতি পালনে পূর্ণ আশ্বাস দেন। এই বর্ণনা থেকে ঐতিহাসিক নিজামি ধারণা করেছেন যে, রামচন্দ্রদেব প্রকারান্তরে সুলতানের সেনাবাহিনীকে গোপনে আহ্বান করেছিলেন।

আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান সম্পর্কে নিজামির মন্তব্য

ড. নিজামির মতে, দেবগিরি থেকে বাৎসরিক কর না পাওয়াই ছিল আলাউদ্দিনের এই অভিযানের কারণ।

অভিযানের দায়িত্বে মালিক কাফুর

১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে আলাউদ্দিন মালিক কাফুরকে দেবগিরি অভিযানের প্রধান দায়িত্ব দেন। তাঁর সহকারী নিয়োগ করা হয় খাজা হাজি নামে জনৈক সেনাধ্যক্ষকে এবং মালব ও গুজরাটের শাসনকর্তাকে এই অভিযানে কাফুরকে সাহায্য করার নির্দেশ দেওয়া হয়।

আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান সম্পর্কে সুকুমার রায়ের অভিমত

  • (১) ড. সুকুমার রায় মনে করেন, মালিক কাফুরও তাঁর প্রভুর মতো দেবগিরি অভিযানের মধ্য দিয়েই একদিকে যেমন তাঁর বৈচিত্র্যময় জীবনের অবসান ঘটান, অপরদিকে তেমনি এই সময় থেকেই দিল্লি সুলতানি সাম্রাজ্যের গুরুত্বপূর্ণ ক্ষমতার অধিকারী হন।
  • (২) তিনি এই কথাও বলেছেন যে, দেবগিরি অভিযান থেকে তাঁর মৃত্যু পর্যন্ত দিল্লি সুলতানি যুগের ইতিহাস বলতে মালিক কাফুরেরই ক্ষমতাকে বোঝায়।

কাফুরের দেবগিরি জয়

মালিক কাফুর মালব ও গুজরাটের মধ্য দিয়ে দেবগিরিতে অবতীর্ণ হন। আমির খসরুর বর্ণনা থেকে জানা যায়, দেবগিরি তেমন বাধা দেয় নি। অতি সহজেই দেবগিরি পরাজয় বরণ করে। কাফুর প্রচুর ধনরত্ন লাভ করেন। এই সকল লুণ্ঠিত দ্রব্যসহ রামচন্দ্রদেব দিল্লিতে আনীত হন।

আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান সম্পর্কে ফিরিস্তার বর্ণনা

ফিরিস্তার বর্ণনায় দেখা যায়, রামচন্দ্রদেব বিনা যুদ্ধে আত্মসমর্পণ করেন। ফিরিস্তার বিবরণ যথার্থ বলে মনে হয়। কারণ, আলাউদ্দিনও তাঁর প্রতি দিল্লিতে অত্যন্ত সদয় ব্যবহার করেন এবং ছয় মাস আলাউদ্দিনের অতিথি হিসাবে রামচন্দ্রদেব দিল্লিতে অবস্থান করেন।

ভোজসভার আয়োজন

আলাউদ্দিন রামচন্দ্রদেবের সম্মানে এক ভোজসভার আয়োজন করেন। এই ভোজসভায় আলাউদ্দিন রামচন্দ্রদেবকে ‘রায়-রায়ান’ অর্থাৎ ‘রাজার রাজা’ উপাধিতে ভূষিত করেন এবং নভসরী নামে একটি স্থানকে রামচন্দ্রদেবের রাজ্যের সঙ্গে সংযুক্ত করার নির্দেশ দেন।

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন

তাঁকে সসম্মানে নিজ রাজ্যে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করা হয়। এক লক্ষ টাকা উপহার দেওয়া হয়। রামচন্দ্রদেবও তাঁর কন্যার সঙ্গে আলাউদ্দিনের বিবাহ দেন। রামচন্দ্রদেবের সঙ্গে আলাউদ্দিনের এই বৈবাহিক সম্পর্ক দাক্ষিণাত্য অভিযানে অত্যন্ত সহায়ক হয়েছিল।

