আকবরের রাজপুত নীতি

মোগল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি গ্ৰহণের কারণ, রাজপুতদের সাথে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, রাজপুতদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগ, রাজপুতদের বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান, রাজপুতদের সাথে যুদ্ধ, মোগল সাম্রাজ্যের ওপর ও রাজপুতদের ওপর আকবরের রাজপুত নীতির প্রভাব সম্পর্কে জানবো।

মোগল সম্রাট আকবরের রাজপুত নীতি প্রসঙ্গে অহিংসা উপায়ে শান্তি স্থাপন, মুঘল সাম্রাজ্যের সুদৃঢ় ভিত্তি আকবরের রাজপুত নীতি, বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে সংহতি স্থাপন, আকবর কর্তৃক উদার রাজপুত নীতি গ্রহণ, উদার রাজপুত নীতি গ্রহণের কারণ, আকবরের রাজপুত নীতির পদ্ধতি, আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল ও গুরুত্ব সম্পর্কে জানব।

আকবরের রাজপুত নীতি

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের রাজপুত নীতি
মোগলদের প্রতিদ্বন্দ্বীরাজপুত জাতি
হলদিঘাটের যুদ্ধ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দ
আকবরের রাজপুত সেনাপতিমান সিংহ
আকবরের বশ্যতা স্বীকারে অসম্মতিমেবার
আকবরের রাজপুত নীতি

ভূমিকা :- আকবর -এর রাজপুত নীতি হল এক উচ্চ কূটনৈতিক বিচক্ষণতার পরিচায়ক  এবং তাঁর কূটনৈতিক প্রতিভার শ্রেষ্ঠতম বিকাশ। তিনি স্পষ্টই উপলব্ধি করেন যে, কেবলমাত্র সামরিক শক্তির জোরে কোনও সাম্রাজ্য স্থায়ী হতে পারে না, এর জন্য প্রয়োজন প্রজাপুঞ্জের সক্রিয় সমর্থন।

মোগলদের প্রতিদ্বন্দ্বী রাজপুত জাতি

ভারত-এ মোগল সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার সূচনা-পর্বে ভারতীয় শৌর্য-বীর্যের প্রতীক রাজপুতরা ছিল তাদের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী।

রাজপুত শক্তি

রাজপুত নায়ক সংগ্রাম সিংহ তুর্কো আফগান সাম্রাজ্যের ধ্বংসস্তূপের ওপর একটি হিন্দু সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার স্বপ্ন দেখতেন। ১৫২৭ খ্রিস্টাব্দে খানুয়ার যুদ্ধ -এ পরাজিত হয়ে রাজপুত শক্তি কিছুটা হতোদ্যম হলেও, একেবারে ধ্বংস হয়ে যায় নি।

মোগল সাম্রাজ্যের শক্তিস্তম্ভ রাজপুত জাতি

বিচক্ষণ আকবর তাঁর প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী এই শক্তিশালী জনগোষ্ঠীর সঙ্গে কোনও সংঘর্ষে না গিয়ে তাদের সঙ্গে মৈত্রীর সম্পর্ক স্থাপন করেন এবং শত্রুতার পরিবর্তে রাজপুতরা মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম শক্তিশালী স্তম্ভে পরিণত হয়।

আকবরের উদার রাজপুত নীতি কারণ

সম্রাট আকবরের উদার রাজপুত নীতি গ্রহণের পশ্চাতে বেশ কিছু কারণের উল্লেখ করা যায়।যেমন –

