আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

মুঘল সম্রাট আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ প্রসঙ্গে সুলতানি যুগে উত্তরাধিকার প্রথা, আকবরের বংশানুক্রমিক অধিকারের স্বীকৃতি, বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রথা প্রবর্তন, সার্বভৌম ক্ষমতার স্থাপন, অভিযাতাদের দমন, প্রত্যক্ষ শাসন নীতি, রাজপুত ও হিন্দুদের ক্ষেত্রে নমনীয়তা, মুসলিম রাজ্য অধিগ্ৰহণ, হিন্দু রাজ্যকে স্বায়ত্ত্বশাসন প্রদান, শক্তি সাম্য নীতি, দৈবী শক্তি দাবি ও বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের চিন্তা সম্পর্কে জানবো।

মুঘল সম্রাট আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ঐতিহাসিক ঘটনাআকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ
সম্রাটআকবর
রাজত্বকাল১৫৫৬-১৬০৫ খ্রি
পিতাহুমায়ুন
অভিভাবকবৈরাম খাঁ
পুত্রজাহাঙ্গীর
মুঘল সম্রাট আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ

ভূমিকা :- হুমায়ুনের মৃত্যুর পর তাঁর সিংহাসনে তাঁর পুত্র আকবরের উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো সঙ্কট দেখা দেয় নি। যদিও আকবর তখনও প্রাপ্তবয়স্ক হন নি, তথাপি পিতার সিংহাসনে তাঁর দাবীর বৈধতাকে কেউ প্রশ্ন করে নি।

সুলতানি যুগে উত্তরাধিকার প্রথা

সুলতানি আমলে পিতার সিংহাসনে পুত্রের উত্তরাধিকারের বৈধ্যতা অনেক সময় স্বীকৃত হত না। অভিজাতরা যদি সেই পুত্রকে সমর্থন করত তবে তার দাবী বৈধ বলে গণ্য হত। নতুবা অধিকাংশ ক্ষেত্রে অভিজাতদের মনোনীত প্রার্থীই সিংহাসনে বসত। ইলতুৎমিস, বলবন এভাবেই সিংহাসনে বসেন।

আকবরের বংশানুক্রমিক অধিকারের স্বীকৃতি

মুঘল যুগে সিংহাসনে উত্তরাধিকারের ধারা বদলে বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকারের দাবী প্রবল হয়ে ওঠে। আকবর প্রাপ্তবয়স্ক না হলেও সিংহাসনে তাঁর উত্তরাধিকার স্বীকার করে নেওয়া হয়।

আকবরের সিংহাসন লাভ সম্পর্কে ত্রিপাঠীর মন্তব্য

ডঃ আর. পি. ত্রিপাঠী এজন্য বলেছেন যে, “আকবর ছিলেন দিল্লীর প্রথম অ-প্রাপ্তবয়স্ক সম্রাট যাঁর সিংহাসনের উত্তরাধিকার নিয়ে কোনো প্রশ্ন তোলা হয় নি।”

আকবর কর্তৃক বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রথা প্রবর্তন

সম্রাট আকবর নিজ ক্ষেত্রে যে নীতির সুযোগ পান, তিনি সেই নীতি তাঁর বংশধরদের জন্য স্থায়ী করার চেষ্টা করেন। তিনি নিজে ছিলেন হুমায়ুনের জ্যেষ্ঠ পুত্র। তিনি নিজে তার জোষ্ঠ পুত্র সেলিমকে উত্তরাধিকারী নির্বাচন করেন। এইভাবে, তিনি বংশানুক্রমিক উত্তরাধিকার প্রথা প্রবর্তনের চেষ্টা করেন।

আকবরের আমলে সার্বভৌম ক্ষমতা স্থাপন

সম্রাট আকবর অ-প্রাপ্তবয়স্ক অবস্থায় সিংহাসনে বসলেও অভিভাবক বৈরাম খাঁ এবং ধাত্রীমাতা মহম আনাগা ও মহম আনাগার পুত্র আদম খাঁর নিয়ন্ত্রণে তাকে অনেকদিন থাকতে হয়। শেষ পর্যন্ত তিনি বৈরাম খাঁকে পদচ্যুত করেন এবং আদম খাঁকে নিহত করেন।

