আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব

মোগল সম্রাট আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব প্রসঙ্গে ঐতিহাসিক স্মিথের অভিমত, ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত, ব্যক্তি আকবর, বিজেতা ও সংগঠক আকবর, আকবরের ধর্মীয় উদারতা, আকবরের সমাজ সংস্কার, আকবরের বিদ্যোৎসাহিতা, আকবরের শিল্পকলা ও বিরল ব্যক্তিত্ব হিসেবে আকবরের কৃতিত্ব সম্পর্কে জানবো।

মোগল সম্রাট আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব প্রসঙ্গে আকবরের ব্যক্তিত্ব, আকবরের উদারতা, বিজেতা ও সংগঠক হিসেবে আকবর, আকবরের সমাজ সংস্কার, আকবরের বিদ্যোৎসাহিতা, আকবরের শিল্পকলা, বিরল ব্যক্তিত্ব আকবর, সাম্রাজ্যের অধিপতি হিসেবে আকবরের কৃতিত্ব।

আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব (Character and Achievements of Akbar)

বিষয়আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব
রাজত্বকাল১৫৫৬-১৬০৫ খ্রিস্টাব্দ
পূর্বসূরিহুমায়ুন
উত্তরসূরিজাহাঙ্গীর
অবদানমোগল সাম্রাজ্যের বিস্তার ও সুশাসন প্রতিষ্ঠা
আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব

ভূমিকা :- মোগল সম্রাট আকবর ছিলেন ভারত ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ নরপতি। চারিত্রিক দৃঢ়তা, বাহুবল, কূটনৈতিক বিচক্ষণতা, উদার মননশীলতা, প্রগতিশীল ভাবধারা, প্রশাসনিক দক্ষতা, বিদ্যোৎসাহিতা এবং সর্বোপরি মানবতাবোধ তাঁকে বিশ্বের একজন শ্রেষ্ঠ নরপতিতে পরিণত করেছে।

স্মিথের অভিমত

আকবরের কঠোর সমালোচক স্মিথ-এর মতে তিনি ছিলেন একজন সহজাত রাজা এবং ইতিহাসবন্দিত নরপতিদের মধ্যে স্থান করে নেওয়ার একজন যথার্থ দাবিদার।

ঈশ্বরী প্রসাদের অভিমত

ঐতিহাসিক ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ-এর মতে “কেবলমাত্র ভারত ইতিহাসে নয়, বিশ্বের ইতিহাসে তিনি এক বিশিষ্ট স্থানের অধিকারী।”

ব্যক্তি আকবর

  • (১) ব্যক্তিগত জীবনে তিনি নানা গুণাবলীর অধিকারী ছিলেন। তিনি ছিলেন সদালাপী, স্নেহশীল, মিতাহারী এবং শান্ত প্রকৃতির মানুষ। হাস্য-পরিহাস ও আমোদ-প্রমোদে তিনি সহজেই যোগ দিতে পারতেন।
  • (২) দিল্লির অধিবাসীদের তিনি খুব প্রিয় ছিলেন। অনুতপ্ত বিদ্রোহীদের তিনি ক্ষমা করতেন, আবার অপরাধীদের প্রতি তিনি ছিলেন কঠোর।
  • (৩) যে-কোনও গভীর বিষয়ে তিনি সহজেই মনোনিবেশ করতে পারতেন এবং জটিল সমস্যাদি সহজেই বুঝতে পারতেন। তাঁর বুদ্ধিমত্তা ও মানসিক উৎকর্ষ ছিল প্রখর।

বিজেতা ও সংগঠক

  • (১) বিজেতা ও সাম্রাজ্য সংগঠক হিসেবে তিনি অসাধারণ কৃতিত্বের অধিকারী ছিলেন। পিতার মৃত্যুর পর চরম প্রতিকূলতার মধ্যে একজন চোদ্দ বছর বয়স্ক বালক যেভাবে কঠোর বাস্তবের সম্মুখীন হন এবং সাফল্য অর্জন করেন তা বলার অপেক্ষারাখে না।
  • (২) বস্তুতঃপক্ষে সেদিন ভারতে মোগল আধিপত্য বিলুপ্তই হয়ে গিয়েছিল। এই সময় কেবলমাত্র বাহুবল, কূটকৌশল ও বিচক্ষণতার মাধ্যমে তিনি ভারতে মোগল আধিপত্য পুনঃপ্রতিষ্ঠিত করেন এবং ভারতভূমির এক বিশাল অংশ মোগল শাসনাধীনে আসে।
  • (৩) বিশালমোগল সাম্রাজ্যে তিনি সুশাসন প্রতিষ্ঠা করেন। সারা ভারত জুড়ে একই ধরনের আইন কানুন ও শাসনব্যবস্থা স্থাপিত হয়।
  • (৪) হিন্দু-মুসলিম ও বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠী ও ধর্মের মানুষকে এই শাসনব্যবস্থার অঙ্গীভূত করে তিনি যথাযথভাবে এক ভারতীয় শাসনব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়াসী হন।
  • (৫) পূর্বসূরী শেরশাহের শাসনব্যবস্থার অনেক কিছু গ্রহণ করলেও, নিজ মৌলিকতার মাধ্যমে সেগুলিকে তিনি যুগোপযোগী করে নেন।