  •  (১) আকবর উপলব্ধি করেন যে, শৌর্য-বীর্য ও সত্যনিষ্ঠায় রাজপুতরা অতুলনীয় এবং ভারতীয় সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণে রাজপুত-মৈত্রী অপরিহার্য।
  • (২) ডঃ পার্সিভ্যাল স্পিয়ার বলেন যে, “ব্রাহ্মণরা যদি হিন্দুধর্মের মানসিক শক্তি হয়, তাহলে রাজপুতরা ছিল তাদের দৈহিক শক্তি।” আকবর সেই দৈহিক শক্তিকে সাম্রাজ্যের স্বার্থে ব্যবহার করতে উদ্যোগী হন।
  • (৩) আফগান শাসকদের পরাজিত করে ভারতে মোগল আধিপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পানিপথের প্রথম যুদ্ধ -এ ও পানিপথের দ্বিতীয় যুদ্ধ -এ আফগানরা পরাজিত হলেও ভারতে তারা একেবারে নির্মূল হয় নি।
  • (৪) বাংলা-বিহার, মালব ও গুজরাটে আফগানরা তখনও যথেষ্ট শক্তিশালী ও সক্রিয়। তখন রাজপুত ও আফগানদের মধ্যে মোগল-বিরোধী এক ঐক্য গড়েউঠেছিল।
  • (৫) তাই আকবর মোগল সাম্রাজ্যের নিরাপত্তার স্বার্থে আফগানদের কোণঠাসা করে রাজপুত-মোগল ঐক্য গড়ে তুলতে উদ্যোগী হন।
  • (৬) আকবর উপলব্ধি করেছিলেন যে, তাঁর স্বজাতীয় সেনাপতি ও ওমরাহদের মধ্যে অনেকেই লোভী, স্বার্থপর ও ভাগ্যান্বেষী। সুযোগ পেলেই তারা যে কোনও সময় বিদ্রোহ ঘোষণা করতে পারে। তাঁর রাজত্বের সূচনা পর্বে তিনি এই ধরনের একাধিক বিদ্রোহের সম্মুখীন হন।
  • (৭) তাই স্বজাতীয়দের ওপর নির্ভর না করে, বরং তাদের ক্ষমতা সংকোচন করা এবং বিদেশি অভিজাতদের মধ্যে ভারসাম্য সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি রাজপুত-আনুগত্যের ওপর নির্ভরশীল হন।
  • (৮) রাজপুতানায় বেশ কিছু স্বাধীন রাজ্যের অস্তিত্ব আকবরের মতো একজন সাম্রাজ্যবাদীর কাছে অমর্যাদাকর ছিল। তিনি এই রাজ্যগুলির আনুগত্য ও রাজস্ব সাম্রাজ্যের স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছিলেন।
  • (৯) পশ্চিম ও দক্ষিণ ভারতে মোগল আধিপত্য বিস্তার করতে গেলে রাজপুতানার ওপর নিয়ন্ত্রণ প্রয়োজন ছিল।
  • (১০) পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অংশের বাণিজ্য চলত রাজপুতানার মধ্য দিয়ে। সুতরাং আর্থিক কারণেও রাজপুত-মৈত্রী আকবরের কাছে অপরিহার্য ছিল।

আকবরের রাজপুত নীতির পদ্ধতি

রাজপুত-মৈত্রী অর্জনের উদ্দেশ্যে আকবর বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। যেমন –