আকবর কর্তৃক অভিজাতদের দমন

  • (১) আকবর অনুভব করেন যে, তাঁর দরবারের অভিজাতরা তাঁকে নামেমাত্র ক্ষমতায় রেখে নিজ নিজ হাতে ক্ষমতা নিতে আগ্রহী। ১৫৬১-১৫৬৭ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত আকবর এই উচ্চাকাঙ্ক্ষী অভিজাতদের দমনের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। নতুবা আকবরের নেতৃত্বে ‘উদারনৈতিক স্বৈরতন্ত্র’ ও ‘জাতীয় রাজতন্ত্র’ স্থাপিত হতে পারত না।
  • (২) পূর্ব ভারত-এ আফগান, আসফ খাঁ, উজবেগী সর্দারদের, মীর্জা সর্দারদের দমন করে আকবর প্রমাণ করেন যে, সিংহাসনের সার্বভৌম ক্ষমতা একমাত্র তারই হাতে আছে। অভিজাতরা প্রশাসনের আমলা হিসেবে পাদশাহের নির্দেশ মেনে কাজ করবেন।
  • (৩) তারা নীতি নির্ধারণ বা অন্যান্য মৌলিক বিষয়ে হস্তক্ষেপ করতে পারবেন না। আকবর নিজেই ছিলেন তার প্রধানমন্ত্রী। নীতি নির্ধারণ ও অন্যান্য গুরুতর বিষয়ে তিনি সর্বদাই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিতেন।

আকবরের প্রত্যক্ষ শাসন নীতি

আকবর উত্তর ভারতে আফগান শাসকদের শাসিত রাজ্যগুলি উচ্ছেদ করেন। তিনি সিংহাসনে বসার ২৫ বছরের মধ্যেই আফগান বা অন্য মুসলিম রাজ্যগুলিকে ধ্বংস করেন এবং এই রাজ্যগুলি তাঁর প্রত্যক্ষ শাসনে আনেন। সম্ভবত তিনি ‘রাষ্ট্রের ভেতরে রাষ্ট্র’ (Imperium in imperio) নীতিকে সহ্য করতে প্রস্তুত ছিলেন না। তার সাম্রাজ্যবাদ ছিল অপ্রতিহত ও নিরঙ্কুশ।

রাজপুত ও হিন্দুদের ক্ষেত্রে আকবরের নমনীয়তা

  • (১) হিন্দু বা রাজপুত রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে আকবর নমনীয় নীতি নেন। তিনি তাঁর প্রতি বশ্যতা স্বীকারের পরিবর্তে পুরাতন হিন্দু রাজবংশগুলিকে স্বায়ত্বশাসনের অধিকার ফিরিয়ে দেন।
  • (২) ভারতের পুরাতন হিন্দুরাজবংশগুলিকে মোটামুটি উচ্ছেদ করার নীতি থেকে তিনি বিরত থাকেন। গড়-কাটাঙ্গায় তিনি একই শর্তে পুরাতন হিন্দু বংশকে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন। জয়পুর, যোধপুর, বিকানীর, জয়শলমীর প্রভৃতি রাজপুত রাজ্যগুলিকেও তিনি স্বায়ত্ব শাসনের অধিকার দেন।

আকবর কর্তৃক মুসলিম রাজ্য অধিগ্রহণ

মুসলিম রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে রাজ্য অধিগ্রহণ নীতি ছিল আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। সম্ভবত তিনি মুসলিম রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে এই নীতি নেন যে, “ভারতে একমাত্র একজন মুসলিম শাসক থাকবেন” (Only one Muslim ruler in India) এবং তিনি হবেন মুসলিমদের সার্বভৌম অধিপতি।