আলাউদ্দিনের উদার ব্যবহার

রামচন্দ্রদেবের প্রতি আলাউদ্দিনের উদার ব্যবহারকে আধুনিক অনেক ঐতিহাসিকই ‘A master stroke of diplomacy’ বলে অভিহিত করেছেন। কারণ, এই উদার ব্যবহারই দাক্ষিণাত্য বিজয়ে আলাউদ্দিনের নতুন ক্ষেত্র প্রস্তুত করেছিল।

রামচন্দ্রদেবের সক্রিয় সাহায্য

রামচন্দ্রদেব আলাউদ্দিনের শুধুমাত্র অনুগতই ছিলেন না, তাঁর দাক্ষিণাত্য অভিযানে কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করেছিলেন। রামচন্দ্রদেবের সক্রিয় সাহায্য ব্যতীত আলাউদ্দিনের দাক্ষিণাত্য বিজয় এত সহজ হত না। প্রকৃতপক্ষে দাক্ষিণাত্য অভিযানের সময় কাফুর দেবগিরিকে সামরিক ঘাঁটি হিসাবে ব্যবহার করেছিলেন।

দেবলাদেবীর উপাখ্যান

  • (১) দেবগিরি অভিযানের সময় আর একটি ঘটনা খুবই উল্লেখযোগ্য, তা হল কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবীর উপাখ্যান। দেবলাদেবীর ঘটনা সম্পর্কে অনেক উপাখ্যান প্রচলিত আছে। তবে এর পিছনে ঐতিহাসিক তথ্য কতখানি আছে, তা বলা খুবই শক্ত।
  • (২) উপাখ্যানটি হল দেবগিরি অভিযানের সময় গুজরাটের রাজা কর্ণদেবের কন্যা দেবলাদেবী ধৃত হন ও দিল্লিতে প্রেরিত হন। আলাউদ্দিন তাঁর জ্যেষ্ঠ পুত্র খিজির খানের সঙ্গে দেবলাদেবীর বিবাহ দেন।
  • (৩) এই ঘটনার পিছনে যদি ঐতিহাসিক তথ্য থাকে, তা হলে মধ্যযুগীয় পরিমণ্ডলে আলাউদ্দিনের এই কার্যকলাপ প্রগতিশীল কার্যকলাপ বলেই অনেকে মনে করেন।
  • (৪) ড. সুকুমার রায় মনে করেন, এই বৈবাহিক নীতির মধ্য দিয়ে দাক্ষিণাত্যের শাসককুলের সঙ্গে তাঁর নিবিড় সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ হওয়ার কোনো বাসনা ছিল কিনা, তা নিশ্চিতভাবে কিছু বলা যায় না।

উপসংহার :- দাক্ষিণাত্যে একের পর এক রাজ্য জয় করলেও এটা যথার্থ যে, দাক্ষিণাত্যের শাসকগণের সঙ্গে আলাউদ্দিন খলজি কোনো বৈরী নীতি গ্রহণ করেন নি।

(FAQ) সুলতান আলাউদ্দিন খলজির দেবগিরি অভিযান সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আলাউদ্দিন খলজি দেবগিরি অভিযান করেন কখন?

১৩০৬ খ্রিস্টাব্দে।

২. আলাউদ্দিনের দেবগিরি অভিযানের প্রধান সেনাপতি কে ছিলেন?

মালিক কাফুর।

৩. আলাউদ্দিনের অভিযানের সময় দেবগিরির রাজা কে ছিলেন?

রামচন্দ্রদেব।

৪. দেবগিরি অভিযানের সময় উল্লেখযোগ্য ঘটনা কি ছিল?

দেবলাদেবীর উপাখ্যান।

Leave a Comment