সুলতানি যুগের কৃষি

সুলতানি যুগের কৃষি প্রসঙ্গে কৃষি জমির বহুলতা, অনাবাদী জমি, অগ্ৰিম দাদন, সেচ ব্যবস্থা, গালিব ও রবি চাষ, কৃষিজ ফসল, কৃষিপণ্যের বাজার দর, সেচ নীতি, জমির স্বত্ব, রাজস্ব ও পশুপালন সম্পর্কে জানবো।

সুলতানি যুগের কৃষি

ঐতিহাসিক ঘটনাসুলতানি যুগের কৃষি
প্রধান ফসলধান, গম, ভুট্টা
খাল খননফিরোজ শাহ তুঘলক
অগ্ৰিম দাদনমহম্মদ বিন তুঘলক
সুলতানি যুগের কৃষি

ভূমিকা :- সুলতানি যুগের অর্থনীতির অন্যতম প্রধান স্তস্ত ছিল কৃষি। সুলতান ও শাসক অভিজাতদের স্বচ্ছলতার মূলে ছিল কৃষি জমির আয় থেকে পাওয়া কর।

সুলতানি যুগে কৃষি জমির বহুলতা

ডঃ ইরফান হাবিবের মতে, ত্রয়োদশ ও চতুর্দশ শতকে লোকসংখ্যার অনুপাতে ভূমির অভাব ছিল না। গাঙ্গেয় উপত্যকার বহু অংশ তখনও ছিল অকর্ষিত, জঙ্গলময় জমি।

সুলতানি যুগে অনাবাদী জমি

বহু অতিরিক্ত জমি যে অনাবাদী থাকত তার প্রমাণ বিভিন্ন সুলতানদের ফর্মান থেকে পাওয়া যায়। যাদের হাতে অর্থবল ও জনবল ছিল সেইসব উদ্যমী লোকেদের সুলতানরা এই অনাবাদী জমি কর্ষণযোগ্য করার জন্য দায়িত্ব দিতেন। ইসলামীয় পরিভাষায় এই অকর্ষিত জমিগুলিকে বলা হত “মৃত জমি”।

সুলতানি যুগে অগ্ৰিম দাদন

অনাবাদী জমিগুলিকে ফলনশীল করার জন্য মহম্মদ বিন তুঘলক উদ্যমী লোকদের সরকার থেকে অগ্রিম দাদন হিসেবে অর্থ সাহায্য দিতেন। অবশ্য সরকারী কর্মচারীরা এই অর্থের একাংশ নিয়ে নিত।

সুলতানি যুগে সেচ ব্যবস্থা

ফিরোজ শাহ তুঘলক সেচব্যবস্থা চালু করে অনাবাদী জমিকে আবাদী জমিতে পরিণত করার নীতি গ্ৰহণ করেন। তাছাড়া দোয়াব প্রভৃতি অঞ্চলের জমি ছিল দু-ফসলী, ভীষণ উর্বরা। বৃষ্টিপাত বা সেচের ব্যবস্থা থাকলে প্রচুর ফসল ফলত।

দিল্লির সুলতানি যুগে খারিফ ও রবি চাষ

সুলতানি আমলে জমিতে নানারকম ফসল ফলত। ইবন বতুতার বিবরণ থেকে জানা যায় যে শরৎকালীন ফসল বা ‘খারিফ’ এবং বসন্তকালীন ফসল বা ‘রবি’ চাষ হত। ঠাককুরা ফেরুর (Thakkura Pheru) বিবরণ থেকে জানা যায় যে, প্রায় ২৫ রকম ফসলের উৎপাদন চাষীরা বিভিন্ন ঋতুতে বিভিন্ন অঞ্চলের জমিতে করত।

সুলতানি যুগের কৃষিজ ফসল

  • (১) প্রধান কৃষিজাত শস্য ছিল ধান, গম, কলাই, ভুট্টা, আলু, বাদাম, তামাক, আখ, তৈলবীজ, যব, মশলা, নারকেল, পান, সুপারি, আদা, বিভিন্ন প্রকার ফল। এছাড়া বিক্রির জন্য আফিম, নীল প্রভৃতির চাষ হত।
  • (২) মালাবারে প্রচুর মশলা উৎপন্ন হত। এই মশলা বিদেশেও রপ্তানি হত। কাশ্মীরে জাফরান এবং বাংলায় আখ উৎপন্ন হত। গম, ধান, যব প্রভৃতি খাদ্যশস্য অসেচ যুক্ত জমিতে ফলত। বর্ষার জলের ওপরেই এই শস্যগুলির উৎপাদনের জন্য নির্ভর করতে হত।

ইবন বতুতার বর্ণনা

ইবন বতুতা সরসূতি, সাগর অঞ্চলে প্রচুর সরু ধান, ধার অঞ্চলে গম ও পান এবং গোয়ালিয়র অঞ্চলে ভাল জাতের গমের উৎপাদন দেখেন। বাংলার ধানের ফলন দেখে তাঁর মিশর দেশের কথা মনে পড়েছিল। এছাড়া বাংলাতে তিনি আম ও নারকেল সহ নানারকম ফল ফলতে দেখেন।