(ক) বৈবাহিক সম্পর্ক

  • (১) তিনি বেশ কয়েকটি রাজপুত রাজপরিবারের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করেন। ১৫৬২ খ্রিস্টাব্দে কুড়ি বছর বয়সে আকবর অম্বর-রাজ বিহারীমলের কন্যা মণিবাঈকে বিবাহ করেন। ইনিই হলেন যুবরাজ সেলিমের (জাহাঙ্গীর ) গর্ভধারিণী।
  • (২) পরবর্তীকালে আকবর বিকানীর (১৫৭০ খ্রিঃ) ও জয়পুরের (১৫৮৪ খ্রিঃ) রাজকন্যাদ্বয়ের পাণিগ্রহণ করেন। কেবলমাত্র এই নয় তিনি নিজ পুত্র সেলিমের সঙ্গে যোধপুর-রাজ উদয় সিংহের কন্যা যোধাবাঈ-এর বিবাহ দেন।
  • (৩) এইভাবে বিবাহনীতির মাধ্যমে আকবর রাজপুতদের দৃঢ় মৈত্রীর বন্ধনে আবদ্ধ করেন এবং এর ফলে রাজপুত মোগল বিরোধের অবসান ঘটে ও তাদের সাহায্যে ভারতে মোগল সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠিত হয়।
  • (৪) ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন যে, “আমাদের দেশের ইতিহাসে এই বৈবাহিক সম্পর্ক অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এই সম্পর্ক বিবাদ ও তিক্ততার অবসান ঘটিয়ে ঐক্য ও শুভেচ্ছার পরিবেশ তৈরি করে।”
  • (৫) ডঃ বেণী প্রসাদ বলেন যে, “এই বিবাহ-সম্পর্ক ভারত ইতিহাসে এক নবযুগের সূচনা করে, দেশে উল্লেখযোগ্য নৃপতি-ধারা সৃষ্টি করে এবং মোগল রাজবংশের চার পুরুষের জন্য মধ্যযুগের শ্রেষ্ঠ সেনাপতি ও কূটনীতিকদের সাহায্য ও সেবালাভ সম্ভব করে তোলে।”

(খ) উচ্চ রাজপদে নিয়োগ

  • (১) সামরিক ও বেসামরিক বিভাগের বিভিন্ন উচ্চপদে রাজপুতদের নিয়োগ করে আকবর তাদের আনুগত্য লাভে সক্ষম হন।
  • (২) ডঃ বেণী প্রসাদ বলেন যে, রাজপুত জাতিকে উপযুক্ত মর্যাদা ও স্বায়ত্বশাসনের অধিকার দিয়ে আকবর তাদের আনুগত্য ও অমূল্য সহযোগিতা লাভে সক্ষম হন।
  • (৩) মুসলিম মনসবদারদের সঙ্গে সমমর্যাদার ভিত্তিতে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে তিনি রাজপুতদের নিয়োগ করেন। সাম্রাজ্যের বিস্তার, শত্রুর মোকাবিলা, নীতিনির্ধারণ ও বিভিন্ন প্রশাসনিক কাজে তাঁদের ভূমিকা ছিল অতি গুরুত্বপূর্ণ।
  • (৪) অম্বর-রাজের সঙ্গে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠার পরেই রাজা বিহারীমল, তাঁর পুত্র ভগবান দাস এবং ভগবান দাসের পালিত পুত্ৰ মানসিংহ মোগল দরবারে মনসবদার নিযুক্ত হন।
  • (৫)মানসিংহ ছিলেন বহুযুদ্ধের সফল নায়ক এবং মোগলদের বিশ্বস্ত সেনাপতি। রাজা টোডরমল ছিলেন দক্ষ প্রশাসক, সেনাপতি ও আকবরের রাজস্ব সচিব।
  • (৬) বিশিষ্ট সংগীতজ্ঞ রাজা বীরবল ছিলেন আকবরের সর্বক্ষণের সঙ্গী। এ ছাড়াও, আকবর বিভিন্ন বিভাগে বহু রাজপুতকে সরকারি চাকরিতে নিয়োগ করেন।

(গ) বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা

রাজপুতদের মন জয় করার উদ্দেশ্যে আকবর তাঁদের এমন কিছু সুযোগ-সুবিধা দান করেছিলেন, যা এতদিন মুসলিম অভিজাতরাই একচেটিয়াভাবে ভোগ করতেন। যেমন –