ধর্মীয় উদারতা

  • (১) আকবরের ধর্মনীতি তাঁর প্রতিভার এক বিস্ময়কর দান। আকবর একজন ধর্মনিষ্ঠ মুসলিম ছিলেন—ধর্মান্ধ ছিলেন না।
  • (২) ইসলাম ধর্মের প্রায় প্রতিটি বিধি নিষ্ঠার সঙ্গে পালন করেও উদার হৃদয় নরপতির পক্ষে ‘দীন-ই-ইলাহী‘ -র মতো এক সমন্বয়ী ধর্মমত প্রবর্তন করায় কোনও অসুবিধা দেখা দেয় নি।
  • (৩) জাতি-ধর্মের কৃত্রিম ভেদাভেদ মুছে দিয়ে তিনি হিন্দুদের প্রতি এক সহনশীল নীতি গ্রহণ করেন। পরাজিত যুদ্ধ-বন্দিদের ধর্মান্তরকরণ বা দাসে পরিণত করার রীতি এবং তীর্থকর ও জিজিয়া কর তুলে দেওয়া হয়। হিন্দু ও রাজপুতদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করে তিনি মৈত্রীর এক নতুন দিগন্ত খুলে দেন।
  • (৪) লেনপুল-এর মতে আকবর ছিলেন ভারতে রাজত্বকারী সকল রাজন্যবর্গের মধ্যে মহত্তম (“the noblest king that ever ruled in India”) এবং “সাম্রাজ্যের প্রকৃত স্থাপয়িতা ও সংগঠক” (“the true founder and organiser of the empire.”)।
  • (৫) পণ্ডিত জওহরলাল নেহরু তাকে “ভারতীয় জাতীয়তাবাদের জনক” (“Father of Indian Nationalism”) বলে অভিহিত করেছেন।

সমাজ সংস্কার

  • (১) ভারত ইতিহাসের মধ্যযুগে কেবলমাত্র ধর্মসংস্কার বা হিন্দুদের উচ্চ রাজপদে নিয়োগ করাই নয়—হিন্দু সমাজে তিনি একাধিক সংস্কার সাধনে ব্রতী হন। সতীদাহ, বাল্যবিবাহ, বহুবিবাহ প্রভৃতি কুপ্রথাগুলি রদ করার ব্যাপারে তিনি সচেষ্ট হন।
  • (২) মুসলিম সমাজেও তিনি এই ধরনের কিছু সংস্কার সাধনে প্রয়াসী হন। তাই রাজা রামমোহন রায়কে ভারতের ‘প্রথম আধুনিক মানুষ’ বলে অভিহিত করলে মহামতি আকবরও এই অভিধার অধিকারী হতে পারেন।

বিদ্যোৎসাহিতা

  • (১) বিদ্যা ও বিদ্বানের পৃষ্ঠপোষক আকবরের রাজসভায় একাধিক জ্ঞানী-গুণীর সমাবেশঘটে। ‘আকবর-নামা’ ও ‘আইন-ই-আকবরী’ গ্রন্থের রচয়িতা ঐতিহাসিক আবুল ফজল ও ‘তবাকৎ-ই-আকবরী’ প্রণেতা নিজামউদ্দিন, মুক্তাখাব-উল্-তারিখ’ গ্রন্থের রচয়িতা বদাউনি, কবি ফৈজি ও জালালউদ্দিন উরফী, হাস্যরসিক বীরবল, সংগীতজ্ঞ তানসেন ও রাজবাহাদুর, চিত্রকর সৈয়দ আলি ও আবদুস সামাদ, হস্তলিপিশিল্পী মহম্মদ হুসেন ও আবদুর রহিম তাঁর রাজসভা অলংকৃত করতেন। এই সব জ্ঞানী ব্যক্তিরা ‘নবরত্ন’ বা ‘নওরতন’ নামে পরিচিত ছিলেন।
  • (২) ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ বলেন যে, “ভারতবর্ষে মুসলিম শাসনের ইতিহাসে একজন রাজাকে কেন্দ্র করে এবং তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় এত জ্ঞানী, কবি ও দার্শনিকের সমাবেশ আর কখনও হয় নি।”
  • (৩) তাঁর প্রাসাদে একটি বিশাল পাঠাগার ছিল। সম্রাট ব্যক্তিগতভাবে হিন্দি ও ফারসি সাহিত্যের পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই যুগে বেশ কিছু উল্লেখযোগ্য হিন্দি ও ফারসি গ্রন্থ রচিত হয়।
  • (৪)’রামচরিত মানস’ রচয়িতা বিখ্যাত হিন্দি কবি তুলসীদাস এবং হিন্দি গীতিকাব্য ‘সুরসাগর’-এর স্রষ্টা ভক্তকবি সুরদাস এই যুগেই খ্যাতিলাভ করেন।
  • (৫) তিনি একটি অনুবাদ বিভাগ প্রতিষ্ঠিত করেন এবং সেখানে অথর্ববেদ, গীতা, মহাভারত, রামায়ণ, পঞ্চতন্ত্র, কোরান ও বাইবেল অনুদিত হয়।
  • (৬) তিনি নতুনভাবে বিদ্যালয়ের পাঠক্রম তৈরিরও নির্দেশ দেন এবং নৈতিক শিক্ষা, গণিত, ইতিহাস, ন্যায়শাস্ত্র, কৃষিবিদ্যা প্রভৃতির ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন।

