চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব প্রসঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের নায়ক, রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন, ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট, মহাপদ্ম ও চন্দ্রগুপ্ত, সংগঠক ও শাসক এবং শিল্পকলার প্রতি আনুগত্য সম্পর্কে জানবো।

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

ঐতিহাসিক ঘটনাচন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব
মৌর্য বংশের প্রতিষ্ঠাতাচন্দ্রগুপ্ত মৌর্য
রাজ্যমগধ
রাজধানীপাটলিপুত্র
প্রধানমন্ত্রীকৌটিল্য
গ্ৰিক পর্যটকমেগাস্থিনিস
পূর্বসূরিধননন্দ
উত্তরসূরিবিন্দুসার
চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

ভূমিকা :- মুদ্রারাক্ষস নাটকে বিশাখদত্ত বলেছেন যে, ম্লেচ্ছ বা গ্রিকদের দ্বারা ধর্ষিতা পৃথিবী বা ভারতভূমিকে চন্দ্রগুপ্ত নিজ বাহু যুগলের দ্বারা রক্ষা করেছিলেন। এটা শুধু কবির কল্পনা ছিল না।

মুক্তিযুদ্ধের নায়ক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

যে দুর্ধর্ষ গ্রীক জাতি পারস্য জয় করে ভারতের উত্তর-পশ্চিম অঞ্চল দখল করেছিল, যারা আমাদের দেশ ভারতবর্ষকে গ্রীক সভ্যতায় দীক্ষিত করার স্বপ্ন দেখত, সেই গ্রীকদের হাত থেকে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য সত্যই ভারতভূমিকে মুক্ত করেন। আলেকজাণ্ডারকে যদি ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক আক্রমণকারী বলা যায়, চন্দ্রগুপ্তকে প্রথম ঐতিহাসিক সেনাপতি ও মুক্তিযোদ্ধা বলা অসঙ্গত হবে না।

রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপনে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

ইতিহাসের এক সন্ধিক্ষণে চন্দ্রগুপ্ত রঙ্গমঞ্চে এসে পড়েন। নন্দ রাজা ধননন্দ যদিও ছিলেন অমিত পরাক্রমশালী, তথাপি তিনি ছিলেন অত্যাচারী, এজন্য প্রজাদের দ্বারা ঘৃণিত। অপর দিকে ভারতের মাটিতে শনৈঃ শনৈঃ বিদেশী অনুপ্রবেশ ঘটেছিল। নন্দ রাজারা আর তাদের রাজ্য ধরে রাখতে পারতেন কিনা সন্দেহ। চন্দ্রগুপ্ত এই সময় ক্ষমতায় এসে একাধারে ভারতের রাজনৈতিক ঐক্য স্থাপন এবং বিদেশী শাসন থেকে মুক্তি ঘটান।

ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক সম্রাট চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য

বৈদিক সভ্যতা হতে ভারতের ঐক্য স্থাপনের যে আদর্শ গ্রহণ করা হয়েছিল, রাজচক্রবর্তী উপাধি দ্বারা আসমুদ্র ভারতভূমিকে এক শাসনে বাধার যে লক্ষ্য ঘোষণা করা হয়, চন্দ্রগুপ্ত তাকে সফল করেন। পূর্বে বঙ্গোপসাগর থেকে পশ্চিমে আরব সমুদ্র এবং উত্তরে হিমালয় ও হিন্দুকুশ থেকে দক্ষিণে তামিলনাড়ু ও মহীশূর পর্যন্ত এক বিস্তৃত ভূভাগকে তিনি নিজ শাসনে আনেন। ডাঃ এইচ সি রায়চৌধুরী এজন্য চন্দ্রগুপ্তকে “ভারতের প্রথম ঐতিহাসিক বৃহৎ সাম্রাজ্য-এর স্থাপয়িতা বলেছেন।” (First historical founder of a great empire of India)

মহাপদ্ম ও চন্দ্রগুপ্ত

  • (১) এক্ষেত্রে মহাপদ্ম নন্দ -এর সঙ্গে চন্দ্রগুপ্তের তুলনা অনিবার্য হয়ে পড়ে। মহাপদ্মও ছিলেন বিরাট সাম্রাজ্যের অধিকারী এবং তার উপাধি ছিল উগ্রসেনা। কিন্তু মহাপদ্মের সাম্রাজ্যের পরিধি সম্পর্কে সঠিক নির্ভরযোগ্য তথ্যের অভাব আছে।
  • (২) উত্তর ভারতে নন্দ রাজার ক্ষমতা অপ্রতিহত হলেও, পাঞ্জাবে তাদের অধিকার ছিল না। দক্ষিণে কতদূর পর্যন্ত নন্দ রাজাদের রাজ্য ছিল তা সঠিক জানা যায়নি। এজন্য সর্বভারতীয় সম্রাটের মর্যাদা নন্দ রাজারা দাবী করতে পারেন না।
  • (৩) ডঃ আর কে মুখার্জীর মতে, মহাপদ্মকে উত্তর ভারতের সম্রাট বলা চলে। কিন্তু সর্বভারতীয় সম্রাটের মর্যাদা চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যই প্রথম দাবী করতে পারেন। চন্দ্রগুপ্তের এই কৃতিত্ব আরও বড় এই কারণেই যে, তিনি প্রায় অখ্যাত ও অজ্ঞাত অবস্থা থেকে ইতিহাসের পাদপ্রদীপের সামনে এসেছিলেন।