  • (১) রাজপুত রাজাদের আনুগত্যের বিনিময়ে আকবর তাঁদের স্বাধীনতা মেনে নিয়েছিলেন এবং তাঁদের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে তিনি কোনওপ্রকার হস্তক্ষেপ করতেন না।
  • (২) রাজপুত ও হিন্দু-সমর্থন লাভের উদ্দেশ্যে তিনি যুদ্ধবন্দিদের ক্রীতদাসে পরিণত করার রীতি নিষিদ্ধ করেন, ১৫৬৩ খ্রিস্টাব্দে বার্ষিক দুই কোটি টাকা আয়ের “হিন্দু তীর্থকর এবং ১৫৬৪ খ্রিস্টাব্দে ‘জিজিয়া কর তুলে দেন।
  • (৩) ১৫৬৯ খ্রিস্টাব্দে বুন্দি-রাজের সঙ্গে আকবরের যে চুক্তি সম্পাদিত হয়, তার শর্তগুলিকেই রাজপুতদের সঙ্গে আকবরের সম্পর্কের মাপকাঠি বলা যেতে পারে।
  • (৪) চুক্তির শর্তে বলা হয় যে, বুন্দি-রাজ মোগল হারেমে কন্যা পাঠাতে বাধ্য থাকবেন না, জিজিয়া কর রদ করা হল, রাজপুতদের নিজ রাজ্যসীমার বাইরে যেতে বাধ্য করা হবে না, ‘নওরোজ’ উৎসবে মীনাবাজারে তাঁদের মহিলাদের পসরা নিয়ে বসতে বাধ্য করা হবে না।
  • (৫) ‘দেওয়ান-ই-আম-এ সম্পূর্ণ সশস্ত্র অবস্থায় তাঁদের প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়, হিন্দু মন্দিরের সম্মান রক্ষা করা হবে, এবং রাজপুত অশ্বারোহীদের চিহ্নিতকরণ (‘দাগ’) বন্ধ করা হবে।

(ঘ) যুদ্ধনীতি

অম্বর, যোধপুর, জয়পুর, বিকানির, বুন্দি, কোটা প্রভৃতি রাজপুত রাজ্য বিনা যুদ্ধে তাঁর বশ্যতা স্বীকার করলেও মেবার, রণথম্বোর প্রভৃতি রাজ্যের বিরুদ্ধে তাঁকে যুদ্ধনীতি গ্রহণ করতে হয়।

  • (১) মেবারের রাণা সংগ্রাম সিংহের পুত্র উদয় সিংহ আকবরের বশ্যতা স্বীকারে রাজি ছিলেন না। ১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দে আকবর মেবারের রাজধানী চিতোর অবরোধ করলে তিনি পলায়ন করেন এবং শেষ পর্যন্ত মোগল বাহিনী চিতোর দখল করে (১৫৬৮ খ্রিঃ)।
  • (২) উদয় সিংহের মৃত্যুর পর (১৫৭২ খ্রিঃ) তাঁর বীর পুত্র রাণা প্রতাপ সিংহ মোগলদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেন এবং জীবনের সকল সুখ স্বাচ্ছন্দ্য বিসর্জন দিয়ে চরম কৃচ্ছ সাধনার মধ্য দিয়েও মোগলদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যান।
  • (৩) ১৫৭৬ খ্রিস্টাব্দে হলদিঘাটের যুদ্ধে রাণা প্রতাপ সিংহ পরাজিত হন। অনাহারে-অর্ধাহারে চরম অনিশ্চিতভাবে জীবন যাপন করলেও তিনি মোগলদের বশ্যতা স্বীকার করেন নি।
  • (৪) মৃত্যুর পূর্বে (১৫৯৭ খ্রিঃ) তিনি মেবারের বেশ কিছু অংশ পুনরুদ্ধারের সক্ষম হন। তাঁর পুত্র অমর সিংহ মোগল-বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখেন।
  • (৫) রাজপুত বিদ্রোহের সম্ভাবনা সম্পর্কেও আকবর সর্বদা সজাগ ছিলেন। এই কারণে তিনি রাজপুতানার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দুর্গ দখল করে নেন।
  • (৬) তিনি গুরুত্বপূর্ণ রাজকীয় দায়িত্ব দিয়ে রাজপুত নেতৃবৃন্দকে সাম্রাজ্যের বিভিন্ন প্রান্তে নিয়োগ করতেন। এইভাবে তিনি মোগল সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে রাজপুত বিদ্রোহের সর্বপ্রকার সম্ভাবনাকে বিনষ্ট করতে সচেষ্ট হন।