হিন্দু রাজ্যকে আকবরের স্বায়ত্তশাসন প্রদান

  • (১) হিন্দু রাজ্যগুলির ক্ষেত্রে বশ্যতামূলক মিত্রতা নীতি ছিল আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শের বিশেষ বৈশিষ্ট্য। হিন্দুদের ক্ষেত্রে, হিন্দু রাজাদের বশ্যতা পাওয়ার ফলে আকবরের ‘পাদশাহী’ বা সার্বভৌম আদর্শ পূর্ণ হয়।
  • (২) ডঃ আর-এস. ত্রিপাঠীর মতে, “আকবরের দিল্লী পাদশাহীকে শক্তিশালী করায় একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ ছিল স্বায়ত্ব-শাসিত হিন্দু রাজ্যগুলিকে সাম্রাজ্যের মূল অঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দান এবং মুসলিম শাসিত রাজ্যগুলিকে অধিগ্রহণ”।

আকবরের শক্তিসাম্য নীতি

  • (১) আকবর তাঁর দরবারে হিন্দু ও মুসলিম অভিজাতদের সমমর্যাদা দিয়ে তাঁর দরবারে শক্তিসাম্য রক্ষা করতেন। কেবলমাত্র মুসলিম অভিজাতদের ওপর নির্ভর করা তিনি বিপজ্জনক বলে মনে করতেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহের পর তার এই প্রত্যয় আরও দৃঢ় হয়।
  • (২) এজন্য তিনি গুরুত্বপূর্ণ অভিযানগুলিতে একই সঙ্গে হিন্দু ও মুসলিম সেনাপতি নিয়োগ করতেন এবং তাদের মধ্যে ক্ষমতা ভাগ করে দিতেন। বাংলায় দাউদ কররানীর বিরুদ্ধে তিনি টোডরমল ও মুনিম খাঁকে পাঠান।
  • (৩) মহারানা প্রতাপ সিংহ-এর বিরুদ্ধে তিনি আসফ খাঁ ও মান সিংহকে নিয়োগ করেন। ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে আকবরের বিরুদ্ধে বাংলা-বিহারে মারাত্মক বিদ্রোহ দেখা দিলে তিনি টোডরমল ও শাহাবাজ খাঁকে এই বিদ্রোহ দমনের ভার দেন।
  • (৪) এই উদাহরণগুলি প্রমাণ করে যে, আকবর হিন্দু ও মুসলিম সেনাপতিদের যুক্ত দায়িত্ব দিয়ে পরস্পরের ক্ষমতা ভাগ করে দিতেন। তার ফলে কোন সেনাপতি ব্যক্তিগত প্রাধান্য পেত না।

আকবর কর্তৃক ধর্মীয় অভিজাতদের পদানতকরণ

  • (১) আকবর ধর্মীয় অভিজাত বা উলেমা শ্রেণীকেও তাঁর শাসন ব্যবস্থায় প্রাধান্য ভোগের সুযোগ “দেন নি। শরিয়তী প্রথা অনুসারে উলেমারা শরিয়তের যে ব্যাখ্যা দিতেন সেই মত রাষ্ট্রের আইন-কানুন করতে হত। তাছাড়া রাষ্ট্রপ্রধানকে সুন্নী ধর্মের রক্ষক ও খলিফার আজ্ঞাবাহী মনে করা হত।
  • (২) আকবরের শাসনকালে এই প্রথা পরিত্যক্ত হয়। দিল্লীর সুলতান বলবন বা ফিরোজ শাহ তুঘলক-এর মত তিনি খলিফার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেন নি। আকবর বহু হিন্দু ও পারসিককে তাঁর দরবারে উচ্চপদে নিয়োগ করেন। তাছাড়া তিনি হিন্দু ও মুসলিমদের সমমর্যাদা দিয়ে জাতীয় সংহতি বাড়াতে চান।
  • (৩) সুতরাং শরিয়তী প্রথা অনুযায়ী আইন রচনায় উলেমা প্রাধান্য এবং রাষ্ট্রযন্ত্রের ইসলামীকরণ তিনি স্বীকার করেন নি। ১৫৭৯ খ্রিস্টাব্দে আকবর মাহজরনামা ঘোষণা করেন। সুলতান এই ঘোষণার দ্বারা নিজেই ইমাম-ই-আদিলের পদ নেন।
  • (৪) এর ফলে ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দে উলেমা ও মোল্লাগণ আকবরের বিরুদ্ধে বিদ্রোহের ডাক দেন। কিন্তু ১৫৮০-৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর এই বিদ্রোহ দমন করে তাঁর সার্বভৌমত্ব প্রতিষ্ঠা করেন।