শিল্পকলা

  • (১) শিল্পকলার ইতিহাসেও আকবরের আমল এক স্মরণীয় অধ্যায়। তাঁর আমলে বহু প্রাসাদ, সমাধি, উদ্যান ও দুর্গ নির্মিত হয়। এই সময় যে শিল্পরীতি গড়ে ওঠে তাতে ভারতীয় ও পারসিক শিল্পরীতির মিশ্রণ লক্ষ্য করা যায়।
  • (২) ফতেপুর সিক্রি, সেলিম চিস্তির সমাধি, দেওয়ান-ই-আম, দেওয়ান-ই-খাস, জামি মসজিদ, বুলন্দ দরওয়াজা, হুমায়ুনের সমাধি, সেকেন্দ্রার সমাধি ভবন মোগল শিল্পের উল্লেখযোগ্য উদাহরণ।
  • (৩) চিত্রশিল্পের ক্ষেত্রেও আকবরের রাজত্বকাল এক উল্লেখযোগ্য অধ্যায়। চিত্রশিল্পের প্রসারের জন্য তিনি আবদুস সামাদ-এর নেতৃত্বে একটি স্বতন্ত্র বিভাগ স্থাপন করেন। তাঁর আমলে চিত্রশিল্পে হিন্দু-মুসলিম সংস্কৃতির অপূর্ব সমন্বয় পরিলক্ষিত হয়।
  • (৪) তিনি প্রায় একশ জন হিন্দু-মুসলিম শিল্পীর পৃষ্ঠপোষকতা করতেন। এই যুগের ১৭ জন বিখ্যাত শিল্পীর মধ্যে ১৩ জনই ছিলেন হিন্দু। হিন্দু শিল্পীদের মধ্যে বিখ্যাত ছিলেনতারাচাঁদ, জগন্নাথ, যশোবন্ত প্রমুখ। তাঁরা পারসিক গল্প, রামায়ণ-মহাভারত ও আরব্য উপন্যাসের কাহিনী চিত্রে রূপায়িত করতেন।
  • (৫) সংগীত -এর প্রতিও তাঁর বিশেষ আকর্ষণ ছিল। তাঁর দরবারে হিন্দু, ইরানি, তুরানি, কাশ্মীরি প্রভৃতি বিভিন্ন জাতির ৩৬জন সংগীতজ্ঞ ছিলেন। গোয়ালিয়রের মিঞা তানসেন ছিলেন তাঁর দরবারের সর্বশ্রেষ্ঠ সংগীতজ্ঞ।

বিরল ব্যক্তিত্ব

সমগ্র মধ্যযুগের ইতিহাসে আকবর হলেন এক বিরল ব্যক্তিত্ব। তাঁর চরিত্র ও কৃতিত্বের কাছে সমকালীন ইংল্যান্ড -এর রানি এলিজাবেথ, ফ্রান্স -এর চতুর্থ হেনরী এবং পারস্যের মহামতি আব্বাস-এর কৃতিত্বও ম্লান হয়ে যায়।

উপসংহার :- ঐতিহাসিক ডঃ ঈশ্বরী প্রসাদ -এর মতে সকল দিক বিবেচনা করে ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ শাসকদের সঙ্গে তিনি একাসনে বসার অধিকারী।


প্রিয় পাঠক/পাঠিকা আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ সময় করে আমাদের এই “আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব” পোস্টটি পড়ার জন্য। এই ভাবেই adhunikitihas.com ওয়েবসাইটের পাশে থাকুন। যে কোনো প্রশ্ন উত্তর জানতে এই ওয়েবসাইট টি ফলো করুণ এবং নিজেকে তথ্য সমৃদ্ধ করে তুলুন।

সবশেষে আপনার কাছে আমাদের অনুরোধ যদি এই পোস্টটি আপনার ভালো লেগে থাকে তাহলে Comment ও Share করে দিবেন, (ধন্যবাদ)।

(FAQ) আকবরের চরিত্র ও কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মোগল সম্রাট আকবর কবে সিংহাসনে আরোহণ করেন?

১৫৫৬ খ্রিস্টাব্দে।

২. মোগল সম্রাট আকবরের অভিভাবক কে ছিলেন?

বৈরাম খাঁ।

৩. দীন-ই-ইলাহী কে প্রবর্তন করেন?

মোগল সম্রাট আকবর।

৪. ভারতে মনসবদারি প্রথার প্রবর্তক কে?

মোগল সম্রাট আকবর।

অন্যান্য ঐতিহাসিক চরিত্রগুলি

Leave a Comment