আকবরের রাজপুত নীতির ফলাফল

ভারতবর্ষের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ইতিহাসে আকবরের রাজপুত নীতির গুরুত্ব অপরিসীম। যেমন –

(ক) মোগল সাম্রাজ্যের ওপর প্রভাব

  • (১) যে রাজপুতরা সাড়ে তিনশ’ বছরেরও বেশি সময়ধরে সুলতানি শাসকদের বিরুদ্ধে বিরামহীন সংগ্রাম চালিয়েছিল, তারাই আকবরের মিত্র হয়ে মোগল সাম্রাজ্যের অন্যতম প্রধান স্তম্ভে পরিণত হয়।
  • (২) রাজপুতদের আনুগত্য লাভের ফলে কেবলমাত্র সাম্রাজ্যের ওপর রাজপুতানাতেই শান্তি প্রতিষ্ঠিত হয় নি, মোগল সাম্রাজ্যের সুদৃঢ়করণ ও বিস্তৃতির পক্ষেও তা যথেষ্ট সহায়ক হয়।
  • (৩) মানসিংহ ও ভগবান দাসের মতো সেনাধ্যক্ষ এবং টোডরমলের মতো প্রশাসক উপহার দিয়ে রাজপুত জাতি মোগল সাম্রাজ্যের ধারক ও বাহক হয়ে ওঠে। এই বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই যে, মানসিংহ ও টোডরমলের মতো প্রতিভাধরদের “প্রবাহের ধারা বন্ধ হওয়াতেই মোগল সাম্রাজ্য ক্রমশ বন্ধ্যা হয়ে যায়।”
  • (৪) ডঃ সতীশ চন্দ্র বলেন যে, হিন্দু-মুসলিম উভয় সম্প্রদায় নিয়ে গঠিত একটি মিশ্র শাসকগোষ্ঠী গঠনের দিক থেকেও এই রাজপুত মৈত্রী একটি সুদূরপ্রসারী ও অর্থবহ পদক্ষেপ ছিল।
  • (৫)ইরানি, তুরানি, আফগান, ভারতীয় মুসলমান, হিন্দু, রাজপুত প্রভৃতি সর্বগোষ্ঠীর অভিজাত ও সামন্তদের নিয়ে আকবর একটি সুসংহত শাসকশ্রেণী গঠন করতে চেয়েছিলেন।
  • (৬) তাঁর লক্ষ্য ছিল যাতে এক গোষ্ঠী অন্য গোষ্ঠীর ওপর প্রাধান্য বিস্তার করতে না পারে এবং এক গোষ্ঠী বিদ্রোহ করলে যাতে অন্য গোষ্ঠী তার মোকাবিলা করতে পারে। এদিক থেকে তাঁর রাজপুত নীতি সফল হয় এবং রাজপুতদের সহায়তায় বিদেশি অভিজাতবর্গ তাঁর নিয়ন্ত্রণে থাকে।
  • (৭) রাজপুত-মৈত্রীর ফলে মোগল সামরিক বাহিনীও শক্তিশালী হয়ে ওঠে। মোগল রণনীতি ও রাজপুত রণনীতির সংমিশ্রণে বাদশাহি রণনীতি উন্নততর হয়ে ওঠে।
  • (৮) রাজপুত নীতি সাম্রাজ্যের আর্থিক উন্নতির পক্ষে যথেষ্ট সহায়ক হয়। পশ্চিম ও উত্তর-পশ্চিম ভারতের সঙ্গে দেশের অন্যান্য অঞ্চলের বাণিজ্য চলত রাজপুতানার মধ্য দিয়ে। রাজপুতানার ওপর মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হওয়ার ফলে ব্যবসা-বাণিজ্য সহজতর হয়।
  • (৯) মারওয়াড়ের ওপর মোগল কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠিত হলে যোধপুরের মধ্য দিয়ে গুজরাটের সঙ্গে যোগাযোগ, ব্যবসা-বাণিজ্য বা সেখানে সামরিক অভিযান প্রেরণ সহজতর হয়ে ওঠে।
  • (১০) আকবরের রাজপুত নীতি হিন্দু-মুসলিম ঐক্য এবং ভারতের সাংস্কৃতিক জীবনে এক নবযুগের সূচনা করে। বহু রাজপুত কবি, সাহিত্যিক, শিল্পী, চিত্রকর, আকবরের রাজসভা অলঙ্কৃত করতেন। এর ফলে স্থাপত্য, ভাস্কর্য, সংগীত – সর্বক্ষেত্রে হিন্দু-মুসলিম সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়।