আকবরের দৈবী স্বত্ব দাবী

  • (১) ১৫৮০ খ্রিস্টাব্দের বিদ্রোহ দমনের পর ১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে আকবর এক আড়ম্বরপূর্ণ দরবারের অনুষ্ঠান করেন। পারসিক ‘নওরোজ’ উৎসব-এর অনুকরণে এই দরবারে জাকজমক করা হয় এবং অভিজাতরা সম্রাটকে সার্বভৌম শক্তি রূপে ‘সিজদা’ বা আভূমিপ্রণত হয়ে অভিবাদন জানান।
  • (২) এই সময় থেকেই আকবর সিংহাসনে দৈবী অধিকার বা Divine Right দাবী করতে থাকেন। আবুল ফজল আকবরের এই দৈবী অধিকার ব্যাখ্যা করে বলেন যে “রাজপদ ঈশ্বরের দ্বারা আদিষ্ট এবং ঈশ্বরের দান” (Kingship is the gift of God)।
  • (৩) আকবরের এই ঐশ্বরিক রাজতন্ত্রের লক্ষ্য হিসেবে বিভিন্ন জনগোষ্ঠী, ধর্মের মধ্যে সংহতি, সহাবস্থান ও সহিষ্ণুতা স্থাপনকে ঘোষণা করা হয়। কোনো কবি তাঁর নামে রচনা করেন “দিল্লীশ্বরোবা; জগদীশ্বরোবা” (The Lord of Delhi is the Lord of World)।

সম্রাট আকবরের বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য স্থাপনের চিন্তা

  • (১) ডঃ আর.পি. ত্রিপাঠীর মতে, আকবর শেষ পর্যন্ত বিশ্বব্যাপী সাম্রাজ্য ও বিশ্বব্যাপী সার্বভৌমত্ব স্থাপনের বাসনা পোষণ করতেন। পারস্য, মধ্য এশিয়া, আনাতোলিয়া ও আরব দেশ জয় করে এই সাম্রাজ্য গঠনের কল্পনা তাঁর ছিল।
  • (২) তৈমুর ও চেঙ্গিজের উত্তরাধিকারী হিসেবে তিনি এই সঙ্কল্প নেন। এই দিক থেকে বিচার করলে আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শকে জাতীয় না বলে বিশ্বজনীন বলা উচিত ( Akbar’s idea was not so much national as of universal kingship)।

আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে নুরুল হাসানের অভিমত

ডঃ নুরুল হাসানের মতে, আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ ছিল পিতৃতান্ত্রিক। তিনি প্রজাদের নিজ সন্তানের মতই দেখতেন এবং তাদের মঙ্গলের কথা চিন্তা করতেন।

উপসংহার :- আকবরের বিশ্বজনীন রাজতান্ত্রিক আদর্শের জন্য তাঁর প্রজাদের জাতি, ধর্ম নির্বিশেষে সমান চক্ষে দেখতেন। ধর্মসহিষ্ণুতা নীতি বা সুলহ-ই-কুল নীতি ছিল তাঁর রাজতান্ত্রিক আদর্শের মর্ম।

(FAQ) মুঘল সম্রাট আকবরের রাজতান্ত্রিক আদর্শ সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. আকবর দরবারে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করে কখন?

১৫৮২ খ্রিস্টাব্দে।

২. আকবর কোন উৎসবের অনুকরণে দরবারে আড়ম্বরপূর্ণ অনুষ্ঠান করেন?

পারসিক নওরোজ উৎসব।

৩. কোন সময়কালে আকবর অভিজাতদের দমন করেন?

১৫৬১-৬৭ খ্রিস্টাব্দে।

৪. আকবর প্রথম কোন অভিজাতকে পদচ্যুত করেন?

বৈরাম খাঁ।

Leave a Comment