সংগঠক ও শাসক হিসেবে চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব

  • (১) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য কেবলমাত্র বিজেতা ছিলেন না, সাম্রাজ্য সংগঠক ও শাসক হিসেবে তিনি ছিলেন বিরল কৃতিত্বের অধিকারী। নন্দ রাজাদের শাসন ব্যবস্থা কিরূপ ছিল তা বিশেষ জানা যায়নি। ইতিহাস এদিক থেকে চন্দ্রগুপ্তের প্রতি সুবিচার করেছে। তার শাসন ব্যবস্থা সম্পর্কে প্রায় সকল তথ্যই আমরা জানি।
  • (২) তিনি এটা জানতেন যে, বিজিত সাম্রাজ্যকে সুশাসন না করলে সাম্রাজ্য স্থায়ী হয় না। তিনি প্রজাদের আবেদনের নিষ্পত্তির জন্য সারাদিন দরবারে থাকতেন। বিশ্রাম নিতে অন্তপুরে যেতেন না। যদিও তার কেন্দ্রীকতার দিকে ঝোঁক বেশী ছিল, তিনি প্রদেশ ও কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় স্থাপন করে শাসন ব্যবস্থা গঠন করেন।
  • (৩) মন্ত্রীসভা তাকে রাজকার্যে নিয়মিত পরামর্শ দিত। যদিও জাষ্টিন বলেছেন যে, চন্দ্রগুপ্ত গ্রীকদের হাত থেকে জনগণকে মুক্ত করে নিজের অধীনে দাসত্বে আবদ্ধ করেন। বনগার্ড লেভিন বলেন যে, জাস্টিনের এই মতকে হালকাভাবে নেওয়া উচিত হবে না।
  • (৪) চন্দ্রগুপ্ত পাঞ্জাবকে গ্রীক শাসন থেকে মুক্ত করেন তাঁর মগধ যুদ্ধের প্রস্তুতির ধাপ হিসেবে। ভারতবর্ষের মাটিকে তিনি বৈদেশিক শাসনমুক্ত করার জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেননি। তার সমগ্র পরিকল্পনা ছিল শুধু নন্দ রাজাদের উচ্ছেদ করে তার নিজের অধীনে ক্ষত্রিয় শাসন স্থাপন। সুতরাং চন্দ্রগুপ্তের বিজয়ের সংকীর্ণ শ্রেণীচরিত্রকে লেভিন সমালোচনা করেছেন।
  • (৫) তবে এর উত্তরে বলা যায় যে চন্দ্রগুপ্ত প্রজাকল্যাণের জন্যে কাজ করতেন। গ্রীকরা স্বয়ংশাসিত পলিস-এর আদর্শে বিশ্বাস করত বলে তাদের কাছে চন্দ্রগুপ্তের শাসন ভাল মনে হয়নি। কিন্তু মেগাস্থিনিস এই শাসন ব্যবস্থার প্রশংসা করেছেন।

শিল্পকলার প্রতি চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের আনুগত্য

  • (১) নিরন্তর সামরিক কাজে ও শাসনঘটিত বিষয়ে নিযুক্ত থাকলেও চন্দ্রগুপ্তের মন থেকে শিল্পকলা ও সুকুমার বৃত্তির প্রতি আগ্রহ লোপ পায়নি। মেগাস্থিনিসের বিবরণ ইণ্ডিকা থেকে জানা যায় যে, পাটলিপুত্রের রাজ প্রাসাদকে তিনি অসাধারণ সুন্দর করে সাজিয়েছিলেন।
  • (২) মৌর্য রাজপ্রাসাদের জাকজমক ও শিল্প-সৌন্দর্য দর্শকের চোখ ধাঁধিয়ে দিত। চন্দ্রগুপ্ত জ্ঞানীগুণীর সঙ্গে আলাপ করতেন। তিনি অবশ্য ঐশ্বর্য ও আড়ম্বরে থাকতে ভালবাসতেন একথা মেগাস্থিনিস বলেছেন।

উপসংহার :- শেষ জীবনে তাঁর মধ্যে আসে বেরাগ্য। ভগবান মহাবীর -এর জৈন ধর্ম তিনি গ্রহণ করেন এবং মহীশূরের শ্রাবণবেলগোলায় অনশনে দেহত্যাগ করেন। তখন লোকে তাকে বলত চন্দ্রগুপ্ত মুনি। ফলে রাজা থেকে তার রাজর্ষিতে উত্তরণ ঘটে।

(FAQ) চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের কৃতিত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাস্য?

১. মৌর্য সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা কে ছিলেন?

চন্দ্রগুপ্ত মৌর্য।

২. চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের প্রধানমন্ত্রী কে ছিলেন?

কৌটিল্য বা চাণক্য।

৩. অর্থশাস্ত্র কার লেখা?

কৌটিল্য বা চাণক্য।

৪. কোন গ্ৰিক পর্যটক চন্দ্রগুপ্ত মৌর্যের রাজসভায় এসেছিলেন?

মেগাস্থিনিস।

Leave a Comment