(খ) রাজপুতদের ওপর প্রভাব

আকবরের এই নীতির ফলে রাজপুতরাও কম লাভবান হয় নি। যেমন –

  • (১) আকবরের আনুগত্য মেনে নিয়ে রাজপুত রাজারা নিজ নিজ রাজ্যে নির্বিঘ্নে ও স্বাধীনভাবে রাজত্ব করার সুযোগ পান।
  • (২) আনুগত্য ও কর্মদক্ষতার স্বীকৃতি স্বরূপ রাজপুত রাজন্যবর্গ বাদশাহি দরবারে নানা গুরুত্বপূর্ণ প্রশাসনিক পদে নিযুক্ত হন। অম্বরের ভগবান দাস লাহোরের যুগ্ম শাসক নিযুক্ত হন। মানসিংহ প্রথমে কাবুল এবং পরে বাংলা-বিহারের শাসনকর্তা নিযুক্ত হন। টোডরমল রাজস্বমন্ত্রী এবং পরে ‘ভকিল’ পদে উন্নীত হন।
  • (৩) বহু রাজপুত রাজা আগ্রা, গুজরাট, আজমীর প্রভৃতি বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ প্রদেশের দায়িত্ব পান। নিজ রাজ্য ছাড়াও সাম্রাজ্যের বিভিন্ন অংশে জায়গির-প্রাপ্তির ফলে রাজপুত রানাদের অনেকেই প্রভূত ধন-সম্পত্তির মালিক হন।
  • (৪) বাদশাহি দরবারে মুসলিম অভিজাতদের সমান মর্যাদার অধিকারী হওয়ায় দিল্লির রাজনীতিতেও তাঁরা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালনের সুযোগ পান।

উপসংহার :- ডঃ এ. এল. শ্রীবাস্তব বলেন যে, “আকবরের রাজত্ব কালের সামরিক, রাজনৈতিক, শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও শৈল্পিক অবদানের ক্ষেত্রে রাজপুতদের ভূমিকা অতি গুরুত্বপূর্ণ। তাদের সহযোগিতা মোগল শাসনকে কেবলমাত্র নিরাপত্তা ও স্থায়িত্বই দেয় নি, ভারতে একটি অভূতপূর্ব অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি, সাংস্কৃতিক নবজাগরণ এবং হিন্দু-মুসলি সংস্কৃতির মিলন, যা ভারতে মোগল শাসনের অমূল্য ঐতিহ্য হিসেবে বিবেচিত, প্রভৃতি সংঘটিত করে।”

(FAQ) আকবরের রাজপুত নীতি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. রাজপুতদের সাথে সম্পর্ক স্থাপনের ক্ষেত্রে আকবর কি কি নীতি গ্রহণ করেন?

বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন, উচ্চ রাজপদে নিয়োগ, বিভিন্ন সুযোগ সুবিধা প্রদান ও যুদ্ধ নীতি।

২. হলদিঘাটের যুদ্ধে আকবরের সেনাপতি কে ছিলেন?

রাজপুত বীর মানসিংহ।

৩. কোন রাজপুত আকবরের রাজস্ব মন্ত্রী ছিলেন?

টোডরমল।

৪. কোন কোন রাজপুত রাজ্য আকবরের বশ্যতা স্বীকার করে নি?

মেবার, রণথম্বোর।

Leave a Comment