সুলতানি যুগে কৃষিপণ্যের বাজার দর

  • (১) খাদ্যশস্য ও অন্যান্য কৃষিপণ্যের বাজার দর সব সময় সমান থাকত না। আলাউদ্দিন খলজির আমলে বাজার দর সম্পর্কে বরণী যে তালিকা দিয়েছেন তা পরীক্ষা করে, গবেষক ডঃ ইরফান হাবিব অভিমত দিয়েছেন যে, সেচ-সেবিত জমির ফসলের দর, অসেচ জমির ফসল অপেক্ষা বেশী ছিল।
  • (২) ফিরোজ শাহ তুঘলকের আমলেও খাদ্যশস্যের দাম অন্তত কোনো কোনো অঞ্চলে কম ছিল। তারিখ-ই-দাউদ থেকে জানা যায় যে, ইব্রাহিম লোদীর আমলে সুলতানি যুগে সর্বাপেক্ষা শস্তাদরে খাদ্য-শস্য বিক্রি হত। এজন্য সরকার থেকে কোনো বলপ্রয়োগ করা হত না।

সুলতানি যুগে সেচ নীতি

  • (১) দিল্লী সুলতানরা মধ্য এশিয়ার আদর্শে উত্তর ভারতে সেচখাল খোদাইয়ের কাজে হাত দেন। ফিরোজ তুঘলকের আমলে বহু সেচখাল ও কূপ খোদাই হয়। তাঁর দুটি বিখ্যাত খাল ছিল রাজাব-ওয়া ও উলুখখানি খাল। এই দুটি খাল যমুনা থেকে হিসার ও ঘর্ঘরা পর্যন্ত খোদাই করা হয়।
  • (২) খাল ও কূপ থেকে ফার্সী চাকার দ্বারা সেচের জল তোলা হত। কৃষকদের সেচের জন্য আলাদা কর দিতে হত। ইসলামীয় তত্ত্ব অনুযায়ী ভূসম্পত্তির মালিকানা ছিল সুলতানের হাতে। যাদের যে স্বত্বই থাকুক না কেন স্বৈরাচারী সুলতানের এক কলমের খোঁচায় এই স্বত্ব লোপ পেয়ে যেত।

দিল্লির সুলতানি যুগে জমির স্বত্ব

মোরল্যাণ্ড বলেছেন যে, আলাউদ্দিন খলজি ওয়াকফ ও ইনামের জমির স্বত্ত্ব কেড়ে নেন। কিন্তু কৃষকদের ক্ষেত্রে সুলতানরা সর্বদাই গঠনমুখী নীতি নেন। তারা সর্বদাই কৃষকদের জমিতে স্বত্ব রক্ষা করতেন। চিরাচরিত নিয়ম ভাঙ্গতে তারা রাজী ছিলেন না। কারণ কৃষকরাই ছিল সুলতানি সম্পদের উৎস।

সুলতানি যুগে রাজস্ব

সুলতানি রাজস্ব প্রধানত কৃষি জমি থেকেই আসত। আলাউদ্দিন ফসলের কর ১/২ ভাগ হিসেবে নেন। অন্যান্য সুলতানরা সর্বদাই অনেক কম হারে কর আদায় করতেন।

আমীর খসরুর মন্তব্য

আমীর খসরু বলেছেন যে, “সুলতানি মুকুটের প্রতিটি মুক্তা ছিল আসলে কৃষকের চোখের জলের জমে যাওয়া ফোঁটা”। অনেকে এই মতকে অতিশয়োক্তি বলে মনে করেন।

সুলতানি যুগে পশুপালন

  • (১) কৃষি ছাড়া পশুপালন ছিল অন্যতম প্রধান জীবিকা। সুলতানি যুগে পশুচারণের জন্য জমির অভাব ছিল না। গৃহপালিত পশুগুলি গ্রামের কাছাকাছি জমিতে চরান হত। এছাড়া অকর্ষিত জমি ও অরণ্যে পশু চারণের ব্যবস্থা ছিল।
  • (২) গরু ও মহিষ ছিল মূল্যবান গৃহপালিত পশু। এই পশুগুলির দ্বারা জমিতে লাঙ্গল টানা, মাল বহনের গাড়ি টানার জন্য ব্যবহার করা হত। গরু ও ঘোড়ার পিঠে মাল বহনের কাজ করা হত।
  • (৩) গরু ও মহিষের দুধ এবং দুধ থেকে জাত ঘি, ছানা প্রভৃতি খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা হত। এছাড়া ঘোড়া, ভেড়া, ছাগল প্রভৃতি পশুও পালন করা হত। ফিরোজ শাহ হিসার অঞ্চলে বহু “খরক” বা “পশুশালা” স্থাপন করেন।

সুলতানি যুগে কৃষির উপজাত পণ্য

বাংলার আখ, গুড় ও চিনি, দক্ষিণ ভারত-এর ও পাঞ্জাবের সরু চাউল, দোয়াবের গমের খুবই চাহিদা ছিল। দিল্লীর বাজারে শিরসুতী চালের খুব নাম ছিল।

উপসংহার :- সুলতানি যুগে আম, কলা, কাঠাল প্রভৃতি ফলের বিশেষ উৎপাদন হত। ফিরোজ শাহ দিল্লীর নিকটে প্রায় ১২০০ ফলের বাগান স্থাপন করেন। সুলতানি যুগে আমের খুব চাহিদা থাকলেও কলমের আম গাছের প্রচলন ছিল না।

(FAQ) সুলতানি যুগের কৃষি সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. সুলতানী যুগে কোন সুলতান অগ্ৰিম দাদন প্রদান করেন?

মহম্মদ বিন তুঘলক।

২. কোন সুলতান সেচের জন্য খাল খনন করেন?

ফিরোজ শাহ তুঘলক।

৩. সুলতানি যুগের প্রধান কৃষিজ ফসল কি ছিল?

ধান, গম, ভুট্টা প্রভৃতি।

৪. সুলতানি যুগে মূল্যবান গৃহপালিত পশু কি ছিল?

গোরু, মহিষ।

Leave a Comment